ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এক দুপুরে একজন বড়লোকের বাড়িতে পাখার নিচে বসে জমিয়ে গল্প করছিলেন। এমন সময় দারোয়ান এলো একটা চিঠি নিয়ে। গরমে ঘামে সে ভয়াবহ ক্লান্ত। বিদ্যাসাগর তাকে ডেকে নিজের পাশে বসালেন,পাখার নিচে বসে অনেকক্ষণ জিরিয়ে ঠান্ডা হয়ে সে ফেরত গেলো।
সাথের মানুষগুলো তারপর রাগ করে বললো, “এমন নিম্নশ্রেনীর একজনকে আপনি আমাদের সাথে বসালেন,এতে আমাদের মান থাকে না।”
বিদ্যাসাগর জবাব দিলেন, “দেখুন! আমি আপনাদের খাইও না পরিও না, আপনাদের ছাড়া আমার চলবে। কিন্তু এই দারোয়ান, মালী, রাঁধুনি,মুচি এদের ছাড়া না আমার না আপনার একটা দিনও চলে না। প্রয়োজনে আমি আপনাদের ছাড়বো, কিন্তু এদের না।”
বিদ্যাসাগর সে কথা রেখেছিলেন, দরিদ্রদের তিনি কখনোই ছাড়েননি, বরং তাদের জন্য অনেক বড়লোকের সাথে সম্পর্ক নষ্ট করেছেন।
বিদ্যাসাগরকে একবার এক বন্ধু রাগ করে বলেছিলো, “কেউ এসে দারিদ্র্যের গল্প শোনালেই তুমি বিশ্বাস করে সাহায্য করো। এই সুযোগে অনেকেই তোমাকে ঠকিয়ে টাকা নিয়ে যায়,আড়ালে হাসাহাসি করে তা কি জানো?”
বিদ্যাসাগর হেসে বলেন, “যাক! তাও তো তারা ঠকে যায় না? অন্যকে ঠকানোর চেয়ে নিজে ঠকা ভালো।”
একবার এক সাহেব বিদ্যাসাগরকে বলেছিলেন, “আপনি কি এই ধুতি চাদর ছেড়ে একটু ভালো পোশাক পরে আসতে পারেন না? আপনার এরকম পোশাকের জন্য আমরা লজ্জায় পড়ি!”
বিদ্যাসাগর জবাবে বলেন, “আপনি নিজের দেশ থেকে এতদূর এসেও কোটপ্যান্ট খোলেননি,আপনি যদি নিজের দেশের পোশাক,সংস্কৃতিকে এতটা সম্মান করতে পারেন যে অন্য দেশে এসেও তাদের ছাড়তে পারেন না,আমি নিজের দেশে বসেই নিজের সংস্কৃতিকে বিসর্জন দেবো এমন অন্যায় আবদার কিভাবে করতে পারেন?”
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর আমার কাছে ঠিক একটা সাগরের মতোই,যার কোন কুল কোন কিনারা আমি খুঁজে পাইনি। একটা মানুষের কোন না কোন শেষ থাকা উচিত কিন্তু বিদ্যাসাগরের কোন শেষ ছিলো না। জীবনের শেষ বিন্দু পর্যন্ত পরোপকারে কাটিয়ে দিয়েছেন এই মানুষটা। সেই আমলে একজন ব্রাহ্মণ সন্তান জাত,ধর্ম এইসব বিবেচনা না করে ডোম,মুচির অসুখে ছুটে গিয়ে সেবা করা,তাদের সন্তানকে কোলে বসিয়ে আদর করা..বিধর্মী,সাহেবসুবো সবার অভাবে বিপদে অর্থসাহায্য করা,কুষ্ঠরোগীর হাতে পানি খাওয়া এসব কোন সহজ কথা না। তিনি যে বিধবা বিবাহ,স্ত্রী শিক্ষা চালু করেছিলেন সেগুলো এখন খুব স্বাভাবিক মনে হলেও তখন অনেকেই মনে করতো পাপ,ধর্মের বিরুদ্ধে যাওয়া।
প্রবল জনমত যখন বিধবা বিবাহের বিরুদ্ধে বিদ্যাসাগর তখন তাদের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে বললেন,”স্বামীবিয়োগ হওয়া মাত্রই কি স্ত্রীজাতির শরীর মরে যায়? যদি তাই যেত তাহলে স্বামী মারা যাবার সাথে সাথে তার সন্তানধারণের ক্ষমতাও মারা যেত। তা যেহেতু যায় না সেহেতু অবশ্যই সে আবার বিয়ে করতে পারে!” ওনার সামনে বসা পন্ডিতগণ আঁতকে উঠে তাকে নাস্তিক উপাধি দিতেও দ্বিধাবোধ করেনি।
ঈশ্বরচন্দ্রের নিজের স্ত্রীই বলতেন,”ছিঃ! আমি আমার ছেলেকে শিক্ষিত মেয়ের সাথে বিয়ে দিই আর ছেলে মরে যাক?” পড়াশোনা জানা মেয়ে বৈধব্য সাথে নিয়ে আসে এমন প্রচলনও ছিলো তখন। সেই হিসেবে ঈশ্বরচন্দ্র সেই যুগে অনেক ধর্মান্ধের শত্রু ছিলেন। কিন্তু নিজের ওপর এতটাই বিশ্বাস ছিলো তার যে কখনো দমেননি। নিজের ছেলেকে তিনি শুধু শিক্ষিত না,বিধবা মেয়ের সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন।
আজ এই মহাপুরুষের জন্মদিন। বাংলা,ইংরেজি,সংস্কৃতে অসামান্য দখল আর ধর্ম সম্পর্কে অনেক বেশী জানাশোনা সকলের প্রিয় এই মানুষটি চাইলে নেতা হতে পারতেন কিন্তু হননি। তিনি বলেছিলেন, “এদিকে দেশের মানুষ না খেয়ে আছে ঐদিকে আমি মঞ্চে উঠে বড়বড় বক্তৃতা আওড়াচ্ছি,এমন হাস্যকর কাজ আমার দ্বারা হবে না।”
নেতা হয়ে সিংহাসনে বসে জনগনের পাশে থাকার বয়ান দেবার থেকে তিনি সাধারণ মানুষ হয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে সকলের দুঃখ-দুর্দশা নিজ চোখে দেখে দূর করাতে বিশ্বাসী ছিলেন বেশী। তিনি জনপ্রিয়তা চাননি,শো অফ করেননি,একজনকে সাহায্য করলে আরেকজন তা জানুক তা চাননি বলে একেকজনকে একেক সময় আসতে বলতেন মাসোহারা নিতে। প্রকৃত অর্থেই তিনি একজন সত্যিকার দেশপ্রেমিক ছিলেন যিনি দেশের মানুষের পেট থেকে শুরু করে মস্তিকের খোরাকপর্যন্ত সবকিছুর দায়িত্ব নিয়েছিলেন।
আমরা যত বড় বড় লেখক,কবি নিয়েই মাতামাতি করি তাদের সবাইকেই বাংলা লেখার মাধু্র্য জানিয়ে গিয়েছিলেন এই মানুষটিই। নিজের নামে,বেনামে অসংখ্য পুস্তক রচনা করে তৎকালীন বাংলা সাহিত্যের ফাঁকগুলো পূর্ণ করতে তিনি ছিলেন বধ্য পরিকর,তার কারণেই বাংলা ভাষায় লেখালেখিটা প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছে শেষ পর্যন্ত।
শুভ জন্মদিন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। বাংলার প্রতিটি মেয়ের পক্ষ থেকে যাদের জন্য আমৃত্যু লড়ে গেছেন আপনি।
Credit To Go : Jannatul Firdous
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?