দুইশ তেরোর গল্প : লেখিকা তাসনিয়া আহমেদ | Duisho Terror Golpo By Tasnia Ahmed

  • বইঃ দুইশো তেরোর গল্প
  • লেখকঃ তাসনিয়া আহমেদ
  • প্রচ্ছদঃ সানজিদা স্বর্ণা ও তাহমিদ রহমান
  • প্রকাশনী: সতীর্থ প্রকাশনা
  • জনরাঃ সমকালীন উপন্যাস
  • পৃষ্ঠাঃ ২৩০
  • মুদ্রিত মুল্যঃ ৪০০ টাকা
“গাইনির আজকের নাইটটা তুফানের মতো যাচ্ছে। 
একটার পর একটা খারাপ রোগী আসছে। সিজার করতেই হবে, নইলে বাচ্চা-মা দুজনেই ঝুঁকিতে থাকবে, শুধু এইরকম রোগীই আছে তেরো জন; আর লেবার রুমে যারা নরমাল ডেলিভারির জন্য অপেক্ষা করছে, তারা তো আছেই! দেরি করলে বাচ্চা বাঁচানো যাবে না এইরকম রোগী আছে সাত জন। আমাদের সার্জন মাত্র দুই জন; ওটি টেবিলও মাত্র দুইটা। একটার পর একটা অপারেশন হচ্ছে, যন্ত্রের মতো কাজ করে যাচ্ছেন আপুরা। অ্যাডমিশন রুমে অদ্রিজা একজনের পর একজন রোগী রিসিভ করেই যাচ্ছে। বসে এক কাপ চা খাবে, সেই সময়টাও সে পাচ্ছে না। দুই সার্জন আপুর সাথে যন্ত্রের মতো অ্যাসিস্ট করে যাচ্ছি আমি আর অভি। ওটি চলাকালীন যতোবার অভির সাথে চোখাচোখি হলো, ততোবার সে আমার দিকে তাকিয়ে অসহায় দৃষ্টি বিনিময় করলো। আমি সেই দৃষ্টির অর্থ জানি। গত চার ঘন্টা ধরে আমরা টানা অপারেশন থিয়েটারে কাজ করছি। বেচারা সিগারেট খাওয়ার সময় পায়নি। রাত দুইটা-তিনটার দিকে একবার ক্যান্টিনে গিয়ে সিগারেট খেতে না পারলে অভির মাথা কাজ করে না।
আমার পা ব্যথা হয়ে গেছে। একটু চা খাওয়া দরকার। ডয়েন’স রিট্রাক্টর নামক যন্ত্র দিয়ে রোগীর পেটের সব মাংস তুলে ধরে আছি। রোগীর স্বাস্থ্য খুবই ভালো, খাঁটি বাংলায় এইরকম গড়নের মানুষকে এক কথায় ‘মোটা’ বলা হয়। তার চর্বি-মাংসসমেত পেটের চামড়া এক দিকে এক ভাবে ধরে রাখতে রাখতে আমার হাত অবশ হয়ে যাচ্ছে। অন্যমনস্ক হয়ে একটু ঢিল দিয়েছি কি দিইনি, সালমা আপু ধমক দিয়ে বললেন, “কী রে! হাতে শক্তি নাই, নাকি?”
আপুর কোনো দোষ নেই, তিনিও গত চার ঘন্টা টানা সার্জারি করছেন। সাথে সাথে বললাম, “আপু সরি।” 
আপু সুন্দর করে হাসলেন। বললেন, “আরেকটু কষ্ট কর আপু, আর এক ঘন্টা কাজ করলেই দেখবি একটু বসার সময় পাবি।”
বাচ্চাটাও বেশ বড়সড়ই হয়েছে। তাকে টেনে বের করতে গিয়ে আমাদের দুইজনেরই ঘাম ছুটে গেছে। অপারেশন শেষে আপু নিজেই বললেন, “অনেক কাজ করসিশ। চল চা খেয়ে আসি। নইলে পরেরটায় দাঁড়ায়ে থাকতে পারবি না।”
চা খাওয়ার এক ফাঁকে একটু লেবার রুমে উঁকি দিয়ে এলাম। লেবার রুমে আজকে ডিউটি বিভার। ছয় জন প্রসব-যন্ত্রণায় কাতর মহিলা ছয়টা বেডে শুয়ে কাতরাচ্ছে। বিভা একটু পরপর তাদের পরীক্ষা করে দেখছে, কার কতোক্ষণ পরে বাচ্চা হবে। তার জামার হাতায় রক্ত লেগে আছে। কারো ডেলিভারি করাতে গিয়েই লেগেছে। গেলো বেচারির সুন্দর জামাটা!
অভি সিগারেট খেতে গেছে। মরিয়ম আপুও আমাদের সাথে চা খেতে বসেছেন। এইটুকু চা-বিরতিতেও তিনি বসে নেই।রোগীর লিস্ট মিলিয়ে দেখছেন, কাকে আরেকবার পরীক্ষা করা লাগবে, এরপর ওটি টেবিলে কাকে তোলা হবে, কার ব্লাড প্রেশারটা আরেকবার মাপা লাগবে- সব ওই এক কাপ চা খেতে খেতে আরেকবার চেক করলেন। সালমা আপু আর মরিয়ম আপুর অক্লান্ত পরিশ্রম করার ক্ষমতা দেখে আমি মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যাই। কী দিয়ে তৈরী এই মানুষগুলি?
ভোর সাড়ে চারটার দিকে আমাদের জমে থাকা রোগীদের অপারেশন শেষ হলো। নরমাল ডেলিভারি যাদের হওয়ার, মোটামুটি সবারই হয়ে গেছে। যাদের হয়নি, সকালের আগে হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এই সময়টায় ক্লান্তি এসে জেঁকে ধরে। কাজের মধ্যে থাকলে ক্লান্তি টের পাওয়া যায় না। অদ্রিজা সারা রাত রোগী রিসিভ করে এখন টেবিলের ওপর মাথা রেখেই ঘুমিয়ে পড়েছে। বিভাও চুপচাপ টেবিলে মাথা রেখে শুয়ে আছে, যেকোনো মুহূর্তে ঘুমিয়ে পড়বে। সালমা আপু নরম সুরে আমাকে বললেন, “একটু চোখ বন্ধ করে থাক। আমরা জেগে আছি।” আমি জানি আপুরা জেগে থাকবেন। উনারা জেগে থাকেন বলেই এই এতো বড় হাসপাতালে রোগীরা নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারে।
আমারও চোখ লেগে এসেছিলো। মরিয়ম আপুর কণ্ঠ শুনে ঘুম ভেঙে গেলো। আপু অদ্রিজাকে ডাকছেন, “এই অদ্রিজা, বাইরে ট্রলি আসছে, মানে রোগী খারাপ। এক্ষনি ওঠ, দেখ কী অবস্থা। আমি আসতেসি।” ঘুমচোখে মোবাইলের দিকে তাকালাম। পাঁচটা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি। এই সময়ের রোগী মানেই খারাপ রোগী। অদ্রিজার সাথে আমিও বাইরে এলাম রোগী রিসিভ করতে। 
ট্রলির ওপর শুয়ে আছে অপূর্ব রূপবতী একটা মেয়ে। অল্পবয়সী, প্রথম বাচ্চা বোধহয় এবার। চোখ বন্ধ তার। পরীক্ষা করে বুঝলাম, জ্ঞান নেই। রোগীর সাথে এসেছে এক দল মানুষ। স্বামী, শ্বশুর, শ্বাশুড়ি, ননদ, দেবর- আরো কে কে যেন। অদ্রিজা পালসে হাত দিয়েই চমকে উঠলো। ঝড়ের গতিতে প্রেশার মেপে আমাকে বললো, “আপুকে গিয়ে বল বিপি নাই!” আমি দৌড়ে গিয়ে আপুদের ডেকে আনলাম। রোগীর লোককে বারবার আপু জিজ্ঞেস করছেন, কী হয়েছে, কয়দিনের গর্ভবতী, কতোক্ষণ ধরে রোগীর ব্যথা- এক একজন এক একরকম উত্তর দিচ্ছে। সালমা আপু আমার পাশে দাঁড়ানো। আস্তে করে বললেন, “এই পার্টিতে ঘাপলা আছে। বাসায় চেষ্টা করে আনসে। এখন রোগী খারাপ বলে না পেরে হাসপাতালে আনসে।” মরিয়ম আপুকে দেখলাম রোগীর স্বামীকে আলাদা করে ডেকে কথা বলছেন। সালমা আপু অভিকে পাঠালেন আমাদের ফান্ডে থাকা স্যালাইন আনতে। আগে রোগী বাঁচাতে হবে।
রোগী শ্বাস নিচ্ছে খুব ধীরে। যেকোনো সময় যেকোনো কিছু একটা হয়ে যাবে। তার স্বামীর কাছ থেকে জানা গেছে, এটা তাদের দ্বিতীয় সন্তান। প্রথম সন্তানের সময় সিজার করা হয়েছিলো। এবার তারা ভেবেছে বাড়িতেই চেষ্টা করে নরমাল ডেলিভারি করাবে। রোগীর ব্যথা গতকাল সকাল থেকে। সন্ধ্যা পর্যন্ত ব্যথা থাকার পরেও যখন কিছু হয়নি, তারা একজন দাই বা ওরকম কাউকে ডেকে এনেছে। সে এসে কী একটা ইঞ্জেকশন দিয়েছে শিরায়, এরপর ব্যথা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। কিন্তু তবু বাচ্চা হয়নি। রাত দুইটার পর থেকে রোগী আস্তে আস্তে নিস্তেজ হতে শুরু করেছে। তারা এরপর রওয়ানা দিয়ে হাসপাতালে পৌঁছেছে ভোরবেলা! 
মেয়েটার দুই হাতে দুইটা আর দুই পায়ে দুইটা স্যালাইন চলছে। হার্টবিট একটা পর্যায়ে বন্ধ হয়ে গেলো। এনেস্থেশিওলজিস্ট সিপিআর দিয়ে হার্টবিট চালু করেছে। কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাস দিতে হচ্ছে রোগীকে। সালমা আপুকে জিজ্ঞেস করলাম, “আপু, কী ইঞ্জেকশন ছিলো ওইটা? যেটা দেয়ার পর রোগী খারাপ হয়ে গেলো?”
“বুঝিস নাই এখনো?”
আমি বোকার মতো মাথা নাড়লাম। 
“অক্সিটোসিন দিয়েছে ব্যথা ওঠার জন্য। জরায়ু সেই ইঞ্জেকশন দেয়ার পরে তার মতো করে কন্ট্রাকশন করা শুরু করেছে। কিন্তু রোগীর তো আগের বাচ্চাটা সিজার। কিছুক্ষণের মধ্যেই জরায়ু ফেটে গেছে।”
আমি আঁতকে উঠে বললাম, “তার মানে বাচ্চাটা এখন জরায়ু ফেটে পেটের মধ্যে চলে আসছে?”
“হ্যাঁ!”
“আপু, বাচ্চাটা তো বাঁচবে না তাহলে!”
“আর বাচ্চা! সে তো সেই রাতের বেলাই মারা গেছে। মাকে বাঁচানো যায় কি না দেখ! তাকেও তো মেরেই আনসে! এরচেয়ে মাটিতে ফেলে জবাই করলেই পারতো! এরা নাকি পরিবার!”
রোগীর লোকজন আহাজারি করছে। আমার প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। এই আহাজারির কোনো মূল্য নেই এখন। অথচ এই মেয়েটাকে বাঁচানো যেতো। এই মেয়েটার বাচ্চাটাকে বাঁচানো যেতো। এমন না যে মানুষগুলি অশিক্ষিত। সুন্দর, ভদ্র ভাষায় কথা বলছে। এই লোকগুলি বুঝলো না, মেয়েটাকে হাসপাতালে আনা দরকার? দুইটা প্রাণের এইরকম অপচয় করলো আপনজন হয়ে! কীভাবে পারলো নিজের স্ত্রী, নিজের সন্তানের প্রতি এতোটা অবহেলা করতে! 
রোগীকে ওটিতে তোলা হলো রক্ত যোগাড় হয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই। বাঁচানোর চেষ্টা তো করতেই হবে! পেট কেটে মাংসপেশী সরানোর পরেই গর্ভের বাচ্চাটাকে পাওয়া গেলো। রক্তে মাখামাখি হয়ে আছে। ট্রে-র ওপর পড়ে রইলো পরিবারের অবহেলার বলি- একটা ছোট্ট প্রাণ। আমি এই অপারেশনে অ্যাসিস্টে দাঁড়াইনি। অদ্রিজাকে নিয়ে সালমা আপু আর মরিয়ম আপু করছেন সার্জারি। আমি কাছেই আছি, এটা ওটা এগিয়ে দেয়ার জন্য। বাচ্চাটার মৃতদেহের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। তার পরিবারের হয়ে আমি বাচ্চাটাকে মনে মনে একবার সরি বললাম। পাশে পড়ে থাকা তোয়ালেটা দিয়ে তার মুখ থেকে রক্ত মুছে দিলাম। ছোট বাচ্চাটা দেখতে তার মায়ের মতোই সুন্দর হয়েছে। 
সূর্য উঠছে। জানালার কাঁচ ভেদ করে ভোরের প্রথম রোদ বাচ্চাটার মুখের ওপর পড়লো। সেই আলোতে তাকে দেবশিশুর মতো দেখাচ্ছে। আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। আমি তাকে আর স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি না। আমি প্রাণপণে কান্না চাপার চেষ্টা করছি। 
পরের দুই দিন আইসিইউতে বাচ্চাটার মা মৃত্যুর সাথে লড়াই করলো। যমে-মানুষে টানাটানি কথাটা সারাজীবন শুনেছি, দেখিনি কখনো। এই প্রথমবার সামনে থেকে দেখলাম। দুই দিন পর যমই জিতে গেলো। মেয়েটা মারা গেলো শেষ পর্যন্ত। ইউনিটের সবার মন খারাপ। সবাই জানতো কী হতে যাচ্ছে, তবু সবাই সবার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলো। শুধুমাত্র ঠিক সময়ে হাসপাতালে না আনার কারণে আর বাড়িতে রেখে ভুল চিকিৎসার কারণে ওদের আর বাঁচানো গেলো না। 
আইসিইউর করিডোরে অনেকক্ষণ একা একা দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। ডেথ ডিক্লেয়ার করা লাগবে, ডেথ সার্টিফিকেট লিখতে হবে, এরপর তারা লাশ নিয়ে বাড়ি ফিরবে। ভারী পা টেনে হাঁটতে হাঁটতে ওয়ার্ডে ফিরলাম। ডেথ সার্টিফিকেটে সাইন করার আগে আরেকবার বাচ্চাটার কথা মনে পড়লো। মা-ও বাচ্চার কাছেই চলে গেলো! নিশ্চয়ই সৃষ্টিকর্তা তাই চেয়েছিলেন! অতো ছোট বাচ্চা মা-কে ছেড়ে থাকতো কী করে!”
#দুইশোতেরোরগল্প
একদল অতি সাধারণ মেডিকেলপড়ুয়ার জীবনের উপাখ্যান নিয়ে লেখা উপন্যাস দুইশো তেরোর গল্প এর অংশবিশেষ। অত্যন্ত আনন্দের সাথে জানাচ্ছি, খুব শিগগিরই Satirtho Prokashona থেকে বইটার দ্বিতীয় মুদ্রণ প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। বইটার প্রি-অর্ডার চলছে প্রকাশনীর পেইজসহ বিভিন্ন বুকশপে। এর বাইরে যেকোনো তথ্য জানতে ইনবক্সে যোগাযোগের অনুরোধ রইলো। যারা বইটা ইতোমধ্যে পড়ে ফেলেছেন, কমেন্টবক্সে জানাবেন কেমন লেগেছে। 
©তাসনিয়া আহমেদ
লেখক ও চিকিৎসক
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?