তুমি যদি সমস্ত শীতকালটা জানলার পাশে বসে কাটাও তবে আমার রান্না করবে কে? -দেশে বিদেশে

আবদুর রহমান তর্কাতর্কি না করে ফের সেই কোণে গিয়ে আখরোট বাদামের খোসা ছাড়াতে লাগল।
তারপর আপন মনে বলল, কাবুলের আবহাওয়া বড়ই খারাপ। পানি তো পানি নয়, সে যেন গালানো পাথর। পেটে গিয়ে এক কোণে যদি বসল তবে ভরসা হয় না আর কোনো দিন বেরবে। কাবুলের হাওয়া তো হাওয়া নয়— আতসবাজির হক্কা। মানুষের ক্ষিদে হবেই বা কি করে।

আমার দিকে না তাকিয়েই তারপর জিজ্ঞেস করল, হুজুর কখনো পানশির গিয়েছেন?
সে আবার কোথায়?

উত্তর-আফগানিস্থান। আমার দেশ–সে কী জায়গা। একটা আস্ত দুম্বা খেয়ে এক ঢোক পানি খান, আবার ক্ষিদে পাবে। আকাশের দিকে মুখ করে একটা লম্বা দম নিন, মনে হবে তাজী ঘোড়ার সঙ্গে বাজী রেখে ছুটতে পারি। পানশিরের মানুষ তো পায়ে হেঁটে চলে, বাতাসের উপর ভর করে যেন উড়ে চলে যায়।
শীতকালে সে কী বরফ পড়ে! মাঠ পথ পাহাড় নদী গাছপালা সব ঢাকা পড়ে যায়, ক্ষেত খামারের কাজ বন্ধ, বরফের তলায় রাস্তা চাপা পড়ে গেছে। কোনো কাজ নেই, কর্ম নেই, বাড়ি থেকে বেরনোর কথাই ওঠে না। আহ সে কি আরাম! লোহার বারকোশে আঙার জ্বালিয়ে তার উপর ছাই ঢাকা দিয়ে কম্বলের তলায় চাপা দিয়ে বসবেন গিয়ে জানলার ধারে। বাইরে দেখবেন বরফ পড়ছে, বরফ পড়ছে, পড়ছে, পড়ছে দুদিন, তিন দিন, পাঁচ দিন, সাত দিন ধরে। আপনি বসেই আছেন, বসেই আছেন, আর দেখছেন চে তৌর বফ ববারদ কি রকম বরফ পড়ে।
আমি বললুম, সাত দিন ধরে জানলার কাছে বসে থাকব?
আবদুর রহমান আমার দিকে এমন করুণ ভাবে তাকালো যে, মনে হল এ রকম বেরসিকের পাল্লায় সে জীবনে আর কখনো এতটা অপদস্থ হয়নি। ম্লান হেসে বলল, একবার আসুন, জানলার পাশে বসুন, দেখুন। পছন্দ না হয়, আবদুর রহমানের গর্দান তো রয়েছে।
খেই তুলে নিয়ে বলল, সে কত রকমের বরফ পড়ে। কখনো সোজা, হেঁড়া ছেড়া পেঁজা তুলোর মত, তারি ফাঁকে ফাঁকে আসমান জমিন কিছু কিছু দেখা যায়। কখনো ঘুরঘুট্টি ঘন, চাঁদরের মত নেবে এসে চোখের সামনে পর্দা টেনে দেয়। কখনো বয় জোর বাতাস, প্রচণ্ড ঝড়। বরফের পাঁজে যেন সে-বাতাস ভাল গলাবার চর্কি চালিয়ে দিয়েছে। বরফের গুড়ো ডাইনে বাঁয়ে উপর নিচে এলোপাতাড়ি ছুটোছুটি লাগায়— হু হু করে কখনো একমুখো হয়ে তাজী ঘোড়াকে হার মানিয়ে ছুটে চলে। কখনো সব ঘুটঘুটে অন্ধকার, শুধু শুনতে পাবেন সো— ওঁ ওঁ–তার সঙ্গে আবার মাঝে মাঝে যেন দারুল আমানের এঞ্জিনের শিটির শব্দ। সেই ঝড়ে ধরা পড়লে রক্ষে নেই, কোথা থেকে কোথায় উড়িয়ে নিয়ে চলে যাবে, না হয় বেহুশ হয়ে পড়ে যাবেন বরফের বিছানায়, তারই উপর জমে উঠবে ছহাত উঁচু বরফের কম্বল গাদা গাদা, পাঁজা পাঁজা। কিন্তু তখন সে বরফের পাঁজা সত্যিকার কম্বলের মত ওম দেয়। তার তলায় মানুষকে দুদিন পরেও জ্যান্ত পাওয়া গিয়েছে।
একদিন সকালে ঘুম ভাঙলে দেখবেন বরফ পড়া বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সূর্য উঠেছে— সাদা বরফের উপর সে রোশনির দিকে চোখ মেলে তাকানো যায় না। কাবুলের বাজারে কালো চশমা পাওয়া যায়, তাই পরে তখন বেড়াতে বেরোবেন। যে হাওয়া দম নিয়ে বুকে ভরবেন তাতে একরত্তি ধুলো নেই, বালু নেই, ময়লা নেই। ছুরির মত ধারালো ঠাণ্ডা হাওয়া নাক মগজ গলা বুক চিরে ঢুকবে, আবার বেরিয়ে আসবে ভিতরকার সব ময়লা ঝেঁটিয়ে নিয়ে। দম নেবেন, ছাতি এক বিঘৎ ফুলে উঠবে— দম ফেলবেন এক বিঘৎ নেমে যাবে। এক এক দম নেওয়াতে এক এক বছর আয়ু বাড়বে— এক একবার দম ফেলাতে এক শটা বেমারি বেরিয়ে যাবে।
তখন ফিরে এসে, হুজুর, একটা আস্ত দুম্বা যদি না খেতে পারেন তবে আমি আমার গোঁপ কামিয়ে ফেলব। আজ যা রান্না করেছিলুম তার ডবল দিলেও আপনি ক্ষিদের চোটে আমায় কতল করবেন।
আমি বললুম, হ্যাঁ, আবদুর রহমান তোমার কথাই সই। শীতকালটা আমি পানশিরেই কাটাব।
আবদুর রহমান গদগদ হয়ে বলল, সে বড় খুশীর বাৎ হবে হুজুর।
আমি বললুম, তোমার খুশীর জন্য নয়, আমার প্রাণ বাঁচাবার জন্য।
আবদুর রহমান ফ্যাল ফ্যাল করে আমার দিকে তাকালো।
আমি বুঝিয়ে বললুম, তুমি যদি সমস্ত শীতকালটা জানলার পাশে বসে কাটাও তবে আমার রান্না করবে কে?
~দেশে বিদেশে

Anjansukla Ghosh says that আবদুর রহমান এরপর থেকে সুখে দুঃখে প্রায়ই আছে শেষের বিদায়বেলা অবধি।
“স্বয়ং চাণক্য যে ক’টা পরীক্ষার উল্লেখ করে আপন নির্ঘণ্ট শেষ করেছেন আবদুর রহমান সব ক’টাই উত্তীর্ণ হল। তাকে বান্ধব বলব না তো কাকে বান্ধব বলব ?
বন্ধু আবদুর রহমান, জগদ্বন্ধু তোমার কল্যাণ করুন।

মৌলানা বললেন, ‘জানালা দিয়ে বাইরে তাকাও’ বলে আপন সীটটা আমায় ছেড়ে দিলেন।
তাকিয়ে দেখি দিকদিগন্ত বিস্তৃত শুভ্র বরফ। আর অ্যারফিল্ডের মাঝখানে, আবদুর রহমানই হবে, তার পাগড়ির ন্যাজ মাথার উপর তুলে দুলিয়ে দুলিয়ে আমাকে বিদায় জানাচ্ছে।
বহুদিন ধরে সাবান ছিল না বলে আবদুর রহমানের পাগড়ি ময়লা। কিন্তু আমার মনে হল চতুর্দিকের বরফের চেয়ে শুভ্রতর আবদুর রহমানের পাগড়ি, আর শুভ্রতম আবদুর রহমানের হৃদয়।”
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?