ডাবল স্ট্যান্ডার্ড ৩ : ডা. শামসুল আরেফীন | Double Standard 3 – Dr. Shamsul Arefin

  • বই : ডাবল স্ট্যান্ডার্ড ৩
  • লেখক : ডা. শামসুল আরেফীন
  • প্রকাশনী : দি পাথফাইন্ডার পাবলিকেশন্স
  • বিষয় : ইসলামি আদর্শ ও মতবাদ
  • সম্পাদক : মাওলানা আব্দুর রহমান
  • পৃষ্ঠা : 184, কভার : পেপার ব্যাক
  • আইএসবিএন : 978984962371, ভাষা : বাংলা

শুধু মিডল ইস্টের কাহিনী কেন?

শেবাচিম ক্যাম্পাস, বরিশাল।

চিনলেন না তো। বরিশাল মেডিকেল কলেজ। বিশাল মাঠের পাশে বিশাল দীঘি। হলের আলোগুলোর প্রতিবিম্ব পড়ে পানিতে সন্ধ্যার পর। মনে হয় বিরাট দীঘিটা যেন হাসছে। প্রতিদিন গোসলের আগে রাকিব অনেকক্ষণ পানির দিকে চেয়ে থাকে। নিজের ছায়াটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। কী জানি কি হিসাব মেলায়। ভাবে, চেনার চেষ্টা করে। মেলে না। কীভাবে হলো। এমনটা তো কথা ছিল না। উঁহু, কোনোভাবেই এটা হতে পারে না।

গত বছর সেকেন্ড প্রফের মাঝে। প্রফ মানে পেশাগত পরীক্ষা। ডাক্তারিবিদ্যায় ওরা তিনটা পেশাগত পরীক্ষা দেয়, এখন বোধহয় ৪টা দিতে হয়।। ৬০-এ পাশ, ঊনষাটে ফেল। ছয়মাস পর আবার দাও। ভাইভাতে ফেল করে শুধু ভাইভা দেবে? তা হবে না। পুরোটা দাও। লিখিত, ভাইভা, প্র্যাক্টিক্যাল—পুরোটা। মেধা এবং সময়—এগুলোর অপচয় কমাতে না পারলে জাতীয় পঙ্গুত্ব সারানো কষ্ট আছে। আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে জিপিএ সিস্টেম এসেছে, ভার্সিটিতে সেমিস্টার সিস্টেম এসেছে। মেডিকেল শিক্ষাটা সেই মান্ধাতার যুগেই পড়ে আছে।
তো যা বলছিলাম। গত বছর সেকেন্ড প্রফের আগে কে বা কারা রাকিবকে ফুসলিয়ে ছলে-বলে-কৌশলে ঢাকায় নিয়ে আসে। শুধু ওকে না। ওর ব্যাচের আরও নিরীহ বন্ধুবান্ধবসহ, বিভিন্ন ব্যাচের নিষ্পাপ মাসুম ছেলেগুলোকে একটি বিশেষ মহল দুই বাস রিজার্ভ করে পাচার করে ঢাকায়। ঢাকার কাছাকাছি বিশাল এক মাঠে এনে ছেড়ে দেয় ওদেরকে। পুরোটা মাঠ চট দিয়ে শামিয়ানা করা। নিচে তেরপল বিছিয়ে ওদের থাকার জায়গা। বিছানা যার যার সাথেই আছে। অস্ত্রশস্ত্রও ওদের সাথেই নিয়ে এসেছে বিশেষ মহলটি…রান্নার আরকি! মাঠের চারপাশ দিয়ে হাজারে হাজারে দ্বিতল-ত্রিতল টয়লেট ভবন। আর… লক্ষ লক্ষ মানুষ।
টঙ্গীর মাঠ। এক সাগর মানুষ। কেউ হুজুর, কেউ নন-হুজুর, কেউ আধা-হুজুর, পুলিশ, আর্মি, RAB। বিদেশিদের জন্য আলাদা করে ঘেরা। দেশিরা যেতে পারে না সেদিকে। ১০ হাজার শুধু আরববিশ্ব থেকেই। বিদেশি মোট ২০ হাজার। এখনো ২য় পর্ব নাকি বাকি রয়েছে। কোন বিশৃঙ্খলা নেই, অশান্তি নেই। পায়ে পাড়া লাগলে যে পাড়া দিল সেও মাফ চায়, যে পাড়া খেল সেও মাফ চায়। রান্না হচ্ছে জায়গায় জায়গায় অনুচ্চ স্বরে জিকিরের সাথে। লাঠি হাতে কিছু দায়িত্বশীল হাঁক দেয় মাঝে মাঝে— ‘সালামে কালামে চলি, জিকিরের সাথে চলি, রাস্তার ডাইনে চলি।’ এখানে কোনো আইনের দরকার হয় না, রক্ষাকারী বাহিনীর প্রয়োজন হয় না। কে গোলমাল করবে? এখানে সবাই আসে কোনো একজনকে রাজি করতে, রাজি করা শিখতে। যাঁকে কেউ দেখে না, কিন্তু তিনি সবাইকে দেখেন। সবার বড়ো আপন, বড়ো কাছে। হুমায়ুন স্যার মরহুম তাঁর একটা উপন্যাস শেষ করেছিলেন এভাবে— হয়ত বেশি কাছে বলেই তাঁকে দেখা যায় না।
রাকিবের দ্বিতীয় রাত টঙ্গীতে। মাঝরাতে প্রসাবের চাপে ঘুমটা গেল ভেঙে। সারি সারি ক্লান্ত উম্মত জিরিয়ে নিচ্ছে, একটু পর তাহাজ্জুদে উঠবে সবাই। শুরু হবে কান্না, এতিম পথহারা উম্মতের জন্য সেই তাঁর কাছে আহাজারি। ‘একবার তাকাও মালিক, মাফ করে দাও আমাদের। আমাদের দায়িত্ব আমরা পালন করতে পারিনি। তোমার দ্বীন নিয়ে কাফিরদের কাছে যেতে পারিনি। এজন্য তুমি আমাদের যে শাস্তি দিচ্ছ, তা উঠিয়ে নাও। কাফিরদের হাতে আর আমাদের লাঞ্ছিত করো না। পুরো উম্মতের পক্ষ থেকে তাওবা করছি আমরা।’ সাবধানে খেয়াল করে করে ডিঙিয়ে যাচ্ছে রাকিব। প্রস্রাবের চাপে একটু তাড়াও আছে। হঠাৎ আলো আঁধারির ছলনায় মাড়িয়ে দিল এক মুরুব্বির মাথা, বেশ জোরে। না-জানি কি ধমকটা খায় এখন। ইশ, বেচারা ব্যথাও পেয়েছেন খুব। তড়াক করে দাঁড়িয়ে গেলেন মুরুবিব। এরপর যা হলো, তার জন্য প্রস্তুত ছিল না রাকিব। রাকিবের পা ধরে— ‘বাবা, আমার জন্য তোমার অনেক কষ্ট হয়ে গেছে। আমাকে মাফ করে দাও, বেটা।’ হতভম্ব রাকিব মাথাটাথা নাড়িয়ে কোনোমতে ‘স্যরি’ বলে চলে আসে। আবার ঘুমিয়ে পড়েন মুরুব্বি। কিন্তু… ঘুমুতে পারে না রাকিব।
চার বছর ধরে ছাত্ররাজনীতির সাথে আছে। কত মানুষের সাথে উঠাবসা, কারও সাথে দহরম, কারও সাথে গ্যাঞ্জাম; কিন্তু এরা আবার কেমন মানুষ। কেমন এদের শিক্ষা। কেন এরা খাওয়ার সময় গোশতের টুকরাগুলো আমার দিকে এগিয়ে দেয় নিজে না খেয়ে। কেন এরা হাসতে হাসতে গণশৌচাগার সাফ করে বিনা বেতনে। কেন এরা নিজে কষ্ট নিয়ে আরাম পৌঁছাতে চায় আরেকজনকে? বাইরের মানুষগুলো তো ঠিক উল্টো। এদের সমস্যা কী? পরের দু’দিন লেকচারগুলো খুব মন দিয়ে শোনে রাকিব।
হিন্দি সিনেমার পোকা রাকিবকে আখেরি মুনাজাতের প্রতিটি কথা আরও এলোমেলো করে দেয়। ‘সব কাজকে কাজ বানিয়েছি, তোমার হাবিবের কাজকে কাজ মনে করি না; আমাদের এই বেয়াদবি আর উদাসীনতা মাফ করে দাও। কত মানুষ দ্বীন না পেয়ে কবরে চলে গেছে আমাদের দোষে। দ্বীন তাদের কাছে আমরা পৌঁছাতে পারিনি। আমরা দুর্বল। আমাদের কমজোরি মাফ ফরমাও, মালিক।’ ফিরে এসেও বেশ কয়েকদিন কানের মাঝে বাজতে থাকে ওই দিনগুলোর আলাপ-সালাপ। এভাবেই ক্যাম্পাসের ত্রাস, ডাকসাইটে ছাত্রনেতা রাকিব নামের ছেলেটা ধীরে ধীরে অন্যরকম হয়ে যায়।
জাহিলিয়াতের যুগের কাছের মানুষদের মধ্যে একজন ছিল রাহাত। রুমমেট, একই গ্রুপ করত ওরা। হাসি-কান্না- বদভ্যাসের সঙ্গী ছিল ওর। নদীর এপারটাতে ওকে খুব মিস করে রাকিব। প্রিয় বন্ধুকে দিতে চায় সুখের খোঁজ, অপহরণ করে আনতে চায় ‘প্রতি মুহূর্তে তৃপ্তির’ এই পথে, সিরাতুল মুসতাকিমে। কয়েকবার চেষ্টা যে করেনি—তা নয় । রাকিব রাজনীতি ছেড়ে দেওয়ার পর রাহাত একা হয়ে পড়েছে। আগের রাজনৈতিক অবস্থান এখন অনেকটাই নড়বড়ে। একধরনের শূন্যতা আর হতাশা আরও অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে তাকে। রাকিবের এই পরিবর্তনের প্রতি ওর যে অনুভূতি তৈরি হয়েছে তার নাম—ঘৃণা। রাহাতের ধারণা : রাকিব রাজনীতি ছেড়ে দিয়েছে বলেই ওদের গ্রুপের এই দুরবস্থা। আগে থেকেই রাহাত কিছুটা এগনোস্টিকও ছিল। ইসলামের ব্যাপারে প্রচুর সংশয়। সরাসরি অস্বীকার করে না, তবে বোঝা যায় সেটা।
‘বন্ধু, আমি তোকে পাঁচ বছর ধরে চিনি। তুই খুব ভালো করেই বুঝিস, যে পথে আমরা চলতাম তার শেষে শুধু ধ্বংস, অপ্রাপ্তি। নিজেকে তিলে তিলে শেষ করে দেওয়া ছাড়া আর কিছুই নেই এতে। সব নেতারা তোকে ব্যবহার করছে ব্যক্তিগত স্বার্থে। বল, এগুলো তুই জানিস না? তবু কেন? সারা দিনের হতাশার ওষুধ কি উইড, ডেক্সপো, ড্রিংক করা প্রতি রাতে? এগুলোতে কি শেষ হয়ে যায় তোর হতাশা? না বাড়ে? বল। জবাব দিচ্ছিস না কেন?’ আহত বাঘের মতো রাকিবের দিকে চোখ তুলে তাকায় রাহাত।
“দোস্ত, কুরআনে আমাদের বানানেওয়ালা আল্লাহ বলে দিয়েছেন এর সমাধান— “আলা বিজিকরিল্লাহি তাত্বমাইনুল কুলুব” — আর অন্তরের শান্তি রেখে দিয়েছি আমার জিকিরের মধ্যে, আমাকে যে অন্তর স্মরণ করবে, সে অন্তর শান্তি পাবে। তুই একবার আমার সাথে তিন দিনের জামাতে চল। দেখ, শান্তি পাস কি না। একবার আমার কথাটা শোন। প্লিজ রাহাত।’ ছলছল চোখে রাহাতের পা ধরে
[[১] সূরা রা’দ : ২৮
ফেলে রাকিব। আল্লাহর জন্য। নির্বিকার রাহাত হাত দিয়ে সরিয়ে দেয় ওর হাত।
‘রাকিব, কেন ছেলেমানুষি করছিস? তুই তো জানিস ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে আমার খটকা আছে। আজ তোকে বলেই ফেলি। নইলে তুই বার বার আমাকে ডিসটার্ব করবি। আমার মনে হয়, কুরআন-ইসলাম এই সব মুহাম্মাদের বানানো। আমি মানি— স্রষ্টা একজন আছে, নইলে এই দুনিয়া-জগৎ সৃষ্টি হওয়া পসিবল না; কিন্তু ইসলাম তাঁর কাছ থেকে এসেছে, এটা মানি না।’ কনফিডেন্ট রাহাত।
“ঠিক কেন তোর মনে হলো যে, কুরআন নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বানানো?’ প্রশ্নের সাথে রাকিবের কণ্ঠে ঝরে পড়ে আকুতি। প্রিয় বন্ধু কুফরের কারণে জ্বলবে, কীভাবে প্রাণে সয়! সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে রাকিব। হিদায়াতের মালিক আল্লাহ, কিন্তু চেষ্টার শেষটা দেখতে চায় ও।
‘কুরআনের অনুবাদ আমি পুরোটা পড়েছি। আমার সন্দেহের অনেক ভ্যালিড কারণ আছে। তার মাঝে একটা হলো, কুরআনে যে ঘটনাগুলো এসেছে তার সবগুলোই আরবভূমির, বড়োজোর মিডল-ইস্টের, মিশর-আরব-সিরিয়া ইরাক। কুরআনে দাবি করা হচ্ছে যে—এটা সমস্ত মানবজাতির জন্য। অথচ শুধু আরবের ঘটনা বলে বলে আরবদের হিদায়াত করা হলো। সামসময়িক ভারতে উন্নত সভ্যতা ছিল, চীনা সভ্যতা ছিল, ইউরোপে বর্বর জাতিগুলো ছিল, আমেরিকা মহাদেশে সভ্যতা ছিল। তাদের কথা মেনশন করা হয়নি। এটাই প্রমাণ করে যে, এটা আল্লাহ থেকে আসেনি। যেহেতু মুহাম্মাদ আরবভূমির বাইরে কখনো যাননি। তাই তাঁর রচনায় শুধু ঘুরে ফিরে আরবের উপকথা, আর ইহুদি-খ্রিস্টান প্রতিবেশীদের ঘটনাগুলোই এসেছে। যদি আল্লাহ দিতেন, তবে সব এলাকার কথাই থাকত। আমেরিকার কথা মুহাম্মাদ জানতেন না; কিন্তু আল্লাহ তো জানতেন যে, আমেরিকা আছে’, এখন উচ্ছন্নে গেলেও রাজনীতিতে আসার আগ পর্যন্ত রাহাত বেশ পড়ুয়া ছিল। মেডিকেলের বাইরের পড়াশোনা ওর ভালোই।
* কেন? কেন সব এলাকার সব সভ্যতার কথাই কুরআনে থাকতে হবে? কুরআন কি ইতিহাসের বই? ভূগোলের বই? যে মেসেজটা কুরআন দিতে এসেছে, তার জন্য যেটুকু পারফেক্ট, সেটাই আল্লাহ করেছেন। তোর মনে হচ্ছে, আল্লাহ বা নবীজি কি ইতিহাস শেখাতে গিয়ে অসম্পূর্ণ একটা ইতিহাসের বই ধরিয়ে দিয়েছেন?”, নিজের কণ্ঠে রাগ টের পায় রাকিব। নাস্তিকদের কেউ কেউ জানে ভালো, কিন্তু কোরিলেট করা, মিলিয়ে বোঝা জিনিসটা এক্কেবারে যাচ্ছেতাই। মানে, যেকোনো মূল্যে ইসলামে
[২] দেখতে পারেন লেখকের ডাবল স্ট্যান্ডার্ড-১-এর ‘আরব সংস্কৃতি মানব কেন?’ গল্পটি।
থেকে পালিয়ে বাঁচতে হবে। না, রাকিব, রাগা যাবে না। শেষ চেষ্টা কিন্তু এটা। ‘কুরআন নবীজির বানানো, তোর এটা মনে হওয়ার কারণ হলো, কুরআনের প্রেক্ষাপট মিডল ইস্ট। তাই তো?’
*এটা একটা কারণ। আরও আছে।’
‘আচ্ছা, সেগুলো অন্যদিন আলাপ করা যাচ্ছে, সমস্যা নেই। আজকে এটাই হোক। শোন তাহলে। শুনতে হবে কিন্তু। প্রশ্ন করেছিস জবাব দিচ্ছি।’
“ঠিক আছে বল। একটা সিগারেট ধরালাম। তোর আবার সমস্যা হবে না তো।”
‘না, খা তুই’, রাকিব আজ ৬ মাস সিগারেট ছেড়েছে। ও ছেড়েছে বললে ভুল হবে। আল্লাহ ছাড়িয়ে দিয়েছেন। বান্দা স্রেফ হারামকে হারাম মনে করবে, কোনো যুক্তি খাড়া করবে না। আর প্রতিবার ওই গুনাহের পর কেঁদে কেটে খালিস পাক্কা তাওবা করবে। করতে থাকবে, আর প্রতিবারই আর না করার নিয়ত করবে। এখানে ফাঁকি চলে না। তাওবার মতো তাওবার অভ্যাস থাকলে আল্লাহই একসময় গুনাহ ছাড়ার তাউফিক দেবেন, গুনাহ ছাড়ার পরিবেশ করে দেবেন।
একসময় শুধু ধনীরা সিগারেট খেত। ফ্যাশন, কেতাদুরস্তি, আধুনিকতা, টাকার গরম, স্টাইল—এগুলো প্রকাশ পেত ধরানোতে আর ধোঁয়া ছাড়ার ভঙ্গিতে। এখন রাস্তার পাগলেও টানে। পাবলিক প্লেসে। এটা অশিক্ষা, কুরুচি, অসভ্যতা আর গ্রাম্যতা ছাড়া আর কিছুই প্রকাশ করে না। আশির দশকের নায়কদের মতো সিগারেট ধরানোর চেষ্টা করে রাহাত।
‘তারপর বল’, ধোঁয়ায় ঘর ভরে যায়। উঠে গিয়ে সবগুলো জানালা খুলে দিতে থাকে রাকিব। আর বলতে থাকে..
‘পয়েন্ট নাম্বার ওয়ান: কুরআন তোকে আমাকে ইতিহাস-ভূগোল শেখাতে আসেনি। কুরআন আমাদের একটা মেসেজ দিতে এসেছে। মূল মেসেজটা কী? মেসেজ হলো দুইটা—
প্রথমত, আল্লাহ সকল জাতির জন্য নবী পাঠিয়েছেন। নিজের পরিচয় অর্থাৎ, তাওহিদের বার্তা দিয়ে। নবী চলে যাওয়ার পর শয়তান পরবর্তী প্রজন্মে তাওহিদ 
ভুলিয়ে নিয়েছে, শিরক-কুফরে নিমজ্জিত করে ফেলেছে।[নবীর প্রজন্মের তাওহিল পরের প্রজন্মগুলোতে বিকৃত হয়ে উৎপত্তি হয়েছে নানান ধর্মের। কুরআনের পয়লা উদ্দেশ্য—এই বিভিন্ন ধর্মাচারে পথহারা মানুষকে প্রকৃত স্রষ্টার সন্ধান দেওয়া। তাওহিদকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। মানে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’। তাহলে আমাদের দেখতে হবে, ৬ষ্ঠ-৭ম শতকে কোন কোন ধর্মাচারের মানুষ দুনিয়াতে ছিল? খেয়াল করে দেখ, ৬ষ্ঠ শতাব্দীর মানুষের ধর্ম কী কী ছিল।
• চীন ও জাপান ছিল প্রকৃতিপূজারী ও পূর্বপুরুষপূজারী।
[৩] কীভাবে প্রথম শিরক শুরু হল:
ا ومكروا مكرا كباراً ، وقالوا لا تدري الهاكم ولا تدري وداً ولا سواعاً ولا يفوت ويعوق ونشر অর্থ: আর তারা বলেছিল, তোমাদের দেবদেবীদের কক্ষনো পরিত্যাগ করো না। আর অবশ্যই পরিত্যাগ করো না ওয়াদ সুওয়াআকে, আর না ইয়াগুস, ইয়াউক ও নাসরকে। এবং তারা খুব বিরাট ষড়যন্ত্র করলো। [সূরা নূহ :
এগুলো ছিল বিভিন্ন প্রতিমার নাম। ওয়াদি ‘দুমাতুল জানদাল’-এর কালব গোত্রের, সুওয়াত্ম সমুদ্র উপকুলবর্তী গোত্র ‘হুজাইল’-এর, ইয়াগুস ইয়ামানের সাবার সন্নিকটে ‘জুরুফ’ নামক স্থানের মুরাদ’ এবং ‘বনি গুত্বায়েফ গোত্রের, ইয়াউক হামদান গোত্রের এবং নাসর হিময়্যার জাতির ‘জুল কিলাআ গোত্রের উপাস্য ছিল। [ইবনু কাসির ৮/২৩৪ ২৩৫, ফাতহুল কাদির ৫/362]
আতা রাহিমাহুল্লাহ থেকে বর্ণিত, ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন—এসব মূর্তিকে নুহ আলাইহিস সালামের কওম পূজা করত। পরবর্তী সময়ে আরবেও তাদের পূজার প্রচলন হয়। এরা মূলত ছিলেন নুহ আলাইহিস সালামের জাতির নেককার বুজুর্গ। আদম ও নুহ আলাইহিস সালামের আমলের মাঝামাঝি সময়ের। যখন এরা মৃত্যুবরণ করলেন, তখন শয়তান তাদের ভক্তদের কুমন্ত্রণা দিল যে—তোমরা এদের প্রতিমা বানিয়ে নিজেদের ঘরে ও দোকানে স্থাপন করো। যাতে তারা তোমাদের স্মরণে সর্বদা থাকেন এবং তাদেরকে খেয়ালে রেখে তোমরাও তাদের মতো নেককাজ করতে পার। প্রতিমা বানিয়ে যারা রেখেছিল, তারা যখন মৃত্যুবরণ করল, তখন শয়তান তাদের বংশধরকে এই বলে শিরকে পতিত করল— ‘তোমাদের পূর্বপুরুষরা তো এদের পূজা করত, যাদের প্রতিমা তোমাদের বাড়িতে বাড়িতে স্থাপিত রয়েছে।’ ফলে তারা এদের পূজা করতে আরম্ভ করে দিল। এখান থেকে প্রতিমা পূজার সূচনা হয়ে গেল।
(সহিহ বুখারি : ৪৯২০; এবং তাফসির আহসানিল বায়ান, পৃ: 1023 ) [4] নবিযুগে চীন-জাপান :
চীনে তখন চলছিল সুই রাজবংশ (৫৮১-৬১৮) এবং তাং রাজবংশের পাঁচজন সম্রাট। ৭০৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। কেবল চীনে বৌদ্ধধর্মের প্রচার শুরু হয়েছে; গ্র্যান্ড ক্যানেল বানাচ্ছে। সামগ্রিক চীনাদের ধর্মবিশ্বাস বলতে নিরীশ্বরবাদী সামাজিক আদর্শ কনফুসিয়বাদ, তাওবাদ, বৌদ্ধধর্ম আর আচার হলো প্রকৃতিপূজা ও
https://www.chinahighlights.com/travelguide/china-history/the-sui-dynasty.htm
• জাপানে তখন চলছে আসুকা আমল (৫৩৮-৭১০ খ্রিস্টাব্দ)। সান রাজবংশ, রাজধানী আসুকা। বৌদ্ধধর্মের প্রচার শুরু হয়েছে। প্রিন্স শোতোকু ১৭ দফার সংবিধান রচনা করেছেন তাওবাদ ও কনফুসিয় তত্ত্বের ভিত্তিতে।
http://www.worldatlas.com/webimage/countrys/asia/japan/jptimeln.htm
• ভারতে বৌদ্ধ ও হিন্দু … মূর্তিপূজারী। হিন্দুরা ছিল আফগান থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত। ইহুদি ও খ্রিস্টান কিছু ছিল দাক্ষিণাত্যে
■ পারস্য সাম্রাজ্য অগ্নিপূজারী।
রাশিয়া ও মধ্য এশিয়ার স্তেপ প্রকৃতিপূজারী।
পূর্ব ও পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্য, মিসর থেকে ইথিওপিয়া পর্যন্ত খ্রিস্টান।
বাকি আফ্রিকা প্রকৃতিপূজারী।
■ মধ্য ও উত্তর ইউরোপ মূর্তিপূজারী বার্বারিয়ান।’, থামল রাকিব। সাথে সাথে কথা ধরে নিল রাহাত।
“তাহলে তুই-ই দেখ রাকিব, কুরআনে বর্ণিত নবীগণ সবাই মিডল ইস্ট এলাকারই। কেন? ইউরোপের, চীনের, ভারতের নবীদের কথা কেন নেই? এক-দুইজনের কথা আসা উচিত ছিল না?’
*আসছি। তোর পয়েন্টেই আসছি। মোটাদাগে যদি ভাগ করিস, পুরো দুনিয়ার মানুষ
৩ ধর্মে বিভক্ত৷
১. মুশরিক (দেবদেবী, পূর্বপুরুষ, প্রকৃতিপূজা, আগুনপূজা)। নিরীশ্বরবাদীরা (কনফুসীয়, তাওবাদ, বৌদ্ধধর্ম) প্রকৃত অর্থে নাস্তিক/ধর্মহীন না। তারাও বুদ্ধের মূর্তি, পূর্বপুরুষ, ড্রাগন ইত্যাদির উপাসনা করে। সুতরাং মুশরিকের ভেতরেই পড়বে।
২. ইহুদি
৩. খ্রিস্টান। এ পর্যন্ত ঠিক আছে? কোনো প্রশ্ন থাকলে করতে পারিস।’
[৫] নবিযুগে ভারতবর্ষ:
পাকিস্তান-আফগানিস্তান-উত্তর ভারত : গুপ্ত রাজবংশ (বৌদ্ধ) হর্ষবর্ধন ( 608 689 )
সিন্ধুর রাই রাজবংশ ( ৪81-632)
• বাংলার পাল রাজবংশ (বৌদ্ধ)
[6] নবিযুগে পূর্ব এশিয়া:
• ইন্দোনেশিয়া ইন্দোনেশিয়ার জাভায় তখন প্রাচীন হিন্দু রাজবংশের শাসন ৬৬৯ পর্যন্ত। তারুমানগরের রাজা পূর্ণবর্মনের একটা রাজফরমান আছে শিলালিপিতে। আর সুমাত্রায় মালয় রাজবংশ। অধিবাসীরা অধিকাংশই হিন্দু। বৌদ্ধরাষ্ট্র শ্রীবিজয় সুমাত্রা জয় করে নিচ্ছে।
• মালয়েশিয়া মালয় উপদ্বীপে হিন্দু কেদাহ রাজবংশ ৬৩০ সালে প্রতিষ্ঠা করলেন মহারাজা দরবার রাজা। • লাওস কম্বোডিয়া : চেনলা রাজবংশ (৬ষ্ঠ শতক-৮০২)। একে একে হিন্দুরাজা রুদ্রবর্মণ, ভববর্মণ,
মহেন্দ্ৰবৰ্ষণ, ঈশানাবর্মণ, জয়বর্মণ শাসন করেন। • থাইল্যান্ড: ৭ম-১০ম শতকে মধ্য থাইল্যান্ডে চলছিল দ্বারবর্তী সংস্কৃতি, মূলত থেরাভাদা বৌদ্ধ। আর দক্ষিণ
খাইয়ে চলছিল হিন্দু শাসন। • বার্মা : ৪র্থ শতকের মধ্যে ইরাবতী ভ্যালির পিউ নগররাষ্ট্রগুলো বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হয়ে যায়।
‘হুম, তারপর বল’, সন্দিগ্ধ কণ্ঠে জবাব দিল রাহাত।
‘লিখে রাখলাম এটা.. [ক] দিয়ে। ৩ ক্যাটাগরির ভুল বিশ্বাসধারী মানুষের কাছে তাওহিদের বার্তা পৌঁছাতে হবে। আমরা আবার এটাতে ফিরে আসব। আগে ইসলামের দ্বিতীয় মেসেজটা বলে নিই। এবার আয়।’ রাকিব চেয়ার থেকে বিছানায় গিয়ে বসে। বলতে থাকে…
‘ইসলামের দ্বিতীয় মেসেজটা হলো : মানুষ যেন দুনিয়া-পরকালে সুখে থাকে সেজন্য ইহজীবন পরিচালনার একটা মূলনীতি দিয়ে দেওয়া; প্রবৃত্তি ও নৈতিকতার মধ্যে ব্যালেন্স করে ভারসাম্যপূর্ণ একটা পথ বলে দেওয়া। অর্থাৎ দ্বিতীয় অংশ ‘মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’, নবীজির আনা জীবন-পদ্ধতি। এবং জীবনপদ্ধতিটা কমপ্লিট হতে হবে। মানবজাতির প্রতি আল্লাহর বার্তা কমপ্লিট করে দেওয়া হবে। এরপর আর ওহির প্রয়োজন থাকবে না। তাই নবীরও প্রয়োজন থাকবে না। তার পর আর কোনো নবী পাঠানো হবে না। বার্তা হতে হবে একটাই—যা সকল ধর্মবিশ্বাসের মানুষের প্রতি দেওয়া হবে; যা কিয়ামত অব্দি কার্যকর থাকবে।
*এখানে আমার প্রশ্ন আছে, দোস্ত’, শোয়া থেকে উঠে বসে রাহাত। ‘বার্তা একটাই কেন হতে হবে। নানা ভাষায় হলে কী সমস্যা? শুধু আরবিতে কেন? বলা হচ্ছে, কুরআন সকল মানুষের জন্য সংবিধান বা ইউজার ম্যানুয়াল। একটা সফটওয়্যারের ইউজার ম্যানুয়ালও আজকে পৃথিবীর কমপক্ষে ৬টি ভাষায় থাকে। কুরআন একই সাথে তৎকালীন সবগুলো প্রধান ভাষায় অবতীর্ণ হওয়া কি উচিত ছিল না? শুধু আরবিতে হওয়াটা এর বিশ্বজনীনতাকে নস্যাৎ করে না?”
‘উত্তর পরে দিতাম। যেহেতু প্রশ্ন এসেই গেল, তাহলে বলি। তোর সফটওয়্যারের ইউজার ম্যানুয়ালের তুলনাটা ভুল। সফটওয়্যার একই সাথে একই সময়ে বিভিন্ন ভাষার মানুষ ব্যবহার করে। দ্বীন এমন না। মানে শুধু একটা বই আকাশ থেকে কয়েক ভাষায় ফেলে দিলে হবে না’, মনপ্রাণ ঢেলে বোঝানোর চেষ্টা করে রাকিব। ‘তুলনাটা হবে এমন : চিফ ইঞ্জিনিয়ার প্রোটোটাইপ বানিয়ে এর ফাংশন ব্যাখ্যা করছেন, সেটা একটা ভাষাতেই করছেন। 
একজন মানুষ একই সেকেন্ডে একাধিক ভাষায় কথা বলতে পারে না। মূল ডিজাইন ম্যানুয়াল একটা ভাষায়ই ইনজিনিয়ার লেখেন। পরে সেটা অনুবাদ হয় কয়েক ভাষায়। কুরআন আসবে, নবী সেটাকে হাতে-কলমে শেখাবেন। কুরআন বলবে নামাজ পড়ো, নবী সেটা করে দেখিয়ে দেবেন, পরবর্তীরা বর্ণনা করবেন : আমি নবীজিকে এভাবে এভাবে নামাজ পড়তে দেখেছি। একজন মানুষ প্র্যাকটিক্যালি দেখিয়ে দিতে হবে ব্যক্তি-ব্যবস্থাপনা.. দাঁত মাজা, হাসি, কথা বলা, আচরণ, চরিত্র। বলে দিতে হবে পেশাব-স্ত্রী-সহবাসের আদব, দেখিয়ে দিতে হবে মডেল হয়ে। 
COLLECT THIS BOOK FROM – ROKOMARI AND WAFILIFE 
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?