রিভিউ_________________________________
আত্মজীবনী পড়তে আমার বরাবরই ভালো লাগে। কেননা এতে সেই লেখককে সবচেয়ে ভালোভাবে চেনা যায়। লেখকের গান, কবিতা বা গল্প-উপন্যাস বিশ্লেষণ করে লেখকের মতাদর্শ, দৃষ্টিভঙ্গি জানার চেয়ে এটা অনেক সহজ যদিও অনেকটা ঝুঁকি থেকে যায় কেননা সবাই তো আর নিজের সমালোচনা সঠিকভাবে করতে পারেন না। এই ঝুঁকিটা থাকা সত্ত্বেও আমি বারবারই দ্বারস্থ হই বিভিন্ন আত্মজীবনীমূলক বইয়ের। জীবনকথা বইটা পল্লীকবি জসীম উদদীনের আত্মজীবনী ; এতে উঠে এসেছে তাঁর জীবনের প্রথমাংশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা ব্যক্তিবর্গ এবং ঘটনার কথা।
এক কথায় বললে বইটা কবির কবি হয়ে ওঠার যাত্রার কথা বলেছে। আর এই কথা বলতে গিয়ে তিনি বলে গিয়েছেন নিজ পরিবারের কথা, তৎকালীন সমাজের উৎসব, সংস্কার, আচারের কথা, যেসব ব্যক্তি তাঁর জীবনে কণামাত্র ভূমিকা রেখেছিলেন তাদের কথা। কবি হয়ে ওঠার কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন তিনি গ্রাম্য জীবনের সহজিয়া ভাবের কথা, কবিগানের মতো গ্রাম্য অনুষ্ঠানের কথা যা তাঁকে জীবনকে সহজভাবে দেখতে শিখেয়েছে, ছন্দ রচনার প্রথম ভীত গড়ে দিয়েছে। এছাড়া বলেছেন তাঁর গুরু শ্মশানবাসী এক সাধুর কথা যাঁর কাছ থেকে তিনি শিখেছিলেন সবাইকে ভালোবাসার শিক্ষা, মানুষ হয়ে ওঠার শিক্ষা। গ্রাম্যজীবনের যত উৎসব আর সংস্কার তিনি দেখেছেন বলে গিয়েছেন তাদের প্রতিটার কথা। আর তাঁর জীবনের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তি সাধুবাবার কথা যেমন বলেছেন তেমনি বলেছেন তাঁর কবিতার প্রশংসা করা তাঁর শিক্ষকদের কথা, প্রথম কবিতা প্রকাশে সহায়তা করা শশীদার কথা, মা হয়ে ওঠা বন্ধু ধীরেনের মায়ের কথা, বোন হয়ে ওঠা সেজদির কথা, প্রথম ভালোবাসার মানুষ যাকে নিজের করে না পাওয়ায় হতাশা ধরেছে তাঁর কন্ঠে সেই বড়ুর কথা।
বইটার যেদিকটা আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে তা হলো কবির গ্রামকে ফুটিয়ে তোলা, গ্রামকে ধারণ করা, গ্রামের পরিবর্তনে হতাশ হয়ে যাওয়ার দিকটা। আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা সবই গ্রামে। যদিও চার-পাঁচ বছর হলো শহরে থাকছি তবু শহরের গতিময়তার সাথে কেন যেন আমি নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারি না। গ্রামের সবুজ পরিবেশ, ধীরে চলা মুহূর্ত, গ্রামীন সব সংস্কার -কুসংস্কার, হাজারো অদ্ভুত সব মানুষ আর অসংখ্য ছোট-বড় উৎসব এসবের সাথেই নিজেকে মেলাতে পারি বেশি। তাইতো বইটাতে কবি যখন নিজের গ্রামের কথা বলেছেন তখন আমি আসলে আমার গ্রামকেই দেখেছি ; গ্রামের পরিবর্তন যে খুবই ধীর গতিতে হয় সেটার জন্যই তা সম্ভব হয়েছে। আবার গ্রামের পরিবর্তনে যে লেখক বারবার হতাশ হচ্ছিলেন সে হতাশাটা আছে আমারও। ‘প্রাকৃতিক গ্রাম’ থেকে এই যে গ্রামগুলোর ‘শহুরে গ্রাম’ হয়ে ওঠা ( জানি সেটা ঘটবেই, দরকারও আছে) সেটা কেন জানি আমাকে বিরক্ত করে। এখন যে আর ঝিঁঝি পোকার ডাক শুনতে পারি না, এখন যে শুনতে হয় বিদ্যুৎচালিত তাঁতের শব্দ ; এখন যে দলবেঁধে গোল্লাছুট খেলা বা খালে সাতার কাটা হয় না এখন যে সবাই মোবাইলে ব্যস্ত!
দ্বিতীয় যে দিকটা খুব ভালো লেগেছে সেটা হলো লেখকের কৃতজ্ঞতাবোধ এবং সততা। তাঁর কবি হওয়ার যাত্রায় যাঁদের সামান্যতম অবদানও ছিল তাদের তিনি হৃদয় খুলে প্রশংসা করেছেন। এর পাশাপাশি নিজের যাবতীয় দোষের কথা, ভুলগুলোর কথা সরাসরি, কোনো রাখ-ঢাক না রেখেই বলে দিয়েছেন। বলতে ভোলেন নি যাঁরা তাঁর প্রতি অবিচার করেছেন, বিনা দোষে শাস্তি দিয়েছেন, উপকার পেয়েও অপকার করেছেন তাদের কথাও। নিজেকে নিয়েও মজা করতে ছাড়েন নি তিনি ; বই বিক্রি করে আইসক্রিম খাওয়া থেকে শুরু করে গাছে উঠে থিয়েটার দেখা বা উকিলের নামে বেনামী পত্র লেখা – সবই জানিয়েছেন পাঠকদের।
তৃতীয় ভালো লাগার দিকটা হলো লেখকের গদ্যরীতি। ভূমিকাতে লেখক উল্লেখ করেছেন পত্রিকায় বইটা পড়ে কোনো এক রসিক পাঠক নাকি মন্তব্য করেছিলেন ‘ জসীম উদদীনেন জীবনকথা পড়িতেছি না, মায়ের হাতের পিঠা খাইতেছি’! তাহলেই বুঝুন বইয়ের ভাষা কোন ধরণের! কাব্যিক সেই ভাষায় লেখক যখন গ্রামের উৎসবের কথা, সাধুসঙ্গের সেই দিনগুলোর কথা, তাঁর প্রিয়জনদের কথা লিখেছেন তখন যেন মনে হয় চোখের সামনে সব দেখতে পাচ্ছি।
এত ভালো লাগার ভেতরে যে একটা দিক খারাপ লেগেছে সেটা হলো লেখক কোনো সময়কাল ধরে এগোন নি। ফলে তাঁর জীবনকে ধারাবাহিকভাবে বুঝতে অসুবিধা হয়েছে। অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যৎ মিলে কেমন যেন এক জাল সৃষ্টি করেছেন লেখক, অবশ্য রসালো উপস্থাপনের জোরে তা কাটিয়েও উঠেছেন।
গ্রাম্য কবিগান থেকে যে মানুষটার ছন্দ শেখা সেই মানুষটাকে জানতে, গ্রামকে অন্তরে ধারণকারী এক কবিকে বুঝতে, কবিকে অপার্থিব কিম্ভূতকিমাকার মানুষ ভেবেও শেষ পর্যন্ত কবি হয়ে ওঠা কবিকে খুঁজে পেতে, সাধুর সঙ্গী হয়ে হিমালয়ে রওনা হয়েও ভাগ্যের ফেরে কবি হওয়া কবিকে উপলব্ধি করতে তাই আমন্ত্রণ বইটা পড়ার।
Click here to download jibon kotha PDF