◾ বই : জল কুঠুরি
আকাশে মেঘেদের তান্ডব। একেকটা গর্জন সিংহের গর্জনকে চাপিয়ে দেয়ার মতো। বিদ্যুৎ চমকানো, ঝোড়ো হাওয়া, তার সাথে মানানসই মুষল বৃষ্টি। আকাশ কুচকুচে কালো। সূর্যের সামান্য আলোও আর অবশিষ্ট নেই। মেঘেরা উন্মত্ত হয়ে গিলে ফেলেছে সেই আলো। বাইরে তাকিয়ে বোঝার উপায় নেই, এখন দুপুরের সময়। রাত থেকে অঝোরে বৃষ্টি চলছে। পানিতে ভেসে যাচ্ছে চারদিক। পুকুর টইটম্বুর হয়ে গেছে। উঠোনে গোড়ালি সমান পানি। আবার ঝুম বৃষ্টি নেমেছে। ঝুম বৃষ্টি একনাগাড়ে হয় না, থেমে থেমে হয়। বাদলা দিনে! পাড়ি দেওয়া শেষ হয়ে গেলে, পথের দূরত্ব কমে যায়। তাই চল্লিশ বছর পাড়ি দেওয়া পথের দূরত্বও আরিফুর রহমানের কাছে খুব কম সময় মনে হচ্ছে। ভাবনার অতল গহ্বরে তলিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে ফিরে গেল সেই অতীতে।
যুদ্ধ শুরু হয়েছে। কমলপাড়ায় দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। পাকিস্তানি মিলিটারির লোকজন আরিফুর রহমানদের বাড়িতে ঘাঁটি করেছে। তাদের সাথে ভালো সখ্যতা গড়ে উঠেছে আরিফ সাহেবের বাবা তালেব রহমান বারীর। পাকিস্তানি আর্মিরা আগুন দিয়েছে সরকারবাড়িতে। হিন্দুদের জন্য টেকা আরও কঠিন। হয় দেশ ছাড়ো, না হয় মরো। মুসলমানরা মোটামুটি নিরাপদ। সরকারবাড়ি পোড়ানোর পর সব হিন্দু ইন্ডিয়ার বর্ডার দিয়ে গ্রাম ছেড়ে চলে যাচ্ছে। রওশন আরা বারী ছাড়া আরিফুর রহমানের অন্য দুই বান্ধবী ছিল হিন্দু। তারাও গ্রাম ছেড়ে চলে যাচ্ছে। সুরুইগাঙের পাড়ে দেখা করতে এসেছে তুতশ্রী সরকার ও আরিফ। আজ আরিফের বাড়ি ফেরার তাড়া নেই, বাবার বকার আশঙ্কা নেই, থাকার মধ্যে কেবল আকাশে জমাট কালো মেঘ, সুরুইগাঙের সন্ধ্যের স্রোত আর অদ্ভুত প্রশান্তি। যুদ্ধ শেষে কলকাতায় গিয়ে দেখা করা, মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করে বিয়ে করা…আরও কত কী পরিকল্পনা।
এক যুদ্ধ মুহূর্তেই উলটেপালটে দিয়েছিল সবকটা জীবন। সোনার স্বপ্নগুলো ছাই হয়ে উড়ে গেছে সময়ের হাওয়ায়।
চোখ দুটো সরু করে তাকিয়ে আছেন আরিফ সাহেব। আর কিছুক্ষণ একইভাবে তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘করিম?’
‘চিনতে পেরেছিস তাহলে।’ পানির উপর ভাসমান একটা দোকানের বেঞ্চিতে বসে বললেন করিম মজুমদার। ভাসমান দোকানটাকে গ্রামের অনেকে জলকুঠুরিও বলে।
জলকুঠুরি হচ্ছে বাঁশ দিয়ে পানির উপর ভাসমান রং-বেরঙের কুড়েঘর। যে কুড়েঘর বহন করে চলছে মানুষের সুখ-দুঃখের গল্পগুলো। যেখানে বসে মানুষ গল্পের আসরও জমায় বটে। এ কুড়েঘরের সাথে মানুষের নানারকমের স্মৃতি জড়িত। যে স্মৃতিগুলো সুখকর আবার বিষাদময়ও।
করিম মজুমদার, আরিফ সাহেবের হাইস্কুল জীবনের সহপাঠী। চল্লিশ বছর পর গ্রামে এসে পুরোনো মানুষগুলোকে খুঁজে বেড়াচ্ছে আরিফ সাহেব। স্মৃতিরা কখনও হারিয়ে যায় না, নির্দিষ্ট একটা সময় পর তারা আড়াল হতে সম্মুখে ফিরে আসে। ডানা মেলে ঝাপটে ধরে কর্তাকে। তখন স্মৃতিগুলো কারো আত্মাকে তৃপ্ত করে। আবার কারো মনকে বিষাদগ্রস্ত করে তোলে। আরিফ সাহেবকেও ঝাপটে ধরেছে অতীতের স্মৃতিগুলো। তাই হন্যে হয়ে খুঁজছে কিছু মানুষকে। শুধুই কি মানুষকে নাকি কিছু অজানা প্রশ্নের উত্তরও? যে অতীত অচেনা হয়ে যায়, তাকে পুনরায় ধরার প্রচেষ্টা কেবল বিড়ম্বনার সৃষ্টি করে। যে ভুল চল্লিশ বছর আগে করেছে, সেটা কি আদৌও শোধরানো সম্ভব?
➪ কাহিনি সংকোচন :-
রাতে যে মানুষটার বুকে মুখ গুঁজে ঘুমিয়েছিল রিতা, সেই মানুষটাকে পরদিন সকালে ঘুম থেকে ওঠে হঠাৎ নিরুদ্দেশ। এরপর শুরু হয় পিতৃহীন ছেলে বাদলকে নিয়ে রিতার সংগ্রামের সংসার। সমাজে বাস করা শকুনের চোখ ফাঁকি দিয়ে বেঁচে থাকাটা দিন দিন আরও কঠিন হয়ে উঠছে। তবুও নিজেকে সুরক্ষিত রাখার মাধ্যমে সামনে এগিয়ে চলছে সে। মসজিদের পুকুরের পাশের মায়ের কবরকে নিয়ে রিতার বুকভরা গর্ব। গর্বের সেই শেষ চিহ্নটুকু নিয়ে সে বেঁচে আছে। যদি সেই চিহ্নটুকু নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে বসে, তখন রিতার কী হবে?
আমেরিকা প্রবাসী আরিফুর রহমান দীর্ঘ চল্লিশ বছর পর নিজ গ্রামে ফিরেছে। জমি-জমার বাঁটোয়ারার কাজে। ওনার অংশের মালিকানার অর্ধেক নিজের ভাইকে আর বাকি অর্ধেক রানু ফুফুকে দিতে চান। শুধুই কি জমি-জমার মালিকানা দিতে এসেছে? সাথে যে অতীত তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে সেটা থেকে নিস্তার পাবার জন্যও কমলপাড়ায় আসা তার। শেষমেশ অতীত খুঁড়তে গিয়ে কেঁচো বের হয় নাকি সেটা দেখার বিষয়।
➪ পাঠ – পর্যালোচনা :-
❛জল কুঠুরি❜ কি শুধু স্মৃতিভারাক্রান্ত এক আমেরিকান প্রবাসীর গল্প, যে দীর্ঘ চল্লিশ বছর পর অতীতের হারিয়ে যাওয়া পরিচিত মুখদের সন্ধানে নিজ গ্রামে ফিরে এসেছে? না। ইহা অতীত আর বর্তমানের মিশেলে গড়ে ওঠা এমন একটি কাহিনি যেখানে আছে ক্ষোভ, দীর্ঘদিনের পুষিয়ে রাখা রাগ, ভুলের প্রায়শ্চিত্ত, ঈর্ষা, প্রতিহিংসা, প্রতিশোধ, আত্মসম্মান রক্ষা আর মায়ের পৃথিবী উজাড় করা কান্নার গল্প।
হারানোর নিষ্ঠুরতা কত ভয়ংকর সেটা যে হারায়নি সে কখনো বোঝেনি। শূন্যতা মানুষের দৈহিক মৃত্যু না ঘটালেও আত্মিক মৃত্যু ঘটায়। আত্মিক মৃত্যু নিয়ে অনুশোচনা করে বেঁচে থাকা খুবই কষ্টকর। এ গল্পটা অনুশোচনায় ভুগতে থাকা এক মানুষের গল্প, চল্লিশ বছর আগে যে মানুষটার চোখে নেশা ছিল। নতুন পৃথিবী দেখার উত্তেজনা ছিল। নতুনের ডাকে কী অমূল্য অর্জন ছেড়ে গিয়েছিল, তখন তা জানা ছিল না। এখন জানেন। তাই অতীতের সময়টা ফিরে পেতে আবার ছুটে এসেছেন নিজের চিরচেনা সেই পরিবেশে। যা চলে যায়, তা কি কখনো ফিরে আসে? হয়তো আসবে না। তবে অতীতের স্মৃতি হাতড়াতে হাতড়াতে সেই সময়ের দিনগুলোতে ফিরে গিয়ে একটু যদি প্রশান্তির দেখা মিলে তাহলে মন্দ কী! আর সেই অতীত যদি ভয়ংকর রহস্য লুকিয়ে রাখে তাহলে সেখানে ফিরে আসবে অকল্পনীয় মুহূর্ত যা হৃদয়কে অগ্নিদগ্ধ করে ছারখার করে দিতে পরোয়া করবে না।
❛জল কুঠুরি❜ বন্যা কবলিত একটি গ্রামের মানুষের গল্প। এখানে কোনো পিচঢালা রাস্তা নেই, আছে শুধু কাঁচা মাটির রাস্তা। একপশলা বৃষ্টি হলে খেতগুলো পানিতে ভেসে যায়৷ পুকুর টইটম্বুর হয়ে যায়। উঠোনে গোড়ালি সমান পানি থৈথৈ করে। বন্যায় ফসল হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে শেষমেশ ফাঁসি দিয়ে আত্মহত্যা করার ঘটনাও ঘটেছে এখানে। ভেলা বা ইঞ্জিনচালিত নৌকা এখানকার মানুষের নিত্যদিনের সঙ্গী। তবুও এখানে স্নিগ্ধতার আবেশে প্রকৃতির মেলে ধরা অপার সৌন্দর্যের মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলার মতো একটা স্বর্গীয় ব্যাপার আছে যা হৃদয়ে প্রবলভাবে প্রশান্তির আলোড়ন তোলে।
তারুণ্যের উন্মাদনায় ভাসা কিছু মানুষের গল্প ❛জল কুঠুরি❜। যুদ্ধের ভয়াল থাবা স্বপ্নের জাল বোনা এ মানুষগুলোর জীবনকে মুহূর্তে পাল্টে দিয়েছিল। তারপর বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় মানুষগুলো। সাথে তাদের স্বপ্নগুলোও। যা সময়ের পরিক্রমায় কারো না কারো শূন্যতা বাড়িয়ে চলেছে। আর কারো শূন্যতা বাড়ার আগেই কালের অতল গহ্বরে হারিয়ে গেছে।
❝যে মেয়ে একা একা বড় হয়, সে পুরুষ চেনে।❞
গ্রামীণ সমাজে একটা মেয়ের একা বড় হতে গেলে শুধু নিজেদের সঙ্গে লড়াই করলে হয় না; সমাজ, সমাজের আশেপাশের মানুষগুলোর সাথেও লড়াই করে বেঁচে থাকতে হয়। যুবক থেকে শুরু করে বৃদ্ধা মানুষগুলো পর্যন্ত একাকিত্বের সুযোগ নিয়ে ফায়দা লুটতে চায়। এখানে এমন এক নারীর দেখা মিলবে, যে এসব বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করবে। ভালো মানুষের মুখোশধারীদের মাঝেও কঠিন হৃদয়ের মানুষের দেখা মেলে; যারা সত্যিকার অর্থে কঠিন নয়, কোমল হৃদয়ের মানুষও বটে। প্রয়োজনের সময় তাদের সেই কোমলতা চুইয়ে চুইয়ে পড়ে। কুৎসা রটানো গ্রামীণ সমাজের এক চিরচেনা দৃশ্য। সেটা সত্য হোক কিংবা মিথ্যা, গ্রামের মানুষগুলো তা যাচাই বাছাই না করে বাতাসের সাথে ছড়িয়ে দেয়। বিশেষ করে নারীদের এমন ভোগান্তিতে পড়তে হয়। অনেকক্ষেত্রে তখন বেঁচে থাকার পথটা পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যায় তাদের।
সন্তানের অসুস্থতায় আত্মহারা হয়ে ওঠা এক মায়ের গল্প ❛জল কুঠুরি❜। সন্তানের সামান্য অসুখ হলে মায়েরা স্থির থাকতে পারে না। সন্তানের পাশে বসে অনাহারে নিদ্রাহীন রাত কাটিয়ে দেয়৷ তবুও তাদের চোখেমুখে ক্লান্তির ছাপটুকু দেখা যায় না। নিজেকে উজাড় করে দিয়ে হলেও সন্তানের মঙ্গলের জন্য সবকিছু করে। সন্তানের অসুখ যখন সেরে যায় তখন মায়ের মুখখানা উজ্জ্বলতায় প্রস্ফুটিত হয়।
এ গল্পেও বড়ো একটা ইতিহাস জড়িয়ে আছে, যে ইতিহাসটা নিয়ে আমরা গর্ববোধ করি; যে ইতিহাস পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শিখিয়েছে আমাদের। মুক্তিযুদ্ধের সেই ইতিহাস পৃথিবীর বুকে স্বর্ণাক্ষরে রচিত আছে। যদিও-বা ইতিহাসটার বিস্তর আলোচনা নেই এখানে। গল্পের প্রয়োজনে লেখক ইতিহাসটা টেনে আনলেও সেই ইতিহাসটা দারুণভাবে প্রভাব ফেলেছে গল্পে, যা অনেকগুলো মানুষের জীবনকে মুহূর্তে উলটপালট করে দিয়েছিল।
➪ সমাপ্তি :-
সামাজিক উপন্যাসে সমাপ্তি নিয়ে পাঠকের কখনো আকাশচুম্বী চাওয়া থাকে না। সেখানে পাঠককে বা সমাজকে দেওয়া লেখকের বার্তাগুলো প্রধান হয়ে ওঠে। সেইদিক থেকে লেখক সার্থক, ওনার পরিশ্রমটুকু বৃথা যায়নি। সাথে গল্পের সমাপ্তিও যে কাউকে মনঃপূত করার মতো। চরিত্রের মধ্যে দিয়ে নাকি গল্পের সমাপ্তি সম্পর্কে আঁচ করা যায়। কিন্তু এ গল্পের চরিত্রগুলোর সাথে ভালোভাবে মিশে যাওয়ার পরও সমাপ্তি সম্পর্কে আন্দাজ করতে ব্যর্থ হয়েছি। মোদ্দা কথা, ঘোল খাইয়ে দিয়েছে লেখক। তবে সেটা আমার ক্ষেত্রে নাকি বাকি সব পাঠকের ক্ষেত্রেও ঘটেছে, সেই প্রশ্নে যাব না। সমাপ্তিটা তৃপ্তিদায়ক ছিল, যা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে বাধ্য করেছে। অনেকদিন মনে থাকবে এ সমাপ্তির কথা।
➪ লেখনশৈলী :-
লেখক মুশফিক উস সালেহীনের লেখনশৈলীর সাথে পূর্বে থেকে পরিচিত বলে ❛জল কুঠুরি❜র প্রি-অর্ডার শুরু হওয়ার সাথে সাথে বইটি অর্ডার করে দিই। বইয়ে লেখক সুন্দর কবিতা সম্বলিত একটা অটোগ্রাফ দিয়েছেন যা হৃদয়স্পর্শীও বটে। পড়ে মনটা জুড়িয়ে গেল। অটোগ্রাফের সাথে এত সুন্দর কিছু কথা উপহার দেওয়ার জন্য লেখকের প্রতি চিরকৃতজ্ঞ। যাই হোক, জল কুঠুরির সাথে দারুণ একটা সময় কেটেছে।
লেখকের দর্শন ও বর্ণনাভঙ্গি বেশ প্রশংসনীয়। বিশেষ করে সংলাপগুলো হৃদয়ে গেঁথে যাওয়ার মতো। কাহিনির পাশাপাশি পারিপার্শ্বিক আবহের বিস্তারিত বর্ণনা গল্পের ভেতর সহজে ডুবিয়ে রেখেছে। গ্রামবাংলার প্রকৃতি, সেখানকার মানুষের সহজ-সরল জীবনযাত্রা, বেঁচে থাকার সংগ্রাম প্রভৃতি দক্ষতার সাথে কলমের কালিতে চিত্রায়িত করে তুলেছেন লেখক। প্রকৃতির বর্ণনার সময় বইয়ের পাতায় এমনভাবে হারিয়ে গেলাম, সেই মুহূর্ত ছিল শুধুই অনুভবের। প্রকৃতির কাছে দু’হাত প্রসারিত করে নিলাম একরাশ শুদ্ধতা। যান্ত্রিক শহরে বাস করা মানুষের কাছে বর্ষা মৌসুমের সৌন্দর্য অচেনা। বর্ষা মৌসুম যে এত সুন্দর সেটা গ্রামবাংলার চিরচেনা পরিবেশে না গেলে কখনো বোঝার জো নেই। এই রোদ তো, এই বৃষ্টি। আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে থাকে। সেখানে সারাক্ষণ মেঘেদের গর্জন চলতে থাকে। চারিদিক পানিতে থৈথৈ করে। ছোট-বড় সবাই খাল-বিলে মাছ ধরতে যায়। ছেলেরা উদোম গায়ে কাদাভরা মাঠে ফুটবল খেলে। সন্ধ্যা হওয়ার সাথে সাথে ঝিঁঝিঁপোকা রাস্তায় নেমে চারপাশ আলোকিত করে দেয়। ব্যাঙ ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ করে ডাকা শুরু করে। নিঃসন্দেহে মনোলোভা পরিবেশ। লেখক এত সুন্দরভাবে এ পরিবেশের বর্ণনা করেছেন, মনে হচ্ছিল নিজেই গল্পের একটা গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র, যে সবকিছু অবলোকন করতে পারছে।
চল্লিশ বছর আগের ও পরের গ্রামের পরিবেশ আর মানুষগুলোর জীবনযাত্রার মধ্যে তেমন উল্লেখযোগ্য পার্থক্য না দেখানোটা আমার কাছে যুক্তিসঙ্গত মনে হয়েছে। এখনো আমাদের দেশে এমন অনেক গ্রাম আছে, যেগুলো বছরের বেশিরভাগ সময় বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়ে থাকে। যেখানে পিচঢালা রাস্তার হদিস পাওয়া যায় না, কাঁচা রাস্তায় একমাত্র চলাচলের সম্বল।
➪ চরিত্রায়ন :-
❛জল কুঠুরি❜-কে উপভোগ্য করে তোলার পেছনের মূল কারিগর হচ্ছে গল্পের চরিত্ররা। মূল চরিত্র আরিফুর রহমান হলেও এর পাশাপাশি গল্পে ঠাঁই পাওয়া প্রতিটি চরিত্র ছিল গুরুত্বপূর্ণ, দু-একটি চরিত্রকে বাদ দিলে। লেখক চরিত্রগুলোর অতীতের গল্প বলার সময় পাঠককে একহাত করে নিয়েছিল। বলা যায়, পাঠকের মনকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছেন। কখনো রোমান্টিক প্রেমের গল্পে মশগুল করে রাখতেন, আবার কখনো দুঃখবোধের চাদরে ঢেকে দিতেন পাঠককে। তখন বুক চিরে বেরিয়ে আসত হাহাকার।
লেখক আরিফুর রহমানের বাবাকে একজন রাজাকার হিসেবে দেখালেও তার সম্পর্কে বিস্তারিত বলেননি। অন্যদিকে পাকিস্তানি আর্মির সাথে বিয়ের দুইদিন পর রওশান আরা বারীর বিধবা হয়ে যাওয়ার কারণটা খোলাসা করেননি। এরকম আরও কয়েকটা বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত বলা যেত। লেখক স্বাধীনতার জায়গা থেকে এমনটা চাননি বলে এসব ঘটেনি। তবে এসব নিয়ে না লেখাটা যে গল্পে বিন্দুমাত্র প্রভাব ফেলেছে তা কিন্তু নয়। শেষ অবধি গল্পের আমেজটা লেখক ঠিকই ধরে রাখতে পেরেছেন। এখানেই লেখকের সার্থকতা।
রিতা চরিত্রটা বেশ ভালোভাবে মনে ধরেছে। আমাদের সমাজে অন্যের অনুগ্রহ না নিয়ে চলা মানুষের দেখা খুব কম পাওয়া যায়। তার উপর মেয়ে মানুষ হলে তো কথা নেই। সেইদিক থেকে রিতার আত্মসম্মান নিয়ে নিন্দুকের মুখে চুনকালি মেরে সংগ্রাম করে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকাটা একপ্রকার দুঃসাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে। আমাদের সমাজে এমন নারীর খুব প্রয়োজন।
❛জল কুঠুরি❜ দারুণ একটা সময় উপহার দিয়েছে। লেখকের ও এর সাথে সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসা রইল।
➪ বানান ও সম্পাদনা :-
বইয়ে যে একেবারে ভুল বানান ছিল না, তা কিন্তু নয়। অনেকগুলো প্রচলিত ভুল বানান লক্ষ করেছি। যেমন : ব্যাবসা, তোশক, লক্ষ্য (লক্ষ আর লক্ষ্য, দুটো বানানের মধ্যে অনেক বড় পার্থক্য আছে; এ দুটো বানান সম্পর্কে সচেতন না হওয়ার দরুণ অনেকেই শব্দ দুটোর ব্যবহার করতে গিয়ে গুলিয়ে ফেলেন) ইত্যাদি। ই-কার, ঈ-কারেরও ভুল প্রয়োগ ছিল। আচ্ছা লেখক পরিবেশের খাতিরে স্রোতকে ইচ্ছাকৃতভাবেই কি শ্রোত লিখেছিলেন?
কয়েকটা বাক্যে অসামঞ্জস্যতা লক্ষ করেছি। আর ২-৩ জায়গায় উপমার ভুল প্রয়োগও ছিল। গল্পে এমনভাবে মজে ছিলাম ছিল যে এসবে ভ্রুক্ষেপ ফেলার সময় পাইনি।
➪ নামকরণ, প্রচ্ছদ ও প্রোডাকশন :-
জলকুঠুরি ছোট্ট একটা শব্দ, অথচ এর গভীরতা বিশাল। রিভিউয়ের শুরুতে গল্পের ছলে শব্দটার অর্থ বলে দিয়েছি। তাই এখানে সেটার জন্য আর বাক্য ব্যয় করছি না। তবে নামকরণে লেখকের সার্থকতা নিয়ে না বললেই নয়। সেইদিক থেকে লেখক সফলও হয়েছেন বটে। গল্পে উল্লেখিত গ্রামটি শুধু পানিতে ভাসমান ছিল না, সেখানকার মানুষগুলোর জীবনও একপ্রকার ভাসমান অবস্থায় ছিল। জীবনের তরে ভাসতে ভাসতে তারা কোনদিক থেকে কোনদিকে হারিয়ে যায় তা কেউ জানে না।
প্রচ্ছদে নান্দনিকতার ছাপ না থাকলেও বেশ নজরকাড়া একটা প্রচ্ছদ তৈরি করেছেন জাওয়াদ উল আলম। নামলিপিটাও দারুণ হয়েছে। প্রচ্ছদে এমন একটা ভাইব আছে যে, হাতের পরশ বুলিয়ে দিতে অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করছিল।
চিরকুট প্রকাশনীর প্রোডাকশন নিয়ে বহুবার বলেছি, তবুও গলায় বিন্দুমাত্র বিরক্তির ছাপ আসেনি। শুরু থেকে যেমন পাঠকবান্ধব প্রকাশনী হিসেবে পরিচিত হয়ে আসছে, এখনো সেই ধারাটা বহাল আছে। নান্দনিকতার ছোঁয়া লাগিয়ে যে প্রোডাকশন দিচ্ছে তাতে সন্তুষ্ট না হওয়ার উপায় নেই।➪
➪ উৎসর্গপত্র :-
❝জ্ঞানের আলোয় পৃথিবী ভালো মানুষের হোক।❞