যখন আমরা নতুন কিছুর জন্য পুরাতন কিছু ছেড়ে দেই তখন আমরা বুঝতে পারি না আসলে কি অমূল্য জিনিস হারাচ্ছি! কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় একদিন ঠিকই বুঝতে পারি। তখন অতীত খুঁজে ফিরি আর দীর্ঘশ্বাসের সাথে আফসোস করি। তাতে অতীত কখনও ফিরে আসে না। বরংচ মাঝে মধ্যে অতীত থেকে অজানা কিছু ঘটনা সামনে উঠে আসে। যা দীর্ঘশ্বাস দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর করে দেয় অথবা এনে দেয় স্বস্তি।
- বই: জলকুঠুরি
- লেখক: মুশফিক উস সালেহীন
- জনরা: সামাজিক উপন্যাস
- প্রচ্ছদ: জাওয়াদ উল আলম
- প্রকাশনী: চিরকুট প্রকাশনী
- মুদ্রিত মূল্য: ৩০০টাকা
- পৃষ্ঠা সংখ্যা: ১৬০
- কাহীনি সংক্ষেপে:
আমেরিকা থেকে ষাটোর্ধ্ব আরিফ সাহেব ৪০বছর পর দেশে ফিরলেন। এই ৪০বছরে বদলে গেছে অনেক কিছু। কমলপাড়ার রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে রানু ফুফুও। যে রানু ফুফুকে আরিফ সাহেব রানু বলে ডাকতেন তাকে এখন ফুফু ডাকতে হচ্ছে!
এতো কিছু বদলে গেলেও শুধু বদলায়নি তাদের বাড়িটা। ৪০বছর আগেও যেমন বৃষ্টি এলে ডুবে যেতে বাড়ির নিচ তলা, এখনও ডুবে যায়। আরিফ সাহেবের চোখের সামনে ভেসে ওঠে সোনালী অতীত। ভেসে ওঠছে কলেজ জীবনের স্মৃতি।
সরকার বাড়ির শ্রীর কথা মনে ওঠতেই হয়তো আরিফ সাহেবের চোখে জ্বালা করে!
যুদ্ধ চলাকালীন সেই ৪০ বছর আগে এমন কী হয়েছিল? যাতে দেশ ছেড়ে বিদেশ পাড়ি জমিয়েছেন আরিফ সাহেব?
শ্রী এখন কোথায়?
আরিফ সাহেব কী শুধু জায়গা জমি ভাগ করে দিতে এসেছেন? নাকি অতীত খুঁজতে?
পাঠপ্রতিক্রিয়া:
বইটা মূলত গ্রামীণ প্রেক্ষাপটে রচিত হয়েছে। গ্রামীণ সৌন্দর্যের বর্ননায় মুগ্ধ হয় না এমন মানুষ খুব কমই আছে। তাছাড়া লেখকের বর্ননা দেয়ার ভঙ্গিমা বরাবরই আমার ভালো লাগে।
বইটা শুধু যে গ্রামীণ প্রেক্ষাপটে এসেছে আসলে তাও নয়, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন কিছু দৃশ্য উঠে এসেছে। দুটো দিক সমান ভাবেই তুলে ধরছে লেখক।
ব্যাক্তিত্ব, ভালোবাসা, হিংসা, প্রতিশোধ সবকিছুই এক মলাটে তুলে দিয়েছে।
হিংসা থেকেই আসে প্রতিশোধ পরায়ন চিন্তা। আর প্রতিশোধ কখনওই ভালো কিছু বয়ে আনে না। এই ব্যাপারটা বেশ ভালো ভাবেই উঠে এসেছে।
প্রধান চরিত্র আসলে কোনটা আরিফ সাহেব নাকি রিতা?
এ নিয়ে প্রথম দিকটায় পাঠকের মনে সংশয় জাগতেই পারে। লেখকের সবগুলো লেখার ধরন বরাবরই এমন, তিনি প্রায় সব চরিত্রে সমান গুরুত্ব দেন।
বইটিতে একদিকে যেমন আরিফ সাহেবের ব্যাক্তিত্ব উঠে এসেছে। তেমনি উঠে এসেছে রিতার আত্মসম্মানবোধ। তাই শেষ পর্যন্ত না পড়া অব্দি বুঝে উঠতে পারিনি যে আরিফ সাহেবই মেইন চরিত্র।
প্রধান চরিত্র যেহেতু ষাটোর্ধ্ব এক ব্যাক্তির তাই বইয়ের এক তৃতীয়াংশ তার স্মৃতিচারণ। তবে তাতে পড়ার গতি মোটেই থেমে যায় নি।
লেখককে সবাই থ্রিলার লেখক হিসেবেই চিনে। তার টুইস্ট ভিত্তিক থ্রিলার বই পড়ার পর যখন তার সামাজিক উপন্যাস আসার ঘোষণা আসছে, তখন স্বাভাবিকভাবেই বইটার প্রতি আগ্রহ বেশি ছিল।
থ্রিলার এবং সামাজিক উপন্যাস যেমন আলাদা জনরার, তেমনি পাঠকের জনরা ভিত্তিক অনুভূতিও আলাদা হয়।
থ্রিলার যেমন পয়েন্টে পয়েন্টে রহস্য না থাকলে জমে না। তেমনি সামাজিক উপন্যাস সহজ, সাবলীল না হলে মুগ্ধতা আসে না।তাই সঙ্গত কারণেই এখানে প্রশ্ন থেকে যায়, যে “জলকুঠুরি” পড়ে মুগ্ধতা আসছে?
জ্বী, মুগ্ধতা এসেছে। এবং আগ্রহটাও জলে যায় নি। জলকুঠুরি বড় বড় জলাশয়ের মতোই, নিরব কিন্তু গভীরতা অনেক।
সবশেষে কিছু প্রশ্নও থেকে যায়। সবথেকে বড়ো প্রশ্ন রয়েছে রাতুলের বাবাকে নিয়ে। মানে রিতার বরকে নিয়ে। তবে কিছু প্রশ্ন বোধহয় থেকে যাওয়াই ভালো।
এতো এতো মুগ্ধতার মধ্যেও আমার একটু আক্ষেপ রয়েই গেছে।আমার মনে হয়েছছ কিছু কিছু অংশে প্রকৃতির সৌন্দর্য বর্ননায় লেখক কৃপণতা করেছেন। এবং সেইসব অংশে যদি আরেকটু প্রকৃতির বর্ননা থাকতো তবে আরও উপভোগ্য হতো।এবং সালমান ভাইয়ের রিভিউর দুটো লাইন আমার রিভিউর সাথে যুক্ত করে দিতে চাই। কারণ আমিও ভাইয়ার সাথে একমত।
“চোখে লাগার মত বিষয় বলতে অনেকের কাছে হয়তো মনে হবে নিজের বেশ কিছু স্টেটমেন্ট চরিত্রগুলোকে দিয়ে বলিয়ে নিচ্ছেন লেখক। কিন্তু অনেকের হয়তো ঠিক এই কারণেই ভালো লাগবে। আমি দ্বিতীয় দলে। ”
চরিত্রায়ন: সবগুলো চরিত্রই বেশ উপভোগ্য।এরপরেও আমার মনে হয়েছে শ্রী কে আরও হাইলাইট করা উচিত ছিল। এছাড়া আরিফ সাহেব, রিতা, রানু ফুফু, শ্রী বাদেও সাইড চরিত্র হিসেবে আমার কাছে ছুটি, করিম মজুমদার,হারুন,শেখ কাদির,সতী চরিত্র গুলো বেশ ভালো লেগেছে।
ছুটির চরিত্রটা একেবারে নিজের ছেলেবেলায় নিয়ে গিয়েছে। বিশেষ করে কাগজের নৌকা ভাসানো ব্যাপারটা আলাদা একটা মুগ্ধতা এনে দিয়েছে।
প্রচ্ছদ ও নামকরণ:
চোখের শান্তি বলতে যা বুঝায় সেটাই জলকুঠুরির প্রচ্ছদ। সাদাসিধে কিন্তু ভীষণ মনোমুগ্ধকর। শুধুমাত্র সাধারণ প্রচ্ছদের কারণেই অনেকে বইটা এড়িয়ে যাবে। আবার অনেকে একই কারণে বইটা হাতে তুলে নিবে।
কারণ প্রচ্ছদে থাকা ফুলটার পানিতে প্রতিফলন ছাড়া গল্পের সাথে কোথাও মিল নেই।
নামকরণ নিয়ে ইতিমধ্যে অনেকেই আলোচনা করেছে এবং জলকুঠুরি মানে কী তাও তুলে ধরছে। তাই বিশেষ কিছু বলার নেই। তবে হ্যাঁ,নামের সাথে গল্পের পুরাপুরি মানিয়ে গেছে।
প্রোডাকশন এবং সম্পাদনা: চিরকুটের বাইন্ডিং, পেইজ কোয়ালিটি বরাবরই দারুণ,এদিকটা অভিযোগ করার জায়গা রাখে না। প্রোডাকশন কোয়ালিটিতে সেরা ৫টি প্রকাশনীর নাম বলতে বললে, আমি ৫টি প্রকাশনীর মধ্যে চিরকুটের নামও রাখবো। তবে চিরকুটের একটাই মুদ্রা দোষ। আর তা হচ্ছে যদি তারা বলে বইটা মে মাসে প্রকাশিত হবে। তাহলে সেই বইটা আগস্ট/সেপ্টেম্বরে প্রকাশ হয়। বারবারই তাদের এমনটা হয়। এটা যদি তাদের বিজনেস পলিসির একটা অংশ , তাহলে তো আর এখানে কিছু বলার নেই।
বানান ভুল নিয়ে শুধু চিরকুটের কথা বলে লাভ নেই। বর্তমানে অধিকাংশ প্রকাশনীই পাঠকদের প্রুফরিডার বানিয়ে নিয়েছে!
“জলকুঠুরি”-তেও ৩/৪ টা বানান ভুল রয়েছে।
এর মধ্যে “ Mushfik Us Salehil /Mushfik Us Salehin” এটা একেবারে চোখে বিধে যায়। মানে সয়ং লেখকের নামেরই বানান ভুল!
সম্পাদনার দিকটায় আরও মনোযোগ দেয়া দরকার।
বই থেকে ২/৩টা প্রিয় লাইন:
🔴জানালা দিয়ে তারা দেখতে না পেলে বিদ্বান হওয়াও বৃথা। প্রকৃতিকে চোখ দিয়ে দেখতে হয়, বই পড়ে তার স্বাদ জানা যায় না।
🔴বয়েস যত কম থাকে, মাটির সাথে দূরত্বও তত কম হয়। তখন শরীরে মাটি লাগলে, তাতে নোংরা মনে হয় না, ব্যথাও হয় না।
মাটির সাথে দূরত্ব যত বৃদ্ধি পায়, ততই বিষন্নতা ভর করে। বয়েসটাও বাড়ে।
🔴যে মেয়েকে একা তার সংসার সামলাতে হয়, তার সম্মান পরের হাতেই থাকে। তার মেরুদণ্ড সোজা রাখতে অনেক শক্তি লাগে।
🔴মেয়ে মানুষের হিংসে বড়ো ভয়ঙ্কর জিনিস। চারপাশ জ্বালিয়ে দেয়।
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?