চিন্তার পরিশুদ্ধি : লেখক : মুহাম্মাদ কুতুব | Chintar Porishuddhi By Mohammad Kutub

  • বই : চিন্তার পরিশুদ্ধি
  • লেখক : মুহাম্মাদ কুতুব
  • প্রকাশনী : রুহামা পাবলিকেশন
  • বিষয় : আত্মশুদ্ধি ও অনুপ্রেরণা
  • অনুবাদক : ইফতেখার সিফাত
  • পৃষ্ঠা : 284, কভার : পেপার ব্যাক
  • ভাষা : বইটি বাংলা ভাষায় লিখিত
  • প্রথম প্রকাশ : ১৬ মে, ২০২২

আজ ইসলামি বিশ্ব ইতিহাসের যে পর্বটি অতিক্রম করছে, তা সবচেয়ে বেদনাদায়ক ও মর্মান্তিক। বিষয়টি আমি অন্য বইয়ে ইঙ্গিত দিয়েছি। যদি মুসলিম উম্মাহর পুরো ইতিহাসে এটি সবচেয়ে মর্মান্তিক অবস্থা নাও হয়, তবে ইতিপূর্বে মুসলিম উম্মাহর ওপর আপতিত দুর্যোগগুলো এভাবে একই সময়ে পুরো উম্মাহর ওপর আপতিত হয়নি— যেভাবে বর্তমান অবস্থায় হচ্ছে। লাঞ্ছনা, অপমান আর দুর্দশা পুরো উম্মাহব্যাপী ছিল না—যেভাবে আজ পুরো উম্মাহকে বিষয়গুলো গ্রাস করে নিয়েছে।

যদি গত শতাব্দীতে স্পেনপতনকে মুসলিমদের ওপর বয়ে যাওয়া সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি হিসেবে গণ্য করা হয়, তাহলে ফিলিস্তিন ট্র্যাজেডি এর চেয়েও বড়। কারণ, যে সময়ে স্পেন থেকে মুসলিমদের ছায়া সংকুচিত হয়ে আসছিল, সে সময়ে তারুণ্যদীপ্ত উসমানি খিলাফত কনস্টান্টিনোপলে হামলা করে তা ইসলামি খিলাফতের রাজধানীতে রূপান্তর করছিল। অতঃপর সেনাবাহিনী নিয়ে উসমানিরা ইউরোপে প্রবেশ করছিল। একপর্যায়ে মুসলিম বাহিনী ভিয়েনা ও সেন্ট পিটার্সবার্গ পর্যন্ত পৌঁছে যায়। পক্ষান্তরে ফিলিস্তিন ট্র্যাজেডি যখন সংঘটিত হয়ে চলেছে, মুসলিমদের কর্তৃত্ব তখন প্রতিটি ভূখণ্ডে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ছে। কোনো অঞ্চলই মুসলিমদের গণহত্যা থেকে মুক্ত থাকছে না। ফিলিপাইন, ইথিওপিয়া, ইউরোপ, চাদ, নাইজেরিয়া, হিন্দুস্তান, আফগানিস্তান, সমাজতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক সমস্ত অঞ্চলে মুসলিমদের হয়তো কুফর নয়তো মৃত্যু– যেকোনো একটি বেছে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। আন্তর্জাতিক অপশক্তির বলয়ে ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণ্য চক্রান্ত চলছে। ইসলামি বিশ্বকে টুকরো টুকরো করে ফেলা হচ্ছে। ইসলামি ভূখণ্ডে অনৈসলামি রাষ্ট্র গঠনের জন্য একের পর এক পরিকল্পনা হচ্ছে। প্রতিবারই ইসলামি ভূখণ্ড থেকে একটি করে অংশ কেটে নেওয়া হচ্ছে। সেখানে অবশিষ্ট মুসলিমদের হয়তো গোলাম বানানো হচ্ছে, নয়তো হত্যা করা হচ্ছে। হত্যা করা হচ্ছে ইসলামের দায়িদের। তাদের ওপর ইতিহাসের সবচেয়ে লোমহর্ষক নির্যাতন চালানো হচ্ছে ইসলামের ধ্বজাধারী শাসকদের হাতে যারা মুসলিমদের জন্য আল্লাহর শরিয়াহ দিয়ে শাসন করা প্রত্যাখ্যান করেছে।
২. অর্থাৎ ‘ওয়াকিউনাল মুআসির’ বইয়ে। এ বইয়ের আগে ‘মাফাহিম’ বইটি প্রকাশ হওয়ার কথা ছিল, যেহেতু মাফাহিম বইটি এ বইয়ের কয়েক বছর পূর্বে লিখিত হয়। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছা ছিল তার কয়েক বছর পরে ‘মাফাহিম’ প্রকাশ হবে। ‘মাফাহিম’ বইয়ের কয়েক বছর পরে যে বইটি লিখেছি সেটা তার পূর্বে প্রকাশ পাবে। সবকিছুরই আল্লাহর কাছে একটা নির্ধারিত সময় আছে।
ইতিহাসের নজিরবিহীন এমনই মর্মান্তিক কালো অধ্যায় আজ মুসলিম বিশ্ব পার করছে।
এই পরিস্থিতিতে কোনো কিছুই লক্ষ্যহীনভাবে ঘটছে না। বস্তুত মানব ইতিহাসে লক্ষ্যহীনভাবে কোনো কিছু ঘটা সম্ভবও নয়। মানব ইতিহাসে সবকিছুই আল্লাহর সুন্নাহ মোতাবিক সংঘটিত হয়। কোনো সৃষ্টির ব্যাপারেই আল্লাহর সুন্নাহ ভিন্নতর হয় না, কারও পক্ষপাতও করে না।
فلن تجد لسنت الله تبديلا ولن تجد لسنت الله تحويلا
‘অতএব আপনি আল্লাহর বিধানে কখনোই পরিবর্তন পাবেন না। আর আল্লাহর নীতিতে আপনি কিছুতেই কোনো ব্যতিক্রমও পাবেন না।
আল্লাহর একটি নীতি হচ্ছে, তিনি কোনো জাতির প্রতি কোনো নিয়ামত দান করলে তা ওই সময় পর্যন্ত পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না সে জাতি নিজেই সে নিয়ামতকে পরিবর্তন করে যতক্ষণ না তারা নিজেরাই পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে যায়।
ذلك بأن الله لم يك مغيرا نعمة أنعمها على قوم حتى يغيروا ما بأنفسهم وأنّ
الله سميع عليم
‘সেটার কারণ এই যে, আল্লাহ সেসব নিয়ামত কখনোই পরিবর্তন করেন না, যা তিনি কোনো জাতিকে দান করেছেন, যতক্ষণ না সে জাতি নিজেই সে নিয়ামত পরিবর্তন করে। আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা সর্বজ্ঞ।
আল্লাহর আরেকটি নীতি হচ্ছে, কেউ সৎ ও পুণ্যবান জাতির সন্তান হওয়ার কারণেই আল্লাহ তার পক্ষপাত করেন না।
وإذ ابتلى إبراهيم ربه بكلمات فأتمهن قال إني جاعلك للناس إماما قال ومن ذريتي قال لا ينال عهدي الظالمين
স্মরণ করুন সে সময়ের কথা, যখন ইবরাহিমকে তার রব কয়েকটি বিষয়ে পরীক্ষা করলেন, অতঃপর তিনি তা পূর্ণ করে দেখালেন। তখন পালনকর্তা বললেন, “আমি তোমাকে মানবজাতির নেতা বানাব।” তিনি বললেন,
৩. সুরা ফাতির ৩৫ : ৪৩। ৪. সুরা আল-আনফাল, ৮:৫৩।
“আমার বংশধর থেকেও।” পালনকর্তা বললেন, “আমার অঙ্গীকার জালিমদের পর্যন্ত পৌঁছবে না। ***
আল্লাহ কোনো জাতিকে কেবল তখনই ক্ষমতা দান করেন, যখন তারা নিজেরাই সৎ মুমিন হয়ে যায়।
وعد الله الذين آمنوا منكم وعملوا الصالحات ليستخلفنهم في الأرض كما استخلف الذين من قبلهم وليمكنن لهم دينهم الذي ارتضى لهم وليبيلتهم من بعد خوفهم أمنا يعبدونني لا يشركون بي شيئا
‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান আনে এবং সৎকর্ম করে, তাদেরকে আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, তিনি তাদের অবশ্যই পৃথিবীতে শাসনক্ষমতা দান করবেন—যেভাবে তাদের পূর্ববর্তীদের শাসনক্ষমতা দান করেছিলেন। তিনি অবশ্যই তাদের দ্বীনকে সুদৃঢ় করবেন, যা তিনি তাদের জন্য পছন্দ করেছেন এবং তাদের ভয়ভীতির পরিবর্তে অবশ্যই তাদের নিরাপত্তা দান করবেন। তারা আমার ইবাদত করবে এবং আমার সাথে কাউকে শরিক করবে না।
যারা আল্লাহর কিতাবকে গতানুগতিক উত্তরাধিকার হিসেবে লাভ করে—তথা আল্লাহর কিতাবকে তারা নিজেদের জন্য বিশেষ কিছু বা আবশ্যকীয় মনে করে না – বরং শুধু বাপদাদা থেকে প্রাপ্ত মিরাসি সম্পদ গণ্য করে, তারাই হচ্ছে অযোগ্য এবং কলঙ্কিত উত্তরসূরি। এদের মন্দ পরিণতি থেকে মুসলিমদের সতর্ক করার জন্য বনি ইসরাইলের আলোচনাপর্বে কুরআনে এদের প্রতিই ইঙ্গিত করা হয়েছে।
فخلف من بعدهم خلف ورثوا الكتاب يأخذون عرض هذا الأدنى ويقولون سيغفر لنا وإن يأتهم عرض مثله يأخذوه ألم يؤخذ عليهم ميثاق الكتاب أن لا يقولوا على الله إلا الحق ودرسوا ما فيه والدار الآخرة خير للذين يتقون
أفلا تعقلون
‘অতঃপর তাদের পরে কিছু অপদার্থ আসে। যারা কিতাবের উত্তরসূরি হয়ে পার্থিব তুচ্ছ বস্তু গ্রহণ করত আর বলত, “আমাদের ক্ষমা করা হবে।” বস্তুত
৫. সুরা আল-বাকারা, ২: ১২৪। ৬. সুরা আন-নূর, ২৪: ৫৫।
তাদের সামনে আবারও এ ধরনের তুচ্ছ বস্তু আসলে তারা তা গ্রহণ করে নেবে। তবে কি তাদের কাছে কিতাবের মধ্যে প্রতিশ্রুতি নেওয়া হয়নি যে, তারা আল্লাহর ব্যাপারে কেবল সত্যই বলবে। অথচ তারা কিতাবে যা আছে, তা অধ্যয়ন করেছে। বস্তুত পরকালের আবাস মুত্তাকিদের জন্য উত্তম পুরস্কার। তোমরা কি বোঝো না?!?
এরাই সেই জাতি, যাদের ব্যাপারে মহান রব বলছেন
تخلف من بعدهم خلف أضاعوا الصلاة واتبعوا الشهوات فسوف يلقون
غيا
‘অতঃপর তাদের পরে এমন অপদার্থরা আসলো, যারা সালাত নষ্ট করল এবং প্রবৃত্তির অনুসরণ করল। সুতরাং তারা অচিরেই ভ্রষ্টতার মুখোমুখি হবে। ৮
এ সবই হচ্ছে আল্লাহ প্রদত্ত নীতি। যার মাধ্যমে মানবজীবনের সকল বিষয় পরিচালিত হয়। যা কারও পক্ষপাতিত্ব করে না। কোনো মানুষের সামান্য প্রবৃত্তির সামনে যা কিঞ্চিতও পরিবর্তন হয় না।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহর ওপর কর্তৃত্ব, খিলাফত ও নিরাপত্তার অনুগ্রহ দান করেছিলেন। আসমান-জমিনের সকল কল্যাণের দরজা তাদের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন। যেভাবে মুত্তাকিদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন :
ولو أن أهل القرى آمنوا واتقوا لفتحنا عليهم بركات من السماء والأرض
‘যদি জনপদবাসীরা ইমান আনত এবং তাকওয়া অবলম্বন করত, তবে অবশ্যই তাদের প্রতি আসমান-জমিনের বরকতের দরজা খুলে দিতাম।
অতঃপর তাদের অবস্থার পরিবর্তন হলো। খিলাফত, কর্তৃত্ব আর নিরাপত্তার অবস্থান থেকে দুর্বলতা, লাঞ্ছনা আর নিরাপত্তাহীনতার স্তরে নেমে গেল। তারা গৃহহীন, লাঞ্ছনা আর হত্যাযজ্ঞের শিকারে পরিণত হলো—যখন তারা সেই চরিত্রে রূপ নিল, যে চরিত্রের ব্যাপারে রাসুল তাদের সতর্ক করেছেন :
৭. সুরা আল-আরাফ, ৭: ১৬৯।
৮. সুরা মারইয়াম, ১৯৫৯। ৯. সুরা আল-আরাফ ৭:৯৬।
«يوشك الأمم أن تداعى عليكم كما تداعى الأكلة إلى قصعتها»، فقال قائل: ومن قلة تحن يومين؟ قال: «بل أنتم يومئذ كثير، ولكنكم غثاء كغثاء
““অচিরেই অন্যান্য জাতিবর্গ তোমাদের বিরুদ্ধে একে অপরকে ডাকতে থাকবে—যেভাবে খাবার গ্রহণকারীরা খাবারপাত্রে একে অপরকে ডাকতে থাকে।” তখন সাহাবিদের কেউ জিজ্ঞেস করলেন, “সেদিন কি আমরা কম হওয়ার কারণে এমনটি হবে হে আল্লাহর রাসুল!” রাসুল বললেন, “বরং তোমরা সেদিন সংখ্যায় অনেক হবে; কিন্তু তোমরা হবে বন্যার স্রোতে ভেসে যাওয়া খড়কুটোর মতো।…
তাহলে কোন বস্তুর পরিবর্তন হলো? কীভাবেই বা ঘটল এই পরিবর্তন?
ইতিহাসের দীর্ঘ পরিক্রমায় মুসলিমদের জীবনে অনেক বিকৃতি-বিচ্যুতিই ঘটেছে। আল্লাহর দেওয়া মানহাজ থেকে তাদের জীবনে প্রতিটি বিচ্যুতিরই একটি শাস্তি রয়েছে। বিচ্যুতির ধরন অনুযায়ী নিশ্চিতভাবেই তাদের ওপর এই শান্তি আপতিত হয়েছে— তৎক্ষণাৎ বা দেরিতে, বিচ্যুতির ব্যাপারে উম্মাহর শাসক, উলামা ও জনসাধারণের অবস্থান অনুপাতে। একপর্যায়ে বিচ্যুতি যখন তার সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছল, তখন তাদের সেই পরিণতি হলো, যা আমরা আজ দেখতে পাচ্ছি। খিলাফত, কর্তৃত্ব ও নিরাপত্তার পরে তাদের জুটল দুর্বলতা, লাঞ্ছনা ও ভয়ভীতি।
এ বইয়ে আমরা সমস্ত বিচ্যুতির দীর্ঘ পথপরিক্রমা সম্পর্কে আলোচনা করব না।
এখানে আমরা বিকৃতির একটি নির্দিষ্ট প্রকার নিয়ে আলোচনা করব। এই প্রকারের বিকৃতিটিই বর্তমান সময়ে মুসলিম জীবনে বেশি বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথবা ঐতিহাসিকভাবে এই প্রকারটিই বিকৃতির সারনির্যাস।
অনেক মুখলিস দায়িরাও বিশ্বাস করেন, মুসলিমদের ওপর যে দুর্যোগ আপতিত হয়েছে, তা কেবল বিশুদ্ধ ইসলাম থেকে তাদের পদ্ধতিগত বিচ্যুতির কারণেই হয়েছে।
১০. সুনানু আবি দাউদ : ৪২৯৭, মুসনাদু আহমাদ: ২২৩৯৭। ১১. এ সম্পর্কে ওয়াকিউনাল মুআসির’ বইয়ে আলোচনা করেছি।
মুসলিমদের কার্যক্রমের ক্ষেত্রে বিচ্যুতির বিষয়টি এতটাই স্পষ্ট যে, তা বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না। কেননা, তাদের জীবনের অঙ্গনে যে মিথ্যা, ধোঁকাবাজি, নিফাকি, দুর্বলতা, কাপুরুষতা, হীনতা, বিদআত ও নাফরমানি ছড়িয়ে পড়েছে, যুবকদের মাঝে গা বাঁচানো ও পলায়নের যে মানসিকতা ঢুকে পড়েছে, মানুষের মাঝে পাপাচার ও অন্যায়ের প্রতি ঝোঁক এবং অন্যান্য আরও যে শত মন্দ কাজ ও স্বভাবগুলো জেঁকে বসেছে—এসবের কোনোটারই ইসলামে বৈধতা নেই; অথচ মুসলিমরা আজ এসবের মাঝেই বাস করছে।
উপরন্তু এদের জীবনে বিচ্যুতি শুধু কর্মগত বিচ্যুতিতেই সীমাবদ্ধ নয়। তাদের জীবনে এটাই সবচেয়ে ক্ষতিকর বিচ্যুতি নয়। যদি বিষয়টি এ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকত, তবে খারাপ হলেও তা অনেক সহজ ছিল! কিন্তু বিষয়টি সীমা অতিক্রম করে ‘বুঝ ও বিশ্বাসের মাঝে বিচ্যুতি পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। আর ইসলামের মৌলিক সকল বিশ্বাস শুরু হয় ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ থেকে।
কোনো মানুষের যখন কর্মগত বিচ্যুতি থাকে কিন্তু তার দ্বীনের ব্যাপারে বুঝ-বিশ্বাস সঠিক ও বিশুদ্ধ থাকে, তখন তার পেছনে সামান্য চেষ্টা করলেই তাকে কর্মগত বিচ্যুতি থেকে ফিরিয়ে আনা যায়। যার দ্বীনি বুঝ সঠিক, তার সে বুঝ ঠিক করতে আপনার কোনো চেষ্টারই প্রয়োজন পড়বে না। কেননা, তার বুঝ এমনিতেই সঠিক আছে; যদিও তার কাজগুলো এর থেকে বিচ্যুত। আর যখন কারও স্বয়ং দ্বীনি বুঝের মধ্যেই বিচ্যুতি থাকে, তখন প্রথমে তার দ্বীনি বুঝ ঠিক করতে অনেক পরিশ্রমের দরকার হবে। তারপর তার কর্মপদ্ধতি ঠিক করতে আরও সময় যাবে।
বর্তমান ইসলামি বিশ্বের এটাই বাস্তবতা।
কর্মগত ভুল অতিক্রম করে দ্বীনের মৌলিক বুঝের মাঝে ভ্রান্তি ঢুকে পড়েছে। এ কারণে ইসলাম আজ সেই অপরিচিতিই ধারণ করেছে, যার কথা রাসুল বলেছেন :
بدأ الإسلام غريبا، وسيعود كما بدأ غريبا،
‘ইসলাম অপরিচিত অবস্থায় শুরু হয়েছে। অচিরেই অপরিচিত অবস্থায় ফিরে বে, যেভাবে তা শুরু হয়েছে। ১২
ইসলাম বাস্তবেই আজ অপরিচিত হয়ে গেছে। স্বয়ং মুসলিমদের কাছেই আজ ইসলাম অপরিচিত হয়ে গেছে। তারা ইসলামকে তার সঠিক অবস্থা থেকে ভিন্নভাবে কল্পনা
১২. সহিহ মুসলিম: ১৪৫।
করে। সেই সাথে তো পদ্ধতিগত বিচ্যুতি আছেই। যখন তাদের সামনে ইসলামকে বাস্তব চিত্রে পেশ করা হয় — যেভাবে কুরআন-সুন্নাহয় এসেছে এবং সালাফে সালিহিনদের জীবনে যার পূর্ণাঙ্গ প্রয়োগ হয়েছে—তখন তাদের কাছে ইসলাম অপরিচিত মনে হয়।
আমাদের কর্তব্য হচ্ছে বিষয়টির বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়া।
কারণ, দ্বীনি বুঝের বিচ্যুতি রেখে আমরা মানুষের আমল ঠিক করার ব্যাপারে যত চেষ্টাই ব্যয় করি না কেন, তা কখনোই পরিপূর্ণ ফল বয়ে আনবে না এবং বর্তমানে উম্মাহ যে গর্তে পতিত হয়ে আছে, তা থেকে কখনোই বের হতে পারবে না। তাই শ্রেষ্ঠ প্রজন্মের মুসলিমগণ ইসলামের প্রথম পর্যায়ের অপরিচিতি দূর করতে যে কষ্ট মুজাহাদা করেছেন, ইসলামের দ্বিতীয় পর্যায়ের অপরিচিতি অবস্থা দূর করার জন্যও আমাদের আরও বেশি কষ্ট-মুজাহাদা করতে হবে।
এই দ্বিগুণ শ্রম-সাধনাই আজ সচেতন ইসলামি সমাজের অবধারিত মিশন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এ ক্ষেত্রে আমরা সর্বপ্রথম ইসলামের সঠিক বুঝ গ্রহণের মানহাজ বা পদ্ধতি ঠিক
করার চেষ্টা করব।
এই দ্বীনের বুঝ আমরা কোথা থেকে পাব? কিতাবুল্লাহ, সুন্নাতে রাসুল এবং সালাফে সালিহিনদের জীবনী থেকে? নাকি এই সুস্পষ্ট ও সরল বুঝের ওপর যে বিকৃত ও নবাগত চিন্তার আস্তর পড়েছে, যে চিন্তা মুসলিম উম্মাহর জীবনের বিগত কয়েক শতাব্দীর পরিক্রমায় বিভিন্ন কর্মের প্রভাবে সৃষ্টি হয়েছে এবং বিভিন্ন চিন্তা-চেতনা এবং মত-পথের সাথে সর্বদা সহাবস্থানের কারণে তৈরি হয়েছে, তা থেকে?!
যখন আমরা সঠিক বুঝ প্রাপ্তির মানহাজ ও উৎস সংশোধন করব এবং সেগুলোর ওপর ভিত্তি করে উত্তরসূরি মুসলিমদের অনুভূতিতে ইসলামের মৌলিক বুঝের ব্যাপারে যে বিকৃতি প্রবেশ করেছে, তা সংশোধন করব, তখন আমাদের সামনে অপর একটি মিশন বাকি থাকবে, যা পূর্বের মিশন থেকে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। তা হলো, এ দ্বীনের সঠিক বুঝের ওপর উম্মাহকে তারবিয়াত দেওয়ার মিশন।
তারবিয়াত হলো সেই প্রকৃত ও বাস্তবসম্মত চেষ্টা, যা থেকে প্রত্যাশিত ফল আশা করা যায়। কিন্তু এ ফল কেবল তখনই আসবে, যখন তা সঠিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত এই বইটি ইসলামের মৌলিক কিছু বিষয়সংশ্লিষ্ট বুঝ সঠিক করার সামান্য প্রচেষ্টা। যা গ্রহণ করা হয়েছে কুরআন সুন্নাহ এবং সালাফে সালিহিনের পবিত্র জীবনী থেকে। সেই সাথে এগুলোর ওপর মুসলিম উম্মাহর বিগত কয়েক শত বছরের ইতিহাসে যে বিকৃতি যুক্ত হয়েছে, তাও দূর করা হয়েছে।
এ বইয়ে আমরা ইসলামের মৌলিক পাঁচটি বিষয়ের মর্ম সন্নিবেশিত করেছি।
এক. ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র মর্ম।
দুই. ইবাদতের মর্ম।
তিন, কাজা ও কদরের মর্ম।
চার. দুনিয়া ও আখিরাতের মর্ম।
পাঁচ সভ্যতা ও পৃথিবী আবাদের মর্ম।
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচনা পাবেন ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র মর্মসম্পর্কিত। তারপর পাবেন ইবাদতের বুঝসংক্রান্ত আলোচনা। কারণ, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহই হচ্ছে ইসলামের সবচেয়ে বড় এবং প্রধান ভিত্তি। আবার এই ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র বুঝের মধ্যে বিকৃতিই মুসলিমদের জীবনে সবচেয়ে বড় এবং ভয়ানক। একইভাবে ইবাদতের বুঝের ক্ষেত্রেও একই কথা। এই উম্মাহর সোনালি যুগ ও তখনকার অবদানগুলোর ক্ষেত্রে যেমন এর ছিল বিস্তৃত ও সর্বব্যাপী অর্থ, ঠিক তেমনই বর্তমান মুসলিমদের অধঃপতিত বাস্তবতায় এর অর্থ হয়ে গেছে সংকীর্ণ ও সীমাবদ্ধ।
তাই যখন এই মর্মগুলো সঠিক করা হবে এবং তার প্রকৃত কার্যকর ও জীবন্ত চিত্র মুসলিমদের হৃদয়ে ফিরে আসবে, তখন আল্লাহর সাহায্যে মুসলিমদের গ্রাস করা প্রতিটি বিচ্যুতি ও খারাপ প্রভাব সংশোধন করা সহজ হয়ে যাবে।
এই নগণ্য প্রচেষ্টায় আল্লাহ যদি আমাকে কিছু তাওফিক দান করেন, তবে অবশ্যই আমি তাঁর নিয়ামতের শোকরগোজার করব। আল্লাহর সাহায্য ছাড়া আমার কোনো শক্তি-সামর্থ্য নেই।
-মুহাম্মাদ কুতুব
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?