- চরৈবেতি : এক প্রেমগাথা
- লেখক : অমৃতা শঙ্কর ব্যানার্জী
- প্রচ্ছদ : বিপাশা মিত্র
- প্রকাশক : মাথামোটার দপ্তর
- মুদ্রিত মূল্য : ২২২.০০
সকলের বক্তব্য শোনার পর মহারানার বিশিষ্ট হিতাকাঙ্খী ও অনুরাগী রাও জয়মল মহারাণার প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে বললেন, ‘মহারানা, এই অবস্থায় এই দুর্গে আপনি এবং বিশেষত রাজপরিবারের স্ত্রীগণ, সঙ্গে যুবরাজ প্রতাপ ও অন্যান্য যুবরাজগণ রয়ে যাওয়ার অর্থ একটিই হয়। ওদিকে সৈন্যবল লক্ষাধিক, মহারানা! আমরা মাত্র আট সহস্র। মেবার আমাদের জননী। চিতোর রাজপুতানার গর্ব। গর্ব আমরা ভুলুণ্ঠিত হতে দিতে পারি না কিছুতেই। মহারানা, আপনার চিতোর সুরক্ষিত থাকবে। তবে এখন আপনার এই দুর্গ আগলে বসে থাকার জন্য যথার্থ সময় নয়। কখনও কখনও বিজয়ের প্রতি লক্ষ্য স্থির রেখে পিছু হটতে হয়। এ সকলই আপনি জানেন, রানাজী। আমার এ সকল বলা ধৃষ্টতা মাত্র। তবে চিতোর রাজপরিবারকে সুরক্ষিত রেখে আপনারা আপাতত অলক্ষে সরে থাকুন। এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাই এই সময়ে উচিত কাজ হবে। বাকি মহারাণার বিচার।’
মহারানা গম্ভীরমুখে শুনলেন। তিনি জানেন এছাড়া আর অন্য উপায় এখন নেই। সত্যিই বিজয়ের প্রতি লক্ষ্য স্থির রেখে প্রাথমিকভাবে দু-পা পিছিয়ে আসতে হয় বৈকী!
গভীর আবেগে তিনি রাও জয়মলের কাঁধে হাত রাখলেন।
কম্পিত রূদ্ধকন্ঠে বললেন, ‘এই চিতোরগড় আমি আপনার হাতে সঁপে দিয়ে যেতে চাই। আমার অবর্তমানে এই দুর্গের যাবতীয় রক্ষণাবেক্ষণের ভার আপনার, রাওজী। আপনি হবেন এই দুর্গের দুর্গাধ্যক্ষ। আমার সেনাবাহিনীর পরিচালক, সেনাপতি।’
সজ্জা সম্পূর্ণ হতে তাকে একখানি বোরখা পরিয়ে দেওয়া হল, সাথে হিজাব। চোখ কালো ফেট্টি দিয়ে বেঁধে দেওয়া হল। সে বুঝল তাকে কোথাও নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, কিন্তু সে কোন স্থান সে সম্পর্কে তার কোনও ধারণা ছিল না। বেশ অনেকক্ষণ ধরে কোনও এক অজানা গন্তব্যের উদ্দেশে যাওয়ার পরে একটি স্থানে নিয়ে এসে তার চোখের বাঁধন খুলে দেওয়া হল।
সে দেখল, সে একটি অন্ধকার জীর্ণ মলিন প্রকোষ্ঠের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। চারিপাশে আরও কিছু একই ধরনের প্রকোষ্ঠ। তার সাথে কিছু প্রহরাদার এসেছে সেখানে। সে বুঝল তারা সকলে বাদশাহের হারেমের জন্য নির্দিষ্ট কিছু খোজা প্রহরাদার। তারা তাকে ওই প্রকোষ্ঠের দিকে এগিয়ে যেতে নির্দেশ দিল। প্রকোষ্ঠটি লৌহশলাকা দিয়ে ঘেরা ও তার বাইরে ভীষণদর্শন দুই ব্যক্তি দাঁড়িয়ে আছে।
তারা যে সেই প্রকোষ্ঠটির প্রহরায় নিযুক্ত, তা বোঝা যাচ্ছে। প্রকোষ্ঠটির সম্মুখে এসে সে দেখতে পেল একটি মানুষ জীর্ণ দীর্ণ বেশে বসে রয়েছে। তার দেহে বহুসংখ্যক শুকিয়ে যাওয়া ক্ষত, দেহের বিভিন্ন স্থানে প্রহারের নিদর্শন সুস্পষ্ট। মুখ দাড়িগোঁফের জঙ্গলে ঢেকে রয়েছে। তাকে পরিচিত লাগে, তবু যেন অপরিচিত। ব্যক্তি অধোবদনে বসে ছিল।
কারও আগমন টের পেয়ে চোখ তুলল। চোখ কালিমালিপ্ত, কোটরাগত। রাজকুমারী চেয়ে দেখলেন, যেন কত জন্মের পরিচয় অথচ চেনা যায় না। এ জন্মের পরিচিতি সূত্র হাতরে খুঁজে না পেয়ে, গতজন্মে ফিরে গিয়ে খুঁজতে হয়। কয়েক পলের ভিতরে রাজকুমারী নিশ্চিত চিনলেন — কুমার ভৈরণ! দুই চোখ জলে টলটল করে উঠল। হৃদয় ভেঙে যায়। একবার মনে হল সমগ্র পৃথিবী দুলছে, তিনি বুঝি সেখানেই মূর্ছিত হবেন-