গোল্ড ইজ মানি – লেখক জেমস রিকার্ডস | Gold Is Money Review

গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড!?

শব্দটা শোনার পর অনুবাদকের মতো আমারো প্রথম এক্সপ্রেশন ছিল – ভ্রুকুঞ্চন। তাচ্ছিল্যভাবে মনে মনে ভাবতে থাকলাম এটা তো আদিম সমাজের মুদ্রার প্রচলন। আদৌ কি এখন এর কোন প্রয়োজন আছে! চলমান অর্থব্যবস্থা কি যুতসই নয়!
 ঠিক এই সময়ই গত শতাব্দীর পুরো অর্থব্যবস্থা এবং কারেন্সি সিস্টেমকে বিশ্লেষণ করে এই ব্যবস্থাকে কাঠগড়ায় দাড় করিয়েছেন জেমস রিকার্ডস। স্বর্ণের সাথে সম্পর্কহীনতাকেই প্রচলিত অর্থ ও মুদ্রাব্যবস্থাকে সকল সমস্যার জন্য দায়ী এবং উত্তরণের একমাত্র পথ স্বর্ণভিত্তিক মুদ্রাব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবি উপস্থাপন করেন রিকার্ডস।

কে এই জেমস রিকার্ডস?

– ১৯৯৮ সালে মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভের সাথে আলোচনা করে লং টার্ম ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্টকে দেউলিয়াত্বের হাত থেকে বাঁচানোর প্রধান মধ্যস্ততাকারী ছিলেন। মার্কিন আইনজীবী ও নিউইয়র্ক টাইমস বেস্টসেলার রাইটার। কর্মজীবনে দীর্ঘ পয়ত্রিশ বছর বিশ্ব অর্থনীতির প্রধান কেন্দ্র ওয়াল স্ট্রিটে কাজ করেছেন।তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রচনার অন্যতম  হিসেবে বিবেচিত হয়েছে ‘দ্য নিউ কেস ফর গোল্ড’।
গোল্ড ইজ মানি বইটি অনুবাদ করেছেন রাকিবুল ইসলাম (হাফিজাহুল্লাহ)।তিনি বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যয়নরত অবস্থায় আছেন। বইটি স্বাধীনভাবেই অনুবাদ করেছেন, গড়পড়তা অনুবাদ নয়। বাংলায় বইটির নামকরণ করা হয়েছে ‘গোল্ড ইজ মানি’। মূলত মূল বইয়ের ছায়া অনুবাদ বলা চলে।অনুবাদক সাহেব বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কিছু নতুন তথ্য সন্নিবেশ করেছেন এবং সাথে উৎস উল্লেখ করে দিয়েছেন।বইটি পড়ে শেষ করার পর সামান্য কিছু লেখার চেষ্টা… 
  • বই: গোল্ড ইজ মানি
  • লেখক: জেমস রিকার্ডস
  • অনুবাদক ও সম্পাদক: রাকিবুল হাসান
  • প্রকাশনী: ফাউন্টেন পাবলিকেশন্স
  • পৃষ্ঠা: ১৪৪ 
গোল্ড ইজ মানি বইটিকে নয়টি অধ্যায়ে সুসজ্জিত করা হয়েছে।প্রতিটি অধ্যায়ের আলোচনা সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরা হলো:
প্রথম অধ্যায়:  এ অধ্যায়ে পূর্ব থেকে বর্তমানে মূদ্রা ব্যবস্থার একটা রুপ অর্থাৎ কড়ি,স্বর্ণ-রৌপ্য মুদ্রা থেকে কীভাবে কাগুজে অর্থে স্থানান্তরিত হলো তা তুলে ধরা হয়েছে।১ম ও ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর অর্থনৈতিক অবস্থা স্বর্ণ থেকে কীভাবে কাগুজে নোটের উপর নির্ভরশীল হয়ে উঠে তার স্বরূপ দেখা যায়।
দ্বিতীয় অধ্যায়: এ অধ্যায়ে মুদ্রাযুদ্ধ নিয়ে আলোচনা করা হয়।মুদ্রাযুদ্ধ বলতে দেশের নিজস্ব মুদ্রার মূল্যহ্রাসকে বোঝায়। তবে মুদ্রাযুদ্ধের পূর্বে ক্লাসিকাল গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড যে জটিলতা মুক্ত ছিলো তা বর্ণনা করা হয়েছে। প্রথম মুদ্রাযুদ্ধ ও দ্বিতীয় মুদ্রা যুদ্ধের বিস্তর আলোচনার পর তৃতীয় মুদ্রাযুদ্ধ শুরু হয়েছে তার ইংগিত দেওয়া হয়েছে।
তৃতীয় অধ্যায়: এ অধ্যায়ে লেখক স্বর্ণবিরোধীদের যুক্তি খন্ডন করেছেন।তাদের উত্থাপিত ছয়টি অভিযোগের মধ্যে পাঁচটি অভিযোগই গবেষণা ও ইতিহাসের আলোকে এবং অবাস্তব প্রমাণ করেছেন।তার মধ্যে একটি সঠিক কিন্তু তাও সমালোচনা নয় বরং স্বর্ণ যে অর্থ ব্যাবহারযোগ্য সে কথারই প্রমাণ।
চতুর্থ অধ্যায়: এ অধ্যায়টি মূলত স্বর্ণ ও ফেডারেল রিজার্ভ নিয়ে আলোচনা আলোচনা করা হয়েছে। এই ফেডারেল রিজার্ভ ব্যবস্থাটি সম্পূর্ণ দাঁড়িয়ে আছে জনগণের আস্থার উপর। একবার যদি তাদের উপর থেকে জনগণের আস্থা হারিয়ে যায় তবে শুধুমাত্র গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড পারে সেই আস্থা ফিরিয়ে আনতে।
পঞ্চম অধ্যায়: এ অধ্যায়ের মূল আলোচনাই হচ্ছে স্বর্ণ এবং স্বর্ণই হচ্ছে অর্থ। অর্থ বিবেচিত হতে হলে তিনটি মূল অংশে উত্তীর্ণ হতে হবে। তা হল; বিনিময় মাধ্যম, মূল্য সংরক্ষক এবং মূল্য পরিমাপক। যার তিনটির মানদন্ডেই স্বর্ণ উত্তীর্ণ। স্বর্ণ এবং আন্তর্জাতিক অর্থব্যবস্থায় সাথে এর যোগসূত্র। কেন স্বর্ণ মজুদ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং আসন্ন অর্থ ব্যবস্থা ধ্বংসের পর এই মজুদ স্বর্ণই যে মূল ভূমিকা পালন করবে তার আলোচনা করা হয়েছে।
ষষ্ঠ অধ্যায়: বিশ্ব অর্থব্যবস্থার মোড়লদের মনে হয় এখন স্বর্ণ বাদ দেওয়া দরকার। তা বাতিল হয়ে গিয়েছে কিন্তু ভেতরে ভেতরে এরাই হাজার হাজার টন স্বর্ণ গোপনে মজুদ করে রাখছে। আমেরিকা,ইউরোপ, রাশিয়া ও চীন প্রত্যেক বড় বড় মাথাওয়ালাদেরই লক্ষ্য হচ্ছে স্বর্ণ মজুত করা। কেননা ভবিষ্যতে এই স্বর্ণই হবে ‘প্রধান অতিথি’র ট্যাগ ছিনিয়ে নেওয়ার প্রধান মাধ্যম।
সপ্তম অধ্যায়: আমরা কাগজে মুদ্রা ব্যবহারের ফলে এতোটুকু বুঝতে পারি মুদ্রাস্ফীতি বা মুদ্রাহ্রাসের ফলে  কিভাবে পণ্যের দামের কমবেশি হয়।মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে গেলে টাকার দাম কমে যায়।ফলে শুরু হয় অস্থিরতা। ঠিক তখন স্বর্ণই হয় ত্রানকর্তা হিসেবে আবির্ভাব হয়।কিন্তু স্বর্ণের মূল্য কখনোই হ্রাস বৃদ্ধি ঘটে না। স্বর্ণ একটি পরিবর্তনহীন মুদ্রা। 
অষ্টম অধ্যায়: স্বর্ণের স্থিতিস্থাপকতা নিয়ে এই অধ্যায়ের আলোচনা। কাগুজে নোটের পতন যেকোন সময়ে ঘটলেও স্বর্ণের যেকোন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ঘুরে দাঁড়ানোর সক্ষমতা রয়েছে।অতীতে যেরকম পেরেছে ভবিষ্যতেও পারবে।
নবম অধ্যায়: মূল্যবান সম্পদ স্বর্ণ কীভাবে সংরক্ষণ করতে হবে তার পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। স্বর্ণ কম হলে নিজের কাছে যেকোন জায়গায় রাখা যায়। তবে পরিমাণে বেশি হলে ব্যাংকের ভোল্ট এবং প্রাইভেট ভোল্ট দুই জায়গায় স্বর্ণ সংরক্ষণ করে রাখা যায়। তবে ব্যাংকের ভোল্টে যেহেতু সরকার হস্তক্ষেপ করে তাই লেখক প্রাইভেট ভোল্টকেই রাখার জন্য নির্বাচিত করেছেন।
মূলত সরকার চায় যেনো আমরা যেনো স্বর্ণের কথা ভুলে যাই।সরকার এতে সফলও বটে। কিন্তু মুদ্রাস্ফীতি যে ভয়ংকর তা আমাদের দেশের বর্তমান অবস্থা দেখেই বুঝা যাচ্ছে।এক সময় লেনদেনের মাধ্যম ছিলো স্বর্ণমুদ্রা, তারপর মাধ্যম হলো কাগুজে নোট আর এখন চলে এসেছে ডিজিটাল মুদ্রা যা ধরা-ছোয়ার বাইরে।তাই ভবিষ্যতের ভয়াবহ অবস্থা সম্পর্কে চিন্তা করে আমাদের সকলের পরিমিত স্বর্ণ মজুত রাখা। আশা করা যায় গোটা বিশ্বে আবার স্বর্ণমুদ্রা নিজের দাপটে ফিরে আসবে।
শুরুর দিকে বইটি পড়তে অনেক বেগ পোহাতে হয়েছিল, কেননা অর্থনীতি সম্পর্কে তেমন পড়াশুনা ছিলো না। কিন্তু যতই সামনে গিয়েছি ততই  সুখপাঠ্য ছিলো। সমালোচনা করার যোগ্যতা আমার নেই।বইটি বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বোঝার জন্য খুব জরুরি এবং প্রাসঙ্গিক। 
একটা কাহিনী বলে শেষ করবো।আজ থেকে ৬-৭ বছর আগের ঘটনা। তখন বাসায় পত্রিকা পড়ার সময় একটি নিউজ দেখে চমকে উঠেছিলাম। সেখানে লেখা ছিল জিম্বাবুয়েতে মানুষেরা যদি রাস্তায় টাকা ভর্তি একটি ছালার বস্তা পায় তাহলে তারা সেই টাকাগুলি ফেলে বস্তাটা নিয়ে চলে যায়। তখন খুব অবাক হয়েছিলাম কেননা  তখন মুদ্রাস্ফীতি সম্পর্কে আমার তেমন ধারণা ছিল না। এখন বুঝতে পারছি কি ভয়াবহ অবস্থা ছিল সেই দেশে বিরাজ করেছিলো। কিন্তু কিছুদিন আগে একটি নিউজ পোর্টালে এই খবরটা দেখে আমার খুব ভালো লেগেছিল যে জিম্বাবুয়েতে স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন শুরু হয়েছে। 
বিপ্লব শুরু হয়েছে। 
রিভিউ লেখক: কাউছার সোহেল
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?