- বই : গাভীর বিত্তান্ত
- লেখক : আহমদ ছফা
- ধরন : সমকালীন উপন্যাস
- প্রচ্ছদ মূল্য : ২৫০ টাকা
- মানসিব জুনায়েদ চৌধুরী
যাই হোক, উপাচার্য হওয়ার পর আবু জুনায়েদের ভাগ্য এবং জীবনযাপন পুরোপুরি বদলে গেলো। প্রাসাদসম বাড়ি, চাকর, মালি, সুযোগ-সুবিধা কোন কিছুর অভাব ছিলো না তার। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের নোংরা রাজনীতি, দুর্নীতি, উপর মহলের চাপ সামাল দিতে গিয়ে তিনি বুঝলেন, উপাচার্যের দায়িত্ব পালন মোটেও সহজ নয়। তার সাথে যুক্ত হয় স্ত্রী এবং মেয়ের উদ্ধত আচরণ।
এমতাবস্থায় আবু জুনায়েদের সাথে পরিচয় হয় তার শ্বশুরবাড়ির দুঃসম্পর্কীয় আত্মীয় তবারক আলীর সাথে। তবারক আলী পেশায় ছিলেন একজন কন্ট্রাক্টর। ঘটনাক্রমে তার কাছ থেকে আবু জুনায়েদ একটি গাভী উপহার পান, যা তার অনেকদিনের সুপ্ত ইচ্ছা ছিলো। এই গাভীটিই পুরো উপন্যাসের মূল চালিকাশক্তি।
গাভীর জন্য আবু জুনায়েদ গোয়ালঘর তৈরি করেন। নিজে হাতে গাভীকে খাওয়ানো, যত্ন করা- তার দৈনন্দিন কাজের অংশ হয়ে গেলো। অফিস শেষে বাসায় ফিরে প্রথমেই তিনি গোয়ালঘরে গাভীটিকে দেখতে যান। ধীরে ধীরে অনেক শিক্ষকই গোয়ালঘরে গাভী দেখতে আসেন। ক্রমে সেই গোয়ালঘরই হয়ে উঠে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার অন্যতম কেন্দ্র! এভাবেই উপন্যাসের কাহিনী এগিয়ে যায়।
বিশ্ববিদ্যালয় একটি দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এখানে বিদ্যা-বুদ্ধির চর্চা হবে, গবেষণা হবে- এটাই কাম্য।
উপন্যাসে দেখানো হয়েছে তথাকথিত দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সবাই কিভাবে অন্যায়ভাবে সুযোগ-সুবিধা কিংবা পদোন্নতি পেতে চায়। ছাত্র রাজনীতির নোংরা দিকটিও উঠে এসেছে উপন্যাসে। ছাত্রদের চালে কাঁকড় কিংবা ছাত্রী হলে কারেন্ট চলে যাওয়ার মত ঘটনায় উপাচার্যের বিরুদ্ধে মিছিল হয়, ভাংচুর হয়।
বর্তমান সমাজে যেসব টপিক নিয়ে কথাই বলা যায় না, ’ধর্ম, নাস্তিকতা, ছাত্র রাজনীতি’ এইসব বিষয়ে উনার বর্ণনাভঙ্গিটা একটু লক্ষ্য করলেই সেটা টের পাবেন। তিনি চাইলেই একজন নাস্তিককে উগ্রবাদী বা অতি ভালো মানুষ, কিংবা একজন ইসলামী লেবাসধারীকে উগ্রবাদী, বা অতি ভালোমানুষ – এরকম পরিচয় দিতে পারতেন, পক্ষপাতিত্ব করতে পারতেন, এবং এতে দোষের কিছু ছিল না, যেহেতু এটা ফিকশন। তিনি কিন্তু সেটা করেন নি। বরং, একটা ভুল মানুষের ভুল মতবাদকেও তিনি সেই ভুল মানুষের দৃষ্টিকোণ থেকেই ব্যঙ্গ করেছেন। সঠিকটা কি, সেটা আর বলেন নি। সেটা পাঠকের উপর ছেড়ে দিয়েছেন।এই ধরণের মানসিকতার কারণেই আহমদ ছফা আমার প্রিয় লেখকদের তালিকায় জায়গা করে নিলেন।
এছাড়াও, উপন্যাসে লেখক মানুষের মাঝের দ্বৈত সত্তাকে চমৎকারভাবে উপস্থাপন করেছেন। উপাচার্য আবু জুনায়েদ, তবারক আলীর কাছ থেকে গরু উপহার নিয়ে নিজেকে সান্তনা দিচ্ছেন এই বলে যে- তিনি উৎকোচ নেননি, তাকে উপহার দেয়া হয়েছে। আবার ব্যাপারটি লোক জানাজানি হবার ভয়ও তার মনে আছে। এরকম সুবিধাবাদী মনমানসিকতা আমাদের সমাজে অপ্রতুল নয়।
বইটি পড়লেই বুঝা যায়, আজকের মানব সমাজের চাইতে পশুসমাজ অনেকগুণে উন্নত। তারা নিরীহ, কিন্তু এখনকার জগৎ-সংসারের মতো কুটিল নয়।