গল্পঃ গ্রীষ্মের বিকেলে ঝরে পড়া কৃষ্ণচূড়া ১১তম পর্ব ©মারুফ হুসাইন

গল্পঃ গ্রীষ্মের বিকেলে ঝরে পড়া কৃষ্ণচূড়া
১১তম পর্ব
©মারুফ হুসাইন।
story grismer bikele ghorepora krisnochura by Maruf hossin part 11 গল্পঃ গ্রীষ্মের বিকেলে ঝরে পড়া কৃষ্ণচূড়া ১১তম পর্ব ©মারুফ হুসাইন love story Bangla

আড়াই মাসে মুনার সাথে আরো দুবার শরিফুলের মুখামুখি হতে হয়। শরিফুল এড়িয়ে যায়। মুনার রিয়েকশন কী ছিল, সে খেয়াল করেনি৷ কিন্তু এবার আর এড়িয়ে যেতে পারল না। পড়ানো শেষ করে সিড়ি দিয়ে নামছিল। ট্যামনিক্যাল সমস্যার কারণ লিফট বন্ধ৷ তাই সিড়ি বেয়ে নামতে হচ্ছে। অর্ধেক পথ যেতেই সে মুনাকে দেখতে পেল। মাথা কাত করে ব্যাগের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা খুঁজছে৷ সে না দেখার ভান করে পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ার কথা ভাবল৷ 
মুনার কাছাকাছি আসতেই মুনার ব্যবহার করা পার্ফিউমের ঘ্রাণ তার নাকে এসে ঠেকল। পরিচিত ঘ্রাণ৷ সে বুঝতে পারে, তার স্বরণেই মুনা এখনো এই পার্ফিউমটা ব্যবহার করে যাচ্ছে৷ ভুলে গেলে এতোদিনে পার্ফিউমটাও চ্যাঞ্জ হয়ে যেত৷ আগে সে অন্য পার্ফিউম ব্যববার করত৷ একদিন মুনা তাকে নিয়ে পার্ফিউম কিনতে গিয়েছিল। তার পছন্দের পার্ফিউমের বিল করতে যাবে ঠিক তখন সে দেখতে দেখতে এই পার্ফিউমের ঘ্রাণ শুনে বলেছিল, এই পার্ফিউমের ঘ্রাণটা কত সুন্দর! তখন মুনা নিজের পছন্দেরটা রেখে শরিফুলের পছন্দ করা পার্ফিউমটা কিনে নেয়। এরপর তারা এক সাথে যতদিন ছিল, মুনাকে শরীর থেকে এই পার্ফিউমের ঘ্রাণটাই পেয়েছে। তার মেয়ের টিউশনি আসার পর যতবার তার সাথে দেখা হয়েছে, ততবারই এই পার্ফিউমের ঘ্রাণটাই পেয়েছে৷ তাই তার মনে আর কোনো সন্দেহ থাকে না, মুনা যে এই পার্ফিউমটাই নিয়মিত ব্যবহার করে।
মুনাকে পাশ কাটিয়ে এক পা এগুতেই মুনা তার হাত ধরে ফেলল। শরিফুল ভেবেছিল, ব্যাগে ব্যস্ত থাকায় মুনা তাকে খেয়াল করবে না। কিন্তু তাকে ভুল প্রমাণ করে মুনা তাকে দেখে ফেলল। সে ঘুরে তাকাল। মুনা তার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার এমন চাহনিতে শরিফুলের বুকে মোচড় দিয়ে ওঠল।
মুনার দিকে তাকাতেই সে তার অনেকটা কাছাকাছি হয়ে গেছে। মুনার নিঃশ্বাস তার মুকে এসে পড়ছে।
‘তুমি আমাকে এভাবে এড়িয়ে যাও কেন?’
‘কী করব না হলে?’
‘তোমার এভাবে এড়িয়ে যাওয়াটা আমাকে ক্ষত-বিক্ষত করে দেয়৷’
‘কিন্তু এখন আর কী করার আছে।’
‘তাও কথা, এখন আর কী করার আছে!’ তাচ্ছিল্যসহ হেসে মুনা যোগ করে, ‘যখন করার ছিল, তখনি তো করোনি। চোরের মতো পালিয়ে গিয়েছিলে!’
‘হ্যাঁ, আমি চোরের মতো পালিয়ে গিয়েছিলাম। এখনো পালিয়েই থাকতে চাচ্ছি। কিন্তু দিচ্ছো না কেন?’ রাগান্বিত হয়ে উচ্চ স্বরে শরিফুল বলে। 
‘আমি ভালোবেসেছিলাম তাই!’ খুব মোলায়েম কন্ঠে বলে মুনা শরিফুলের হাত ছেড়ে দেয়। 
শরিফুল জানে, মুনা অভিমান থেকেই তার হাত ছেড়ে দিয়েছে৷ সেদিন যে সে পালিয়ে যায়নি, বলতে ইচ্ছা করে তার৷ কিন্তু বলে না। সে মনে পাথর চেপে রেখে মুনার থেকে নজর সরিয়ে নিচের দিকে পা বাড়ায়।
শরিফুল সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে যাচ্ছে, মুনা তাকিয়ে দেখতে থাকে। তার চোখ বেয়ে পানি ঝরে পড়ে৷ সে পানি মুছে বাসার দিকে পা বাড়ায়৷
ব্যাগটা রেখে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে। তার কাঁদতে ইচ্ছে করছে। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে৷ সে বেসিনের কল ছেড়ে দেয়, ঝর্ণাও ছেড়ে দেয়। সে আর বেশিক্ষণ কান্না আটকে রাখতে পারে না।  বুক ফেটে কান্না বেরিয়ে আসে।
রমনার ভিতর ছায়া দেখে শরিফুল একটা বেঞ্চিতে বসে পড়ল। তার ভালো লাগছে না। সে জানে মুনা তার জন্য কষ্ট পাচ্ছে। সেও কষ্ট পাচ্ছে। মুনার থেকে কম নয়৷ বরং বেশি৷ দুজনের আলাদা হয়ে গেলেও মুনা বিয়েশাদি করেছে। তার সংসার হয়েছে। সুন্দর গোছানো সংসার। সে সংসারে তার কোনো কিছুর কমতি আছে বলে মনে হয় না। সেখানে সে নিজেকে তার সামনে ঠিকভাবে হাজির করে তিনটা মানুষের সংসার কিভাবে নষ্ট করে দেয়! হয়তো মুনা তার কমতি ফিল করছে। 
তা ছাড়া সব দিক থেকেই তো তার পাওয়ার কোনো কমতি নেই৷ সেগুলাকে সে নষ্ট করতে পারে না। তার সে অধিকার নেই। নিজের যত কষ্টই হোক না কেন, মুনার গোছানো জীবন এলোমেলো করার ক্ষমতা তার নেই৷ একজনের কমতি দূর কর‍তে গিয়ে তার গোছানো জীবনটা নষ্ট হোক, সে চায় না। সে সিদ্ধান্ত নেয়, এই মাস শেষ হলেই পড়ানোর কথা না করে দিবে। দরকার হলে আফজাল সাহেবের অফিসে গিয়ে তাকে বুঝিয়ে বলবে। 
শরিফুল রমনা থেকে উঠে পড়ে৷ হাসপাতাল যাবে। অনেক দিন হলো, বিলকিস আপার সাথে দেখা করে না। তাই তার সাথে দেখা করতে যাবে৷ 
‘আপনে এতো দিন পর আইলেন! আম্মায় আপনারে প্রত্যেকদিন খুজে!’ শরিফুলকে দেখে পাখি এগিয়ে এসে বলল।
‘কী করার মা বল! আমার যে আসার একদম সুযোগ হয় না।’ বলতে বলতে শরিফুল বিলকিস আপার বিছানার দিকে এগিয়ে যায়। পাখিকে সে মিথ্যা বলেছে৷ তার আসার সুযোগ হয়। আসেও। কিন্তু বিলকিস আপার সাথে দেখা করতে ইচ্ছে করে না। সে চায় না, মায়া আরো বাড়ুক। আবার নতুন করে হারানোর যন্ত্রণাটা সে পেতে চায় না। কিন্তু এই একটা ব্যপারে তার জীবনের কঠিন সত্য। তার হারাতে হয়। প্রিয়জনরা তার কাছে বেশিদিন থাকতে পারে না। হারিয়ে যায়। সে তার জীবনে কাউকে বেশিদিন ধরে রাখতে পারে না। 
শরিফুল আসার আধ ঘন্টা পর বিলকিস আপার ঘুম ভাঙ্গে, ‘তুই আইলি ভাই?’
শরিফুল বুঝতে পারে, বিলকিস আপার কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। তবুও তাকে দেখে বিলকিস আপার ঠোঁটের কোণে হাসির রেখে দেখা যাচ্ছে।
‘হ্যাঁ, আপা আমি এসেছি!’ শরিফুল উত্তর দেয়। 
‘এতো দিন পর আইলি!’ শরিফুল খেয়াল করে বিলকিস আপার চোখের কোণে পানি জমে ওঠেছে, ‘তোরে অনেক দেখতে মন চায় ভাই! তুই আপারে মাঝে মাঝে দেখতে আইস!’
শরিফুল কী বলবে বুঝে উঠতে পারে না৷ তারও চোখ বেয়ে পানি নেমে আসতে চায়। কিন্তু নিজেকে আটকে রাখে। অন্য দিকে তাকায়। বিলকিস আপার দিকে তাকালেই তার কষ্ট হয়। সেদিনের কথা মনে পড়ে যেদিন সে ঘুম থেকে উঠে প্রথমবার বিলকিস আপাকে দেখেছিল। কী শক্ত-পোক্ত একজন মানুষ ছিল৷ আর আজ তার কী হাল!
‘ভাই আমি আর বেশিদিন বাঁচমুনারে!’ বিলকিস আপার কাপা গলা শুনে শরিফুল কান এগিয়ে দেয়, ‘আমি মইরা গেলে আমার মাইয়াটার আর কেউ থাকব না। তুই আমার মাইয়াডারে দেইখা রাখবি?’ বিলকিস আপার এমন অসহায় আবদার শুনে শরিফুলের কষ্ট হয়।
সে বিলকিস আপার হাতের উপর হাত রেখে বলে, ‘আপা! তুমি কোনো চিন্তা কইরো না। আমি পাখিরে নিজের মেয়ের মত করেই বড় করব। ওরে কোনো কিছুর অভাব পড়তে দিব না।’
বিলকিস আপার গাল বেয়ে পানি পড়ছে। তার চোখের পানি শরিফুলের দেখতে ইচ্ছে করে না, ‘আপা আজ উঠি!’ বলে শরিফুল উঠে পড়ে। তার এখানে আর থাকতে ইচ্ছে করছে না।  সে উঠে যায়। দরজার দিকে পা বাড়ায়। 
চলবে……..
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?