খোয়াবনামা কি এবং কেন পড়বেন? খোয়াবনামা PDF Download

খোয়াবনামা 
পাঠপ্রতিক্রিয়া
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস 
এই বইটির পাঠপ্রতিক্রিয়া লেখার আগে বেশ কয়েকবার ভেবেছি। তার কারণ এর পাঠপ্রতিক্রিয়া লেখার জন্য যে সাহিত্য শিক্ষার প্রয়োজন তা আমার আছে কি না, সে বিষয়ে আমি নিজেই যথেষ্ট সন্দিহান। কিন্তু তারপর মনে হলো, যে কোনো সাহিত্যেরই নানাবিধ অনুধাবন সম্ভব, তাই নিজের মনে হওয়াটা কেই এই লেখাটির মাধ্যমে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। ত্রুটিবিচ্যুতি থাকাটা স্বাভাবিক, নিজগুণে ক্ষমা করে দেবেন বা আলোচনার মাধ্যমে সংশোধন করে দেবেন এই আশা রাখি।

“খোয়াব” শব্দের অর্থ স্বপ্ন। স্বপ্ন ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না। স্বপ্ন নিয়েই মানুষ নানান প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষায় ছুটে বেড়ায় এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই  মানুষের স্বপ্ন অবশ্য  অধরাই থেকে যায়। 
আখতারুজ্জামান  ইলিয়াসের “খোয়াবনামা’ উপন্যাসে “খোয়াবের” আড়ালে বাস্তবতার এক নির্মম এবং  সত্যনির্ভর কাহিনী তুলে ধরেছেন।  
এই উপন্যাসের চরিত্রগুলির বিচরণ দেশভাগের আশপাশের সময়কালে। উপন্যাসের উৎপত্তিস্থল হলো উত্তরবঙ্গের এক সুপ্রাচীন দিঘী, কাৎলাহার বিল ও তার পাশের গ্রাম গিরিরডাঙা, নিজগিরির ডাঙ্গা ও গোলাবাড়ি হাট। নানা স্থানের মানুষজনের চেতন-অবচেতন মনের জগতের সঙ্গে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ঘটনা এই উপন্যাসে চিত্রিত হয়েছে। 
এটি একটি  ইতিহাস-আশ্রিত বা ইতিহাস সংলগ্ন  উপন্যাস। উপন্যাসের নানা অংশে উঠে এসেছে তেভাগা আন্দোলনের কথা, সেইসাথে উঠে এসেছে তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষ, ছেচল্লিশের নির্বাচন,  সাতচল্লিশের দেশভাগ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা আর এসব ঘটনার সামাজিক প্রতিক্রিয়া এবং জনমানসে তার প্রভাব। 
তবে এই উপন্যাস শুধুমাত্র দেশভাগের সময়কালের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, দেশভাগের সময় ছাড়িয়ে এই উপন্যাসের প্রেক্ষাপট যেমন পলাশি পর্যন্ত চলে যায়, ঠিক তেমনই 
কাৎলাহার বিল থেকে শুরু করে তার যাত্রাপথ চলে যায় করোতোয়া, বাঙালী এবং যমুনা নদীতে। এমনকি  তা ছড়িয়ে পড়ে শহর কলকাতাতেও। 
পলাশীর আমবাগান থেকে শুরু করে ফকির সন্ন্যাসী আন্দোলন এবং ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের মতো ঘটনাগুলিকে লেখক তাঁর এই উপন্যাসে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিকভাবে  তুলে ধরেছেন, দেশ-কালের সীমারেখা অতিক্রম করে এই উপন্যাস মনুষ্যজীবনের প্রবাহমানতার এক অসামান্য দলিলে রূপান্তরিত হয়েছে। 
ফকির আন্দোলনের নেতা মজনু শাহের অনুগামী মুনসি বায়তুল্লাহ  ইংরেজদের গুলিতে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। উপন্যাসে প্রথম পাতায় এই বায়তুল্লাহ জীবন্ত হয়ে ওঠেন একেবারে অলৌকিকভাবে। বই থেকেই কিছু অংশ উদ্ধৃত করলাম – 
“ঐসব দিনের এক বিকালবেলা মজনু শাহের বেশুমার ফকিরের সঙ্গে মহাস্থান কেল্লায় যাবার জন্যে করতোয়ার দিকে ছোটার সময় মুনসি বয়তুল্লা শাহ গোরা সেপাইদের সর্দার টেলরের বন্দুকের গুলিতে মরে পড়ে গিয়েছিলো ঘোড়া থেকে। বন্দুকের গুলিতে ফুটো গলা তার আর পুরট হলো না। মরার পর সেই গলায় জড়ানো শেকল আর ছাইভস্মমাখা গতর নিয়ে মাছের নকশা আঁকা লোহার পান্টি হাতে সে উঠে বসলো কাৎলাহার বিলের উত্তর সিথানে পাকুড়গাছের মাথায়। সেই তখন থেকে দিনের বেলা রোদের মধ্যে রোদ হয়ে সে ছড়িয়ে থাকে সারাটা বিল জুড়ে। আর রাতভর বিল শাসন করে ওই পাকুড়গাছের ওপর থেকেই। তাকে যদি এক নজর দেখা যায়–এই আশায় তমিজের বাপ হাত নাড়াতে নাড়াতে আসমানের মেঘ খেদায়।”  উপন্যাসের এই অংশে এবং আরো বেশ কিছু জায়গায় জাদুবাস্তবতা (magic realism) / পরাবাস্তবতার (Surrealism) ব্যবহার বিশেষ ভাবে লক্ষণীয়।  
তমিজ, তমিজের বাপ, কুলসুম, ফুলজান, কাদের, চেরাগ আলী ফকির, হুরমতুল্লাহ- এরা এই উপন্যাসের উল্লেখযোগ্য চরিত্র। চরিত্রগুলির সন্নিবেশ এবং কথোপকথনের মাধ্যমে সোহরাওয়ার্দী-শের-ই-বাংলা থেকে শুরু করে ভবানী পাঠক আর ফকির মজনু শাহের মতো ঐতিহাসিক চরিত্রগুলি যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে এই উপন্যাসে । এই চরিত্রগুলির প্রধান বিচরণ স্থল হলো কাৎলাহার বিল ও তার আশপাশের গ্রামগুলি। 
“খোয়াবনামা”  উপন্যাসের চরিত্রগুলি সবাই খোয়াব বা স্বপ্ন দেখে। শরাফত খোয়াব দেখে আরো বেশি জমির  মালিক হওয়ার, তার ছেলে আবদুল কাদের স্বপ্ন দেখে স্বাধীন পাকিস্তানের। তমিজ স্বপ্ন দেখে এক টুকরো ধানী জমির। মুনসির শোলোক (গান) গেয়ে ঘুরে বেড়ায় চেরাগ আলী ফকির। তার নাতনি কুলসুমের হাত ধরে সে শোলোক (গান) শুনিয়ে বেড়ায় এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে। চেরাগ আলী  মানুষের স্বপ্নের ব্যাখ্যা করতে পারত। স্বপ্ন ব্যাখ্যার একটি কিতাব ছিল তার যা সবার কাছে অলৌকিক গ্রন্থ বলে মনে হতো। স্বপ্ন ব্যখ্যার এই বইটিই যেন “খোয়াবনামা”। 
এইসব শোলোকের কয়েকটি আবার বেরিয়ে আসত তার নাতনি কুলসুমের মুখ দিয়ে আবার কখনো বা বৈকুণ্ঠ গিরির মুখ থেকে। বৈকুণ্ঠ গিরিও একজন বোহেমিয়ান স্বভাবের মানুষ । ফকির সন্ন্যাসী বিদ্রোহে তার পূর্বপুরুষ (ভবানী পাঠক) অংশ নিয়েছিল। চেরাগ আলীর মুখের শোলোক সে গাইতে পারত। চেরাগ আলীর গাওয়া সেই গান শোনা যায় তমিজের বাপের মুখেও। কুলসুমের গলায় শোলোক শুনে কেরামতের মনে হয় চেরাগ আলীর আত্মা ভর করেছে তার নাতনির ওপর।
নাতনি কুলসুম বিবাহযোগ্য হলে তমিজের বাপের সঙ্গে তার বিয়ে দিয়ে দেয়। চেরাগ আলীর মৃত্যুর পর সেই বইয়ের মালিক হয় তমিজের বাপ। কুলসুম কামনা-বাসনা বিবর্জিত নয়। তার শরীরে রয়েছে শারীরিক চাহিদা, এর স্বাভাবিক ফলস্বরূপ কুলসুমের মাতৃত্ববোধ তার সৎপুত্র তমিজের প্রতি মমত্ববোধে জড়িয়ে যায়। কুলসুম ও তমিজ একে অপরের প্রতি মিলিত হয়, চরিত্র নির্মাণে ফ্রয়েডীয় চেতনার ব্যবহার লক্ষণীয়। 
একটা জাতির দীর্ঘ সময়ের সযত্নে লালিত বিশ্বাস বা অন্ধবিশ্বাস , সংস্কার বা কুসংস্কার, তাদের স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের বিবরণ, বৈচিত্রপূর্ণ শোলোক চমৎকারভাবে বর্ণিত হয়েছে এই বইটিতে। 
উপন্যাসের কাল্পনিক চরিত্রগুলোর মধ্যে দেখা যায় এক অদ্ভুত সামাজিক ও পারিবারিক ভাবের আদানপ্রদান।  এদের সম্পর্ক-প্রেম-কাম এসব এক অনিশ্চিত এবং অসম পথে এগোতে থাকে, এই “Randomization” এই উপন্যাসের একটি মূল বৈশিষ্ট্য । সমসাময়িক রাজনৈতিক অগ্রগতির সাথে এই বাস্তবতার অনেক মিল পাওয়া যায়। মূলত ক্ষুধা, দারিদ্র্য আর সামাজিক,অর্থনৈতিক এবং আদর্শগত বৈষম্যই নিয়ন্ত্রণ করে এই চরিত্র গুলিকে। ঠিক যেমন একদেশদর্শীতা, অনমনীয়তা, আর চূড়ান্ত অবিশ্বাস নিয়ন্ত্রণ করেছিল সমসাময়িক রাজনীতি আর সমাজকে। এই বিষয়টি এই উপন্যাসের একটি লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য। 
এই উপন্যাসের আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়,ইতিহাস-আশ্রয়ী উপন্যাসে সাধারণত কাল্পনিক কাহিনি বিন্যাসের ফাঁকে ঐতিহাসিক উপাদানগুলো স্থাপন করা হয়। উপন্যাসে সামাজিক উপাদানের জন্যও একই কথা প্রযোজ্য। কিন্তু “খোয়াবনামা” এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। এই উপন্যাসে  সামাজিক ও রাজনৈতিক উপাদানের ফাঁকে ফাঁকে গল্পগুলি আশ্রয় নিয়েছে, তারা  আশ্রয় পেয়েছে সমসাময়িক রাজনীতি আর সামাজিক বিবর্তন-রেখার একেবারে প্রান্তিক সীমায়। তাই এ উপন্যাসের গল্পের প্রবাহে নিরবিচ্ছিন্ন রসবোধ সেরকম ভাবে নেই, এর পাতায় পাতায় সেরকম টানটান  রোমাঞ্চকর উপাদানও নেই, তবে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনাচরণ, প্রকৃতি, এবং প্রকৃতির সাথে জীবনের একাত্মতা, কৃষি, বর্গা আর জোতদারির কষাঘাতে, অত্যাচারে জর্জরিত কৃষক, তাদের স্বপ্ন দেখা আর তার তাড়না পাঠককে একরকম আবিষ্ট করে রাখে। 
ব্যক্তিগত ভাবে আমার মনে হয়েছে যে এই উপন্যাস খুব একটা “সুখপাঠ্য” নয় এবং এও মনে হয়েছে লেখক সেই চেষ্টাও করেননি। এই উপন্যাসের লেখাগুলি স্রোতের মতো প্রবাহমান। এই উপন্যাসের আরেকটি বৈশিষ্ঠ চোখে পড়ে, ইলিয়াস সাহেব এই উপন্যাসের ভাষা, সংলাপে  ব্যবহার করেছেন আঞ্চলিক এবং সাধারণ মানুষের কথ্যভাষা। কোন তুলনা করছি না, বোঝার সুবিধার জন্য বলা যেতে পারে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মানদীর মাঝি’ উপন্যাসে যেমন আঞ্চলিক ভাষা প্রয়োগ দেখতে পাওয়া যায়, একই বিষয় লক্ষণীয় “খোয়াবনামা” উপন্যাসেও, এবং আরো বিস্তৃত আকারে।  বেশ কিছু ক্ষেত্রেই আঞ্চলিক শব্দের প্রয়োগের কারণে মাঝে মধ্যেই খেই হারিয়ে ফেলেছি, কিন্তু এরপরেও কিছুটা মোহাবিষ্ট হয়েই বইয়ের শেষ অবধি পড়েছি এবং খুবই ভালো লেগেছে। 
এই উপন্যাসে সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার নানা মুহুর্তগুলো লেখক বেশ নির্লিপ্তভাবে উপস্থাপন করেছেন, সেখানে আবেগপ্রবণতা সেরকম দেখা যায় না কিন্তু সংবেদনশীলতা লক্ষণীয় এবং তা যথেষ্ট বাস্তবসম্মত বলেই মনে হয়েছে। গল্পে সেরকম কোনো টুইস্ট নেই। মানুষের জীবনে ট্রাজেডি তো আর ঘটা করে আসে না,  তাই “খোয়াবনামা” উপন্যাসের নানা ট্রাজিক মুহুর্তগুলো চিত্রিত হয়েছে একেবারেই স্বাভাবিক, নির্মোহ এবং  নৈর্ব্যক্তিক ছন্দে, মাঝে মধ্যে আবার কিছুটা কমেডির মাধ্যমে, এই “contrast” বিশেষভাবে লক্ষণীয়।  তবে সেই মুহুর্তগুলো মানবজীবনের গতিপথ কীভাবে পরিবর্তন করে দেয়, তা অত্যন্ত মুন্সিয়ানায় লেখক তুলে ধরেছেন তাঁর এই উপন্যাসে। 
সব মিলিয়ে এই উপন্যাস পাঠককে সাহিত্য – শিক্ষিত করে তোলে, অন্যভাবে ভাবতে শেখায় গতানুগতিক ধারার বাইরে গিয়ে। এই “out of comfort zone reading”  অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বলে আমার ব্যাক্তিগত ভাবে মনে হয়। [DOWNLOAD PDF]
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?