🍁 বইয়ের নাম: খুন হওয়া ঘুম
🍁 লেখক: সালাহ উদ্দিন শুভ্র
🍁 প্রকাশনা: বৈভব
🍁 প্রকাশকাল: জানুয়ারি, ২০২২
🍁 প্রচ্ছদ: তৌহিদ হাসান
🍁 মূল্য: ৪৫০
প্রতিটা ঔপন্যাসিকের নিজস্ব রচনাশৈলী থাকে। সালাউদ্দিন শুভ্রর ক্ষেত্রেও তা ব্যতিক্রম নয়।
দার্শনিক মনছুর যাকে ঘিরে কাহিনী আবর্তিত, তার হেঁটে চলা, থেমে যাওয়া, অতঃপর
নিঃশেষিত হবার প্রাক মুহূর্তগুলোকেও কি নিদারুন বর্ণনায় না বেঁধেছেন লেখক।
অতিনাটকীয়তা উপন্যাসের একটি মাত্রা হলেও এর মধ্যেই রচিত হয়েছে এক মহাকাব্যিক দ্যোতনা।এপিক ক্যানভাসে কাহিনীকার সমসাময়িক বাস্তবতা ও নরনারীর সম্পর্ক উপরন্তু পরিবর্তিত জীবনধারায় তুলে এনেছেন আধুনিক মানুষের অস্তিত্বের সংকট ও অনিশ্চিত জীবনের বিরহ গাঁথা। চমৎকার রুপকের ব্যবহার কাহিনীর বর্ণনের ক্ষেত্রে নতুন কাঠামো সৃজন করেছে।
“খুন হওয়া ঘুম”এমন এক কাহিনীকাব্য যা মানবিক জীবনকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে। লেখকের বর্ণনায় মানুষ গাছের জন্য মায়া দেখালেও সামান্য দয়াটুকু তার নেই আরেকটা মানুষের প্রতি। এর করুন সাক্ষী মনছুর, লায়লা, শিমু, রোমানা। প্রেমময় সম্পর্কের আড়ালে যৌনতা, জীবনের সারশূন্যতা, নিরেট বাস্তবতা, মানবিক জীবনাচার, ভিন্ন ভিন্ন জীবনদর্শন কাহিনীর মূল আলেখ্য।
এ শহরে কারো জীবনই সম্পূর্ন নয়। মা যিনি নিঃস্বার্থভাবে দিয়ে যান সময়ের পাল্টাঘাতে তিনিও অনিশ্চয়তায় ভুগেন, ক্রমেই হয়ে উঠেন স্বার্থপর। কর্পোরেট সেক্টরে কাজ করা রোজী স্বার্থপর হয়ে উঠে নিজ অবস্থান টিকিয়ে রাখতে। শমসের, তরফদ্দার টিকে থাকে তাদের ক্ষমতার মসনদে।কত মানুষের জীবন বলি দিয়ে তারা আজ সর্বেসর্বা। “এখন সময়টা ম্যাগালোম্যানিয়াক।” ক্ষমতার লড়াইয়ে কেউ হারতে চায় না। বরং ক্ষমতা হারানোর সামান্যতম সম্ভাবনাই মানুষকে করে তুলে হিংস্র, পশুর সমতুল্য। এর সফল অথচ দৃঢ় রুপান্তর কাহিনীর শক্তিশালী দিক।
লেখক নিজ সম্পর্কে খুব বেশি কিছু বলেননি। কাহিনীর মনছুর যেন তিনি। বারবার তার জীবনদর্শন পাঠককে নাড়া দেয়। কত অবলীলায় বলা হয় কিছু আর ভালো লাগছে না এ কথাগুলো কাউকে বলা যায়না। মনছুর বর্তমান সময়ের মানুষের প্রতিভূ। তার মনে কতো ঘটনার উদ্বেলিত ভাব। কি নিদারুন ভাবে বলে যায় সে – “আসল কথাটা কখনো সংসারে বলা যায় না। নিজে মনে মনে ভেবে থাকলেও বলা যায় না বাবা খারাপ, মা খারাপ, বোন এলোমেলো, ভাই উচ্ছৃঙ্খল, বউকে আর ভালো লাগছে না।” আসলেই তাই।
চমৎকার উপমার মধ্য দিয়ে বলা হয় নগ্ন জীবনযাপনের মধ্য দিয়ে লালিত বস্তিবাসীদের মুখের ভাষার মতো তাদের জীবনও খোলামেলা বই। শুধু মধ্যবিত্ত নৈতিকতা আর মূল্যবোধের পৃষ্ঠাঘাতে জর্জরিত এই মধ্যম শ্রেণীর মানুষগুলো।
মনছুরের মন খারাপ হলেই সে হাঁটে। তার এই হেঁটে চলাও যেন মানবজাতির বহমান সময়। কেননা একের পর এক অধ্যায়, ভাবনা, ভাবনার মধ্যকার ঘাত, প্রতিঘাত প্রতিবাদী কন্ঠে গেয়ে উঠে। নিষ্কৃতি চায় অন্য কোন মানুষের কাছে।
প্রতিটি চরিত্রই একা। তাদের স্বাধীন জীবনযাপনের আড়ালে তাদের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ নজর কাড়ে বিশেষ ভাবে। এক একটি অধ্যায়ের সাথে সাথে আমরা একেকটা চরিত্রের বর্ণনা পাই।
কাহিনীর শুরুতে যে মনছুর কিছুটা উদ্ভ্রান্ত, কাহিনীর সমাপ্তির কাছাকাছি এসে সেই নতুন করে স্বপ্ন দেখে প্রেমিকাকে ঘিরে বাঁচার। কিন্তু তার সমগ্ৰ স্বপ্নকে ছাড়িয়ে তার ঠিকানা হয় নির্জন এক দ্বীপে। কি অপরাধ ছিল তার? একদিন অফিসে না যাওয়াকে কেন্দ্র করে যে ঘটনার সূত্রপাত সেখান থেকে ক্রমাগত সে নিজেকে আবিষ্কার করে এক গোলক ধাঁধায় যেখান থেকে নিস্কৃতির সুযোগ নেই। পরে নিজের বেঁচে থাকার জন্যই তাকে লড়ে যেতে হয় নিরন্তর।
সত্যিই তো বর্তমান সময়ে মানুষ তার জীবনের বেঁচে থাকার অবলম্বন তার চাকরিটা হারানোর ভয়েই গুটিয়ে থাকে। যে কোন মুহুর্তে সে তার আর্থিক অবলম্বন হারাতে পারে। সেই সঙ্গে তার সামাজিক অবস্থানও।
এজন্যই এই উপন্যাসের কাহিনী হয়ে উঠে বর্তমান সময়ের প্রতিভূ। কাহিনীর শেষে আমরা দেখতে পাই এক হেরে যাওয়া মনছুরকে মে অধীর আগ্রহে তার স্বাধীনতার জন্য অপেক্ষা করছে।
ভালো লাগা কিছু লাইন:
*জীবন চক্রাকার, কোনো কিছু থেকে পালিয়ে থাকা যায় না।
* ব্যর্থ লোককে সমাজ পছন্দ করে না।সবাই যেখানে ব্যর্থ হয়েও এমন একটা ভাব ধরে থাকে যে সে সফল, সে সুখে আছে-সেখানে তাদের সাথে কাজ করতে গিয়ে কেউ ব্যর্থ হলে বাদবাকী সবাই তাকে ত্যাগ করে।
* মনের মধ্যে ঘৃনা আর বিষাদ নিয়ে, যার যার বাসনাকে সে সে গিলে নিয়ে, পারলে অন্যের গায়ে সেটা উগ্ৰে দিয়ে, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় জীবন-যাপন করে যায়।
* কিন্তু বাস্তবের এ জেল স্কুলে কিভাবে আটকা পড়ল সে। এই নিষ্ঠুরালয় চালায় কারা?
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?