ক্যারিয়ার নাকি পরিবার? | carrier naki poribar?

বিরক্তিকর’ সিন্ডি বলে উঠল। সিন্ডি, বয়স ৩৫, নর্থ ক্যারোলিনার র‌্যালি শহরের বাসিন্দা এবং দুই সন্তানের মা: সামান্থা (বয়স চার) এবং স্যাম (বয়স সাত)। বর্তমানে সে তার ছেলেমেয়ের সাথে বাড়িতে বসে দিন কাটাচ্ছে।

‘পুরুষরা সব সময় আমাকে লোভী বলে অভিযুক্ত করে—যখন আমি কাজ এবং পরিবার—দুটোই চাওয়ার কথা বলি। আরে বাবা, আমি তো আর মহারানি হওয়ার কথা বলছি না! আমি মৌলিক কিছু চাহিদার কথা কথা বলছি; ভালোবাসা এবং কাজ। কোন সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ এগুলো চায় না?
এটা আমার কাছে একটা বড়ো আফসোসের ব্যাপার যে সামান্থার জন্মের সময় যখন আমি সংক্ষেপিত সময়সূচী চেয়েছিলাম, তখন আমাকে আমার ক্যারিয়ার ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছিল এবং আমার সিভিতে ভুরি ভুরি অভিনব যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও আমি ফিরে যাওয়ার পথ খুঁজে পাচ্ছি না। আর এটা মোটেই চেষ্টার অভাবের জন্য নয়। আমি কয়েক ডজন চাকরির আবেদন লিখেছি এবং পাগলের মতো নেটওয়ার্কিং করেছি; কিন্তু সপ্তাহে ৩৫-৪০ ঘণ্টা কাজ করতে চায়—এমন একজন নির্বাহী কর্মকর্তাকে নিয়োগ করতে কেউ আগ্রহী বলে মনে হয় না।
এমন হতো যে, আমি কোনো ফরচুন ৫০০ কোম্পানিতে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখছি, তাহলে মেনে নিতাম যে, আমাকে যেকোনো একটা বেছে নিতে হবে: ক্যারিয়ার বা সন্তান; কিন্তু আমার পরিকল্পনা হচ্ছে—দুটি বাচ্চাকে মানুষ করা এবং মিড্ল ম্যানেজমেন্টে একটি পার্টটাইম ক্যারিয়ার গড়ে তোলা। এটা কি অযৌক্তিক শোনাচ্ছে?’
অন্যদিকে কেট, বয়স ৫২, স্বীকার করেন, ‘আমি কখনোই নিঃসন্তান হতে চাইনি।’ কেট সিয়াটেল শহরের বাসিন্দা এবং ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল ফ্যাকাল্টির একজন সদস্য।
‘কিন্তু আমার মেডিক্যাল প্রশিক্ষণ শেষ হয় ৩৫ বছর বয়সে এবং তারপরে আমি শিকাগোতে পোস্ট-ডক্টরেট করি। এখন অতীতের দিকে তাকালে, আমি ভেবে পাই না—কেন আমি আমার ক্যারিয়ারকে আমার গোটা ত্রিশের দশকের জীবনকে গিলে ফেলতে দিয়েছি। খেয়ালই করিনি।
আমি সবে এর পরিণতিগুলো বুঝে উঠতে শুরু করেছি। সেদিন যখন কিছু তথ্য ঘাঁটছিলাম, তখন হঠাৎ উপলব্ধি করি যে, যদি আমি ৬৫ বছর বয়স পর্যন্ত সুস্থ থাকি, তাহলে সম্ভাবনা হলো—আমি আরও ১৯.১ বছর বেঁচে থাকব। কাজের সঙ্গতা ছাড়া এত দীর্ঘ একটা সময় পুরোপুরি একা কাটানো ভয়ংকর ব্যাপার। আমি জানি না—কেন আগে বুঝিনি যে, যেহেতু আমার সন্তান নেই, সুতরাং আমার কোনো দিন নাতি-নাতনিও হবে না।’
সিন্ডি এবং কেট—তারা দুজনই ‘হাই অ্যাচিভিং উইমেন ২০০১’ জরিপে অংশ নিয়েছিল। দুজন দুটি ভিন্ন প্রজন্মের প্রতিনিধি, ভিন্ন পেশার অন্তর্গত, দেশের ভিন্ন অঞ্চলে বসবাস করে এবং জীবনের ভিন্ন পথ বেছে নিয়েছে। তবুও দুজনে আজ একই কঠোর বাস্তবতার মুখোমুখি। উভয়ই মনে করে যে, তাদেরকে যেকোনো একটি বেছে নিতে বাধ্য করা হয়েছে: ক্যারিয়ার বা পরিবার, ভালোবাসা বা কাজ। এই নারীদের কষ্ট এবং অনুশোচনার গল্প এই বইয়ের একটি কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তুকে তুলে ধরে—উচ্চশিক্ষিত, দক্ষ নারীদের ওপর যে কাজ/পরিবারের যেকোনো একটা বেছে নেওয়ার শর্ত চাপিয়ে দেওয়া হয়, সেটির ব্যাপক এবং সুদীর্ঘ প্রচলন।
সমীক্ষায় যারা অংশগ্রহণ করেছিল, তাদের মধ্যে মাত্র ১৬% অনুভব করেছে যে, একজন নারী কাজ এবং পরিবার—দুটো একসাথে পেতে পারে। এই সংখ্যাটি প্রায় অবিকল আরেকটি সংখ্যার সাথে মিলে যায়: হার্ভার্ড অর্থনীতিবিদ ক্লডিয়া গোল্ডিনের মতে, ব্রেকথ্রু প্রজন্মের নারীদের মধ্যে যারা একই সাথে ক্যারিয়ার, স্বামী এবং অন্তত একজন সন্তান লাভ করতে সক্ষম হয়েছে, তাদের সংখ্যাও প্রায় ১৬%। ১৯৯৫ সালের একটি সমীক্ষায় ক্লডিয়া দেখতে পান যে, যারা ৭০ দশকের গোড়ার দিকে স্নাতক হয়েছেন, তাদের মধ্যে ১৩% থেকে ১৭% নারী ক্যারিয়ার ও পরিবার উভয় অর্জন করতে পেরেছে।
সংখ্যাগুলো খুবই ছোটো। নারীর জীবনের পরিপূর্ণতার পরিপ্রেক্ষিতে, গত একশ বছরে, আমরা যেমনটা কল্পনা করতে ভালোবাসি, তার চেয়ে অনেক কম পরিবর্তন হয়েছে। শার্লট পার্কিন্স গিলম্যান, একজন সুপরিচিত নারীবাদী এবং স্বেচ্ছাকর্মী, সেই ১৮৯৭ সালে লিখেছিলেন:
‘আমরা জীবনকে এমনভাবে সাজিয়েছি যে, একজন পুরুষ বাড়ি, পরিবার, ভালোবাসা, সাহচর্য, গৃহজীবন ও পিতৃত্ব উপভোগ করতে পারবে। একই সাথে সে তার প্রজন্ম এবং তার দেশের একজন সক্রিয় নাগরিকও হতে পারবে। অন্যদিকে, আমরা জীবনকে এমনভাবে সাজিয়েছি যে, একজন নারীকে অবশ্যই যেকোনো একটি ‘বাছাই’ করতে হবে: হয় একা, প্রেমহীন, সঙ্গহীন, যত্নহীন, গৃহহীন এবং সন্তানহীন জীবন—যার একমাত্র সান্ত্বনা হবে জগতের সেবায় অর্পিত তার কাজ; নয়তো ভালোবাসা, মাতৃত্ব এবং গৃহ-সেবার আনন্দলাভের জন্য জগৎসেবা ত্যাগ করা।’
এক শতাব্দীরও বেশি সময় পার হয়েছে, অথচ এখনো অনেক নারীকে একইভাবে ‘বাছাই’ করতে বাধ্য করা হয়৷ আমরা সমীক্ষায় পেয়েছি যে কর্পোরেট আমেরিকায় উচ্চ-উপার্জনকারী নারীদের মধ্যে ৪২% এবং অতি-উচ্চ-উপার্জনকারীদের ৪৯% নিঃসন্তান। অথচ এদের অধিকাংশই কেটের মতোই বলেছে যে—তারা নিঃসন্তান হতে চায়নি। অনেকের জন্য এই ‘ক্রিপিং ননচয়েজ’ প্রচণ্ড ব্যথা এবং হারানোর কষ্ট বয়ে আনে।
সমীক্ষা থেকে আমরা আরও দেখতে পাই—সিন্ডির মতো নারীদের কর্মজীবন ছেড়ে যাওয়ার সাথে কী পরিমাণ বেদনা এবং মূল্যবান দক্ষতার অপচয় জড়িত৷ যে উচ্চ-শিক্ষিত নারীরা ক্যারিয়ার ছেড়েছে, তাদের পুরো দুই-তৃতীয়াংশ মনে করে যে, তাদের ক্যারিয়ারের পথ থেকে জোরপূর্বক সরানো হয়েছিল এবং তারা ফিরে যাওয়ার পথ খুঁজে পাওয়ার জন্য এখনো ব্যাকুল।
~ সিলভিয়া অ্যান হিউলেট
[লেখাটা ‘সফলতার কান্না’ বই থেকে নেওয়া…]
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?