- বইঃ ক্যানভাসে আঁকা মৃত্যু
লেখকঃ সালসাবিলা নকি
প্রচ্ছদঃ সজল চৌধুরী
প্রকাশনাঃ ভূমি প্রকাশ
প্রকাশকালঃ ২০২১
মুদ্রিত মূল্যঃ ৩২০
শান্তিভবনের এল-৫ ফ্ল্যাটে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যায় এক তরুণী। তদন্ত সূত্রে জানা যায়, ওটা আত্মহত্যা ছিল। এরপর পরই বাড়ির মালিক রহমান সাহেব তার ভাতিজা আশরাফকে বাড়িটি তদারকির দায়িত্ব দিয়ে তার পুত্র নিহাল ও স্ত্রীসহ চলে যান ইতালি। যাওয়ার আগে এল-৫ ফ্ল্যাট ভাড়া দেওয়া তো দূরের ব্যাপার, প্রবেশেই নিষেধাজ্ঞা দিয়ে যান। কিন্তু কেন?
ঘটনার ছয় বছর পর আশরাফের স্ত্রী শাহানার জোরাজুরিতে আর বাড়তি কিছু আয়ের উদ্দেশ্যে সেই এল-৫ ফ্ল্যাট গোপনে ভাড়া দেন তুলিকে—যে কিনা শাহানারই বান্ধবী। ভাড়া দেওয়ার আগে নিষিদ্ধ ফ্ল্যাটে ঢুকতেই এক ভয়ংকর ঘটনার মুখোমুখি হয় শাহানা। যা পরবর্তীতে ফ্ল্যাটে ওঠার পর তুলির স্বামী চিত্রশিল্পী রায়হানকেও মুখোমুখি হতে হয়। কী সেই ভয়ংকর ঘটনা?
উকিল তাজউদ্দীন ভোরবেলা কবর খুঁড়ে বের করেন ছয় বছরের এক বাচ্চা মেয়েকে! কী তার পরিচয়?
সেসময়ই ইতালি থেকে বাংলাদেশে আসে নিহাল। এসেই তাকে দেখতে হয় তার কাছের চার বন্ধুর নির্মম পরিণতি, যা ধেয়ে আসে তার দিকেও। পারবে কি সে নিজেকে বাঁচাতে?
সবগুলো প্রশ্নের উত্তর যেন দেওয়া হয়ে গেছে ছয় বছর আগেই। আর সেই উত্তর মৃত্যু দিয়ে আঁকা আছে ক্যানভাসে।
পাঠ প্রতিক্রিয়াঃ
“ক্যানভাসে আঁকা মৃত্যু” এই চমৎকার নামকরণ আমাকে এই বইয়ের প্রতি বেশী আকৃষ্ট করেছে। তার সাথে প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে বইয়ের কাহিনী সংক্ষেপ। সালসাবিলা নকির লিখা এই প্রথম পড়া হলো। ফ্ল্যাপের কল্যাণে জানতে পারি ফেসবুকের পাশাপাশি একটা ওয়েবসাইটেও তিনি লেখালেখি করেন, এছাড়া বিভিন্ন গল্প সংকলন এ তার বেশ কিছু গল্প প্রকাশিত হয়েছে। এর আগে লেখিকা সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিলনা। যদিও “ক্যানভাসে আঁকা মৃত্যু” বইটি লেখিকার প্রথম বই।
বইটিতে মূলত আমাদের সমাজের নারীদের অবহেলা, ধর্ষণের শিকারের করুণ পরিণতির চিত্র ফুটে উঠেছে। নেশাগ্রস্ত কিছু মস্তিষ্ক বিকৃত নরকের কিটের দ্বারা শিশু ধর্ষণ থেকেই মূলত কাহিনীর সূত্রপাত। এরপর আস্তে আস্তে একের পর এক টুইস্ট আসতেই থাকে৷ ধর্ষণ এর প্রেক্ষাপটে লেখিকা বেশ কিছু সুন্দর উদাহরণ দিয়েছেন৷ সাথে আমাদের সমাজের মানুষদের বেশ কিছু সচেতনতা মূলক ম্যাসেজ দেয়ার চেষ্টা করেছেন।
“যেই ছেলেরা ধর্ষণ করে ওদের জন্ম নরকে হয় না। কোনো পরিবারের, তোমার আমার মতো কারো না কারো সম্ভান ওরা। পরিবার থেকে, বাবা-মা থেকেই তো ওদের নৈতিক শিক্ষা পাওয়া উচিত। কিন্তু আমরা মেয়েদেরই শেখাই, তোমরা সাবধানে থেকো নাহলে ধর্ষিত হবে। ছেলেদের শেখাই না কেন, তোমরা ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ কোরো না?
এই লাইনগুলো আমরা কতগুলা মানুষ ই বা ঠিকমতো ধারণ করি ৷”
ইসলামের কিছু রেফারেন্স টেনেও উনি নারী পুরুষের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে বলেছেন। সর্বোপরি খুব সুন্দর মত সমাজের এত বড় অসংগতির বাস্তবিক কারণের পাশাপাশি সমাধানের ক্ষেত্রে করণীয় কিছু বার্তা দেয়ার চেষ্টা করেছেন বইটির মাধ্যমে। বইটি লেখতে গিয়ে কয়েকটা রোগ নিয়েও সম্ভবত লেখিকা রিসার্চ করেছেন।
আমাদের সমাজের কতিপয় কিছু বখে যাওয়া ছেলেদের নেশার জগতে ঢুকে পড়ার সাথে আস্তে আস্তে অপরাধে লিপ্ত হওয়ার বাস্তব চিত্র ও ফুটে উঠেছে। আমরা যেসব মানুষ দেখে মুখ দিয়ে বলে ফেলি জানোয়ার। তেমন কিছু চরিত্র আপনার সামনে এই গল্পে উপস্থিত হবেন। পারিবারিক অবহেলায় সন্তানদের সঠিক পরিচর্যার অভাবের ও কিছু বাস্তব উদাহরণ ছিল গল্পে৷
যদি গল্পের লেখা সম্পর্কে আসি, লেখিকার স্টোরিটেলিং আর বাক্যগঠন পাঠককে ধরে রাখার মত। টানা বসে বইটি শেষ করা ছাড়া উঠতে ইচ্ছে করছিলো না৷ প্রত্যেক পাতায় পাতায় টুইস্ট ছিল। আর ঘটনা গুলো আমাদের আশেপাশের বাস্তব কাহিনীর সাথে মিলে যাচ্ছিলো দেখে আরো বেশী আগ্রহী হয়ে পড়তে থাকি৷ নিঃসন্দেহে অনেক সুন্দর একটি গল্প ভেবেছেন লেখিকা৷
তবে কিছু ক্যারেক্টার বিল্ডআপ এ আরেকটু সময় নেয়ার দরকার ছিলো৷ ক্যারেক্টার গুলোর ব্যাকগ্রাউন্ডে আরেকটু ফোকাস করতে পারতেন। ঘটনা গুলোর পরিস্থিতি বর্ণনা বেশ ভালো থাকলেও ঘটনা ঘটাতে বেশ তাড়াহুড়ো পরিলক্ষিত হয়েছে। খুব তাড়াতাড়ি একের পর এক খুন করে ফেলছিলেন লেখিকা৷ বইটিতে হরর এলিমেন্ট গুলো খুব একটা জমাতে পারেনি,তবে চেষ্টা ভালো ছিলো। প্রথম থেকে সুপার ন্যাচারাল জন্রার মনে করলেও ক্লাইম্যাক্সে গিয়ে লেখিকা চেয়েছিলেন বইটিকে রিভেঞ্জ থ্রিলার বানাতে। সেক্ষেত্রে হরর এলিমেন্ট গুলো অন্যভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারতেন৷
যাইহোক এই ছোটখাটো কয়েকটা অসংগতি কে সাইডে রেখে বলতে গেলে অনবদ্য একটি বই “ক্যানভাসে আঁকা মৃত্যু”। এক বসায় অনায়াসে বিরক্তিহীন ভাবে শেষ করতে পারবেন আশাকরি। উনার লেখা সত্যিই প্রশংসনীয়। বইটির মূল মেসেজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বইটির মাধ্যমে যে বার্তা তিনি দিতে চেয়েছিলেন সেদিক থেকে লেখিকা সফল।
বইয়ের প্রোডাকশন নিয়ে বলতে গেলে খুব সুন্দর বাঁধাই সাথে নিউজ প্রিন্টের পাতাগুলোও ভালো ছিল। বানান ভুল খুব একটা চোখে পড়েনি দুই একটা ছাড়া৷
বইয়ের প্রচ্ছদ টা অনেক সুন্দর। পড়া শেষ করে প্রচ্ছদ এ চোখ বুলিয়ে রিলেটেড এলিমেন্ট এর উপস্থিতি তৃপ্তিদায়ক।
Leave a comment