কোরআন – সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকীদা। লেখকঃ ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহিমাল্লাহু)

গ্রন্থঃ কোরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকীদা।
লেখকঃ ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহিমাল্লাহু)
পৃষ্ঠাঃ ৭২০
(এটি অত্যন্ত গুুরুত্বপূর্ণ একটি বই। বইটিতে লেখক দ্বীনের মূল বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করেছেন, যেগুলো সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন, রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়ন জরুরী এবং সব গর্হিত কাজকে অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে রোধ করা সকলের নৈতিক ও ঈমানী দায়িত্ব।)
———————–
ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের প্রথম ও প্রধান স্তম্ভ হলো ঈমান। ঈমান মুখের স্বীকৃতি ও অন্তরের সত্যায়ন। ঈমান অর্থ বিশ্বাস। শরিয়তের যাবতীয় বিধি-বিধানগুলো অন্তরে বিশ্বাস, মুখে স্বীকার ও সেই অনুযায়ী আমল করা হলো ঈমান। ঈমান আত্মার খোরাক, এক স্বর্গীয় প্রশান্তি এবং দ্বীনে প্রবেশের একটি অপরিহার্য মাধ্যম। ঈমান ও আমল দু’টোই আল্লাহর নির্দেশ এবং বান্দাকে তা অর্জন করে নিতে হয়।
কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, সাধারণভাবে আমরা দেখতে পাই, সমাজের অনেকেই ঈমানের বিধি-বিধান সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞান রাখেন না। কেউ কেউ জ্ঞান রাখলেও অহংকারী হয়ে উঠেন। আবার কেউ কেউ জেনে বুঝে মেনে চলেন না। যেখানে ঈমানই মূল বিষয় সেখানে ঈমান সম্পর্কে না জেনে বা ভাসা ভাসা ধারণা নিয়ে বা ফেইসবুক থেকে দু’লাইন শিখে বা অধিক জ্ঞানে অহংকারী হয়ে আমরা কিভাবে মুসলিম হতে পারি?
রাসূলুল্লাহ (সঃ) যে কাজ করেননি সে কাজ গুলোকে দ্বীনদারি মনে করা এবং তিনি যা বলেননি সেগুলোকে ইসলামী বিশ্বাসের আওতাভুক্ত মনে করার অর্থ হলো তার সুন্নাহকে অবজ্ঞা করা কিংবা অপূর্ণ মনে করা; যা কঠিন পাপ।
রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেন,
❝যে ভুল করে, সে “মানুষ”
যে ভুলের উপর স্থির থাকে, সে”শয়তান”
আর যে ভুল করার পর আল্লাহর কাছে ক্ষমা চায় সে “মুমিন”।❞
যুগে যুগে অনেক জাতিই হিদায়াহ্প্রাপ্ত হয়ে ঈমান লাভ করেছে। কিন্তু তারা তা ধরে রাখতে পারেনি। বরং ঈমান বিনষ্টকারী বিশ্বাস বা গর্হিত কর্মের মাধ্যমে ঈমান হারিয়ে ফেলেছে। অতএব বিষয়গুলো সম্পর্কে সচেতন থাকা মুমিনের অন্যতম দায়িত্ব। এক্ষেত্রে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) এর আদর্শই হলো মুমিনের একমাত্র মুক্তির পথ।
বর্তমান সমাজচিত্রের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই __
এমন কিছু মানুষ আছে, যে বা যারা মুসলিম হিসেবে শরীয়ত সম্মত জীবন-যাপনেে আগ্রহী। ইসলামের নামে যা বলা হয় তারা তা সহজেই মেনে নেন। কেউ কেউ কোন সত্য বিষয় সম্পর্কে অবগত হলে তাও খুব সহজেই মেনে নেন এবং নিজেদের ভুল স্বীকার করেন। আবার কেউ কেউ সত্য মেনে নেওয়া তো দূরের কথা উল্টো ভুলকে আঁকড়ে ধরে গলাবাজি করেন কিংবা ভুলের পক্ষ হয়ে উকালতি করেন।
কিছু আছে লেবাসধারী শয়তান। লোক দেখানো কাজে তারা খুব পটু। অর্থাৎ সে এমনকিছু সৎ কাজ করবে, যা করলে মানুষের নজরে আসবে এবং প্রশংসা কুড়াবে। অন্যথায়, কাজগুলো থেকে বিরত থাকে। যদি তার কোন শুভাকাঙ্ক্ষী এমন গর্হিত কাজে বাঁধা দেয় তাহলে তাকে টেনে-হিচঁড়ে নিচে নামিয়ে ফেলে এবং খিলখিলিয়ে হাসে। কারন সে তাদের মনে যুগিয়ে চলতে পারে না। এভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয় আসল মানুষ গুলো। এভাবে ঠকে যায় আসল মানুষ গুলো। এতে একদিকে যেমন পরিবার গুলো প্রশ্রয় দিচ্ছে। অন্যদিকে, সমাজ এবং স্বজনরা তার অবদানের জন্য বাহবা দিচ্ছে। ফলে, সে নিরবে বেপরোয়া, সেচ্ছাচারী ও অত্যাচারী হয়ে উঠে।
আবার অনেকে পুরোপুরি দ্বীন পালন করলেও জীবনে এমন কিছু উদ্দেশ্য থেকে যায়, যা অর্জন করতে প্রয়োজন হয় ধৈর্য ও দোয়া। কিন্তু ধৈর্য ধারণ আর দোয়া, এত কষ্ট সে কেন করবে?
এমতাবস্থায়, কুফুরি কালামই তার একমাত্র ভরসা। দ্বীনের সঠিক জ্ঞান থাকা সত্বেও নির্দিষ্ট উদ্দশ্য হাসিলের জন্য যারা কুফুরি কাজে লিপ্ত হয় এমন মানুষ গুলো কতটুকু ভয়ংকর হয়, তা বলার বাইরে। এ কাজে তারা কতটুকু সফল? কিংবা আদৌ সফল কিনা?
এভাবে প্রতিনিয়তই ঘটে যায় হাজারো ঘটনা। ফলে জনসাধারণ আটকে যায় বিভ্রান্তির বেড়াজালে।
পরিবারে এমন কিছু মানুষ দেখা যায়, যারা অত্যাচারী। তারা ছলেবলে কৌশলে পরিবারের মূল সদস্যদের হাতের মুঠোয় রেখে, চাবির গোছা হাতে নিয়ে পুরো পরিবারকে এমনভাবে নেতৃত্ব দেয়, যেন তার কথা মতো বাকিদের চলতে হয়। এক্ষেত্রে তাদের কাছে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের কোন কথা কিংবা তাদের চাওয়ার-পাওয়ার কোন মূল্য থাকে না। ফলস্বরূপ, দিনের পর দিন অন্যের অধিকার খর্ব করে তাদের অবহেলার পাত্র বানিয়ে রাখে। অমর্যাদা, অসম্মান এবং হক নষ্ট করে। যদি কালো কিংবা ক্ষুতযুক্ত কেউ হয় তাহলে তো কথায় নেই, অত্যাচারের পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পায়।
প্রিয় বাবা-মা, অল্প শিক্ষিত বা হাতুড়ে কবিরাজের কথা মতো নিজেকে পরিচালিত করবেন না। মানুষ বিষাক্ত হলে কতটা ক্ষতিকর হয়, এরাই তার জলন্ত উদাহরণ। কোন বুদ্ধিমান ব্যাক্তিই না জেনে, না বুঝে কোন কাজ করেন না। অবহেলা খুব মারাত্মক একটা জিনিস যা একটা জীবিত মানুষের বেচে থাকার ইচ্ছেকে মেরে ফেলে।
সমাজে আরও এক দল ব্যক্তিবর্গ আছেন যারা শুধুমাত্র সুবিধাবাদী মানুষ। তারা, জেনে বুঝে নিজেদের সুযোগ-সুবিধা অনুযায়ী হাদিস বর্ণনা করে বা হাদিসের উদ্বৃতি টেনে নিজেদের উদ্দেশ্য হাসিলের চেষ্টা করেন। অর্থাৎ কাঙ্খিত উদ্দেশ্য সাধনই হলো এর মূল লক্ষ্য। কাজটি যেমনই হোক, করে দিতে হবে, নয়তো আপনি কিসের তাকওয়াবান?
যদি উদ্দেশ্য হাসিলের বিষয়টি আপনি বুঝে ফেলেন কিংবা এতে অসম্মতি জানান, তাহলে শুধুমাত্র আপনার তাকওয়ার চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করবেনই না বরং আপনার অবস্থা হবে আরও ভয়াবহ। প্রকৃতপক্ষে, শরীয়াহ সম্মত জীবন-যাপন তো দূরের কথা, এসবের কোন পরোয়া তারা করেন না।
এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ্ বলেন,
❝যদি কারও হিদায়াহ্ প্রকাশিত হওয়ার পরেও রাসূলের বিরোধিতা করে এবং বিশ্বাসের পথ ছেড়ে অন্য পথ অনুসরণ করে, তাহলে আমি তাদের জাহান্নামে নিক্ষেপ করব; যা নিকৃষ্ট গন্তব্যস্থল।❞
[সূরা নিসা, আয়াতঃ ১১]
রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেন,
❝তোমাদের মধ্যে যারা আমার পরে বেঁচে থাকবে তারা অনেক মতবিরোধ করবে। এক্ষেত্রে তোমাদের দায়িত্ব হলো আমার সুন্নাহ এবং খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাহকে অনুসরন করা। তোমরা দৃঢ়ভাবে তা আঁকড়ে ধরো, কোন প্রকারেই এর বাইরে যাবে না। আর নতুন উদ্ভাবিত সকল বিষয় সর্বতোভাবে পরিহার করবে। কারন সকল উদ্ভাবিত বিষয়ই বিদাত। আর সকল বিদাতই বিভ্রান্তি ও পথভ্রষ্টতা।❞
[তিরমিজি, আস-সুনান ৫/৪৪; আবু দাউদ, আস- সুনান ৪/২০০; ইবনে মাজাহ, ১/১৫৫]
আমরা যত ইবাদাহ্ বা সৎকর্ম করি সবকিছু মহান আল্লাহ্ তা’য়ালার নিকট কবুল হওয়ার প্রথম শর্ত হলো শিরক-কুফর মুক্ত বিশুদ্ধ ঈমান। ঈমান ইসলামের মূল ভিত্তি। আবার বিশ্বাস ও কর্মের সমন্বয়ে ইসলাম। সঠিক বিশ্বাসই মানুষের সকল সফলতা ও সৌভাগ্যের চাবিকাঠি। সঠিক বিশ্বাস মানুষকে মানবতার শিখরে তুলে দেয় এবং জীবনে বয়ে আনে শান্তি ও সমৃদ্ধি। আর ভুল বিশ্বাস বা কুসংস্কার মানুষের মনকে সদাব্যস্ত, অস্থির ও হতাশ করে ফেলে।
ঈমানের রক্ষণাবেক্ষণ এবং তার উন্নয়ন মুমিনের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব। ঈমান এমন বড় এক সম্পদ, যার উপর আমাদের পার্থিব ও পারলৌকিক জীবনের সকল কল্যাণ ও মুক্তি নির্ভর করছে। ঈমানের ক্ষতি হলে আমরা চূড়ান্ত ধ্বংস ও ক্ষতির মধ্যে নিপাতিত হব। অতএব, আমাদের এই অবস্থার পরিবর্তন করা প্রয়োজন।
দ্বীনের মূল সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে হলে আমাদের প্রয়োজন যথোপযুক্ত জ্ঞান। জ্ঞান ঈমানের পরিপূরক। জ্ঞান বুদ্ধিবৃত্তিকে সক্রিয় করে। জ্ঞান সৎ কাজে আদেশ এবং অসৎ কাজে নিষেধ করে। ফলে ব্যক্তির ঈমান, আমল ও চিন্তায় পরিবর্তন আসে। সুতরাং মানুষের জ্ঞান যতই বৃদ্ধি পাবে, নিঃসন্দেহে তার আমল ততই বৃদ্ধি পাবে। ঈমানের দিক থেকেও সে হবে অধিক শক্তিশালী।
মূলকথা হলো প্রতিটি কাজ নিয়তের উপর নির্ভরশীল। যারা সৎ পথে জীবন-যাপন করেন মহান আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে অধিক হিদায়াত দান করেন। সত্যিকার অর্থে তারাই সাফল্যমণ্ডিত। ঈমানদারের চিহ্ন ও সফলতার সূত্র হিসেবে রাসুল (সঃ) বলেন__
❝নেক আমল মানুষকে আনন্দিত করে এবং বদ আমল কষ্ট দেয়, সেই হলো প্রকৃত ঈমানদার❞।
[তিরমিজি, হাদিস : ২১৬৫]
সুতরাং সঠিক পথের সন্ধান লাভের পর কোন সুস্থ ব্যক্তি ভ্রান্ত পথে দৌড়াই না। এটাই মানুষের ফিতরাত।
অতএব, সময় থাকতে নিজেকে শুধরে নিন।
পড়ুন, জ্ঞান অর্জন করুন এবং আমল করুন।
।। ঈমান, আকীদা এবং বর্তমান সমাজচিত্র।।
রুকমিলা জান্নাত
০৯.০৭.২০২২

বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?