ফ্রান্স ১৮৩২ খৃষ্টাব্দে এক তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে আলজেরিয়া দখল করে নেয়। শুরু হয় একশত তিরিশ বৎসরের দখলদারিত্ব। আর আলজেরিয়া ১৯৬২/৬৩ সাল পর্যন্ত ফরাসি নিষ্পেষণে নিস্পেষিত হতে থাকে।
বিশ্বের অন্যতম শক্তিধর, প্রগতিশীল, মুক্তচিন্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রবক্তা (!) ফ্রান্স পুরো সময়কাল সেখানে শান্তি (!) প্রতিষ্ঠা ও আধুনিকায়নের নামে যে ঘৃণ্য বর্বরতা, পৈশাচিক নৃশংসতা, নির্যাতন, ধ্বংষযজ্ঞ ও হত্যাকান্ড চালিয়েছে তা মানবিতিহাসে বর্ণনাতিত!
আফসোস, সেই বর্বরতা, সেই হত্যাযজ্ঞ আর নৃশংসতাকে না আঁকা হয়েছে কোন লেখকের লেখাতে, আর না তুলে ধরা হয়েছে কোন নির্মাতার সেলুলয়েডের ফিতায়। মুসলিম বাবা মা’র সন্তানদের যে অংশটি চলচিত্র নির্মাতা হয়েছেন তারা বানিয়েছেন হলিউডের অনুকরণে অশ্লীল রোমান্টিক প্রেমের ছবি, যে সব লেখক তৈরি হয়েছেন তারা লিখেছেন প্রেমের গল্প কেবল, জীবন ও সমাজের করুণগাঁথা লেখার সময় তাদের হয় নি।
আগ্রাসি শক্তি ফ্রান্সের দ্বারা দেশ আক্রান্ত হবার পরে স্বভাবতই আলজেরিয় মুসলমানরা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। লজ্জা আর অনুশোচনার কারণ হলো, ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা ওসমানীয় খেলাফতের গভর্নরের নেতৃত্বে যখন ফরাসি বাহিনীকে প্রতিরোধে ব্যস্ত, ঠিক তখন সেকুল্যার, আরব জাতিয়তাবাদে উজ্জীবিত ‘মাখজেন’ গোত্র আগ্রাসি ফরাসি শক্তিরই সহযোগী! আলজেরিয়াকে ‘বর্বর তুর্কি’মুক্ত করে ‘আধুনিক আলজেরিয়া’ গড়তে!!
আহা, রাজনীতির কি কারিশমা, আধুনিকতার কি মোজেযা! জাতিয়তাবাদী চেতনার কি বাহারি উন্মাদনা!! রাজনীতির সেই কারিশমা বুঝতে, আধুনিকতার সেই মোজেজা দেখতে আর জাতিয়তাবাদী উন্মাদনার স্বরুপ দেখতে আলেজেরিয়াকে প্রায় পাঁচলক্ষ প্রাণের নজরানা পেশ করতে হয়েছে।
কেবলই কি তাই? পাঁচলক্ষাধিক প্রাণের বাইরেও এক বিশাল মূল্য দিতে হয়েছে আলজেরিয়বাসীকে। আজ আলজেরিয়ার দ্বিতীয় প্রধান ভাষা, সরকারি অফিস আদালতে, বেসরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ইউনিভার্সিটিতে আরবির পাশাপাশি ফ্রেঞ্চ-ই হলো প্রধান ভাষা।
আধুনিক আলজেরিয়া গড়তে হলে পশ্চাৎপর, সেকেলে ইসলাম দূর করো। নারীমুক্তির নামে নারীকে রাস্তায় নামাও সমঅধিকার আদায় করো।
ইসলামের বুনিয়াদি দূর্গ; ঘরকে অরক্ষিত রেখে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দক্ষ ও সুনাগরিক হিসেবে তৈরি করার মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব থেকে নারীকে কৌশলে বের করে এনে ইসলামি সমাজ, তথা বৃহত্তর মানব সমাজের সুষ্ঠূ বিকাশের ধারা বন্ধ করে পথে নামো! স্বাধীনতা ও আধুনিকতার নামে ভোগবাদীতার সয়লাবে নিজেকে ভাঁসিয়ে দাও আধুনিক হও!
ইসলামি শিক্ষা সংকুচিত করে সেখানে ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা হলো (প্রকৃতপক্ষে তা হলো খৃষ্টধর্ম অথবা সেকুল্যারপন্থী শিক্ষাব্যবস্থা, যার মুল বক্তব্যই হলো; ইসলাম বিরোধি হয়ে বেড়ে ওঠা বা ইসলামের বিরোধিতা করা)।
ইসলাম মেনে চলাকে কঠিন করে তোলা হয়। ক্রমাগত অপপ্রচার চালিয়ে ইসলামের অনুশাসন যারা মেনে চলে, তাদেরকে দেশ ও সমাজের জন্য ক্ষতিকর, পশ্চাৎপর, প্রতিক্রিয়াশীল হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। হাজার হাজার আলেমকে দেশ ও সমাজে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায়ের নামে হত্যা করা হয়। মসজিদ ও মাদ্রাসা বন্ধ ও লক্ষ লক্ষ মুসলমানের অর্থনৈতিক ও সামাজিক মেরুদন্ড ভেঙ্গে দেয়া হয়।
আর এরই পাশাপাশি জোরদার করা হয় খৃষ্টধর্ম প্রচারের কার্যক্রম। প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানের মাধ্যমে খৃষ্টধর্ম প্রচারে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিবর্গকে উৎসাহিত করে তাদের সহযোগীতা করা হয় রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে নানা কৌশলে। আলজিয়ার্স’সহ দেশের বড় বড় শহরগুলোতে খোলা হয় মিশনারী স্কুল, হাসপাতাল আর গির্জা। প্যারিস থেকে বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত আরবি জানা পাদ্রিরা গিয়ে ভীড় করতে লাগলেন পুরো আলজেরিয়ার আনাচে কানাচে, আরবি ভাষায় খৃষ্টবাদ প্রচারের জন্য।
বিনোদনের নামে প্রতিষ্ঠা করা হয় সিনেমা হল, দিনে তিনটি শো’তে চালানো হতো যৌনতা ও অশ্লীলতানির্ভর ফরাসি চলচিত্র। সারা দেশ জুড়ে খোলা হয় অসংখ্য পানশালা; মদের ছড়াছড়ি! প্রত্যেকটি শহরে গড়ে উঠে ক্লাব, বিনোদনের নামে রাতভর নারী-পুরুষের অবাধে মেলামেশা, আড়ালে আবডালে হাতে কলমে চলে ‘আধুনিক’ হবার প্রশিক্ষণও!
শত শত পত্রিকা, ম্যাগাজিন আর বই-পত্র রচনা ও প্রকাশ করা হলো মুক্তচিন্তা, নাস্তিক্যবাদ, সেকুল্যারজিমের নামে ইসলাম বিদ্বেষ, অথবা নিদেনপক্ষে ইসলামি বিধি বিধান ও দর্শনের প্রতি সন্দিহান একটা প্রজন্ম তৈরির জন্য।
এভাবেই সরাসরি ফরাসি সরকার ও সমাজের প্রত্যক্ষ কর্মপরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে মুসলিম আলজেরিয়ায় গড়ে উঠে একটা সুশীল সমাজ, রক্ত মাংশে আলজেরিয়, বোধ-বিশ্বাসে সেকুল্যার;কট্টর মুসলিম বিদ্বেষী প্রজন্ম, খোদ মুসলিম বাবা-মা’র গর্ভেই!
ফরাসি সরকারের চিন্তাই ছিল কিভাবে আরও দ্রæত আলজেরিয় সমাজ থেকে ইসলামকে দূর করা যায়। সে লক্ষ্যে গৃহিত এতসব পদক্ষেপের পরেও আলজেরিয় বিষয়ক দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীর ঘুম হারাম হবার জোগাড়। অনেক ভাবনা চিন্তার পরে তিনি আলজেরিয়া থেকে কয়েক ডজন মুসলিম ছাত্রীকে ফরাসি সরকারের বিশেষ বৃত্তি প্রদান করে উচ্চশিক্ষার জন্য প্যারিসে এনে বিভিন্ন স্কুল কলেজে ভর্তি করিয়ে দিলেন।
মুসলিম এসব মেয়েরা ফরাসি ছাত্রীদের সাথে একই হোস্টেলে, একই সমাজে, একই পরিবেশে থেকে লেখা পড়া করে বৎসরের পর বৎসর। গ্রীষ্মের ছুটিতে মাস দেড়েকের জন্য তারা আলজেরিয়ায় তাদের বাবা-মা’র কাছে যাবার সুযোগ পেতো। এভাবে এক নাগাড়ে তের বৎসর প্যারিসে সেকুল্যার পরিবেশে থেকে গ্রাজুয়েশন শেষ করে। শিক্ষাবর্ষ শেষে এইসব ছাত্রীদের আনুষ্ঠানিকভাবে সনদ প্রদানের আয়োজন করা হলো। উক্ত অনুষ্ঠান প্যারিসের সুশীল সমাজের অনেক গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গ ছাড়াও মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাগণ, প্রেস, সাংবাদিক, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দসহ অনেক নারী-পুরুষ উপস্থিত ছিলেন।
গোল বাধলো অনুষ্ঠানস্থলে যখন আলজেরিয় মুসলমান ছাত্রীরা দল বেঁধে উপস্থিত হলো, তখন। সকলে অবাক বিষ্ময়ে, একরাশ হতাশামাখা দৃষ্টি নিয়ে লক্ষ্য করলো প্রতিটি আলজেরিয় ছাত্রীই পরিপূর্ণ ইসলামি পোশাক ও হিজাব পরেই অনুষ্ঠানস্থলে এসে হাজির!
দীর্ঘ তের বৎসর প্যারিসে ফরাসি খৃষ্টান মেয়েদের সাথে থেকে পড়াশুনা ও বসবাস করেছে তারা। স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের সুপরিকল্পিত ও সযতœ প্রয়াস সত্তেও এসব মেয়েরা কেউই ইসলামি সংষ্কৃতি ও পোশাক ছেড়ে খৃষ্টবাদী ফরাসি, তথাকথিত আধুনিক সংস্কৃতি ধারন করেনি! এটা দেখে চরম অসন্তুষ্ঠ ফরাসি সুশীল সমাজ মন্ত্রীর কাছে এর কারণ জানতে চাইলে মন্ত্রী এক চমৎকার জবাব দিয়েছিলেন, বলেছিলেন; আমার কি দোষ? মুসলমানদের কুরআন পুরো ফ্রান্সের সকল সম্পদ ও শক্তির চেয়েও শক্তিশালী হলে আমি কি করবো?
আপনি কি বর্তমান বিশ্বসমাজের শক্তিমত্তা দেখে আতংকিত? বিশ্বাস করুন, ভয় কি? আপনার না কুরআন আছে! আল কুরআন তাবৎ বিশ্বশক্তির চেয়েও শতগুন বেশি শক্তিশালী। আপনি যদি কুরআনের শিক্ষাকে ধারণ করতে পারেন, তবে হয়ে উঠবেন অজেয়! কুরআন নাজিলের মাসে কুরআনটাকে আঁকড়ে ধরবেন না!!
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?