কুরআন অনুধাবন : পদ্ধতি ও সতর্কতা | Quran Anudhabon ; Poddoti O Shotorkota

  • কুরআন অনুধাবন : পদ্ধতি ও সতর্কতা
  • লেখক : ড. খালিদ বিন আব্দিল কারীম মুহাম্মাদ
  • প্রকাশনী : উমেদ প্রকাশ
  • বিষয় : কুরআন বিষয়ক আলোচনা
  • অনুবাদক : মুফতী জাওয়াদ আহমাদ
  • সম্পাদক : শায়খ ইউসুফ ওবায়দী
  • পৃষ্ঠা : 248
  • ভাষা : বাংলা

শয়তানের একটি বড় যন্ত্রণা হলো, কুরআন নিয়ে মানুষের তাদাব্বুর-চিন্তা ফিকির করা। কারণ, শয়তান জানে কুরআন নিয়ে চিন্তা-ফিকির করলেই হেদায়াত লাভ হয়।’

ইবনু হুবায়রা রহ. এর এই কথাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, কুরআনই তো সর্বোত্তম নাসীহাহর গ্রন্থ। মানুষ যদি কুরআন নিয়ে ভাবে, উপদেশ গ্রহণের নিয়তে চিন্তা করে, তা তাকে আল্লাহর দিকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে। এটা তো শয়তানের জন্য যন্ত্রণাকরই হওয়ার কথা।

মুফতী মুহাম্মাদ শফী রহ. বলেন, ‘প্রতিটি মানুষ কুরআনের অর্থ ও মর্ম সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করুক এটিই কুরআনের দাবি। সুতরাং এ কথা মনে করা ঠিক নয় যে, কুরআন মাজীদের আয়াতসমূহে চিন্তা-ভাবনা করা শুধু ইমাম ও মুজতাহিদ (বা বড় বড়
আলিমের) কাজ। অবশ্য জ্ঞান ও প্রজ্ঞার
পর্যায়ের মতোই চিন্তা-ভাবনারও বিভিন্ন পর্যায় রয়েছে।’

মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক হাফি. বলেন, ‘নামাযের রুহ যেমন খুশু-খুযু, তিলাওয়াতের রুহ হলো তাদাব্বুর ও তাযাক্কুর তথা চিন্তা-ভাবনা ও উপদেশ গ্রহণ। কালামে পাকের তিলাওয়াতে আবার সেই প্রাণ ফিরে আসুক! এটা এখন বড়ই প্রয়োজন।’

তবে কুরআন অনুধাবনেরও পদ্ধতি আছে। যে কেউ যেকোনোভাবে কুরআন নিয়ে তাদাব্বুর করলে তা উপকারী নাও হতে পারে। উপদেশ গ্রহণের নিয়তে চিন্তা-ভাবনা করা আর কুরআনের অর্থ বোঝার গৌরব অর্জনের প্রচেষ্টা কখনো এক নয়।

কেমন হবে আমাদের কুরআনের তাদাব্বুর, আর তা করতে গিয়ে কোন কোন বিষয়ে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে তা নিয়েই এই বই—কুরআন অনুধাবন।

মানবজাতির জন্য কুরআন হচ্ছে সবচেয়ে বড় সম্পদ। একজন মানুষ, একটি পরিবার, একটি সমাজ, একটি রাষ্ট্র সুষ্ঠুভাবে চলতে গলে যত ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়, এ সবকিছুর সমাধান নিহিত রয়েছে মহাগ্রন্থ পবিত্র আল-কুরআনের মধ্যে। উপরন্তু আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সাথে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা ও তা ধারাবাহিক রাখার ক্ষেত্রে কুরআন হচ্ছে মৌলিক ও অদ্বিতীয় এক কালামের নাম ।

মহাগ্রন্থ আল-কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে সর্বশ্রেষ্ঠ মানব, আল্লাহ তাআলার সর্বাধিক প্রিয় বান্দা, পৃথিবীর একমাত্র মুক্তিদূত হযরত মুহাম্মাদ মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর। জিবরীল আলাইহিস সালামের মাধ্যমে কুরআনের প্রত্যেকটি আয়াতের সর্বপ্রথম সবক তিনি গ্রহণ করেছেন এবং আল্লাহ তাআলা তাঁকে কুরআনের যে পরিমাণ বুঝ ও ফাহাম দান করেছেন, নিঃসন্দেহে অন্য কেউ এর ধারে-কাছে নেই। তাই তো তাঁর মুখ-নির্গত কথা ও বচন, তাঁর থেকে প্রকাশিত কার্যাবলি ও সম্মতি ইসলামের বিধান প্রণয়নের দ্বিতীয় উৎসমূল। তাই কুরআনের পরিচয় তাঁর ভাষায় যে পরিমাণ উজ্জ্বল ও সুস্পষ্ট আকারে ফুটে উঠবে, তা অন্য কারও ভাষায় পাওয়া যাবে না।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, কুরআন হচ্ছে আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে প্রেরিত এক মহান গ্রন্থ। যাতে রয়েছে পূর্ববর্তী ও পরবর্তীদের সম্পর্কে যথেষ্ট তথ্য। যাতে রয়েছে তোমাদের সকল বিষয়ের সমাধান। কুরআন সব বিষয়ের ফায়সালাকারী। যেখানে অনর্থক বিষয়াদির কোনো স্থান নেই। যে ঔদ্ধত্যবশত কুরআনকে পরিত্যাগ করবে, আল্লাহ তাকে সমূলে বিনাশ করে দেবেন। যে কুরআন ব্যতীত অন্য কোথাও হিদায়াত অন্বেষণ করবে, আল্লাহ তাআলা তাকে পথভ্রষ্ট করেন। কুরআন হচ্ছে আল্লাহর পক্ষ হতে এক মজবুত শক্তিশালী রজ্জু, জ্ঞানগর্ভ উপদেশ, সরল পথ। এর অনুসরণে কু-প্রবৃত্তির মৃত্যু ঘটে। তার তিলাওয়াতে জবান জড়তার শিকার হয় না। জ্ঞানীগণ যার জ্ঞানভান্ডারের অফুরন্ত ফোয়ারার আকৃষ্টে আরও তৃষ্ণার্ত হয়ে ওঠেন। যার প্রতি মুগ্ধতা কখনো শেষ হওয়ার নয়। যার অভিধান-পৃষ্ঠায় পুরোনো হয়ে যাওয়া বলতে কোনো শব্দ নেই। যার তিলাওয়াতের মুজিজায় মুগ্ধ হয়ে জিন-জাতি বলেছিল,

إنا سمعنا قرانا عجبا

“নিশ্চয় আমরা এক আশ্চর্য কালামের তিলাওয়াত শুনেছি।” যে কুরআন মোতাবেক কথা বলবে, সে সত্যবাদী। যে কুরআন অনুযায়ী ফায়সালা করবে, সে ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তি। যে কুরআন অনুযায়ী আমল করবে, উভয় জাহানের জন্য সে মহাপুরস্কারের ভাগীদার হবে। আর যে কুরআনের প্রতি মানুষকে আহ্বান করবে, সে সঠিক পথের দিকে হিদায়াতপ্রাপ্ত হবে।

কুরআনের অফুরন্ত কল্যাণ ও দিক-নির্দেশনা দ্বারা লাভবান হওয়ার জন্য সর্বপ্রথম শর্ত হচ্ছে একে পূর্ণাঙ্গরূপে বোঝা, এর মর্মবাণী সঠিকভাবে অনুধাবন করা। তিক্ত হলেও এটাই সত্য, আমরা যারা অনারব রয়েছি, তারা কুরআন বোঝার প্রতি তেমন কোনো গুরুত্বই দিই না। আমাদের শিক্ষাঙ্গনে ইংরেজিসহ অন্যান্য ভাষা চর্চার বেশ গুরুত্ব রয়েছে। এ সমস্ত ভাষা আমরা রপ্ত করি নিজের মাতৃভাষার মতো। এই ভাষাগুলোতে আমরা সমানভাবে দক্ষ ও পারদর্শী হই। অথচ একজন মুসলমান হিসেবে ধর্ম মানার লক্ষ্যে কুরআন বোঝার জন্য যে ভাষাটি শিক্ষা করা সবচেয়ে বেশি জরুরি তা হচ্ছে আরবী; যার সাথে আমাদের সমাজের অধিকাংশ মানুষেরই ন্যূনতম কোনো সংযোগ নেই। এ ভাষার ব্যাপারে আমরা এতটাই অজ্ঞ যে, অনেকে এর অক্ষরগুলোকে পর্যন্ত সঠিকভাবে উচ্চারণ করতে পারে না।

আমরা যারা অল্পসংখ্যক শ্রেণির মানুষ আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে এই ভাষাটি শিক্ষা করার তাওফীকপ্রাপ্ত হয়েছি, ভাষা বোঝার সক্ষমতা অর্জন করতে পেরেছি, আমাদের মাঝেও অনেকেই সঠিকভাবে কুরআনের মর্ম বোঝার পেছনে যথেষ্ট সময় ব্যয় করছি না। এর প্রতি গুরুত্ব দিচ্ছি না। যদ্দরুন আমাদের মুখে

১. সূরা জিন (৭২) : 01 ২. সুনানুত তিরমিযী, ২৯০৬; মুসান্নাফু ইবনি আবী শাইবা, ৩০,০০৭, সনদ দুর্বল।

জীবনে সফলতা লাভের মাধ্যম’

পার্থিব জগতের সব ধরনের সমস্যা ও জটিলতা থেকে মুক্তি এবং আত্মশুদ্ধির একমাত্র উপায় হচ্ছে সঠিক জ্ঞান অর্জন। জ্ঞানলাভের মূল উপাদান হলো পড়া ও লেখা। আল্লাহ তাআলা যখন সৃষ্টিকুলের হিদায়াতের ইচ্ছা করলেন, তাদের গোমরাহীর আঁধার থেকে ঈমানের আলোর দিকে নিয়ে আসার ফায়সালা করলেন, তখন নাযিল করলেন এক মহান গ্রন্থ যা তারা পাঠ করবে। এ গ্রন্থের সর্বপ্রথম সূচনা হয়েছে এক মহাবাক্যের দ্বারা, ” (হে নবী, আপনি পড়ুন আপনার প্রভুর নামে), যে বাক্য সকল যুগের সকল স্থানের মানুষের জন্য সংশোধনের চাবিকাঠি। এটা চিরন্তন সত্য, কুরআন ও সুন্নাহর শিক্ষা মানবজাতির আত্মশুদ্ধি ও সফলতার একমাত্র মাধ্যম। জীবনের যেকোনো অংশে উন্নতি অগ্রগতি লাভের কার্যকরী পথ হচ্ছে কুরআন তিলাওয়াত করা, এর মর্ম বোঝা, এতে নির্দেশিত আদেশ-নিষেধের বাস্তবায়ন করা।

জীবনে ব্যর্থ হওয়ার কারণ

কুরআনে আল্লাহ তাআলাই স্পষ্ট বলেছেন, মানুষের জীবনে ব্যর্থ হওয়ার কারণ দৃঢ় সংকল্পের অভাব;যা তৈরি হয় তার ভুলে যাওয়া রোগ থেকে। আল্লাহ তাআলা বলেন,

ولقد عهدنا إلى ادم من قبل فنسي ولم تجد له عنما

“আর ইতিপূর্বে আমি শপথ নিয়েছিলাম আদম থেকে। অতঃপর সে ভুলে গিয়েছিল এবং আমি তার মধ্যে দৃঢ়তা পাইনি।”

তিনি আরও বলেন,

وإذا مش الإنسان فر دعا ربه منيبا إليه ثم إذا حوله نعمة منه نسى ما كان يدعوا إليه من قبل وجعل يله انداذا ليضل عن سبيله ” قل تمتع بكفرك قليلا ” إنك من أصحب النار

“আর যখন মানুষ কোনো বিপদের সম্মুখীন হয়, তখন সে একাগ্রচিত্তে তার

১. কুরআন সৌভাগ্য ও সফলতার অধ্যায়ে এ বিষয় বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

২. সূরা আলাক, (১৬) : ১

৩. সূরা তহা, (২০) : ১১৫

প্রতিপালককে ডাকতে থাকে। তারপর যখন তিনি বিপদ দূর করে তাকে নিজ পক্ষ থেকে (স্বস্তির) নিয়ামত প্রদান করেন, পূর্বে সে কী কারণে তার রবকে ডেকেছিল তা সে ভুলে যায় এবং তাঁর শরীক (অংশীদার) স্থাপন করে। যার মাধ্যমে সে নিজেও পথভ্রষ্ট হয়, অন্যকেও পথভ্রষ্ট করে। হে নবী, আপনি বলে দিন, তোমরা তোমাদের দুনিয়ার জীবনকে যৎসামান্য কাল পর্যন্ত উপভোগ করে নাও। নিশ্চয়ই তোমরা জাহান্নামী।” তিনি আরও বলেন,

فإذا ركبوا في الفلك دعوا الله مخلصين له الذين قلما تجاهم إلى

البر إذا هم يشركون “যখন তারা নৌকায় আরোহণ করে এবং ঝড়-তুফানের সম্মুখীন হয়, তখন বড় একনিষ্ঠতার সাথে আল্লাহকে ডাকতে থাকে। এরপর যখন তিনি বিপদমুক্ত করে তাদের পাড়ে এনে পৌঁছে দেন, তখন পুনরায় তারা শিরকে লিপ্ত হয়ে যায়।”

উপর্যুক্ত আয়াত থেকে আমরা বুঝলাম, বিপদের মুহূর্তে মানুষের মাথায় একমাত্র লা ইলাহা ইল্লাল্লাহর জ্ঞান অবশিষ্ট থাকে। সে তখন আল্লাহর একত্ববাদ ও তাঁর প্রতি একনিষ্ঠ হওয়া ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারে না। নিজ থেকেই তখন কল্যাণের প্রতি ধাবিত হয়, কিন্তু বিপদ কেটে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার কাছে সবকিছু এক ঘোরের মতো লাগে। যা কেটে যেতেই মাথা থেকে উধাও হয়ে যায় কালিমার জ্ঞান। সে সবকিছু ভুলে যায়। পুনরায় ফিরে আসে কুফর-শিরকের দিকে। নিজের কু-প্রবৃত্তির বাসনা পূরণের দিকে। যা কেবল তাকে ধ্বংস করবে। তার জন্য কঠিন হয়ে যায় সেই মন্দ বাসনা পরিত্যাগ করে কল্যাণকে আঁকড়ে ধরা, যা হচ্ছে তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

তাই আবারও বলছি, ব্যর্থতার মূল কারণ দৃঢ় সংকল্পের অভাব, আর সংকল্পে ব্যত্যয় ঘটে আমাদের ভুলে যাওয়া রোগ থেকে।

১. সূরা যুমার, (৩৯) : ৮

২. সূরা আনকাবুত, (২৯) : ৬৫

কখনো ফুরাবার নয়। কিন্তু সত্য হলো, এমন কোনো আবে জমজমের কূপ যদি মানবকুলের জন্য থেকে থাকে, তা হচ্ছে শুধু পবিত্র আল-কুরআন। এ বিষয় নিয়ে আমরা সামনে আরও বিশদভাবে আলোচনা করব।

কুরআন তিলাওয়াত মুমিনের ঈমানকে আরও বৃদ্ধি করে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাযি. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,

كان رسول الله صلى الله عليه وسلم أجود النّاس، وكان أجود ما يكون في رمضان حين يلقاه جبريل، وكان جبريل يلقاه في كل ليلة من رمضان، فيدارسه القرآن، فلرسول الله صلى الله عليه وسلم حين يلقاه جبريل أجود بالخير من الريح المرسلة “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উদার-দানশীল ছিলেন, আর রমযান মাসে যখন জিবরীল (আলাইহি সালাম) তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন তখন তিনি আরও বেশি দানশীল হয়ে যেতেন। জিবরীল (আলাইহি সালাম) রমযানের প্রত্যেক রাতে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে কুরআন পাঠ করে শোনাতেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সঙ্গে যখন জিবরীল (আলাইহি সালাম) দেখা করতেন, তখন তিনি মানুষের কল্যাণে প্রেরিত বায়ুর চেয়েও অধিক দানশীল হতেন।”

একজন মুসলমান যে স্তরের ঈমানদার হোক, তার ঈমান যতই শক্তিশালী হোক, কুরআনের বারংবার পাঠ ও তিলাওয়াত তার ঈমানকে বৃদ্ধি করে থাকে। তার রবের নিকট তার মর্যাদাকে আরও বাড়িয়ে তোলে। এর অন্যতম দৃষ্টান্ত হচ্ছেন স্বয়ং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। যা আমরা উপর্যুক্ত হাদীস থেকে জানতে পারলাম। তিনি ছিলেন নেক আমলের ক্ষেত্রে সবার চেয়ে অগ্রগামী। যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও জিবরীল আমীন পরস্পর কুরআন তিলাওয়াত করছেন, একে অপরকে শোনাচ্ছেন, তখন তাঁর এ অগ্রগামিতা আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। একজন মুমিন যত বেশি কুরআন তিলাওয়াত করবে, তার মর্যাদা ততই বৃদ্ধি পাবে। তার রবের প্রতি তার বিশ্বাস আরও গাঢ় হবে।

১. সহীহ বুখারী, ৩২২০; সহীহ মুসলিম, 2008 |

‘সমস্ত প্র ংসা আল্লাহ তাআলার জন্য, যিনি তাঁর বান্দার ওপর কিতাব (কুরআন) নাযিল করেছেন এবং তাতে কোনো বক্রতা রাখেননি।”

এ ধরনের আরও অনেক আয়াত রয়েছে। উপর্যুক্ত আয়াতগুলো থেকে প্রতীয়মান হয়, কুরআন আমাদের জন্য অনেক বড় নিয়ামত। যাকে ঘিরে আমাদের লাভ করা সম্ভব আরও বহু নিয়ামত। এ বিষয়টি তার জন্যই উপলব্ধি করা সহজ হবে, যে কুরআনকে বাস্তবিক অর্থে নিয়ামত মানে। তাই আল্লাহ তাআলা যাদের জন্য কুরআনের জ্ঞানকে উদ্ভাসিত করেছেন, তার প্রকৃত স্বাদ দান করেছেন, তার জীবনে এর থেকে বড় পাওয়া আর কিছুই হতে পারে না।

মূল কিতাবের আলোচ্য বিষয়ের সারাংশ

এ কিতাবে একটি ভূমিকা ও কুরআন অনুধাবনের দশটি পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

ভূমিকায় আমরা যা পাচ্ছি : তাদাব্বুর বলতে কী বোঝায় এবং এর নির্দেশনাবলি

কী কী? তাদাব্বুরে কুরআন নিয়ে একটি ভুল ধারণা।

প্রথম অধ্যায় যা দিয়ে সাজানো : মানুষের অনুধাবন ও অনুভূতিশক্তির মূল কেন্দ্ৰ হচ্ছে অন্তর। আর অন্তরের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আল্লাহ তাআলার হাতে। তিনি যেভাবে ইচ্ছে সেভাবেই একে পরিচালিত করেন। যখন ইচ্ছে কল্যাণের জন্য উন্মুক্ত করেন। এবং যখন ইচ্ছে হয় উন্মুক্ত না করার, তখন করেন না। আমাদের অন্তর কল্যাণের জন্য উন্মুক্ত হতে পারে দুইটি কাজ করার মাধ্যমে। একটি হচ্ছে সর্বদা আল্লাহ তাআলার কাছে দুআ করা, রোনাজারি করা। আরেকটি হচ্ছে কুরআনের মহত্ত্ব ও গুরুত্ব নিয়ে অধিক পড়াশোনা করা। এ ব্যাপারে সালফে সালেহীনদের কী অবস্থা ছিল, এ সমস্ত বিষয় গভীরভাবে অধ্যয়ন করা।

১. সূরা কাহাফ, (১৮) : ১ ২. কুরআনের অপার্থিব স্বাদ এক অনস্বীকার্য বাস্তবতা। বর্তমান যুগে তো বটেই, স্বয়ং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগেও তাঁর কট্টর শত্রু দর মুখে এ সত্যের উচ্চারণ হয়েছে। বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত আছে যে, কুখ্যাত মুশরিক ও নবীর দুশমন ওয়ালীদ বিন মুগীরা পর্যন্ত আল্লাহর কালাম শুনে বলেছিল, *এতে এক অন্যরকম স্বাদ রয়েছে!’ আবু নুআইম ইস্পাহানী; দালাইলুন নবুওয়াহ, ১৮৬; বায়হাকী, দালাইলুন নবুওয়াহ, ২/১৯৯; শুআবুল ঈমান, ১৩৩। আল্লামা ইরাকীর মতে শুআবুল ঈমানের মারফু সনদটি গ্রহণযোগ্য। তাখরীজু আহাদিসি ইয়াহইয়া, ৩২৪।

দ্বিতীয় অধ্যায় থেকে আমরা যা পাব: যখনই আমরা কুরআন পড়ব, তখন কুরআনের মূল্যবোধ ও মহত্ত্বের কথা সম্পূর্ণরূপে উপস্থিত রেখে কুরআন পড়ব। কুরআন তিলাওয়াতের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসমূহ সামনে রেখে তিলাওয়াত করব। প্রয়োজনে কোনো কাগজ-কলমের সাহায্যে সেগুলো নোট করব। সাধারণত কুরআন পড়ার সময় মৌলিক পাঁচটা উদ্দেশ্য একজন পাঠকের সামনে থাকা দরকার। ইলম অর্জন, কুরআন অনুযায়ী আমল, রবের সাথে কথোপকথন, সাওয়াব লাভ ও রোগ থেকে শিফা লাভ।

তিন থেকে দশ নম্বর অধ্যায় : একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর। তা হচ্ছে, কোন পদ্ধতিতে আমরা কুরআন তিলাওয়াত করলে কুরআনকে গভীরভাবে বুঝতে পারব।

প্রত্যেকে ততটুকু কুরআন বুঝতে সক্ষম, যতটুকু আল্লাহ তাআলা তাকে তাওফীক দান করেন। গভীরভাবে কুরআন বোঝার জন্য যা করা লাগবে তা হচ্ছে নামাজে দাঁড়িয়ে আওয়াজ করে তারতীলের সাথে কুরআন তিলাওয়াত করতে হবে। কুরআনের মর্মবাণীকে নিজের জীবনের সাথে মিলিয়ে দেখতে হবে, পাশাপাশি প্রত্যেক সপ্তাহের জন্য নির্দিষ্ট একটি অংশ নির্ধারণ করা এবং তা তাদাব্বুরের সাথে পড়ে ষ করা।

এগুলো হচ্ছে পুরো বইয়ের সারাংশ। আল্লাহ তাআলা আমাদের আমাদের নেক উদ্দেশ্য পর্যন্ত পৌঁছার তাওফীক দান করুন। আমাদের উপকারী ইলম অর্জন ও সৎকর্ম করার সক্ষমতা দান করুন। তিনি সমস্ত কিছুর মালিক এবং সর্বোচ্চ ক্ষমতার আধার। দরুদ ও সালাম বর্ষিত হোক রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর, তাঁর পরিবার-পরিজনের ওপর এবং সমস্ত সাহাবার ওপর।

কুরআন অনুধাবনের দশটি চাবিকাঠি :

১. অন্তর। কারণ, অন্তর হচ্ছে মানুষের বোধশক্তির মূল মাধ্যম। এর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ কেবল আল্লাহ তাআলার হাতে। তিনি যেভাবে চান সেভাবে একে পরিচালনা করেন। তাই আল্লাহ তাআলার কাছে দুআ করা, যেন তিনি অন্তরকে সঠিক পথে পরিচালনা করেন।

২. কুরআন পড়ার সময় তিলাওয়াতের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যসমূহ সামনে রেখে তিলাওয়াত করা।

৩. নামাজে কুরআন তিলাওয়াতের প্রতি আলাদাভাবে গুরুত্ব দেয়া।

৪. রাতের বেলা তাহাজ্জুদের নামাজে কুরআন তিলাওয়াত করা। কারণ, তখন পুরো পরিবেশ থাকে একদম নিরিবিলি ও ঝঞ্ঝাটমুক্ত।

৫. যতটুকু অংশ মুখস্থ করা হয়েছে—চাই তা এক পারা পরিমাণ হোক—প্রত্যেক সপ্তাহে একবার করে তা পুনরায় পড়া।

৬. এমনভাবে কুরআন মুখস্থ করা যেন নামাজ হোক কিংবা নামাজের বাইরে, যখনই কুরআন তিলাওয়াত করা হবে, পঠিত আয়াতগুলো চোখের সামনে ভেসে ওঠে। ৭. ভালোভাবে মুখস্থ ও গভীরভাবে মর্ম উদ্ধারের লক্ষ্যে একটি আয়াতকে বারবার পড়া।

৮. কুরআনের মর্মবাণীকে জীবনের বাস্তবতার সাথে মিলিয়ে দেখা।

৯. তাড়াহুড়া করার প্রবণতা বাদ দিয়ে ধীর-স্থিরভাবে কুরআন তিলাওয়াত করা। কারণ, কুরআন পড়ার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে বোঝা। ‘কত বেশি পরিমাণ পড়তে পারলাম’ এটা মূল উদ্দেশ্য নয়। আমরা অনেকেই এ সমস্যার ভুক্তভোগী। যার কারণে অনেক কল্যাণ থেকে আমরা বঞ্চিত হচ্ছি।

১০. ভালোভাবে বোঝার লক্ষ্যে আওয়াজ করে তিলাওয়াত করা। যেন উচ্চারণ ও আওয়াজ উভয়টার সংমিশ্রণে কুরআনের তিলাওয়াত হয়।

এ দশটি জিনিসের প্রতি যত্নবান হলে আমরা সঠিকভাবে কুরআনের তাদাব্বুর করতে পারব এবং কুরআন দ্বারা যথার্থ উপকৃত হব। ফলে কুরআনের অমূল্য বাণী আমাদের হৃদয় ও আত্মা স্পর্শ করতে সক্ষম হবে।

ড. খালিদ বিন আব্দুল কারীম আল-লাহিম

কুরআন অনুধাবন : পদ্ধতি ও সতর্কতা

বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?