কুরআনি ভাবনা : মাওলানা মাহদী হাসান | Qurani Vanna By Mawlana Mahdi Hasan

  • বই : কুরআনি ভাবনা
  • লেখক : মাওলানা মাহদী হাসান
  • প্রকাশনী : দারুত তিবইয়ান
  • বিষয় : কুরআন বিষয়ক আলোচনা
  • পৃষ্ঠা : 128, কভার : হার্ড কভার
  • ভাষা : বাংলা

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তাআলার; যিনি কলম ও কালির স্রষ্টা। তিনি কুরআন নাজিল করেছেন—যা কোনোরকম সন্দেহহীন। তিনি কুরআনে দিয়েছেন মানুষের পরিপূর্ণ জীবনবিধান; যা অত্যন্ত নিঁখুত এবং সমৃদ্ধ।

আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারিমকে এমনভাবে সাজিয়েছেন—যার পরতে পরতে রয়েছে মনুষ্য জীবনের বহু উপাদান। প্রতিটি জায়গা এমনভাবে আলাপন হয়েছে যে, তার গভীরতম দিক আমাদের আকৃষ্ট করে, টেনে নেয় নতুন পরিমণ্ডলে, সামনে মেলে ধরে ভিন্ন এক জগৎ।
কুরআনুল কারিম নিয়ে ভাবনা প্রসারিত করার মাধ্যম হলো তাদাববুর। সেজন্য কুরআনুল কারিমের তাদাববুরের প্রতি এতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়ে থাকে। কুরআনুল কারিমের তেমনই কিছু বিস্ময় তুলে আনা হয়েছে বইটিতে। লেখক কুরআনুল কারিম নিয়ে ভাবনার দুয়ার মেলে ধরেছেন এবং সামনে সম্মিলন ঘটিয়েছেন এমন কিছু বিষয়কে যেগুলো পাঠককে কুরআন নিয়ে ভাবতে আগ্রহী করে তুলবে।
আপনি যদি কুরআনুল কারিমের বিস্ময় পরিক্রমা নিয়ে ভাবতে চান, সুনিপুণ কুরআনকে ভেতর থেকে অনুধাবন করতে চান—তবে এ গ্রন্থটি আপনার জন্য। কুরআনুল কারিমের সাথে আপনার ভাবনাকে ঝালাই করতে ‘কুরআনি ভাবনা’ আপনার পাথেয় হবে।
আমাদেরকে এমন একটি গ্রন্থ উপহার দিয়েছেন আজীজুল উলুম মাদরাসার সম্মানিত উসতাদ মাওলানা মাহদী হাসান। এমন একটি বই প্রকাশ করতে পেরে আমরা আল্লাহর তাআলার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। সেই সাথে লেখকের সর্বাঙ্গিন সফলতা কামনা করছি। আল্লাহ তাকে উত্তম বিনিময় দান করুন।
সবশেষ পাঠকের কাছে নিবেদন, একটি বইকে সুন্দর ও নির্ভুল করতে যতটুকু চেষ্টা করা দরকার; আমরা তা করেছি। কিন্তু তারপরও যদি কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি দৃষ্টিগোচর হয়; তাহলে আমাদের জানাবেন। আমরা সংশোধন করে নেব ইনশাআল্লাহ।
বইটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে আল্লাহ তাআলা উত্তম বিনিময় দান করুন
এবং বইটির ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা দান করুন। আমিন।
— প্রকাশক দারুত তিবইয়ান।

লেখকের কথা

প্রশংসা কেবল পরম করুণাময় আল্লাহ তাআলার, যিনি এক ও অদ্বিতীয়। যার কোনো শরিক নেই। যিনি ব্যতীত আর কোনো ইলাহ নেই।

হাজারো দুরুদ ও সালাম মানবতার মুক্তির দিশারি হযরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি এবং তাঁর পরিবার-পরিজনের প্রতি ও তাঁর সহচরদের প্রতি; যারা দ্বীনের জন্য নিজেদের সর্বস্ব কুরবান করে দিয়েছেন।
পবিত্র কুরআন আল্লাহ তাআলার নাযিলকৃত সর্বশেষ আসমানী কিতাব। এই কিতাব অন্ধকারের যাত্রীকে আলোর পথে নিয়ে আসে। লাঞ্ছিত ও অপদস্থ ব্যক্তিকে সম্মান ও মর্যাদার সর্বোচ্চ শিখরে নিয়ে যায়।
পৃথিবীতে যত কিতাব বা বই আছে, কোনো বইয়ের লেখকই তার বইয়ে নির্ভুলের দাবি করতে পারেনি। কিন্তু পবিত্র কুরআন এর সম্পূর্ণ উল্টো। এই কিতাবের সূচনাতেই আল্লাহ তাআলা পুরো দুনিয়াকে এই বলে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন যে—
ذلك الكتاب لا ريب فيه
এটা সেই কিতাব, যাতে কোনোই সন্দেহ নেই। [সূরা বাকারা, আয়াত : ২ ]
কিন্তু আজ পর্যন্ত ১৪০০ বছর পেরিয়ে গেছে; যুগে যুগে কত জ্ঞানী মহাজ্ঞানীর আগমন ঘটেছে, যারা এই কুরআনের ভুল ধরতে তাদের চেষ্টার বিন্দুমাত্র কমতি করেনি। কিন্তু ভুল ধরতে গিয়ে এই কিতাবের অলৌকিকতার সামনে তারা হার মেনে মুসলিম হয়ে গেছে।
এই তো গেল কুরআন ভুল না হওয়ার দিক থেকে চ্যালেঞ্জ! কুরআনের অনুরূপ কুরআন না আনতে পারার দিক থেকেও আল্লাহ তাআলা জীন ও মানবজাতিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন — لين اجتمعت الانس والجن على أن يأتوا بمثل هذا القرآن لا يأتون بمثله ولو كان بعضهم لبعض ظهيرا .
বলো, এই কুরআনের মতো একখানা কুরআন আনার জন্য; যদি সমগ্র মানব আর জীন একত্রিত হয় তবুও তারা তার মতো আনতে পারবে না, যদিও তারা পরস্পর পরস্পরকে সাহায্য ও সহযোগিতা করে। [সূরা ইসরা, আয়াত : ৮৮]
জীন ও মানুষ কুরআনের অনুরূপ কুরআন রচনা করতে ব্যর্থ হয়েছে, অতঃপর আল্লাহ তাআলা তাদেরকে কেবল দশটি সূরা রচনা করার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলেছেন—
ام يقولون افتريه قل فأتوا بعشر سور مثله مفتريت و ادعوا من استطعتم من دون الله إن كنتم صدقين .
তারা কি বলে সে (অর্থাৎ মুহাম্মদ সা.) এটা রচনা করেছে? বলো, তাহলে তোমরা এর মতো দশটি সূরা রচনা করে আনো, আর (এই কাজে সাহায্য করার জন্য) আল্লাহকে বাদ দিয়ে যাকে ডাকতে পারো ডেকে নাও, যদি তোমরা সত্যবাদী হয়েই থাকো। [সূরা হৃদ, আয়াত : ১৩ ]
একই ব্যক্তি দশটি সূরা তৈরি করতে হবে—এমন কোনো বাধ্যবাধকতা জুড়ে দেননি, বরং সারা দুনিয়ার জীন ও মানুষ মিলে রচনা করতে বলেছেন, কিন্তু তাতেও তারা ব্যর্থ হওয়ায় আল্লাহ তাআলা তাদের কেবল একটি সূরা রচনা করার চ্যালেঞ্জ করে বললেন—
وإن كنتم في ريب مما نزلنا على عبدنا فأتوا بسورة من مثله وادعوا شهداءكم من دون الله إن كنتم صدقين .
আমি আমার বান্দার প্রতি যা নাযিল করেছি তাতে তোমাদের কোনো সন্দেহ
থাকলে তোমরা তার মতো একটি সূরা এনে দাও আর তোমরা যদি সত্যবাদী হও, তবে আল্লাহ ছাড়া তোমাদের সকল সাহায্যকারীকে আহ্বান করো। [সূরা বাকারা, আয়াত: ২৩]
কিন্তু তারা তাতেও ব্যর্থ হয়েছে, আর আল্লাহ তাআলা তার পরের আয়াতে কেয়ামত অবধির জন্য এক অবিশ্বাস্য চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলেছেন—
فإن لم تفعلوا ولن تفعلوا
যদি তোমরা না পারো এবং কখনো পারবেও না। [সূরা বাকারা, আয়াত : ২৪ ]
তিনি বলেছেন, কখনো পারবেও না। সেই চ্যালেঞ্জ আজও চলমান, কুরআন নাযিলের এত দীর্ঘসময় অতিবাহিত হওয়ার পরও আজ পর্যন্ত না কেউ এই চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে পেরেছে, না কেউ পারবে? -initis কখনো পারবেও না। কেননা, আল্লাহ তাআলা যে বলেছেন—এ
পৃথিবীতে যত আসমানী কিতাব নাযিল হয়েছে, কোনোটিই বিকৃতির হাত থেকে রেহাই পায়নি। কেবল মহাগ্রন্থ আল কুরআনই একমাত্র কিতাব, যা নাযিল হওয়ার এত দীর্ঘ সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরও আজ পর্যন্ত কেউ বিকৃতির সামান্য আঁচড় বসাতে পারেনি। কেননা, এই কিতাবের সংরক্ষণের ভার যে আল্লাহ তাআলা নিজে নিয়েছেন। তিনি এই কিতাবকে সর্বশেষ দিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করবেন বলে পৃথিবীকে জানিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন—
إنا نحن نزلنا الذكر وإنا له لحفظون
আমি স্বয়ং এই উপদেশ গ্রন্থ অবতরণ করেছি এবং আমি নিজেই এর সংরক্ষক। [সূরা হিজর, আয়াত : ৯ ]
এবার আসি বক্ষ্যমাণ বইটি প্রসঙ্গে, এই বইয়ে কুরআনি ভাবনা নিয়ে মোট ৩৯টি লেখা স্থান পেয়েছে। তাদাব্বুরকে ভালোবাসি, তাদাব্বুর নিয়ে পড়তে ভালোবাসি; সেই পড়ারই নির্যাস এই বইটি।
লেখালিখির দিক থেকে আমি একেবারেই নবীন। ইলমের দিক থেকে তো পুরোই দেউলিয়া, নিজের গুনাহ আর অযোগ্যতার স্তুপের দিকে তাকালে মাথা থেকে টুপি পড়ে যায়, সে অধম আপনাদের কীই-বা আর উপহার দিতে পারে। তারপরও আল্লাহ তাআলার ওপর পূর্ণ আস্থা ও ভরসা নিয়ে কাজে নেমে পড়ি, বইটির পরতে পরতে তিনি আমাকে সাহায্য করেছেন, তাঁর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের ভাষা আমার নেই। ‘কুরআন ভাবনা”, এটি অধমের প্রথম বই, এবং কুরআন সিরিজেরও প্রথম বই। ধারাবাহিকভাবে কুরআন সিরিজের বইগুলো বের হতে থাকবে ইনশাআল্লাহ। আপনাদের দুআয় অধমকে শামিল রাখবেন, যাতে করে বাকি কাজগুলো আল্লাহ তাআলা অধমকে করার তাওফীক দান করেন।
পরিশেষে সুপ্রিয় পাঠকের কাছে করজোেড় অনুরোধ থাকবে যে, বইটিতে কোনো ভুল দৃষ্টিগোচর হলে অবশ্যই আমাকে অবহিত করবেন, আমি আমার ভুলগুলো শুধরে নেব, আপনাদের প্রতি চির কৃতজ্ঞ থাকব।
—মাহদী হাসান
আজীজুল উলুম মাদরাসা
চৌমুহনী, বেগমগঞ্জ, নোয়াখালী ১৭ই রমাদান, ১৪৪৩ হিজরী।

গোছালো জীবন

মানুষের জীবন খুব একটা গোছালো থাকে না। জীবনকে খুব সুন্দর করে গুছিয়ে নিতে হয়। অগোছালো জীবন কখনো উন্নতির সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে পারে না। ফলে অগোছালো জীবন উন্নতির ছোঁয়া কখনোই পেতে পারে না। কখনো-বা মনে বল নিয়ে বুকে হিম্মত রেখে উন্নতির সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে গেলে পিচ্ছিল খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়তে হয় মাটিতে, হারিয়ে ফেলতে হয় অবশিষ্ট জিইয়ে রাখা হিম্মতটুকু।
তালাক শব্দটি শুনতেই গা কেমন ছমছম করে ওঠে। তিন অক্ষরের ছোট্ট এই শব্দটি মানুষের বহুদিনের গোছালো সংসারকে নিমিষেই অগোছালো করে দেয়। পবিত্র কুরআনে তালাকের আলোচনা অনেক স্থানেই স্থান পেয়েছে। তালাক নিয়ে তো স্বতন্ত্র একটি সূরাও আছে। যাহোক সূরা বাকারায় অন্যান্য বিধি-বিধানের সাথে ২২৮ নম্বর আয়াত থেকে ২৪১ নম্বর আয়াত পর্যন্ত মোট ১৪ টি আয়াতে তালাকের বিধি-বিধান সম্পর্কে আলোচনা হয়েছে।
অবাক করা বিষয় হলো, ১৪ টি আয়াতে তালাকের আলোচনা করতে করতে মাঝখানে এসে ২৩৮ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তাআলা নামায় নিয়ে আলোচনা করেছেন। নামাযের প্রতি যত্নবান হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন—
حفظوا على الصلوت والصلوة الوسطى وقوموا لله قيتين .
তোমরা সালাতের প্রতি যত্নবান হও, বিশেষ করে মধ্যবর্তী সলাতের প্রতি এবং আল্লাহর সামনে বিনীতভাবে দণ্ডায়মান হও। [সূরা বাকারা, আয়াত :
নামাযের প্রতি যত্নবান হওয়ার নির্দেশ দেওয়ার পর পুনরায় তালাকের অবশিষ্ট আলোচনার ইতি টানেন।
প্রশ্ন থেকে যায়, তালাকের আয়াতগুলোর মধ্যখানে নামাযের প্রতি যত্নবান হওয়ার নির্দেশ দেওয়ার রহস্য কী হতে পারে! এমন উত্থিত প্রশ্নের উত্তরে বলা যেতে পারে যে, স্বামী-স্ত্রীর মাঝে তালাক হলে যেমন তাদের বহুদিনের গোছালো সংসার নিমিষেই অগোছালো হয়ে যায়। নিষ্পাপ সন্তানগুলোর জীবন জীবনের ঊষালগ্নেই তছনছ হয়ে যায়; তেমনই মানুষের মাঝে নামাযের গুরুত্ব না থাকলে, নামাযের প্রতি যত্নবান না হলে, গোছালো জীবন অগোছালো হয়ে যায়। আর যদি তা হয় অগোছালো তাহলে আরও অগোছালো হয়ে যায়। তাই জীবনকে গুছিয়ে নিতে নামাযের প্রতি যত্নবান হওয়ার কোনো বিকল্প নেই।
প্রিয় পাঠক, আপনি জেনে আরও অবাক হবেন যে, যখন পৃথিবীতে সূর্যগ্রহণ, চন্দ্ৰগ্ৰহণ ও অনাবৃষ্টি হয়, তখন গোছালো পৃথিবী নিমিষেই অগোছালো হয়ে পড়ে; সেই অগোছালো পৃথিবীকে গুছিয়ে নিতে ইসলাম আমাদের নামায পড়ার আদেশ করে। ফলে নামায় অগোছালো পৃথিবীকে সুন্দর করে গুছিয়ে দেয়। যখন নামায পৃথিবীর জটিল থেকে জটিল বিষয়াবলি গুছিয়ে দিতে পারে, তাহলে কি নামায পারে না—মনুষ্য জীবনকে গুছিয়ে দিতে? অবশ্যই পারে। তবে আজ থেকে আর নামায কাযা কেন?

সিজদা

রবের তরে সিজদা করতে পারা মহান রবেরই এক অপার অনুগ্রহ। এই অনুগ্রহে কেবল তারাই সিক্ত হতে পারে, যারা মনেপ্রাণে নিজেকে তার রবের কাছে সঁপে দিতে পারে। সিজদায় নিজেকে সঁপে দেওয়ার মাধ্যমে মনের আঙিনায় প্রশান্তির যে হিমেল হাওয়া প্রবাহিত হয়, হৃদয়ের শুষ্ক যমীনে শান্তির যে বারিবর্ষণ হয়, তার অনুভব বর্ণনাতীত।
সিজদার মাধ্যমে বান্দা আল্লাহ তাআলার সবচেয়ে কাছাকাছি হয়। বান্দা আল্লাহ তাআলার নৈকট্য লাভে ধন্য হয়, তৃষ্ণার্ত হৃদয় তৃপ্ত হয়।
পবিত্র কুরআনে সূরা ইসরা ও সূরা নাজমের সমাপ্তি ঘটেছে সিজদা দিয়ে। দুটি সূরাতেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইসরা এবং মেরাজ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সূরা ইসরায় আলোচনা হয়েছে ইসরা নিয়ে আর সূরা নাজমে আলোচনা হয়েছে মেরাজ নিয়ে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইসরা এবং মেরাজের মাধ্যমেই আল্লাহ তাআলার নিকটবর্তী হয়েছেন। আর মজার ব্যাপার হলো, উভয় সূরা সিজদার মাধ্যমে সমাপ্তি হয়ে আমাদেরকে এই শুভবার্তা দিয়ে গেছে যে, বান্দার পক্ষে যেহুতু ইসরা আর মেরাজের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার নিকটবর্তী হওয়া মোটেও সম্ভব নয়, তাই একজন বান্দা চাইলে সিজদার মাধ্যমে অবশ্যই আল্লাহ তাআলার নিকটবর্তী হতে পারে।
সিজদার মাধ্যমে বান্দা যে কেবল আল্লাহ তাআলার নিকটবর্তী হয় তা কিন্তু নয়, বরং সিজদা আল্লাহ তাআলার প্রতি আত্মসমর্পণের এক চূড়ান্ত নমুনা। এমন আত্মসমর্পণ কেবল যে আমরা করি সেটাও নয়, বরং সৃষ্টিজগতের প্রতিটি বস্তুই আল্লাহ তাআলার নিকট এমন আত্মসমর্পণ করে থাকে এবং নিজেদের দুর্বলতা প্রকাশ করে থাকে। এ ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা তাঁর মহাগ্রন্থ আল কুরআনে বলেন—
الم تر أن الله يسجد له من في السموت ومن في الأرض والشمس و القمر والنجوم والجبال والشجر و الدواب و كثير من الناس .
তুমি কি দেখো না, আল্লাহর উদ্দেশ্যে সিজদা করে যা কিছু রয়েছে আসমানসমূহে এবং যা কিছু রয়েছে যমীনে, সূর্য, চাঁদ, তারকারাজি, পর্বতমালা, বৃক্ষলতা, ১৮] জীবজন্তু ও মানুষের মধ্যে অনেকে। [ সূরা হজ, আয়াত :
আল্লাহ তাআলার সৃষ্ট সকল কিছু নিজেদের আত্মসমর্পণের চূড়ান্ত নমুনা প্রকাশ করতে গিয়ে আল্লাহ তাআলাকে সিজদা করে।
আমরা অবাক হই, বিস্ময় প্রকাশ করি, তবে অবিশ্বাস নয়; কীভাবে চন্দ্র, সূর্য, তারকা ও গাছ-পালা এবং সমূহ সৃষ্টি আল্লাহ তাআলাকে সিজদা করে! আমাদের এই অবাক হওয়া এবং আমাদের এই অবাক হওয়া এবং আমাদের এই বিস্ময় প্রকাশ করা যতটা না অবাক হওয়ার, তারচেয়ে বেশি অবাক হলো, মানুষ কী করে আল্লাহ তাআলাকে সিজদা না করে থাকতে পারে, কী করে তাঁর তরে মাথা না ঠুকে নিজেকে ধন্য করতে পারে!
হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালামের পাখি হুদহুদের বিস্ময়ভাব দেখে আরও বেশি
বিস্মিত হতে হয়।
হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালামের পাখি হুদহুদ কওমে সাবা থেকে ফিরে এসে হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালামের নিকট আল্লাহ তাআলা ব্যতীত অন্য কাউকে সিজদা করতে দেখে যে বিস্ময় প্রকাশ করেছে, তা পবিত্র কুরআনে এভাবে বিবৃত হয়েছে
وجدتها وقومها يسجدون للشمس من دون الله .
আমি তাকে ও তার কওমকে দেখতে পেলাম, তারা আল্লাহর পরিবর্তে সূর্যকে সিজদা করছে। [সূরা নামল, আয়াত 24]
আকাশের বুকে পেখম মেলে উড়ন্ত পাখিরাও জানে, আল্লাহ তাআলা ব্যতীত আর কাউকে সিজদা করা যায় না। সিজদার যোগ্য কেবল তিনিই, তাঁর জন্যই কেবল সিজদা করা মানুষের জন্য সাজে।
তাই আসুন, রবের তরে সিজদা দিয়ে নিজেকে তৃপ্ত করুন, সিজদার শবনমে নিজেকে
সিক্ত রাখুন, তার আবেশে নিজেকে আবৃত করে রবকে খুঁজুন। 

ঘরের শত্রু

মানুষ শত্রুকে ভয় পায়, তার থেকে নিজেকে দূরে রাখতে চায়। মানুষ বাহিরের শত্রু দ্বারা যতটা না কষ্ট পায়, যতটা না ক্ষতির সম্মুখীন হয়। তারচেয়ে বেশি হয় ঘরের শত্রু দ্বারা। এরা বন্ধুর রূপে শত্রু। এমন বন্ধুর ছদ্মবেশী শত্রু যে কেবল ব্যক্তিগত জীবনে থাকে, তা কিন্তু নয়! বরং ব্যক্তিগত জীবন থেকে পারিবারিক জীবন, সমাজিক জীবন ও রাষ্ট্রীয় জীবনেও এদের বিপুল উপস্থিতি থাকে। এদের এহেন দ্বিমুখী আচরণের কারণে যুগে যুগে কত পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র কত যে সমূহ বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছে—তা বলাই বাহুল্য।
ইসলাম বন্ধুরূপী এমন শত্রুর নাম দিয়েছে মুনাফেক’। যারা ওপরে ইসলামের সাইনবোর্ড ব্যবহার করে ভেতরে ভেতরে কাফেরদের সাথে গভীর আঁতাত রাখে। এরা ইসলাম ও মুসলমানদের সঙ্গে শত্রুতায় কাফেরদের চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়। বরং কাফেরদের চেয়ে অনেকাংশে এগিয়ে।
এই কারণে আল্লাহ তাআলা তাদেরকে জাহান্নামে কাফেরদের সাথে একত্রিত করার কথা বলতে গিয়ে বলেন
إن الله جامع المنفقين والكفرين في جهنم جميعا. নিশ্চয় আল্লাহ মুনাফেক ও কাফেরদের সকলকেই জাহান্নামে একত্রিত করবেন। [সূরা নিসা, আয়াত : ১৪০]
আয়াতাংশে আল্লাহ তাআলা মুনাফেকদের কথা কাফেরদের আগে উল্লেখ করেছেন। কেননা, এদের দুশমনি ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য খুবই মারাত্মক, উপরন্তু এরা ঘরের শত্রু, আর ঘরের শত্রু বাহিরের শত্রু থেকেও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ ও বিপজ্জনক।
ঘরের শত্রু এই মুনাফেকরা ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য এতটাই ঝুঁকিপূর্ণ ও বিপজ্জনক যে, অধুনাকালে কাফেরদের অত্যাধুনিক বিপুল ভারি ভারি অস্ত্রের গর্জন
যেখানে আকাশ-বাতাসকে প্রকম্পিত করে তোলে, সেখানে আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে অভয় দিয়ে বলেন
فلا تخافوهم
তোমরা তাদেরকে ভয় করো না। [সূরা আলে ইমরান, আয়াত : ১৭৫]
আর ঘরের শত্রু এই নিরস্ত্র মুনাফেকদের ব্যাপারে তিনি আমাদেরকে সতর্ক করতে গিয়ে বলেন
هم العدو فاحذرهم .
এরাই শত্রু, অতএব এদের ব্যাপারে সতর্ক হও। [সূরা মুনাফিকূন, আয়াত : ৪]
যেহেতু এরা আমাদের সাথে থাকে, আমাদের সাথে পানাহার করে, হাসি-ঠাট্টা-আনন্দ উদযাপন সবই একসাথে থেকেই উপভোগ করে। সুখ-দুঃখ এদের সাথেই ভাগ করে নিতে হয়। কিন্তু এরা যে ভেড়ার ছদ্মবেশে নেকড়ে, সেটা কে জানত? যেকোনো মুহূর্তেই অতর্কিতভাবে হামলে পড়তে পারে। তাই আল্লাহ তাআলা এদের ব্যাপারে অগ্রিম আমাদেরকে সতর্ক করেছেন। কারণ, এরা যে ঘরের শত্রু।
সূরা বাকারার শুরুতে আল্লাহ তাআলা মুত্তাকীদের আলোচনা করার পর, পরপর দুটি
জাতির আলোচনা করেছেন : ১. কাফের, ২. মুনাফেক।
কাফেরদের অবস্থা কেবল দুটি আয়াতে বর্ণনা করেছেন। আর নিকৃষ্ট মুনাফেকদের অবস্থা খুলে খুলে দীর্ঘ তেরোটি আয়াতে বর্ণনা করেছেন। কেননা, এরা যে খুবই বিপজ্জনক, এরা যে ঘরের শত্রু।
কথা কেবল এখানেই শেষ নয়, মুনাফেকরা যেমন মানুষের কাছে নিন্দিত, তেমন আল্লাহ তাআলার কাছেও চরম ঘৃণিত ও নিন্দিত।
তাদের এমন ঘৃণ্য কাজের পরিণামে, সঠিক পথে ফিরতে আল্লাহ তাআলা তাদের চারটি শর্ত দিয়েছেন, যেখানে কাফেরদের জন্য মাত্র একটি শর্ত।
আল্লাহ তাআলা কাফেরের তাওবা গ্রহণ করার জন্য কেবল একটি শর্তারোপ করেছেন।
১. বিরত হতে হবে অর্থ্যাৎ মুসলিম হতে হবে।
قل للذين كفروا إن ينتهوا يغفر لهم ما قد سلف
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?