- বই : কাশ্মীর দ্য হিডেন হিস্ট্রি
- লেখক : ফয়জুল হক
- প্রকাশনী : শোভা প্রকাশ
- বিষয় : ইতিহাস ও ঐতিহ্য
- পৃষ্ঠা : 160, কভার : হার্ড কভার
- আইএসবিএন : 9789849473251
কাশ্মীর! চেনারের বনে ঝড়ো হাওয়া। হৃদ উত্তাল। সারি সারি মৌন পাহাড়গুলো আর ঘুমিয়ে নেই। বন আর পর্বত কাঁপিয়ে গর্জন করে চলেছে ট্যাংক-কামান-ন্যাট-হানটান। “ভূস্বর্গে” আবার হানাদার। ১৯৬৫-র কাশ্মীর আবার তামাম দুনিয়ার ভাবনা। দিকে দিকে দুশ্চিন্তা, উল্লাস, উত্তেজনা, ফিসফাস।
১৯৬৫-র কাশ্মীর আরও আকষর্ণীয়, কারণ আগুন এবার আরও দাউ দাউ, আরও ব্যাপ্ত। আগস্টের ৫ তারিখে হানাদার এসেছিল রাত্রির অন্ধকারে নিঃশব্দ পায়ে, তস্করের মতো। হাতে আধুনিক অস্ত্র থাকলেও উর্দি ছিল তাদের গায়ে। তিন হাজার থেকে পাঁচ হাজারের সেই “জিব্রালটার-ফৌজ’ কবরস্থ হওয়ার মুখে মুখোশ ছেড়েই এগিয়ে এসেছিল আসল শত্রু।
১ সেপ্টেম্বর ৭০টি ট্যাংক আর এক ব্রিগেড সুসজ্জিত পদাতিক সৈন্য নিয়ে দুঃসাহসীর মতো আন্তর্জাতিক সীমানা পার হয়ে ভারত আক্রমণ করেছি পাকিস্তান। ভারত তার জবাব দিয়েছিল খাস পশ্চিম পাকিস্তানের দিকে পথ বাড়িয়ে। বাইশ দিন যুদ্ধের পর ক্ষত-বিক্ষত মুমূর্ষু পাকিস্তান আনত মস্তকে যুদ্ধবিরতি মেনে নিয়েছিল। কিন্তু কাশ্মীর-উপত্যকা থেকে এখনও সে তা লুব্ধ দৃষ্টি সরিয়ে নেয়নি।
এখনও তার মুখে উদ্ধত আস্ফালন, -দরকার হলে হাজার বছর যুদ্ধ চালিয়ে যাবে পাকিস্তান! এখনও সগর্ব প্রতিজ্ঞা- দরকার হলে পাকিস্তান ধরাপৃষ্ঠ থেকে চিরতরে মুছে যাবে কিন্তু তবুও কাশ্মীরের দাবি ছাড়বে না। যুদ্ধ, অতএব থামেনি। আগুন আপাতত ধিকিধিকি জ্বলছে মাত্র শত্রুর প্রস্তুতি চলছে। সেই সঙ্গে অন্যদের কানাকানি, মন্ত্রণা, গুঞ্জনও। ১৯৬৫-র কাশ্মীর নিয়ে বিশ্বে উত্তেজনার অন্ত নেই।
উত্তেজনা ঝিলমের তীরে যত, তার চেয়ে অনেক বেশি টেমস-এর ধারে, ডাল বা উলার হৃদের চেয়েও অনেক বেশি তরঙ্গ-ভঙ্গ লেক সাকসেস-এ এবং অন্যত্র। কাশ্মীর ভারতের একটি অঙ্গরাজ্য। দৈর্ঘ্য ৩৫০ মাইল, প্রস্থ ২৭৫ মাইল। উত্তরতম সীমান্তের এই রাজ্যটি ভারতের অন্যতম রাজ্য। আয়তনে কাশ্মীর ৮৪,৪৭১ বর্গমাইল।
ভৌগোলিক দিক থেকে মোটামুটি তিনটি স্বতন্ত্র এলাকায় ভাগ করা যায় একে। লাদাক গিলগিট অঞ্চল বা উত্তরের এলাকা, মধ্যবর্তী খাস কাশ্মীর উপত্যকা আর দক্ষিণের জম্মুর সমভূমি অঞ্চল। ই.এ. নাইট একদা কাশ্মীরের নাম দিয়েছিলেন— “তিন সাম্রাজ্যের মিলনস্থল”, “হোয়ার থ্রী এমপায়ারস মীট”। কাশ্মীর আজ বিশ্বের চোখে তার চেয়েও গুরুতর স্থান। এখানে জনবসতি খুবই কম।
১৯৪১ সালে জন-গণনায় দেখা গিয়েছিল এই বিশাল রাজ্যটিতে মাত্র ৪০, ২১, ৬১৬ জন মানুষের বাস। তার মধ্যে মুসলমান শতকরা ৭৭.১১ ভাগ, হিন্দু ২০.১২ ভাগ, শিখ এবং বৌদ্ধ ২.৭৭ ভাগ। ১৯৬১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী কাশ্মীরের জনসংখ্যা ৩৫,৬০,৯৭৬ । তার মধ্যে মুসলমান- ২৪,৩২,০৬৭, হিন্দু ১০,১৩,১৯৩, শিখ— ৬,৩০৬৯, বৌদ্ধ– ৪,৮৩৬০, খ্রিষ্টান— ২৮৪৮ এবং জৈন— ১,৪২৭৫ জন। দেশ বিভাগ, হানাদার, যুদ্ধ-বিরতি সীমারেখা ইত্যাদির ফলে কাশ্মীরের জনসংখ্যা কুড়ি বছর আগেকার তুলনায় আজ আরও কম। তবুও কাশ্মীর নিয়ে দিকে দিকে এমন আগ্রহ, কারণ, তিন সাম্রাজ্যের মিলনস্থল কাশ্মীরের চার দিক ঘিরে আজ পাঁচ পাঁচটি দেশ। দক্ষিণে পাঞ্জাব তথা ভারত এবং পাকিস্তান, পশ্চিমে পাকিস্তানের উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং আফগানিস্তান, উত্তরে পামির মালভূমি, চীন এবং রুশ তুর্কিস্তান, পূর্বে তিব্বত তথা আবার চীন।
কাশ্মীর নিয়ে অতএব বিশ্ব ভাবিত হবে বৈ কি! ব্রিটেন বা আমেরিকার অবশ্য কাশ্মীরের সঙ্গে ভৌগোলিক যোগ নেই। কিন্তু রাশিয়া এবং চীনের অবস্থিতির ফলে তারাও কাশ্মীর উপলক্ষ্যে অন্যতম মনোযোগী দেশ। কাশ্মীর পাকিস্তানের হাতে তুলে দিতে পারলে, কিংবা একান্তই যদি তা না পারা যায় তবে কাশ্মীরকে “স্বাধীন” রাখতে পারলে তাদের বড়োই সুবিধা! দেশ-বিভাগের দিন থেকেই সুদূর ভারতের একটি রাজ্যকে নিয়ে বিশ্বের নানা রাজধানীতে তাই অতিশয় “উদ্বেগ”,–সরকারিভাবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিদায় নিতে না নিতেই, সীমান্তের ওপার থেকে ঢেউয়ের পর ঢেউ হানাদার।
সেদিন ২২ অক্টোবর, ১৯৪৭।
ফুলের-দেশে হঠাৎ হানাদার। অ্যাবোটাবাদ ডোমেল রোডের পথে হাজার হাজার লুঠেরা এসে হাজির হয়েছে কাশ্মীরে। ক্রুর তাদের চেহারা। হাতে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র, মুখে জেহাদের আহ্বান। দেখলেই বোঝা যায় তারা উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের নানা উপজাতির লোক। পাকিস্তান ওদের কাশ্মীর বিজয়ে পাঠিয়েছে। কাশ্মীরের মুসলমানদের মনোজয়ের অনেক চেষ্টা করেছেন জিন্না, হাওয়ার গতি পাল্টাবার জন্য বিস্তর সাধনা করেছে মুসলিম লীগ। কাশ্মীর তবুও অনড়। সুতরাং এবার এই নব-বিধান ।
কাশ্মীর মুসলমানের দেশ হয়েও লীগ-পন্থী হতে পারেনি সেদিন, কারণ রাজনৈতিক ঐতিহ্য তার সম্পূর্ণ অন্য ধরনের। মুসলিমপ্রধান রাজ্য, কিন্তু রাজা হিন্দু। গরিবের দেশ। দেশের ঐশ্বর্য বলতে যা সেকালে বলতে গেলে তার সবটুকুই প্রায় সংখ্যালঘু হিন্দুদের দখলে। রাজ্যের শাসন ব্যবস্থায়ও তারাই প্রধান। তারই স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে ১৯৩১ সালের গ্রীষ্মে হঠাৎ গণবিদ্রোহ, দাঙ্গা। হিন্দু মুসলমান দাঙ্গার চেহারা নিলেও ওই বিদ্রোহ আসলে ছিল রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রজা আন্দোলন। কাশ্মীরে সে-ই প্রথম রাজনৈতিক চেতনার জন্ম।
তারপরের বছরই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল রাজ্যের প্রথম রাজনৈতিক দল, – মুসলিম কনফারেন্স। ভারতময় তৎকালে জাতীয় আন্দোলন। তার ঢেউ পৌঁছাল কাশ্মীরেও। সাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান মুসলিম কনফারেন্স তার সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করার সাধনায় ব্রতী হলো। ’৩৬ সালে অ-মুসলমানদের জন্যও দুয়ার খুলে দেওয়া হলো তার। ‘৩৯ সালে মুসলিম কনফারেন্স নাম পাল্টে পুরোপুরি জাতীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হলো। নাম হলো তার ন্যাশনাল কনফারেন্স। লক্ষ্যে ও আদর্শে ন্যাশনাল কনফারেন্স তখন ভারতের জাতীয় কংগ্রেস থেকে অভিন্ন। অন্যান্য দেশিয় রাজ্যে প্রজা আন্দোলনের মতোই কাশ্মীরের জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে কংগ্রেসের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। জিন্না-সাহেব সেখানে কেউ না।
‘৩১ সালের আন্দোলনের পর মহারাজা শাসন-সংস্কারের জন্য কমিশন বসিয়েছিলেন একটা। জি.বে. ল্যানসির অধিনায়কত্বে সে কমিশনের পরামর্শমত রাজ্যে আইন সভা প্রতিষ্ঠিত হলো (১৯৩৪)। জাতীয়তাবাদীরা তাতে সুযোগ পেলেন। দশ বছর পরে, ১৯৪৪ সালে রাজ্যে প্রধন জনপ্রিয় মন্ত্রিসভা। সেখানেও দুজন মন্ত্রি ছিলেন ন্যাশনাল কনফারেন্সের প্রতিনিধি হিসেবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের পদত্যাগ করতে হয়।
কারণ রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী তখন কুখ্যাত রামচন্দ্র কাক। দেশে দায়িত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠায় তার কোন আগ্রহ নেই। ন্যাশনাল কনফারেন্সের জাতীয়তাবাদী নায়কদের জব্দ করার জন্য তিনি সেদিন যা করেছিলেন তার তুলনা নেই। আগেই বলা হয়েছে কাশ্মীরের প্রথম গণআন্দোলন শুরু হয়েছিল হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার মধ্য দিয়ে। দেশে সাম্প্রদায়িকতাবাদী মুসলিম নেতারাও ছিলেন। ন্যাশনাল কনফারেন্স-এর উদার জাতীয়তাবাদকে কোনো দিনই তারা সমর্থন করতে পারেননি।
তারা মুসলিম লীগের অনুকরণে ১৯৩২ সালেই কাশ্মীরে একটি সাম্প্রদায়িক দল গড়েছিলেন। নাম ছিল তার আজাদ কনফারেন্স। ৩৯ সালে ন্যাশনাল কনফারেন্স প্রতিষ্ঠিত করার সঙ্গে সঙ্গে আজাদ কনফারেন্স নাম নিল—মুসলিম কনফারেন্স। কাশ্মীরের জনসাধারণের ওপর কোনদিনই বিশেষ প্রভাব ছিল না তার।
সেখানে সর্বেশ্বর ন্যাশনাল কনফারেন্স এবং ভারতের জাতীয় কংগ্রেস। ‘৪০ সালে সীমান্ত গান্ধী এবং জওহরলাল গিয়েছিলেন কাশ্মীর পরিদর্শনে। কাশ্মীরের জনসাধারণ বিপুল উদ্দীপনায় অভ্যর্থনা জানিয়েছিল। তাদের ‘৪৫ সালে নেহরু-আজাদ এবং সীমান্ত গান্ধী আবার পা দিয়েছিলেন এই দেশিয় রাজ্যটিতে। কাশ্মীর সেদিনও সানন্দে স্বাগত জানিয়েছিল তাদের। তবুও মুসলিম লীগ কাশ্মীরকে ভুলতে রাজি হয়নি। মুসলিম কনফারেন্সকে দিয়ে সে তার মতলব হাসিল করার জন্য একের পর এক চেষ্টা চালিয়ে গেল। ‘৪৪ সালের জুনে স্বয়ং জিন্না এলেন কাশ্মীর উপত্যকায় “বিশ্রাম নিতে”।
মুসলিম কনফারেন্সের বার্ষিক সভায় দাঁড়িয়ে তিনি ঘোষণা করলেন- মুসলিম কনফারেন্সই কাশ্মীরী মুসলমানের একমাত্র প্রতিষ্ঠান। ন্যাশনাল কনফারেন্স একটি গুন্ডার দল। রামচন্দ্র কাকও প্রকারান্তরে তাই প্রমাণ করতে চাইলেন। ১৯৪৬ সালের ৬ মে শুরু হলো ন্যাশনাল কনফারেন্সের উদ্যোগে ব্যাপক গণআন্দোলন—কুইট কাশ্মীর! ডোগরা-রাজ কাশ্মীর ছাড়! কাক উত্তর দিলেন জাতীয়তাবাদী নায়কদের গ্রেফতার করে। এমনকি তার হাত থেকে সেদিন জওহরলাল নেহরুর পর্যন্ত নিস্তার নেই। কাক তাকেও গ্রেফতার করেছিলেন।
এই “গুন্ডা দলকে ” শায়েস্তা করতে গিয়ে কাক সেদিন জিন্নার মতোই তার অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন মুসলিম কনফারেন্সকে। এই প্রতিষ্ঠানটিই সেদিন রামচন্দ্র কাকের প্রধান সমর্থক। পুরানো আইনসভা, রাজ্যের প্রজা-সভা ভেঙে দেওয়া হলো। ন্যাশনাল কনফারেন্সের বিকল্প হিসেবে কাক নতুন রাজনৈতিক দল গড়লেন;- “অল কাশ্মীর স্টেট পিপলস কনফারেন্স” গালভরা নাম তার। ‘৪৬ সালের ডিসেম্বরে নতুন করে নির্বাচন হলো রাজ্যে। ন্যাশনাল কনফারেন্সের নায়কেরা কারাগারে। কর্মীরা নির্বাচন বয়কট করলেন। তারই মধ্যে আবার “গণরাজ” প্রতিষ্ঠিত হলো কাশ্মীরে। প্রধান তার পণ্ডিত রামচন্দ্র কাক। সমর্থক জিন্না সাহেব এবং মুসলিম লীগের অনুচর দল মুসলিম কনফারেন্স।
জিন্নার আশা ছিল মুসলিম কনফারেন্স কার্যোদ্ধার করতে পারবে। উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে সংখ্যালঘু মুসলিম লীগ রাতারাতি পাঠানদের দেশ জয় করে নিয়েছে, কাশ্মীরেও ওরা বিফল হবে না। বিশেষত স্থানীয় রাজ সরকারের সঙ্গে যখন ওদের সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক। ভারত তখন স্বাধীনতার দুয়ারে। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো কাশ্মীরেও প্রবল উত্তেজনা। মুসলিম কনফারেন্স জানাল- কাশ্মীরের পক্ষে স্বতন্ত্র থাকাই ভালো। কাকও মনে মনে যেন তা-ই চান। তার মতিগতি বোঝা দুষ্কর। দেশে আবার আন্দোলন। বাধ্য হয়েই মহারাজাকে আসরে অবতীর্ণ হতে হলো। তিনি রামচন্দ্রকে বিদায় দিলেন। সেদিন ১০ আগস্ট, ১৯৪৭ সাল। ঐতিহাসিক পনেরোই আগস্ট আসতে আর মাত্র পাঁচদিন বাকি। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, ‘৪৮ সালে কাশ্মীরের জনপ্রিয় সরকার আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছিলেন পণ্ডিত রামচন্দ্র কাককে। বিচারে দুবছর জেল হয়েছিল তার। অবশ্য পুরো দু’বছর জেলে কাটাতে হয়নি তাকে। তার আগেই ছাড়া পেয়েছিলেন রামচন্দ্ৰ ।
কাক গেলেন। কিন্তু কাক-তন্ত্র তৎক্ষণাৎ লুপ্ত হলো না। ১৫ আগস্ট তারিখে ভারত পরশাসন মুক্ত হলো। সেই সঙ্গে ভূমিষ্ঠ হলো নতুন রাষ্ট্র-পাকিস্তান। অন্যান্য দেশিয় রাজাগুলোর মতো কাশ্মীরের ভারত কিংবা পাকিস্তান দুই রাষ্ট্রের কোনো একটিতে যোগ দেওয়ার কথা। কিন্তু কাশ্মীরের মহারাজা কালহরণ করতে চান। তিনি ঘোষণা করলেন—দুই রাষ্ট্রের সঙ্গেই আমি এক “স্থিতাবস্থা” চুক্তি করতে চাই। পাকিস্তান রেডিও জানাল, থ্যাঙ্ক ইউ! আমরা তাতে সম্মত। ভারত বলল-আমরা এ জাতীয় চুক্তি অনুমোদন করতে পারি না। ন্যাশনাল কনফারেন্সের প্রধান নায়কেরা তখনও কারাগারে। কেউ কেউ পলাতক, সরকারি চোখের আড়ালে।
পাকিস্তানের ধারণা ছিল “স্থিতাবস্থা” চুক্তি ল’ কাশ্মীরের রাতারাতি ভারত-ভুক্তি ঠেকান গেছে। এখন একটু চাপ দিলেই মহারাজা পাকিস্তানে যোগ দেবেন। সে সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার যখন একমাত্র রাজ্যের রাজার তখন তাকে বেশি ঘাটানো সঙ্গত নয়। বিশেষত, পাক-সমর্থক কাক নেই। “কুইট কাশ্মীর” আন্দোলন থেকে একপাশে সরে দাঁড়াবার ফলে মুসলিম কনফারেন্স আরও দুর্বল হয়ে গেছে। তার অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। পাকিস্তান তাই অন্য চাল চালল। “স্থিতাবস্থা” চুক্তির সুযোগ নিয়ে সে কাশ্মীরের ডাক এবং তার বিভাগ দখল করে বসল। তারপর শুরু হলো তার নব নব চাপ।
তৎকালে উত্তর থেকে কাশ্মীরে আসা যায় একটি মাত্র পথে। সেটি গিলগিট। দক্ষিণে দুটি মাত্র পথ। দুটিই গিয়েছে পাকিস্তানে। আজ আর অবশ্য তা নয়। পাকিস্তান প্রথমে কাশ্মীরে জিনিসপত্র পাঠান বন্ধ করে দিল। পেট্রোল, তেল, খাদ্যশস্য, চিনি, নুন, কাপড়-কাশ্মীরে কিছুই পাওয়া যায় না। অবরোধের ফাঁকে ফাঁকে চলল সাম্প্রদায়িকতার প্রচার। পাঞ্জাবে তখন ব্যাপক দাঙ্গা চলছে। পাকিস্তান রেডিও কাশ্মীরীদেরও ক্রমাগত উস্কানি দিয়ে চলল জেহাদ ঘোষণা করতে। রাওয়ালপিণ্ডি থেকে শ্রীনগরে আসবার পথে পাকিস্তানিদের হাতে একদল কাশ্মীরী খুন হয়ে গেল। কাশ্মীরের সীমান্ত জুড়ে ক্রমাগত অশান্তি। রাজ্যে বলতে গেলে প্রায় অচলাবস্থা। বাধ্য হয়েই সেপ্টেম্বরের ২৯ তারিখে মহারাজা শেখ আব্দুল্লাকে মুক্ত করে দিলেন। আব্দুল্লাহ তার প্রথম ভাষণেই ঘোষণা করলেন—কাশ্মীরে দাঙ্গাবাজি চলবে না। আমরা দুই জাতির তত্ত্ব মানি না। জিন্ন সাহেব আজ আমাদের পাকিস্তানে যোগ দেওয়ার জন্য আহ্বান জানাচ্ছেন।
আমরা কাশ্মীরী মুসলমানরা যখন স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছিলাম তখন কোথায় ছিলেন তিনি? তিনি আরও ঘোষণা করলেন—কাশ্মীর কার সঙ্গে যোগ দেবে সে প্রশ্ন পরে। আগে আমরা মহারাজার শাসালের অবসান চাই। মহারাজা তখনও স্বাধীন কাশ্মীরের স্বপ্নে বিভোর। কাকের আসালে প্রধানমন্ত্রী হয়ে এসেছিলেন ঠাকুর জনক সিং। ‘৪৭ সালের অক্টোবর “পাঁচ বছরের জন্য” নতুন প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হলেন বিচারপতি মেহর চাঁদ মহাজন। তার প্রথম সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি স্পষ্টাস্পষ্টি বলে দিয়েছেন-কাশ্মীর আপাতত কোনো রাষ্ট্রেই যোগ দিচ্ছে না। তিনি আরও বলে দিয়েছেন—“কংগ্রেসী মন্ত্রিদের সম্পর্কে আমার অভিজ্ঞতা ভালো নয়। সুতরাং, এখানে আমি সে জাতীয় কিছু ঘটতে দিচ্ছি না। কাশ্মীরীরা এখনও শাসন পরিচালনার যোগ্যতা অর্জন করেনি।”
পাকিস্তান এই গোলমালের সুযোগে তার শেষ চাল চালল। পাক সরকারের তরফ থেকে দুজন প্রতিনিধি এসে নামলেন শ্রীনগরে। তারা আব্দুল্লাহ তথা ন্যাশনাল কনফারেন্সের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে চান। কথাবার্তা শ্রীনগরেই শেষ হলো না। সেখান থেকে রাওয়ালপিণ্ডি । রাওয়ালপিণ্ডি থেকে লাহোর। আলোচনা ব্যর্থ হলো। তবুও আর এক দফা চেষ্টায় দোষ নেই। পাকিস্তানের তরফ থেকে আব্দুল্লাহকে সেখানে আমন্ত্রণ জানান হলো। শেখ জানালেন— পাকিস্তানে যেতে তার আপত্তি নেই, কিন্তু তার আগে একবার তার দিল্লি যাওয়া দরকার। সেখানে সর্ব ভারতীয় দেশিয় রাজ্য প্রজা সম্মেলনে স্টান্ডিং কমিটির বৈঠক। তারপর আর সময় নষ্ট করার অর্থ হয় না! দিল্লি সম্মেলনের তারিখ ছিল ১৮ অক্টোবর। ২২ অক্টোবর লুব্ধ পাক হানাদারের দল হাজির হলো কাশ্মীরে। তাদের হাতে জ্বলন্ত মশাল।
হানাদার কাশ্মীরে নতুন নয়। কাশ্মীর ইতিহাসে এক আশ্চর্য নায়িকা । তার নামে যুগ থেকে যুগান্তরে লালসার আগুন জ্বলে ।
কাশ্মীর! –কাশ্মীর!
কাশ্মীর থেকেই প্রমোদ ভ্রমণ শেষে লাহোরে ফিরছিলেন সম্রাট জাহাঙ্গীর। পথে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন তিনি। দেখতে দেখতে অবস্থা তার আরও অবনতির দিকে। মৃত্যুপথযাত্রী সম্রাটের কানে কানে তার শেষ বাসনা জানতে চাওয়া হলো। জাহাঙ্গীর ফিসফিস করে উত্তর দিয়েছিলেন নাকি—কাশ্মীর! – শুধু কাশ্মীর!
জাহাঙ্গীর নিঃসঙ্গ বিলাসী নন। কাশ্মীর যুগের পর যুগ অসংখ্য সম্রাট আর লোভাতুর সেনানায়কের একমাত্র বাসনা। উপত্যকার চারদিকে সাজানো মৌন পাহাড়গুলোর মতোই প্রাচীন এই রাজ্যের ইতিহাস। লৌকিক উপকথা বলে : আজ যেখানে কাশ্মীর উপত্যকা একদিন সেখানে ছিল একটি বিশাল হৃদ। নাম ছিল তার— “সতী সার” বা পার্বতীর সাগর। সেই সাগরে জলোদ্ভব নামে এক অত্যাচারী দৈত্য ছিল। তার পীড়নে প্রজাদের দুঃখের শেষ নেই। তাদের কান্না শুনে সতীসারের তীরে এসে হাজির হলেন কশ্যপ মুনি। তিনি স্বয়ং ব্রহ্মার পৌত্র, তদুপরি সিন্ধ ঋষি। জনসাধারণের দুঃখ মোচনের জন্য হাজার বছর তপস্যায় মগ্ন হলেন তিনি। ঋষির সাধনা ব্যর্থ হলো না। “হরি” বা ময়নার রূপে দেবি শারিকা এসে আবির্ভূত হলেন তার সামনে। মুখে তার এক টুকরো নুড়ি। জলদেওয়ের মাথায় সেটি নিক্ষেপ করা মাত্র সে একটি বিশাল প্রস্তরখণ্ডে রূপান্তরিত হলো। সেই পাথরটিই নাকি আজকের হবি-পর্বত। মুনি কশ্যপ হৃদকে ফুলে-ফলে শোভিত উপত্যকায় পরিণত করেছিলেন; তার হাতে গড়া নতুন দেশের নাম হলো তাই— কশ্যপ মীর (বা মার)। সেই থেকেই কাশ্মীর।
কাশ্মীরের জ্ঞাত ইতিহাস শুরু হয়েছে বলা হলে সম্রাট অশোকের কাল থেকে। অর্থাৎ খ্রিষ্টপূর্ব ২৫০ অব্দের কাছাকাছি সময়ে। কিন্তু তার আগেও যে কাশ্মীর ছিল এবং সেখানে যে এক উন্নত সভ্যতা গড়ে উঠেছিল গবেষকরা সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ। নৃতাত্ত্বিকেরা বলেন-কাশ্মীরের বাসিন্দারা আদিতে ছিলেন আর্য। মধ্য এশিয়া থেকে তারা এসে এখানে বসতি স্থাপন করেছিলেন। ধর্মে তারা ছিল বৈদিক ধর্মাবলম্বী অর্থাৎ হিন্দু। আশপাশের পাহাড়িরা উপজাতিগুলো থেকে তারা একান্তভাবেই স্বতন্ত্র। অন্তত বিখ্যাত নৃতাত্ত্বিক জর্জ ক্যামবেল-এর তাই অভিমত। পিকক লিখেছেন—কাশ্মীরী ব্রাহ্মণেরা আদিতে গ্রিক এবং পারসিক। একজন আধুনিক গবেষক বলেন—খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকর প্রথমদিকে ইন্দো-গ্রিকরা কাশ্মীর আক্রমণ করেছিল হয়ত, কিন্তু তারা এখানে বসবাস শুরু করেছিল বলে মনে হয় না। (এ সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনার জন্য দ্রষ্টব্য : আর্লি হিস্ট্রি অ্যান্ড কালচার অফ কাশ্মীর, ড. সুনীলচন্দ্র রায়।) তবে একটি বিষয়ে সবাই একমত : জিন্না সাহেব বা আইয়ুব-ভুট্টো প্রথম অভিযাত্রী নন, ঢেউয়ের পর ঢেউ অভিযাত্রী এসেছে কাশ্মীরে। ইতিহাসের নির্মম নিয়তিকে মেনে অনেকেই আবার ফিরে গেছে যে যার দেশে। কিন্তু কাশ্মীর মুছে যায়নি। উত্তর এবং পশ্চিম ভারতের মতোই “শক হুন দল পাঠান মোগল” এখানকার আদি আর্যদেহে লীন।
আদি হিন্দু-আমলের পরে দীর্ঘ বৌদ্ধ-যুগ। তারপর আবার হিন্দু রাজত্ব। ইসলাম কাশ্মীরে অনেক পরের ঘটনা। শ্রীনগর শহর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন নাকি রাজা প্রভার সেন। সে অশোকের কালেরও আগের ঘটনা। মাত্তানের মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছেন রাজা রামদেব। তিনিও খ্রীষ্ট জন্মের বহু আগেকার নরপতি ।
মৌর্য আমলের শেষদিকে এসেছিল তুর্কি হানাদাররা। তারপর কনিষ্ক তথা কুষান-আমল । কাশ্মীর তখন ভারতে বিশিষ্ট বৌদ্ধ ধর্মকেন্দ্র। কনিষ্কের বিখ্যাত তৃতীয় বৌদ্ধ মহাসম্মেলন এখানেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কুষাণদের পরে খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতকে এলো হানাদার হনেরা, ষষ্ঠ শতকেও কাশ্মীরে তাদেরই প্রতিপত্তি। কুষাণ নায়কদের মধ্যে কাশ্মীরের ইতিহাসে সবচেয়ে কুখ্যাত মিহিরকুলের নাম। বৌদ্ধ ধর্মকে মুছে দেওয়ার জন্য সেদিন তিনি এক উন্মাদ সমর নায়ক। হারওয়ান-এ বৌদ্ধ মঠের ধ্বংসস্তূপ তারই বর্বর হাতের কীর্তি। বৌদ্ধ ভিক্ষুকরা সেদিন অনেকেই আশ্রয় নিয়েছিলেন তিব্বতে। তিব্বতের বৌদ্ধ ধর্মাচারে তাদের অবদান অনেক।
অষ্টম-নবম শতকে আবার হিন্দু রাজত্ব। এই অধ্যায়ে কাশ্মীরের ইতিহাসে স্মরণীয় দুটি নাম- ললিতাদিত্য (৭১৫-৫২ খ্রিষ্টাব্দ) আর অবন্তী বর্ণম (৮৫৫-৮৩ খ্রিষ্টাব্দ) কাশ্মীরময় আজও অনেক স্মৃতি ছড়িয়ে আছে এদের। তার মধ্যে অন্যতম মার্তন্ডের মন্দির আর সূর্যপুর ও তার কাহিনি । মার্কন্ডের বিশাল মন্দিরটি তৈরি করেছিলেন ললিতাদিত্য। সূর্যপুর বলে জায়গাটার নাম হয়েছে অবন্তী বর্ণমের বিখ্যাত স্থপতি সূর্যের নামে। ঝিলমকে বশে এনেছিলেন তিনি! ললিতাদিত্য শুধু কাশ্মীরকে সুখি রাজ্যে পরিণত করেই তুষ্ট হতে পারেননি। সমগ্র উত্তর ভারত তখন তার দখলে। শুধু তাই নয়, তুরস্ক, এমনকি মধ্য এশিয়ার একাংশেও তখন কাশ্মীর রাজের আধিপত্য ।
অভিযাত্রী ভারতীয় সভ্যতার কাছে কাশ্মীর তৎকালে মধ্য এশিয়ার দুয়ার। ভারতীয় ধর্ম আর সংস্কৃতি এখান থেকেই আলোক বিস্তার করেছিল চীন আর কাসপিয়ারে মাঝামাঝি বিস্তীর্ণ এলাকায়। কাশ্মীর সেকালে বৌদ্ধ ধর্ম, শৈবধর্ম এবং সংস্কৃত সাহিত্যের এক বিস্ময়কর হৃদ, নানা রঙের পদ্ম ফুটে আছে সেখানে। ভারতের নানা প্রান্ত থেকে বিদ্যার্থীরা সমবেত হতেন সেখানে। অলংঙ্কার শাস্ত্র ছাড়াও কাশ্মীরে সংস্কৃত সাহিত্যের বহুমুখী চৰ্চা, অতুলনীয় স্ফূর্তি। ক্ষেমেন্দ্র, দামোদর গুপ্ত, বিহলন, কহলন, ‘কথা সরিৎ সাগর’-রচয়িতা সোমদেব ভারতের সংস্কৃত সাহিত্যে কাশ্মীরী নাম অনেক।
পরবর্তীকালে কাশ্মীরের হিন্দু রাজারা অবশ্য এত প্রতিপত্তিশালী ছিলেন না। কিন্তু নানা উপজাতীয় আক্রমণের মধ্যেও মোটামুটি চতুর্দশ শতক অবধি কাশ্মীর হিন্দুর দেশই ছিল। ১৩১৪ সালে ঘোড়ার খুরে বরফ চূর্ণ করে এলেন তুর্কী যোদ্ধা জুলফি কাদির খান। ওরফে কুখ্যাত দালচু। শুরু হলো কাশ্মীরে বলপূর্বক ধর্মান্তকরণ। দালচু এবং তার সৈন্যদল কাশ্মীরেই কবরস্থ। ৫০ হাজার ব্রাহ্মণ বন্দিকে নিয়ে ঘরে ফেরার সময় নিষ্ঠুর প্রকৃতি প্রতিশোধ নিয়েছিল তাকে বরফ চাপা দিয়ে। তারপর এলেন মোহম্মদ গজনভী। কাশ্মীর কোনো দিনই কোনো আক্রমণকারীকে বিনা প্রতিরোধে মেনে নেয়নি। সিংহাসনে তখন একজন রাণী। নাম তার—রানি দিদ্যা। তিনি হানাদারদের বিতাড়িত করেন। স্বদেশের মান রক্ষা করতে গিয়ে আর এক রানি বীরাঙ্গনার মৃত্যুবরণ করেছিলেন। তার নাম কুটি রানি। তার মন্ত্রি ছিলেন একজন মুসলমান। তিনি হঠাৎ নিজেকে কাশ্মীরের অধীশ্বর বলে ঘোষণা করেন। নাম তার—শাহ মীর। শোনা যায়, রানি আত্মহত্যা করে নিজের ইজ্জত রক্ষা করেন, কিন্তু কাশ্মীরে প্রতিষ্ঠিত হলো মুসলিম রাজত্ব।
শাহ মীরের পরে অনেক মুসলমান নরপতিই রাজত্ব করেছেন কাশ্মীরে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত সুলতান জয়নুল আবদীন ( ১৪২৩-‘৭৪), সবচেয়ে কুখ্যাত সিকেন্দর (১৩৯৪-১৪১৬)। সিকেন্দরের কাজ ছিল হিন্দু মন্দিরাদি ধ্বংস করা এবং হিন্দুদের জবরদস্তি করে ধর্মান্তরিত করা। জয়নুল আবেদিন উদার প্রকৃতির মানুষ ছিলন। ভাঙা হিন্দু মন্দির তিনি আবার মেরামত করেছিলেন। কাশ্মীরের শিল্প সাহিত্য ধর্ম—তার আমলে সর্বত্র আবার নবজীবনের হাওয়া।
মুঘলেরা কাশ্মীরে আধিপত্য বিস্তার করেন আকবরের কালে। কাশ্মীর তখন উপজাতীয় ছকদের অধিকারে। আকবরের বাহিনী তাদের পরাজিত করে কাশ্মীর উপত্যকার অধীশ্বর হলো। জাহাঙ্গীরের মতোই আকবরও ভালোবেসেছিলেন কাশ্মীরকে। হরি-পর্বতের দুর্গটির তিনি সংস্কার করেছিলেন। জাহাঙ্গীর বলতে গেলে কাশ্মীর প্রেমে উন্মাদ। ভেরিনাগ, আছিবল, নাসীম, শালিমার-কাশ্মীরের অধিকাংশ বাগিচা তারই কীর্তি। কিংবা নূরজাহানের। ওঁরই নাকি চিনার গাছ এনেছিলেন কাশ্মীর উপত্যকায়। শ্রীনগরের পাথর-মসজিদটি নূরজাহানের দান।
মুঘলের পরে পাঠান। মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তিমকালে নতুন হানাদার কাশ্মীর উপত্যকায়। এবার (১৭৫০) এসেছে আহমদশাহ দুরাণির নেতৃত্বে পাঠানেরা। আবার হিন্দু-হত্যা, ধর্মান্তরকরণ। দীর্ঘ ষাট বছর চলেছিল এই অরাজকতা। পাঠানেরা স্থানীয় মুসলমানদেরও রেহাই দেয়নি। হিন্দু মুসলমান এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তির জন্য আবেদন পেশ করলেন পাঞ্জাব কেশরী রণজিৎ সিংয়ের কাছে। কাশ্মীরে তখন জম্মুর খাঁ আফগান গভর্নর। রাজাগুলোর সিংয়ের অধিনায়কত্বে শিখবাহিনী কাশ্মীর আক্রমণ করলেন। সে ১৮৯৯ সালের কথা। কাশ্মীরে পাঠান শাসালের অবসান হলো।
রণজিৎ সিং ১৮৩৯ সালে মারা গেলেন। ১৮৪৬ সালে পাঞ্জাব ইংরেজের হাতে এলো : ‘৪৬ সালের ১৬ মার্চ বিখ্যাত আমৃতশর-চুক্তি। তার আগে ৯ মার্চ তারিখে আরও একটি চুক্তি হয়ে গেছে। ইংরেজরা ঘোষণা করলেন জম্মু আর কাশ্মীরের অধীশ্বর হলেন এবার থেকে ডোগরা রাজা গুলাব সিং এবং তার বংশধরেরা। আধুনিক কাশ্মীরের তখনই জন্ম। গুলাব সিং সাধারণ একজন সামন্ত হলেও জনপ্রিয় শাসক ছিলেন।
পানিকর লিখেছেন—ঊনিশ শতকের ভারতে গুলাব সিং এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। মহারাজা ছিলেন হরি সিং তারই বংশধর। তার আমলেই ১৯৪৭ সালের পাক আক্রমণ, কাশ্মীরে হানাদার ।
হানাদার।
রাজতরঙ্গিনীর দেশে ঢেউয়ের পর ঢেউ হানাদার। একদল এল অ্যাবোটাবাদের পথে। আর একদল কোহাল্লা দিয়ে। সেখানে মহারাজার একদল সীমান্তরক্ষী ছিল। তারাও যোগ দিল হানাদারের সঙ্গে। দেখতে দেখতে দুশমনেরা এগিয়ে গেল ডোমেল অবধি । সেখান থেকে মুজাফরাবাদ। পথে দু’ধারে যা পড়ল নিমেষে তা ধ্বংস্তূপে পরিণত হলো। যেন ঘূর্ণিবাত্যা। আরও নির্মম এই বর্বরের দল। হত্যা, লুঠ, ধর্ষণ, আগুন;-পায়ে পায়ে ওদের মধ্যযুগীয় কাহিনি? কোহাল্লা-শ্রীনগর রোডের একটি বিন্দুতে উরি। রাজ্য সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার রাজেন্দ্র সিং সেখানে দুদিন ঠেকিয়ে রাখলেন ওদের। ২৫ অক্টোবর উরির পতন হলো। তারপর মাহোরা পাওয়ার হাউসের। রাজ্যের একমাত্র বিদ্যুৎ সরবরাহ কেন্দ্র সেটি। শ্রীনগর এবং উপত্যকার অন্যান্য শহরে অন্ধকার নেমে এলো। ২৬ অক্টোবর বরমুলা শহর শত্রুর হাতে চলে গেল। বরমুলা কাশ্মীরের তৃতীয় বৃহৎ শহর। শ্রীনগর থেকে দূরত্ব তার মাত্র চৌত্রিশ মাইল। মহারাজা শ্রীনগর ছেড়ে আশ্রয় নিলেন জম্মু শহরে। শ্রীনগরের একমাত্র ভরসা ন্যাশনাল কনফারেন্সের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী, – “বাঁচাও ফৌজ।”
শেখ আবদুল্লা আবার দিল্লি ছুটলেন। ২৪ অক্টোবর মহারাজা নিজেই সাহায্যের জন্য প্রার্থনা জানিয়েছেন ভারতের কাছে। ২৫ ন্যাশনাল কনফারেন্সের তরফ থেকে দিল্লি পৌঁছালেন আবদুল্লা। ২৫ গভর্নর জেনারেলের নামে মহারাজার অনুরোধ-পত্র : আফ্রিদিরা আসছে। প্রথমে পুঞ্চ এলাকায়, তারপর শিয়ালকোট অঞ্চলে, তারপর হাজরা জেলায় এবং এখন রাজকোটেও। রাজ্যময় বর্বর হানাদারের দল। ভারত সাহায্য না করলে রাজ্য সরকারের পক্ষে এদের ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। অথচ আমি জানি, কাশ্মীর ভারতে যোগ না দিলে ভারতের পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয়। আমি সেই সিদ্ধান্তই গ্রহণ করলাম।… চিঠির সঙ্গে সঙ্গে রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী মেহের চাঁদ মহাজনও এসে হাজির হলেন দিল্লিতে। ভারত সরকার মহারাজা এবং জনসাধারণ—দুই তরফের অনুরোধ বিবেচনা করলেন। ২৭ ভারত সরকারের পক্ষ থেকে মাউন্টব্যাটেন উত্তর দিলেন মহারাজাকে: ভারত কাশ্মীরের ভারতভুক্তির প্রস্তাব গ্রহণ করল। সেদিনই বেলা ৯টায় ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর প্রথম দলটি এসে নামল শ্রীনগর বিমানবন্দরে। কাশ্মীরের চারদিক ঘিরে তখন আগুন ।
সেদিনই মাত্র কিছুক্ষণ আগে বরমুলার পতন হয়েছে। চৌদ্দ হাজার মানুষের শহর বরমুলা। আজ সে দুহাজারের কোন প্রেতপুরী যেন। কিছুই অবশিষ্ট রাখেনি হানাদারের দল। ২৬০টি ট্রাক বোঝাই করে লুঠের মাল নিয়ে গেছে তারা। তার মধ্যে ছিল শত শত তরুণী। হিন্দু মুসলমান খ্রিষ্টান কাউকে বাদ দেয়নি ওরা। বরমুলার বিখ্যাত সেন্ট জোসেফ কনভেন্টে হানা দিয়ে সেখানেও মেয়েদের ওপর অত্যাচার করেছে বর্বরের দল। আর সকলের সঙ্গে ইউরোপীয় মেয়েদেরও লুঠের মাল হিসেবে ট্রাকে তুলে নিয়ে গেছে। শত শত হিন্দুকে জোর করে ধর্মান্তরিত করা হয়েছে। অসংখ্য ঘর বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। ন্যাশনাল কনফারেন্সের কর্মীদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। সার তেজবাহাদুর সপ্রু হিসেব করেছিলেন স্বরমুলায় নিহতের সংখ্যা কমপক্ষে চার হাজার।
অন্যত্রও একই সংবাদ। শ্রীনগর থেকে মাত্র ২৮ মাইল পশ্চিমে মনোহর গুলমার্গ। সেখানে যা ছিল সবই লুঠ হয়ে গেল। অ্যাঙ্গলিকা গির্জাটিও লোভের আগুন থেকে বাদ গেল না। সোপুর, পাত্তান, বন্দিপুর, হান্দওয়ারা, উরি, থিটওয়াল এবং জম্মুর অসংখ্য নগর গ্রাম ধ্বংসস্তূপে পরিণত হলো। মুঘলদের কাশ্মীর আসা-যাওয়ার সুপ্রাচীন পথের ধারে সুন্দর জনপদ নওশেরা। সেখানে নিহতের সংখ্যা ২০ হাজার, অপহৃতা নারীর সংখ্যা ২ হাজার। হত্যা, লুঠ, ধর্মান্তরকরণ, ধর্ষণ আর আগুন। হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান নেই-হানাদারের কাছে সেদিন সব এক। এক নাগোরতা শিবিরেই উদ্ধাস্তু জমেছিল ৪০ হাজার! জম্মুতে উদ্বাস্তু আশ্রয় নিয়েছিল ৪৩ হাজার!
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?