কাশ্মীর ও আজাদীর লড়াই : আলতাফ পারভেজ | Kashmir O Azadir Lorai

বই : কাশ্মীর ও আজাদীর লড়াই 
লেখক :  আলতাফ পারভেজ
প্রকাশনী : ঐতিহ্য
প্রথম প্রকাশ : জানুয়ারি ২০১৯
পৃষ্ঠা সংখ্যা : ৯৫
মুদ্রিত মূল্য : ১৭০ টাকা

কাশ্মীর সম্পর্কে বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের জানাশোনার দৌড় মূলত এর অনিন্দ্য সুন্দর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পর্যন্তই। এর বাইরে কাশ্মীরের দীর্ঘ ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের রক্তাক্ত উপাখ্যান সম্পর্কে এদেশের মানুষের জানাশোনা তেমন একটা নাই বললেই চলে। যদিও কাশ্মীরের সঙ্গে বাংলাদেশ রাজনৈতিক ইতিহাসের অনেক মিল রয়েছে। গত আগস্ট মাসে কাশ্মীর ভ্রমণের পরে আমি কাশ্মীর সম্পর্কে জানাতে আগ্রহী হই। সেই ধারাবাহিকতায় আমি কাশ্মীরের ইতিহাস ও স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে লেখা বইয়ের খোঁজ করতে থাকি। খুঁজতে খুঁজতে জনাব আলতাফ পারভেজের “কাশ্মীর ও আজাদীর লড়াই” বইটির সন্ধান পাই। বইটি  লেখকের ‘এথনো-পলিটিক্স ইন সাউথ এশিয়া’ সিরিজের ২য় বই।  আজকে এই বইটি নিয়ে আলোচনা করবো।

কাশ্মীরের খ্যাতনামা কবি আগা শহীদ আলী লিখিত ‘কাশ্মীর উইদাউট এ পোস্ট অফিস’ কবিতা দিয়ে লেখক এই বইয়ে ভূমিকার অবতারণা করেন। ১৯৯০ পরবর্তী রাজনৈতিক নিপীড়নের ধারাবাহিকতায় মাসের পর মাস সেখানকার পোস্ট অফিসগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়। সেই প্রেক্ষাপটে এই কবিতাটি লেখা হয়েছিলো। পরে ১৯৯৭ সালে লেখক মূল কবিতাটি বড় করে ‘দ্য কান্ট্রি উইদাউট অ্যা পোস্ট অফিস’ নামে পুনরায় প্রকাশ করেন। কবিতাটিকে কাশ্মীরীদের হৃদয়ের রক্তক্ষরণের কাব্যিক বহিঃপ্রকাশ বলা যেতে পারে। ৯৬ লাইনের কবিতাটির ৯১তম লাইনে কবি লিখেছেন-
I’ve found a prisoner’s letters to a lover-
One begins: “These words may never reach you.”
২৫ বছর আগে লেখা কবিতাটিতে কাশ্মীরের যে রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রকাশ পেয়েছে, বর্তমানে তা আরও খারাপ আকার ধারণ করেছে।
এই বইয়ে ৪২ টি শিরোনামে লেখক কাশ্মীরের অতীত ইতিহাস থেকে শুরু করে বর্তমান রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহের চুম্বক অংশ সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরেছেন। যদিও তা ধারাবাহিকভাবে বর্ননা করা হয় নি। পুরো বইয়ে ১৫৫৫ সালে চাক রাজবংশ থেকে শুরু করে ২০১৮ সালে ভারতীয় সংবিধানের কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন সংক্রান্ত ৩৭০ নং অনুচ্ছেদ নিয়ে ভারতের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে। এরমাঝে চাক রাজবংশের শেষ প্রতিনিধি ইউসুফ শাহ চাককে হটিয়ে মোগল সম্রাট আকবর কাশ্মীর দখল করে। সেই থেকে শুরু হয় কাশ্মীরের পরাধীনতার ইতিহাস। তারপর মোগল শাসন দুর্বল হলে তাদেরকে হটিয়ে পাঠানরা কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। এরপর পাঞ্জাবের শিখ রাজা রঞ্জিৎ সিং এর শিখ বাহিনী আফগানদের কাছ থেকে কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ নেয়। তারপর শিখদের হাত থেকে কাশ্মীরের দখল যায় ব্রিটিশদের হাতে। এরপর ব্রিটিশরা জুম্মুর হিন্দু রাজা গুলাব সিংয়ের কাছে কাশ্মীরকে বিক্রি করে দেয়। ব্রিটিশরা ভারতবর্ষ থেকে চলে গেলে কাশ্মীরের জনগণের মতামতের তোয়াক্কা না করে ভারত এবং পাকিস্তান যে যার মতো করে কাশ্মীরের দখল নেয়। (পাকিস্তান কাশ্মীরের যে অংশ দখলে নিয়েছিলো সে অংশ আজাদ কাশ্মীর নামে পরিচিত।) তারপর শুরু হয় কাশ্মীরীদের আজাদীর লড়াইয়ের এক নতুন অধ্যায়। যা আজও চলমান।
এই বইয়ের মাধ্যমে জানতে পারি কাশ্মীর ভ্যালি বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সামরিকায়িত এলাকাগুলোর একটি। কাশ্মীরের প্রতি বর্গমাইলে ১০০ জন ভারতীয় সৈনিক কর্মরত আছে। প্রতি ১০ জন সাধারণ কাশ্মীরীর জন্য একজন সৈনিক রয়েছে। অথচ ভারত জুড়ে এ বিষয়ে জাতীয় গড় হলো ৮০০:১। জুম্মু ও কাশ্মীরের (লাদাখ ব্যাতিত) মাত্র ৪২ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকায় সাত লাখ সৈন্য প্রায় সার্বক্ষণিক অভিযানে লিপ্ত রয়েছে। কাশ্মীরে প্রতিনিয়ত ঘটছে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা। নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা  গুম, খুন ও ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটালেও Armed Forces Special Power Act বা AFSPA এর মাধ্যমে তাদেরকে দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে। শুধু তাই নয় আফজাল গুরুর মতো নিরপরাধ কাশ্মীরীরা প্রহসনের বিচারের মাধ্যমে বিচারিক হত্যার শিকার হচ্ছে। পুরো কাশ্মীর জুড়ে বিভিন্ন গনকবরে হাজার হাজার নাম না জানা হতভাগ্য কাশ্মীরীদের লাশ পাওয়া যাচ্ছে।
বইটি লেখক বাংলাদেশের ২০১৮ সালে কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনকালে নির্যাতিত শিক্ষার্থীদেরকে উৎসর্গ করেছেন। বিষয়টি আমার ভালো লেগেছে। কারণ এরাও কাশ্মীরের জনগণের মতো নিজেদের ন্যায্য অধিকার আদায় করতে গিয়ে সহিংসতার শিকার হয়েছে।
কাশ্মীর সম্পর্কে আমার মতো আগ্রহী পাঠকরা এই ছোট্ট বইটি পড়ে একনজরে কাশ্মীরের ইতিহাস ও রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহ সংক্ষেপে জেনে নিতে পারবেন। সংক্ষিপ্ত পরিসরে রচিত হলেও বইটি খুবই তথ্যবহুল। এই বইটি বাংলা ভাষায় কাশ্মীরের রাজনৈতিক ইতিহাস সংক্রান্ত বইয়ের ঘাটতি কিছুটা হলেও পূরণ করবে বলে আমি মনে করি।
© শাহরিয়ার রশীদ খসরু
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?