কনফেশনস অব আ শিনাগাওয়া মাংকি : হারুকি মুরাকামি | Confessions of a Shinagawa Monkey

  • নাম : কনফেশনস অব আ শিনাগাওয়া মাংকি
  • লেখক : হারুকি মুরাকামি
  • অনুবাদ : আলভী আহমেদ
  • জনরা : ছোটগল্প
  • প্রচ্ছদ : সব্যসাচী মিস্ত্রি
  • প্রকাশনী : বাতিঘর
  • পৃষ্ঠা সংখ্যা : ১৩৬
  • মুদ্রিত মূল্য : ৩০০-/

বছরের শুরু থেকে মারাত্মক এক বিষণ্ণতার সম্মুখীন হয়। নিজের জগতের সমস্ত কোষ যেন খসে পড়ছিল। আর আমি সমস্ত গা এলিয়ে তাকিয়ে থাকতাম বিষণ্ণ চোখে; আকাশের দিকে। এই সময়টাতে কিছু লেখকের কর্ম গোগ্রাসে গিলেছি। মানুষ নিজেই যখন দুমড়েমুচড়ে বিষণ্ণতার তলানীতে চলে আসে, তখন আকাশ হয়ে পাশে দাঁড়ায় পরাবাস্তব আর বিষণ্ণতার এক কারিগর। পৃথিবীতে মানুষ তাকে নাম দিয়েছে হারুকি মুরাকামি নামে!

আজকের মজলিসের আসর তাঁকে নিয়েই উপায়িত। আর এই উপাখ্যানের শুরুর জন্য যেতে হবে বেশ কিছু বছর আগে। জাপানের এক হট স্প্রিং শহরে। জাপানে কিছু শহর আছে যেগুলোকে বলে ওনসেন। ইংরেজিতে হট স্প্রিং। এসব শহরকে ঘিরে জাপানে গড়ে উঠেছে পর্যটন উপশহর। আমাদের গল্পটিও এমন এক ওনসেনকে নিয়ে।
ঠিক পাঁচ বছর আগের ঘটনা। গুনমো এলাকায় এক সুনশান জাপানিজ মোটেলে উঠে গল্পের প্রোটাগনিস্ট চরিত্র। আমরা তাকে গল্পকথক বলতে পারি। তো মোটেলটার অবস্থা ছিল একদমই জীর্ণশীর্ণ। অনেকটা তালিতপ্পা মেরেই চলছিল। গল্পকথকের মূলত এই এলাকাতে ঘুরে বেড়ানোর জন্যই আগমন। হেমন্তের শেষের দিক। সারাদিন অনেক ঘুরাঘুরির পরে শেষমেষ জাপানিজ এই মোটেলটাতেই উঠে গল্পকথক।
মফস্বলে নিস্তেজ চলার মতো একখানা মোটেল। ডিনারের ও ব্যবস্থা নেই। কোনো ভাবে চলছে। এমনি ভগ্নদশা যেকোন মুহুর্তে ভূমিকম্প হলেই ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা জোরালো। যাই হোক, গল্পকথক মোটেলে তার রুমে ডুকে ব্যাগগোছরা রেখে বের হয়ে যায় কিছু খেতে। কাছেই একটা সোবা নুডলসের দোকানে রয়েছে। সেখানে বসে তিনি কিছু খেয়ে নেই কোনোরকমে। কিছু না খেয়ে ঘুমানোর চেয়ে অন্তত কিছু খেয়ে বিছানায় যাওয়াটা ভালো।
খাওয়া শেষ করে রুমে চলে আসে গল্পকথক। রুমে ফিরে এসে দ্রুত চলে যায় নিচতলাতে শাওয়ার নিতে। কিন্তু অবাক করার মতো বিষয় হলো এমন ভাঙ্গাচোরা মোটেলে শাওয়ারের জন্য বেশ আলিশান ব্যবস্থা। গল্পকথক বেশ আরামেই শাওয়ার নিতে শুরু করে বাথটাবে। শহরের একদম শেষের দিকে মোটেলটির অবস্থান হওয়াতে মানুষের ভীড়েরও প্যারা ছিলনা। বেশ একা শান্তিতেই তাই গল্পকথক বাথটাবে ডুবে আছে।
এমন সময় অদ্ভুত এক ব্যাপার ঘটে যায় রুমে!
 বাথরুমের স্লাইডিং কাচের দরজাটা ঠেলে একটা বানর এসে উপস্থিত হয় রুমে। আর অবাক করার মতো ব্যাপার হলো বানরটা মানুষের ভাষায় কথা বলতে পারে। এসেই গল্পকথকের কাছে অনুরোধ করলো তার পিঠে সাবান লাগিয়ে দিবে। সম্মোহনী শক্তির মতোই রুমটা অদ্ভুত রকমের নীরব হয়ে গেল। বানরটা গল্পকথকের পিঠে সাবান দিতে দিতে বলতে শুরু করে সে টোকিওর শিনাগাওয়ার এক বাড়িতে দীর্ঘদিন ছিল। এভাবেই সে আস্তে আস্তে মানুষের ভাষা থেকে শুরু করে মানুষের সমস্ত স্বভাব নিজের অস্তিত্বে অনুধাবন করতে শুরু করে।
শেষ পর্যন্ত দেখা গেল নিজের স্বজাতির সাথেই তার বিশাল দুরত্বের পাহাড় এসে যায়। এবং সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা সে নিজের গোত্রের কোনো বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ বোধ করেনা। মেয়ে বানরদের প্রতি তার যৌন আকর্ষণ হয়না। তার ভাল লাগে মেয়ে মানুষকে! এই ভাল লাগা থেকেই সে ঘটিয়ে ফেলে এক চরম ঘটনা। প্রায় সাতটি মেয়ে, বানরটির এই ঘটনার ভুক্তভোগী! এমন অবস্থা যে মেয়েগুলো নিজের নাম পর্যন্ত আর স্মরণে রাখতে পারেনা। কিন্তু কী এমন করে যার ফলস্বরূপ মেয়েদের এই অবস্থা হয়? 
আর কয়জনের বা এমন ঘটনার মুখোমুখি হতে হবে সামনে?
এই নিয়ে এগিয়ে যাবে যাবে হারুকি মুরাকামির গল্প কনফেশনস অব আ শিনাগাওয়া মাংকি। মুলত এটি মুরাকামির ছোটগল্পের সংকলন। নাম শিরোনামের গল্পটি ছাড়াও মোট আটটি গল্পের সমন্বয়ে এই গল্পগ্রন্থটি আলভী আহমেদের হাত ধরে আসে ২০২১ এর ডিসেম্বরে। বইয়ের অপর গল্পগুলো হলো ফার্স্ট পারসন সিঙ্গুলার, দ্য ইয়ার অব স্প্যাগেটি, ম্যান-ইটিং ক্যাটস, স্যামসা ইন লাভ, আ উইন্ডো, বার্ন বার্নিং এবং বার্থডে গার্ল। প্রতিটি গল্পই পাঠককে নিয়ে যাবে এক নিজস্ব বানানো জগতে অথচ ভীষণ রকমের বাস্তবতায় ভরা। এ প্রসঙ্গে মুরাকামি বলেন,
“উনিশ আর বিশ শতকের প্রথম দিকে লেখকরা আসল জিনিস উপস্থাপন করতেন। সেটাই ছিল তাদের কাজ। ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’-এ তলস্তয় যুদ্ধক্ষেত্রকে এত কাছ থেকে নিখুঁতভাবে বর্ণনা করেছেন যে পড়তে পড়তে পাঠক ওটাকে বাস্তব বলে ধরে নিত।
​কিন্তু আমি তা করি না। আমি এই পৃথিবীটাকেই আসল ভাবি না। ভান করি, আমরা একটা বানানো পৃথিবীতে বাস করছি। প্রতিদিন সন্ধ্যায় টিভিতে যে নিউজ দেখি, সেটা বানানো। আমরা একটা কৃত্রিম যুদ্ধে লড়াই করছি। সরকারটাও আমরাই বানিয়েছি। তবে এই বানানোর ভঙ্গিতে আমাদের বাস্তবতাকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব। আমার গল্পগুলো ওইরকম। একটা বানোয়াট দৃশ্যে যখন আমরা হেঁটে যাই, তখন ওই হাঁটাটা আমাদের কাছে বাস্তব হয়ে ওঠে।
​ডিটেইলিং আমার খুব পছন্দের কাজ। তলস্তয় ডিটেইলিং করে সামগ্রিক একটা ছবি আঁকতে চাইতেন। আমি ডিটেইলিং করি খুব ছোটো একটা অংশকে ঘিরে। আপনি যখন ছোটো ছোটো জিনিস ডিটেইলিং করবেন, তলস্তয়ের বিপরীতটা তখন ঘটবে। তলস্তয়ের লেখা রিয়েলিস্টিক হলে আপনার লেখা হয়ে পড়বে আনরিয়েলিস্টিক। আর এই জায়গাটাতেই আমি ফোকাস করতে চাই।”
​— হারুকি মুরাকামি (অনুবাদ: আলভী আহমেদ)
বিষণ্ণতার এই কারিগরের ছোটগল্পের বই আছে মোট পাঁচটি। সেগুলোতে এ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে মোট ৬২টি ছোটগল্প। আর কনফেশনস অব আ শিনাগাওয়া মাংকি এই বইটি তাঁর আটটি গল্পের বাছাই করা সংকলন। এর মধ্যে থাকছে ২০২১-এ প্রকাশিত মুরাকামির সর্বশেষ গল্প সংকলন ফার্স্ট পারসন সিঙ্গুলার থেকেও দুটো গল্প আছে এই গল্পগ্রন্থে।
হারুকি মুরাকামির গদ্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য সূক্ষ্মতা ও রহস্যময় আবেশ। তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলোও অদ্ভুত রকমের সরল আর জাদুর মতো বাস্তব। প্রকরণের দিক থেকে এই বইয়ের গল্পগুলোকে নির্দিষ্ট কোনো ধাঁচে ফেলা কঠিন। কিন্তু গল্পগুলোর সাধারণ যে বৈশিষ্ট্য পাঠককে আকৃষ্ট করে তা অন্তর্মুখী, প্রায়শই আত্মবিশ্বাসহীন। ঠিক জীবনানন্দের মতো। জীবনানন্দের আকাশলীনা কবিতা যেন আত্মবিশ্বাসহীনতার স্বরূপ। কবি মনপ্রাণ দিয়ে চায় সুরঞ্জনাকে। অথচ তাকে বেঁধে রাখার শক্তি বেরিয়ে আসছে আকুতি হয়ে। তিনি লিখেছেন,
“সুরঞ্জনা, ওইখানে যেওনাকো তুমি,
বোলো নাকো কথা ওই যুবকের সাথে;
ফিরে এসো সুরঞ্জনা:
নক্ষত্রের রুপালি আগুন ভরা রাতে;”
এই জায়গাতে মুরাকামিও তেমন ছাপ ফেলে যায় পাঠক মননে। মুরাকামির গল্প পড়তে পড়তে নিঃসঙ্গতার একটা চোরা স্রোত বয়ে যায় পাঠকের ধমনিতে।
আধুনিক মানুষের দৈন্যতা কোথায় হারুকি মুরাকামি সেটা জলের মতো উন্মোচিত করে দেয়। তাঁর লেখার কিছু গল্প অস্বস্তি তৈরি করে; মনে দাগ কাটে। কোনো কোনো গল্প আপনাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাবে কমফোর্ট জোনের বাইরে। যেন চেনা পৃথিবীর গল্প নয় এগুলো নয়। এসব সত্ত্বেও পৃথিবীব্যাপী কোটি কোটি পাঠক কেন মুরাকামির লেখা ভালোবাসবে? বেস্টসেলার বইগুলো তরতরিয়ে অনুবাদ হচ্ছে দেশে দেশে। এই গল্পগুলো পড়লে তা বোঝা যাবে।
আর বস্তুত এই জন্যেই হারুকি মুরাকামির উপন্যাস হট কেকের মতো বিক্রি হয়। বিশ্ব জুড়েই তাঁর পাঠক। এর প্রমাণ তাঁর সাহিত্যকর্ম ৫০টিরও বেশি ভাষায় অনুবাদ হওয়া। উপন্যাস ছাড়া তিনি অনেকগুলো ছোটগল্পও লিখেছেন। তাঁর গল্পের প্লট প্রায়শই বাস্তব আর পরাবাস্তবের যোগসাজশে গড়ে ওঠে। সম্প্রতি প্রকাশিত তাঁর ‘শীনাগাওয়ার এক বানরের স্বীকারোক্তি’ গল্পটিও তাই। মূল জাপানিজ থেকে ফিলিপ গাব্রিয়েল কর্তৃক ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে Confessions of a Shinagawa monkey.
আলভী আহমেদের বঙ্গানুবাদে এই গল্পগুলো পাঠকের ধমনীতে নিসঙ্গতার এক খরস্রোতের মতো বয়ে যাবে। চমৎকার আর সাহিত্যভরা শব্দচয়নের সমাহার। মুলত আলভী আহমেদের লেখার অভ্যাস গড়ে উঠেছে নিজের নাটক, সিনেমার চিত্রনাট্য আর গল্প লিখতে গিয়ে। মুরাকামির অনুবাদ ছাড়াও মৌলিকেও লেখক তার জৌলুশতা বজায় রেখেছে। তাঁর মৌলিক উপন্যাস জীবন অপেরা ও গল্পগ্রন্থ ব্লাইন্ডস্পট প্রকাশিত হয়েছে ২০২১-এ। তার আলোচিত ইংরেজি গল্পগ্রন্থ ঢাকা ড্রিমস বিশ্বব্যাপী পাঠকের সম্মুখে এনে হাজির করেছে অ্যামাজন। – লাবণ্যশাহিদা
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?