একাকিত্ব
…………………………..
একাকিত্ব হচ্ছে নিজেকে সবার থেকে দূরে রাখা কিংবা কারোর সাথে সঙ্গ না দেওয়া। এককথায় নিজেকে সবার থেকে গুটিয়ে নেওয়াকেই একাকিত্ব বলা হয়। একদা এক মেয়ে ছিলো।
নাম ছিলো তার অপর্ণা। অনার্স ১ম বর্ষের মনোবিদ্যা বিভাগের ছাত্রী। পড়াশোনায় ছিলো অনেক মেধাবী। ২য় সেমিস্টার পরীক্ষা শুরুর কিছুদিন আগে তার জীবনে নেমে আসে এক বিষাদ কালো অন্ধকার। অপর্ণার আম্মু ক্যান্সারে আক্রান্ত হলে তার আম্মুকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। এদিকে অপর্ণার ২য় সেমিস্টারের পরীক্ষা দরজায় কড়া নাড়তে থাকে। পরীক্ষা শুরুর তিন দিন আগে রাত ৯ টা ৪৫ মিনিটে অপর্ণার মা ইহলোকের মায়া ত্যাগ করে পরলোক গমন করেন। অপর্ণার পরিবারের সবাই ভেঙে পড়ে। পরেরদিন সকাল হলে আত্নীয় স্বজন সবাই তাদের বাড়ি আসে। বাড়ির অন্দরমহল জুড়ে একটা থমথমে পরিবেশ। কেউ কাঁদছে, কেউ কেউ নীরব হয়ে বসে আছে। অন্যদিকে অপর্ণা তার কক্ষে একাকী আনমনে বসে আছে। তার মাথার উপর থেকে যেন ছাদটা সরে গেলো। কারণ, যার মা নেই তার কেউ নেই। পরিবারের সবচেয়ে আপন মানুষটা যখন সবাইকে ছেড়ে চলে যায় তখন কারোর বোধ জ্ঞান থাকেনা। মায়ের ভালোবাসা যে কত মধুর সেটা যার মা নেই সে-ই একমাত্র বুঝতে পারে। যোহরের নামাজের পর অপর্ণার মায়ের জানাযা হয়। দুপুর ২ঃ৩০ এ দাফন সম্পন্ন করা হয়। তারপর থেকেই অপর্ণার জীবনের কালো অধ্যায়ের শুরু। অপর্ণা সব সময় একা একা থাকতো। তার কক্ষে দরজা বন্ধ করে একা একাই কান্না করতো। মায়ের সাথে তোলা ফ্রেমে বাঁধানো ছবিটার দিকে সারাক্ষণ চেয়ে থাকতো। বিড়বিড় করে কি যেন বলতো। অপর্ণার ফুফু বলতো সে তার মায়ের ছবির সাথে একা একাই কথা বলে আর চোখের জলের অশ্রুবিসর্জন দেয়।
খাবার খেতে চাইতোনা সে। খাবার নিয়ে গেলেই বলতো আমার মা-কে এনে দাও।আমি মায়ের হাতে খাবার খাবো। অপর্ণার আব্বুও অনেকটা ভেঙে পড়েন। তার উপরে মেয়েকে নিয়ে চিন্তা তো আছেই। ধীরে ধীরে অপর্ণা সাধারণ জীবনে সরে আসতে লাগলো। এখন যদিও সে একা একা থাকে কিন্তু অল্প খাবার খায় মাঝে মাঝে।
একদিন বিকেলবেলা অপর্ণা গেলো সুপারশপে। ঘরের কিছু কেনাকাটা করবে বলে। একটা সময় সব কেনাকাটা শেষ হয়। তখন পিছন ফিরে তাকাতেই দেখে তার আম্মু সাথে। কিন্তু সে জানতোনা এটা তার মোহ ছাড়া আর কিছুই নয়। সে তার মা-কে বলে, তোমার সব পছন্দ হয়েছে আম্মু? একটা ছবির ফ্রেম দেখতে গিয়ে আবার সে পিছনে তাকিয়ে দেখে তার মা সেখানে নেই। তার ভেতরটা যেন আবার ভেঙে যায়। সুপারশপের বিল পরিশোধ শেষে গাড়িতে করে বাসায় ফিরে অপর্ণা। এসেই অন্য কোনো কিছু না করে মায়ের সাথে ফ্রেমে বাঁধানো সেই ছবিটার দিকে তাকিয়ে আনমনেই অঝোর ধারায় কাঁদতে থাক অপর্ণা।
তার ফুফু এসে তাকে সামলায়। রাতের আঁধারে কক্ষের বাতি বন্ধ করে দিয়ে ঘরের এক কোণে বসে আবার কাঁদতে থাকে সে। একাকীত্ব যেন তাকে কুড়ে কুড়ে খায়। তার বাবাও ব্যবসার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। পড়াশোনাও আর আগের মত ভালোভাবে করেনা সে। যে-ই অপর্ণা ক্লাসের সবচেয়ে ভালো ছাত্রী ছিলো সে-ই অপর্ণা ক্লাসে উদাস হয়ে বসে থাকে। প্রতিদিন রাত হলেই মায়ের ছবির দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে কি যেন বলতে থাকে। এক রাতে তার ফুফু তার সাথে ঘুমোয়। মাঝ রাতে কারোর কান্নার শব্দে ঘুম ভেঙে যায় অপর্ণার ফুফুর। চোখ মেলে তাকাতেই দেখে অপর্ণা ঘরের এক কোণে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে আর বিড়বিড় করে বলছে, মা তুমি ভালো আছো তো? আমাকে ছাড়া কেমন আছো তুমি? তোমাকে ছাড়া আমি থাকতে পারছিনা মা। তুমি আমার কাছে আবার ফিরে আসো মা।
এসব দেখে অপর্ণার ফুফুও কান্নাকাটি করেন। ভাতিজিকে আদর করে জড়িয়ে ধরে বলেন, আমি আছি তো মা। আমিও তো তোর মা। আজ থেকে তুই আমাকেই মা বলে ডাকিস। অপর্ণা নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে ফুফুর সাথে আবার ঘুমানোর চেষ্টা করে। শুয়ে শুয়ে ভাবে, মা তো আর কখনো ফিরে আসবেনা এভাবেই উদাস মনে ঘুমিয়ে পড়ে অপর্ণা। সকাল হলে আবার সেই নিত্যদিনের রুটিন। প্রতিদিন রাতে একাকীত্ব কুড়ে কুড়ে খায় তাকে। নিজেকে সবার থেকে সরিয়ে নেয় সে। এভাবেই চলতে থাকে অপর্ণার একাকীত্বের কালো অধ্যায়।
লেখকঃ- মোঃ ফিরোজ
ভলেন্টিয়ার কন্টেন্ট রাইটার,
রাইটার্স ক্লাব বিডি।
Leave a comment