একটি সুসাইড কেস অতঃপর…(চতুর্থ পর্ব)
©মারুফ হুসাইন।
৯.
সজিবের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট এসেছে৷ তার গলা কাটার আগে ঘাতক পিছন থেকে রড বা এরকম কিছু দিয়ে মাথায় আঘাত করেছে। যার ফলে সে জ্ঞান হারায়। সে অবস্থাতেই কাস্তে দ্বারা তার গলার রগ কাটা হয়। তার মৃত্যু ঘটেছে রাত এগারোটার আগ-পরে। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট থেকে এর বেশী কিছু জানা গেলো না।
হাবিবার ফাইল পাওয়া গেলেও তাতে পানি পরে লেখা সব নষ্ট হয়ে গেছে৷ তাই এটা আমার কোনো কাজে দেয়নি। তাই ভাবলাম, পোস্টমর্টেম ডাক্তারের সাথে দেখা করলে হয়তো পোস্টমর্টেম রিপোর্টটা উদ্ধার করা যাবে।
অফিস থেকে বের হতে হতে বিকেল হয়ে যায়৷ অবশ্য আজ অফিসে এসেছি দেরী করে৷ সকাল থেকে পেটে একটু ঝামেলা করছিলো।
তাই আর বের হয়নি৷ দুপুর দিকে একটু ঠিক মনে হয়েছে আর বেরিয়ে এসেছি। অফিস থেকে সোজা হাসপাতাল চলে গেলাম৷ ডাক্তারের সাথে দেখা করে রিপোর্টার কথা জিজ্ঞাসা করলাম৷ ডাক্তার বলল, ‘রিপোর্টের ডুপ্লিকেট কপি আমরা সংগ্রহে রাখি। কিন্তু বের করে দেয়ার জন্য একটু সময় দেয়া লাগবে। এতো এতো রিপোর্টের মধ্য থেকে খুঁজে বের করতে সময় লাগবে৷’
‘সমস্যা নেই। আপনি বের করে রাখুন৷ আমি কাল এসে নিয়ে যাবো।’
‘একটু অপেক্ষা করলে আজই নিয়ে যেতে পারবেন।’
‘না ডাক্তার আমার শরীরটা একটু খারাপ। কাল এসেই নিবো।’
‘আপনি না আসলেও হবে৷ কাউকে পাঠিয়ে দিয়েন৷ আমি তার কাছে দিয়ে দিবো৷’
‘ঠিক আছে৷’
আমার নিজেরও ইচ্ছা ছিলো রিপোর্টটা নিয়ে তারপরই ফিরবো। কিন্তু শরীর দুর্বল লাগায় আর অপেক্ষা করলাম না৷ কাল নিবো বলে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে পরলাম৷ সন্ধ্যা হয়ে গেছে৷ সাড়ে সাতটা বাজে৷ বাড়ি ফিরতে ফিরতে দশটা বেজে যাবে৷
ট্রলার ঘাটে যখন পৌছাইলাম তখন নয়টার উপরে বাজে৷ ঘাটে কোনো ট্রলার নেই। সাধারণত সারা রাতই ট্রলার পাওয়া যায়। আজ হয়তো আমার ভাগ্য খারাপ৷ আমি ট্রলারের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর ট্রলার না পেলে বাড়িতে ফোন দিয়ে ট্রলার পাঠাতে বলা যাবে৷
আধ ঘন্টা অপেক্ষা করলাম। কোনো ট্রলার আসলো না৷ আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার কথা ভাবলাম৷
ট্রলার ঘাটে বসে মোবাইল ঘাটছি৷ সালেহার ফোন আসলো, ‘তুমি এখনো ফিরছো না কেনো?’
‘ঘাটে ট্রলার নেই। ট্রলারের জন্য অপেক্ষা করছি৷’
‘ট্রলার না থাকলে ফোন দিয়ে বলবে তো!’
‘ভাবলাম ট্রলার আসবে। ফোন দিয়ে শুধু শুধু তোমাদের বিরক্ত করার কি দরকার!’
‘এতো বেশী বুঝো কেনো! ট্রলার নেই। ফোন দিবে। এখান থেকে কাউকে পাঠাবো৷ এতে বিরক্ত করা না করার কি আছে!’ বলেই সালেহা ফোন কেটে দিল।
আমি ফোন রেখে রাস্তার দিকে তাকালাম। চার জন লোক আসছে। প্রথমে ভেবেছিলাম হয়তো ওপারের কোনো বাসিন্দা হবে। কাজ শেষে বাড়ি ফিরছে৷ কিন্তু তারা কাছে এগিয়ে আসতেই আমার ভুল ভাংলো। সামনে এসে অদ্ভুতভাবে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। চোখের নিচ থেকে গামছা পেঁচিয়ে সবার মুখ ঢাকা। আমার আর বুঝতে বাকি রইলো না, আমি মহা বিপদে পরে গেছি। তবুও নিজের নার্ভ ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করলাম৷
এই মুহূর্তে নার্ভাস হওয়া যাবে না। ঠান্ডা মাথায় ব্যাপারটা হ্যান্ডল করতে হবে। আমি চুপচাপ বসে রইলাম। মিনিটখানেক পর একজন লোক আমার দিকে এগিয়ে আসলো। বাকি তিনজন পিছনেই দাঁড়িয়ে রইল। এগিয়ে আসা লোকটার হাতে কাস্তে। আমাকে কাস্তে দেখিয়ে বলল, ‘যা আছে দিয়া দে!’
‘সরি? বুঝলাম না।’
লোকটা আরো দু ইঞ্চি সামনে এগিয়ে এসে চোখ-মুখ শক্ত করে বলল, ‘যা আছে চুপচাপ দিয়া দে বলছি।’
আমি মুচকি হাসলাম৷ পিছনের দিকে হাত দিলাম। কিন্তু পিস্তল নেই। মনে পরলো, আমার ডিউটি গান ঢাকার অফিসে। এখান থেকে কোনো পিস্তল নেইনি। এখন মনে হল একটা পিস্তল নেয়া দরকার ছিলো। আমি হতাশ হলাম। এখন যা করতে হবে হাত দিয়েই করতে হবে৷ কিন্তু এমন দানব দানব চারজনের সাথে একা পারাটা মুশকিল হয়ে যাবে। তবে চেষ্টা করতে কোনো দোষ নেই। আমি মাথা ঠান্ডা রেখে বললাম, ‘যদি না দেই?’
‘এইখানে মেরে ফেলে রেখে যাবো। কেউ কিছু টেরও পাবে না।’
‘আচ্ছা।’
‘শালার লগে এতো কথা কইতাসস কেন? একটা পোজ দে। দেখবি বাপ ডেকে সব দিয়া দিবো। কাস্তির পোস তো খায় নাই৷ খাইলে মজা বুঝবো।’ পিছন থেকে একজন বলে উঠলো।
কাস্তে হাতে লোকটা আমার দিকে আরো এগিয়ে আসলো। আমার গর্দানে কাস্তে ধরে মুখ বরাবর মুখ এনে বলল, ‘সব দিবি নাকি? কাম…..’
আমি লোকটার কথা শেষ করতে দিলাম না। নাক বরাবর এক ঘুষি বসিয়ে দিলাম। লোকটা কাস্তে ছেড়ে আধ হাত পিছে গিয়ে নাক মুখ চেপে ধরলো। আমি উঠে দাঁড়িয়ে লোকটার অন্ডকোষ বরাবর সজোরে এক লাথি দিলাম৷ লোকটা মুখ ছেড়ে অন্ডকোষ চেপে ধরে বসে পরলো। আচমকা হামলা বাকি তিন জন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো৷ দুইজন নিজেকে সামলে নিয়ে দ্রুত গতিতে আমার দিকে এগিয়ে আসল৷
বাকি একজন হাবলার মতো দাঁড়িয়ে রইলো৷ দুইজন কাছে এগিয়ে আসতেই একজন পেট বরারবর লাথি বসিয়ে দিলাম। সে ব্যাথায় পেট চেপে ধরলো। অপরজন আমাকে এক ধাক্কায় ফেলে দিয়ে আমার বুকের উপর চেপে বসলো। এলোপাথাড়ি আমাকে কিল-ঘুশি দিতে লাগলো।
আমি হাতড়ে কাস্তেটা হাতের কাছে পেয়ে গেলাম৷ নিজেকে সামলে নিয়ে লোকটার হাত ধরে আচমকা টানে বুকের উপর থেকে নামিয়ে তার উপর উঠে বসলাম। কাস্তের বাটালি দিয়ে কপালে সজোরে মেরে কাস্তে ফেলে দিলাম৷ নাকে-মুখে পাঁচ-সাতটা ঘুশি দিতেই লোকটা হাল ছেড়ে দিলো।
সম্ভবত অজ্ঞান হয়ে গেছে৷ চতুর্থ জন এসে পাথরের মতো কিছু একটা দিয়ে পিছন থেকে আমার মাথার বাম পাশে আঘাত করলো। আমি ছিটকে পরলাম। অনুভব করলাম মাথা ফেটে গেছে৷ চতুর্থ লোকটা আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। খেয়াল করলাম, প্রথম দুইজনও উঠে দাঁড়িয়েছে। তখনি ট্রলারের ইঞ্জিনের আওয়াজ শোনা গেলো। চতুর্থ যে লোকটা এগিয়ে আসছিল। সে থেমে নদীর দিকে তাকিয়ে ট্রলার দেখতে পেয়ে বলল, ‘কেউ আসছে! ভাগ!’ বলে রোডের দিকে দৌড় দিল। তার পিছু পিছু বাকি দুইজন।
তৃতীয় জন অজ্ঞান হয়ে পরে রইল। মাথার ফেটে যাওয়া জায়গাটা চেপে ধরে বসে রইলাম। মিনিট দুয়েকের মাথায় ট্রলার ঘাটে এসে ভিড়লো। ট্রলার থেকে আসাদ নামলো। আমাকে পরে থাকতে দেখে দ্রুত এগিয়ে আসলো, ‘কি হয়েছে ভাইয়া? আপনার মাথা থেকে তো প্রচুর রক্ত পড়ছে।’ বলে আমাকে ধরে টুলে বসালো। সে কি করবে না করবে বুঝে উঠতে না পেরে তটস্থ হয়ে উঠলো৷ ‘আমার কিছু হয়নি।’ বলে আমি তাকে শান্ত করে পকেট থেকে ফোন বের করলাম। বুললবুলকে ফোন দিয়ে আসতে বললাম৷
১০.
আক্রমণকারী লোকটাকে পুলিশি হেফাজতে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। লোকটার মাথার ভিতরে জখম হয়েছে৷ অবস্থা গুরুতর। আমি ডাক্তারকে বললাম, ‘লোকটার সুস্থ হওয়া জরূরী। হয়তো কেসটার সাথে তার কোনো সম্পৃক্ততা আছে৷’ কিন্তু ডাক্তার কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারলো না। মাথায় কাস্তের বাটালির আঘাতের পর কিছু ঘুশি পড়ায় অবস্থা ক্রিটিকাল হয়ে গেছে। আমার মাথাতেও ব্যান্ডেজ করা হয়েছে।
কোনো সেলাই লাগেনি৷ ডাক্তার এক্সরে রিপোর্ট দেখে বলেছেন যে ভয়ের কিছু নেই। ভিতরে কোনো আঘাত লাগেনি৷ কিছু ঔষধ লিখে দিয়ে সেগুলো ঠিক মতো খেতে বলেছেন। আমি রাতেই হাসপাতাল থেকে ফিরে আসলাম। আসাদ আমার সাথেই ছিলো। সালেহাকে আগে কিছু জানানো হয়নি। শুধু বলেছিলাম, ‘একটা কাজ পড়েছে। আসতে একটু দেরী হবে।’
আসাদ আমার সাথে থাকবে শুনে আর সালেহা তেমন উচ্চ বাচ্য করল না। কিন্তু বাড়ি ফেরার পর যখন দেখলো মাথায় ব্যান্ডেজ। তখন সে আমাকে সহমর্মিতা দেখানোর বদলে আরো ঝাড়তে লাগল, কেনো আমি এখানে এসে এসবে জড়াচ্ছি। তখন শশুড় আব্বা তাকে ধমক দিয়ে বলল, ‘ছেলেটা আঘাত পেয়েছে। তুই তাকে একটু আদর-যত্ন করবি। না উল্টা আরো চেচাচ্ছিস!’
‘কয়দিন পর পর ই সে উমুক চোর, তুমুক ডাকাতের থেকে মার খেয়ে আসে। এখানে আসলাম একটু শান্তিতে থাকার জন্য৷ কিন্তু সে কিনা এখানে এসেও চোর-ডাকাতের পিছনে লেগে গেছে৷ কোন আউশে যে তারে বিয়ে করতে গেলাম।’ সালেহা ননস্টপ কথা বলেই যাচ্ছে৷ এই ফাকে শাশুড়ি আম্মা আমাকে এটা সেটা এনে যত্ন করে খাওয়ানো শুরু করলো, ‘বাবা! তুমি খাও! ও পাগল বকবক করতে থাকুক।’
আমি রাতে খাওয়া-দাওয়া করে ঐষধ খেয়ে ঘুমিয়ে গেলাম।
মোবাইলের রিংটোনে ঘুম ভাংলো। মোবাইল হাতে নিয়ে দেখি বিকেল চারটা বাজে। পাক্কা তেরো ঘন্টা ঘুমিয়েছি৷ মাথা চিনচিন ব্যাথা করছে৷ কল ধরতে ইচ্ছে করছে না। একবার কেটে দ্বিতীয় বার বাজতে শুরু করলো।
অপরিচিত নাম্বার। রিসিভ করবো কিনা ভাবতে ভবতে ধরেই ফেললাম, ‘হ্যালো!’ বলতেই ওপাশ থেকে বলা শুরু করলো, ‘কাল বিকেল তিনটায় বাজারের ভিতরের গ্রামীনের টাওয়ারের নিচে এসে দাঁড়াবেন৷ একা আসবেন। জরূরী কথা আছে। সাথে কাউকে আনবেন না। আসলেই আমার ব্যাপারে জানতে পারবেন৷ এখন কিছু জিজ্ঞাসা করবেন না। ঠিক তিনটাই চলে আসবেন।’ লোকটা এক টানা কথাগুলো বলেই কল কেটে দিলো।
আমি ব্যাক করলাম। ফোন বন্ধ। আমার বুঝে আসলো না, লোকটা কে? আর কেনোই বা এভাবে বলল? লোকটা কি আমাকে বিপদে ফেলতে চাচ্ছে? নাকি কোনো সহযোগীতা করবে? নানা রকম প্রশ্ন আমার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো।
আমি বিছানা থেকে উঠে বসলাম। মাথায় প্রচন্ড ব্যাথা করছে৷ উঠে দাঁড়ালাম৷ বাথরুমে যাওয়া দরকার। আবার মোবাইল বেজে উঠলো৷ বুলবুলের ফোন। রিসিভ করতেই বলল, ‘গতকালের আক্রমণকারি লোকটা মারা গেছে।’ আমি কল কেটে দিলাম।
আমার মাথায় নানা ভাবনা ঘুরুপাক খেতে লাগল, ‘লোকগুলো ছিনতাইকারির মতো আমাকে আক্রমণ করেছিল। তারা কি ছিনতাইকারি নাকি অন্য কোনো রহস্য আছে? লোকটা বেঁচে থাকলে তো কোনো একটা কূল পাওয়া যেতো৷ এখন সেটাও বন্ধ হয়ে গেলো। হঠাৎ আমার মনে হল, কেসটাকে যতটা ক্রিটিকাল ভেবেছিলাম তার চেয়েও বেশী ক্রিটিকাল।’ ব্যাপারগুলো ভাবতে গিয়ে মাথার যন্ত্রণা আরো বেড়ে গেলো। আমি শুয়ে পড়লাম৷ চোখ বন্ধ করে মাথার ভাবনাগুলো দূর করার চেষ্টা করতে লাগলাম।
চলবে……..