একটি শব্দ এবং আমাদের আজকের মনোজগত

| একটি শব্দ এবং আমাদের আজকের মনোজগত | 

ঘটনা: ০১
আমি তখন জাওয়ার মাদরাসায় পড়ি। চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী। পাশেই খাঁ বাড়ি। সেই বাড়ির একজন লেখক আছেন। হঠাৎ হঠাৎ বাড়ি আসেন। একদিন কৌতূহল জাগল লেখককে দেখার। একজনের সঙ্গে গেলাম তার সঙ্গে দেখা করতে। তিনি বৈঠকঘরেই ছিলেন। আমাকে দেখে খুব সুন্দর করে আদুরে ভাষায় কাছে ডাকলেন। এরপর অন্যদিকে মনোযোগ দিলেন। আমি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর বসতে বললেন। জানতে চাইলেন আমরা বাংলা, ইংরেজি, গণিত ইত্যাদি পড়ি কি না! আমি বললাম, ‘পড়ি তো’। আমি কোনো বাংলা কবিতা মুখস্থ পারি কি না জানতে চাইলেন। প্রথমে আমি আমাদের পাঠ্য বইয়ের ‘মুনাজাত’ কবিতাটি বলতে শুরু করি। ‘শুনো দয়াময় আরজু আমার…’ বলতেই তিনি থামিয়ে আরেকটি বলতে বললেন। ‘এই করিনু পণ মোরা এই করিনু পণ’ বলতেই আবার থামালেন। বললেন রবীন্দ্রনাথের কোনো কবিতা জানো? আমি ‘মেঘের কোলে রোদ হেসেছে…’ শুনালাম। তিনি সামনে থাকা লোকজনকে বললেন, “দেখো, এইসব মেধাবী ছেলেদের জীবনটাই নষ্ট করছে মাদরাসাগুলো। পড়াশোনার নামে ‘ভিক্ষা’ আর লিল্লাহ-সদকা খাওয়ানো শিখাচ্ছে।” 
আমার খারাপ লাগল। বের হয়ে চলে এলাম। তিনি ছিলেন কথা সাহিত্যিক রাহাত খান।
ঘটনা: ০২
আমার খুব কাছের আত্মীয়। তিন ছেলের মধ্যে বড় দুই ছেলে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়েছে। পরিবারের ছোটটাকে মাদরাসায় পড়ানোর নিয়ত করেছে। ছোট ছেলেও সেইভাবেই মানসিক প্রস্তুতি নিয়েছে। পঞ্চম শ্রেণি পাশ করে মাদরাসায় ভর্তি হয় ছেলেটি। খুব উৎসাহ নিয়ে পড়তে থাকে। মাদরাসার শিক্ষকগণের কাছে বেশ সমাদৃত হয় সে।
দুই বছর পর একদিন হঠাৎ শুনি তাকে আবার স্কুলে ফেরত আনা হয়েছে। আমি তার সঙ্গে কথা বলি। সে জানায়, “আমাকে সবাই বলে সারা জীবন ‘ভিক্ষা’ করে নাকি খাইতে হবে মাদরাসায় পড়লে। আমার বড় ভাইদের গোলামি করেই নাকি আমার জীবন চলবে। আমার ভয় লাগতে শুরু করেছে। তাই মাদরাসা ছেড়ে দিয়েছি।”
ঘটনা: ০৩
দুই হাজার তিন সাল। অনার্স প্রথম বর্ষের নন মেজর বিষয় সমাজ কর্মের ভূমিকা আমাদের পাঠ্য। সমাজকল্যাণ বিভাগে ক্লাস হয় আমাদের। খুব আগ্রহ নিয়ে ক্লাস করছি। 
সমাজের নানা বিষয় নিয়ে নতুন নতুন জিনিস শিখছি। স্যারও খুব মজা করে ক্লাস নেন। সোস্যাল ইন্টারেকশন, মৌল-মানবিক চাহিদা ইত্যাদি বিষয়ের ক্লাস উপভোগ করছি।
একদিন আমাদের ক্লাসের বিষয় ছিল সামাজিক সমস্যা। সেই সমস্যার মধ্যে ‘ভিক্ষাবৃত্তি’ অন্যতম একটি। ভিক্ষাবৃত্তির সংজ্ঞা বলা হয়েছিল অনেকটাই এমন: ‘ব্যক্তি তার ব্যক্তিগত মৌলিক চাহিদা মেটানোর জন্য মানুষের কাছ থেকে হাত পেতে যা নেয়; সেই নেওয়াটাকে যদি পেশা হিসেবে গ্রহণ করে, তাহলে তা ভিক্ষাবৃত্তি নামে অভিহিত হবে।’ বহুদিন আগের ক্লাস লেকচার। কিছু শব্দ এদিক-সেদিক হতে পারে। এই সংজ্ঞায় ‘ব্যক্তিগত মৌলিক চাহিদা’ কথাটা গুরুত্বপূর্ণ আমাদের এই লেখার জন্য।
স্যার তখন ভিক্ষাবৃত্তির তালিকা দিতে গিয়ে বললেন, মাজার, মসজিদ, মাদরাসার নামে জনগণের কাছ থেকে চাঁদা নেওয়াও ভিক্ষাবৃত্তি। ক্লাসে আমরা কয়েকজন আপত্তি জানালাম। স্যার বললেন, ‘দেখো, আমি নিজেও মসজিদ ও মাদরাসার জন্য কালেকশন করাকে ভিক্ষাবৃত্তি মনে করি না। কিন্তু সমাজকল্যাণ এইটা মনে করে। তোমরা পড়তে এসেছো। পরীক্ষা দিবে নম্বর পাবে। পাশ করবে। এর বাইরে সিরিয়াসলি নিয়ো না এইসবকে।’
তিনটি ঘটনাতেই আমরা দেখি, মসজিদ মাদরাসার জন্য মানুষের কাছে হাত পাতাকে আক্ষরিক অর্থেই ‘ভিক্ষাবৃত্ত’ বলা হয়েছে। এই বলাটা কি সহজাত? না পরিকল্পিত? আমি মনে করি এই বলাটা বা এই শব্দের ব্যবহারটা পরিকল্পিত। কিন্ত যারা এইটা নিয়মিত ব্যবহার করেন, তারা সেই পরিকল্পনার সঙ্গে পরিচিত না। ফলে, চেতনে-অবচেতনে ‘ভিক্ষাবৃত্তি’ শব্দটা ব্যবহার করছে অনেকেই। গত শতকের শেষ দিকে এই শব্দটা মাদরাসা যারা অপছন্দ করত, মাদরাসা শিক্ষিতদের যারা বোঝা মনে করত, তারা ডিহিউম্যানাইজ করতে কোমল শিক্ষার্থীদের সামনে এই শব্দ ব্যবহার করত। আর যারা আরেকটু উচ্চ শিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবি, তারা পত্রিকার পাতা ও ক্লাস লেকচারে বলতেন।
ব্যাপকভাবে সাধারণ মানুষ এগুলো বলতেন না। সাধারণ জনগণকে দেখেছি মাদরাসার কালেকশনে ধান, চাল, টাকা দিয়ে নানান উপায়ে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করতে। আমি নিজেও কওমি মাদরাসায় পড়েছি। মৌসুমী ধান কালেকশন করতে গিয়েছি। যাঁরা চাঁদা দিতেন তাদেরকে কখনোই এইসব চাঁদাকে ভিক্ষাবৃত্তি বলতে শুনিনি। বরং যারা চাঁদা দিতেন না তারা আমাদের হুজুরকে দু-চার কথা শোনাতেন। কেউ কেউ বলতেন, ‘ছোট ছোট বাচ্চাদের এখনই ভিক্ষা করা শিখায়া ফালাইতেছেন!’ হুজুরকে এড়িয়ে যেতে দেখতাম। আমরাও তাদেরকে পথে-ঘাটে দেখলে সালাম দিলেও কথা বলতে চাইতাম না।
ধীরে ধীরে সমাজকর্মী, এনজিও কর্মী বাড়তে থাকে আমাদের সমাজে। শিক্ষার হার বাড়তে থাকে। মাদরাসা শিক্ষা। ইসলামি শিক্ষা নিয়ে ষড়যন্ত্রও সমানতালে চলতে থাকে। একটা সময় সমাজের সচ্ছল ও উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলেরা মাদরাসায় পড়তে আসতে থাকে। শিল্প-সিহিত্যের নামে কেউ কেউ মাদরাসার গণ্ডি পেড়িয়ে নানা চিন্তা ও মতবাদের মানুষের সঙ্গে মিশতে থাকে। একধরনের হীনম্মন্যজাত আভিজাত্য কারো কারো ভেতরে আসতে থাকে। এরা সমাজের একটা শ্রেণিকে সুপিরিয়র ভেবে নিজেদেরকে ইনফেরিয়র ভাবতে থাকে। 
যে ‘ভিক্ষাবৃত্তি’ শব্দটা বিরোধীদের শব্দ ছিল, আজকাল মাদরাসায় পড়ুয়া এবং পড়া শেষ করা অনেকেই আত্মসমালোচনার নামে মাদরাসা মসজিদের জন্য কালেকশনকে অবলীলায় ‘ভিক্ষাবৃত্তি’ বলছে। 
একটা শব্দ ক্রমাগত নানাভাবে নানামাত্রিক ব্যবহারে সেই শব্দ যাদের বিপক্ষে তারাও ব্যবহার করতে থাকে। আর আত্মপ্রবঞ্চিত হতে হতে আত্মপরিচয়হীন হয়ে যায়। ভাষারাজনীতির এ-ও এক জটিল দিক। এই রাজনীতিটা ধরতে না পারলে নিজেই নিজের প্রতিপক্ষ হয়ে, নিজের সর্বনাশ করার জন্য যথেষ্ট।
বর্তমানে সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেদারসে তরুণ আলেম ও মাদরাসা শিক্ষার্থী রীতিমতো ক্যাম্পেইন করে কালেকশন করে জনগণের চাঁদা নিয়ে মাদরাসা পরিচালনার বিপক্ষে মতামত দিচ্ছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোনো বিকল্প প্রস্তাবনা ছাড়াই তারা তাদের প্রতিবাদ জারি রাখছেন। আবার সেই প্রতিবাদীদের অনেকেই শিক্ষাজীবন শেষ করে কওমি মাদরাসার শিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত নন।
কেন চাঁদা ও কালেকশন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এড়ানো সম্ভব নয়? কেন এইটা দরকার? সেই বিষয়ে আলোচনার শেষে কথা বলব। এখন এই ‘ভিক্ষাবৃত্তি’ শব্দটা কেন রাজনৈতিক ও কেন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, তা নিয়ে বলি।
সাম্প্রতিক কালের কিছু কি ওয়ার্ড দেখুন আগে। ‘চ্যারিটি ওয়ার্ক’, ‘ক্রাউড ফান্ডিং’, ‘ত্রাণ তহবিল’, ‘এক টাকার খাবার’ ইত্যাদি নামে চাঁদা কালেকশন চালু আছে সোসাইটিতে। চ্যারিটি ক্রিকেট, চ্যারিটি ফুটবল ম্যাচ ইত্যাদি নামেও চাঁদা কালেকশন করে ‘ওয়ার্ল্ড ভিশনসহ’ বিভিন্ন এনজিও। এই দেশের এনজিও ও মিশনারিদের চাঁদা কালেকশনের বিষয়টা অবশ্য আরও মজার।
এখন আসুন, বন্যা দুর্গতদের জন্য ত্রাণ তহবিল গঠনে চাঁদা উঠালে, অসুস্থ কারো জন্য ক্রাউড ফান্ডিং করলে, পথশিশুদের জন্য এক টাকার মিল সংস্থা চালালে; আমাদের মিডিয়া তাদেরকে এপ্রিশিয়েট করে। আমাদের তরুণ আলেমরা সেইসব কালেকশনে খুব উৎসাহের সঙ্গে অংশগ্রহণ করেন। কখনোই এইরকম ফান্ডিংকে তারা ভিক্ষাবৃত্তি বলেন না। 
বাট, যখনই পৃথিবীর সবচেয়ে বেসরকারি চ্যারিটি শিক্ষাব্যবস্থা; যেখানে খাবারসহ মৌলিক চাহিদা মিটিয়ে একজন প্রান্তিক শিশুকে একটা বেটার লাইফ দেওয়া হচ্ছে, নৈতিক ও সমাজের জন্য উপকারি মানুষ হিসেবে তৈরি করে দিচ্ছে, তখন পরিকল্পিতভাবে সেইসব মাদরাসার জন্য হাতপাতা মুখলিস মানুষগুলোকে ‘ভিক্ষুক’ বলা হচ্ছে। দুঃখজনক বাস্তবতা হচ্ছে, এইসব চ্যারিটি প্রতিষ্ঠানে খেয়ে পড়ে যে আজকে সমাজে সম্মানজনক অবস্থানে এসেছে; সেও অতীত ভুলে তার শিক্ষকদের ভিক্ষুক বলছে। 
অথচ অন্যান্য যতগুলো চ্যারিটি এক্টিভিটি আছে; এর প্রায় কোনোটাই ব্যক্তিকে দীর্ঘ মেয়াদে একটা বেটার লাইফের জন্য তৈরি করে না। এর পরেও আমাদের ভাষারাজনীতি ও অপরাজনীতি এই মহান কাজকে ভিক্ষাবৃত্তি বলে যাচ্ছে। আর মাদরাসা পড়ুয়া দুর্বল চৈতন্যের কিছু মানুষকে শিকড়চ্যুত করছে।
কেন চাঁদা ও কালেকশন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এড়ানো সম্ভব না? প্রথম কারণ, এই দেশের শাসনব্যবস্থা কখনোই ইসলামি শিক্ষাবান্ধব না। রাষ্ট্রের অধীনে রাষ্ট্রীয় সুযোগ নিলে ইসলামি শিক্ষাকে আর ইসলামের মৌলিক পন্থায় দেওয়া সম্ভব হবে না। এছাড়া এই শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য জনগণের ভেতরে ইসলামের চৈতন্য জাগ্রত রাখা। জনগণ-বিচ্ছিন্ন হলে নিজস্ব অর্থায়নে এই শিক্ষা ব্যর্থ হবে। কারণ, এমন অনেক প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের দেখা গেছে তাদের মধ্যে একধরনের এলিটিজম-জনিত অহম এসে জায়গা নেয়। ফলে ইলম ও দ্বীনের খেদমত তাদের দ্বারা হয়ে ওঠে না। খেলাফত ব্যবস্থা না থাকলে ইলমের সিলসিলায় মুসলমানদেরকে গণমুখী হতে হবে। তাহলেই ইলম তার মূল লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে। যদিও আধুনিক পৃথিবীর অনেক দেশের উদাহরণ আনা যাবে যে, খেলাফত না থাকার পরেও তারা ইলমের ক্ষেত্রে বড় অবদান রাখছে। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে; সেই ইলম কতটুকু দ্বীন কায়েমের কাজে লাগছে।
কেন চাঁদা দরকার? পৃথিবীর খুব কম শিক্ষাই আছে যেখানে রাষ্ট্রের ভর্তুকি নেই। ফলে মাদরাসার জন্য, ইসলামি শিক্ষা ও মসজিদের জন্য জনগণ ভর্তুকি দেবে। এইটা খুব অসুন্দর কিছু না। 
এখন প্রশ্ন আসে; এসব চাঁদা তোলার পদ্ধতি অসুন্দর। আনস্মার্ট। চাঁদা অনেক ক্ষেত্রেই আত্মসাৎ হয়। আসলে, মাথাব্যথার জন্য মাথার চিকিৎসা করতে হয়। মাথা কেটে ফেলা যায় না। সকল অসুন্দরের বিপক্ষে বলার জন্য সুন্দর ভাষা আছে। সুন্নাহ সম্মত পদ্ধতি আছে। আমরা সেই পদ্ধতি অবলম্বন করি। কারো এজেন্ডার গিনিপিগ যেন না হই।
ভাষা ও ভাষার ব্যবহার মূলত একটা বিরাট পলিটিক্স। সেই পলিটিক্সটা ধরতে না পারলে নিজেই নিজের শত্রু হয়ে যেতে হয়। ব্যতিক্রম, সততা, ইলমি দায়বোধ, সংস্কার, জমানা, সময়ের ভাষা ইত্যাদি চটকদার শব্দের মোহে পড়ে কেউ তার নিজের অঙ্গনের বিপক্ষেই শত্রু শত্রু খেলায় অবতীর্ণ হয়। সেই ফাঁদ থেকে বাঁচতে হলে ভাষার প্রয়োগ, রাজনীতি ও শব্দ ব্যবহারের উদ্দেশ্যকে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করতে হবে আমাদের। তখনই কেবল আত্মপ্রবঞ্চিত হওয়া থেকে বাঁচা সম্ভব হবে।
সাইফ সিরাজ
কবি ও বিশ্লেষক
সিয়ান | বিশুদ্ধ জ্ঞান | বিশ্বমান
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?