Title একজন কমলালেবু PDF / পিডিএফ / বই রিভিউ
কভার ছবি : একজন কমলালেবু pdf |
“বরিশালের নদী, জোনাকি ছেড়ে তাঁকে পা রাখতে হয়েছে আদিম সাপের মতো ছড়িয়ে থাকা ট্রামলাইনের ওপর। পৃথিবীর দিকে তিনি তাকিয়েছেন বিপন্ন বিষ্ময়ে। বলেছেন সন্ধায় সব নদী ঘরে ফিরলে থাকে অন্ধকার এবং মুখোমুখি বসবার নাটোরের এক নারী”
“আলো-অন্ধকারে যাই—মাথার ভিতরে
স্বপ্ন নয়, কোন্ এক বোধ কাজ করে;
স্বপ্ন নয়—শান্তি নয়—ভালোবাসা নয়,
হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়;
আমি তারে পারি না এড়াতে,
সে আমার হাত রাখে হাতে,
সব কাজ তুচ্ছ হয়—পণ্ড মনে হয়,
সব চিন্তা—প্রার্থনার সকল সময়
শূন্য মনে হয়,
শূন্য মনে হয়”
কলেজ জীবনের প্রেমিকা মন খারাপের প্রতিষেধক হিসেবে এই কবিতাখানা আহ্লাদে আধখানা হয়ে শোনাতে চাইতো বারবার। কিংবা বনলতা সেন নামের সেই কাল্পনিক প্রেমিকার কবিতা শুনতে চাওয়ার অকৃত্রিম আবদার। এক কমলালেবুর সৃষ্টি কে ঘিরে সমগ্র জনগোষ্ঠীর কী এক অপরিমেয় ভালোবাসার সৃষ্টি!
জীবনানন্দকে আমরা ঠিক যেভাবে শুনে আসছি আসলেই কি সেই জীবনানন্দের জীবন আর আনন্দ পরষ্পর সমার্থক ছিল?
এইকয়দিনে বেশ কয়েকজন কে একটা প্রশ্ন করেছিলাম। সুইসাইডাল একটা মানুষের নাম কীভাবে জীবনানন্দ হয়? অনেকের অনেক যুক্তি। কেউ একজন ভাবনাচিন্তা না করেই উত্তরটা দিয়েছিল ঠিক এভাবে,
“কারন ওনার নাম যিনি রেখেছেন তিনি সুইসাইডাল ছিলেন না, আর তিনি ভাবতেও পারেন নি উনি একদিন এমন হতাশাজনক ভাবে জীবনকে দেখতে শুরু করবেন”
এই উত্তরে আমার শতভাগ সন্তুষ্টি। জীবনানন্দকে নিয়ে যতটুকু জানলাম তাতে এই ব্যাপারটাকে কোনোভাবেই ফেলে দেওয়া যায় না। ছোটোবেলায়( স্কুলজীবনকে হয়তোবা আপনি বড়বেলাও বলতে পারেন) জীবনানন্দ দাশের কবিতা পড়ার সময় অদ্ভুত এক ঘোরে থাকতাম। কবিতা বলতে তখন শুধু সেই পাঠ্যবইয়ের সিলেবাসে আবদ্ধ কবিতা। বোটানি পড়ানো সেই শিক্ষক নিজের সর্বোচ্চ মায়া মমতা দিয়ে আমাদের জীবনানন্দের কবিতা পাঠ করে শোনাতেন, বুঝিয়ে দিতেন। সেই কবি পরিচিতির একটা ক্ষুদ্র অংশ শুরু হয়েছিল তাঁর মায়ের পরিচিতির মাধ্যমে। হ্যাঁ! কুসুমকুমারী দাশ। মূলত মায়ের মাধ্যমেই জীবনানন্দের কবিতা লেখায় হাতেখড়ি। সেই সময় থেকে শব্দ অক্ষর আর ছন্দের মায়াজালে আবদ্ধ থাকা মা তাঁর সন্তানকে নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন ” কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে” উপমার বাস্তব প্রয়োগ ঘটাতে। মায়ের অনুপ্রেরণা আর দুঃসাহসিক অভিযানের কারণেই হয়তোবা আজকের এই জীবনানন্দ দাশ। “দুঃসাহসিক অভিযান ” ঠিক কতটা তাৎপর্যপূর্ণ তা আমার পক্ষে লিখে বোঝানো সম্ভব না। সেই সময়ে ডাক্তারের পরামর্শে সবার বিরুদ্ধে গিয়ে ছেলে জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে দিল্লি যাওয়াটা আমার ক্ষেত্রে দুঃসাহসিক অভিযানের চেয়ে বরং বেশি কিছু। বিশ শতকের একজন মহিলা নিজের সন্তানের বন্ধুদের নিয়ে সাহিত্য সভার আয়োজন করে, গতানুগতিক পাঠপদ্ধতির বিরোধিতা করে জীবনকে বুঝতে চাওয়ার যে তাগিদ; সেটাই উপরের উত্তরকে পুরোপুরিভাবে সন্তুষ্ট করে। কুসুমকুমারী দাশ উনুনের পাশে বসে নিড়ানি হাতে নিয়ে শব্দের খেলা করেছেন, জীবনানন্দের কবি হিসেবে পরিচিতি পাওয়ার জীবনটা কি ঠিক ততটাই সন্তুষ্টিতে ভরপুর ছিল? কিংবা জীবিত অবস্থায় আদৌও কি কবি হিসেবে যতটা পরিচিতি পাওয়ার ততটা পেয়েছিলেন?
“সকল লোকের মাঝে ব’সে
আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা?
আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
আমার পথেই শুধু বাধা?”
জীবনানন্দ তাঁর জীবনের প্রায় পুরোটাই কাটিয়েছেন দুঃখ-দুর্দশা, অপ্রাপ্তি আর সীমাহীন যন্ত্রনার মধ্য দিয়ে। ব্যাক্তি কিংবা পারিবারিক জীবনে সুখশান্তি তো ছিলোই না, কবি জীবনের ব্যর্থতা তাঁকে প্রতিনিয়ত বয়ে বেড়াতে হয়েছে।
সবাই যখন সমসাময়িক কবি লেখকদের লেখালেখি নিয়ে ব্যস্ত, ঠিক সে সময়টাতে তিনি আপন সত্তাকে পুরোপুরিভাবে সত্যের মানদন্ডে দাঁড় করিয়েছেন। তাঁর সমসাময়িক রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল কিংবা সত্যেন্দ্রনাথের লেখনশৈলীতে আবদ্ধ না থেকে নিজ কবিসত্তার প্রকাশ ঘটিয়েছেন দুঃসাহস নিয়ে। নানাদিক থেকে আসা তীরের জবাব দিয়েছেন কবিতার মাধ্যমেই। এমন সাদামাটা মানুষটাকে নিয়ে হাস্যরসের শেষ ছিল না কোনোকালেই।
আমারে সে ভালোবাসিয়াছে,
আসিয়াছে কাছে,
উপেক্ষা সে করেছে আমারে,
ঘৃণা ক’রে চ’লে গেছে—যখন ডেকেছি বারে-বারে
ভালোবেসে তারে;
তবুও সাধনা ছিলো একদিন–এই ভালোবাসা;
আমি তার উপেক্ষার ভাষা
আমি তার ঘৃণার আক্রোশ
অবহেলা ক’রে গেছি; যে-নক্ষত্র—নক্ষত্রের দোষ
আমার প্রেমের পথে বার-বার দিয়ে গেছে বাধা
আমি তা’ ভুলিয়া গেছি;
তবু এই ভালোবাসা—ধুলো আর কাদা।
পুরো কবিতার মধ্যে এই অংশটুকু আমার ভীষণ প্রিয়। উপরের পঙক্তিগুলো “বোধ” কবিতা থেকে নেওয়া। আমাদের চিরচেনা সেই কবিতাটা তখন সমসাময়িক কবিদের একজন “গোদ” নামে আখ্যায়িত করেছিলেন। কি সেই বোধ? আদৌও কি তার সমকক্ষ কেউ ছিল না সেই সময়টাতে জীবনানন্দের “বোধ” নিজের বোধগম্য করতে?
হয়তো ছিলো না! নয়তো ছিল, সন্তপর্ণে পাশ কাটিয়ে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে গিয়েছেন। জীবনানন্দ তার ডায়েরিতে ইউরোপের এক কবির রেফারেন্স টেনে বলেছিলেন “আমি আগামী প্রজন্মের জন্য লিখি না, তার পরের প্রজন্মের জন্য লিখি”।
পাঠ্যবইয়ের কবি পরিচিতিতে পড়েছিলাম,
জীবনানন্দকে অনেকেই নির্জনতার কবি হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন, রবীন্দ্রনাথ চিত্ররূপময় বলেছিলেন। নির্জনতা জেঁকে বসলেও কবি জীবনানন্দের কবি জীবনটা চিত্ররূপময় যে ছিল না তা অনায়াসেই বোঝা যায়।
পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে যখন তাঁর প্রথম কবিতা প্রকাশ হয় তখন থেকেই নানা বাধা বিপত্তি সৃষ্টি হয়। ব্যক্তিজীবনে কবি অন্তুর্মুখী ছিলেন আজীবনই। মানুষের সঙ্গ তাঁর অসহ্য লাগত। সাহিত্যিক আলাপ আলোচনার মধ্যে অন্যেরা যদি হাজার হাজার কথা বলতেন, জীবনানন্দের মুখ থেকে বেরুতো দু-একটি নিস্পৃহ মন্তব্য। সবাই সাহিত্য আড্ডায় যেতে বললে সে আড্ডা এড়িয়ে যেতেন তিনি। সেই অন্তর্মুখিতা তাঁর কবি জীবনেও প্রভাব ফেলেছে বরাবরই। তাই হয়তো তার জীবদ্দশায় প্রকাশিত কবিতার সংখ্যা সবেমাত্র ১৬২ টি। তাঁর লিখিত প্রায় আড়াই হাজার কবিতা, বিশটি উপন্যাস ও অজস্র ছোটগল্পের সবটুকু পড়ে ছিল ট্রাঙ্কে। তাঁর মৃত্যুর চল্লিশ বছর পর সেসব প্রকাশের মুখ দেখে।
আবদুল মান্নান সৈয়দ সম্পাদিত জীবনানন্দের প্রকাশিত অপ্রকাশিত কবিতাসমগ্রের ভূমিকার প্রথমাংশ ঠিক এভাবে শুরু ” জীবনানন্দ দাশ শুধু আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি নন, চৌদ্দ শো বছরের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের একজন নায়ক। অমলেন্দু বসু বলেছিলেন জীবনানন্দ ইয়েটস এর চেয়েও বড় কবি। প্রচলিত আছে মৃত্যুর আগে কেউ কাউকে ভালো বলে না। জীবনানন্দের ক্ষেত্রে তা শত ভাগ সত্য। লিখেছিলেন
“ আমি বিশিষ্ট বাঙালিদের মধ্যে পড়ি না; আমার বিশ্বাস জীবিত মহত্তর বাঙালিদের প্রশ্রয় পাওয়ার মতনও কেউ নই আমি। কিন্তু আমি সেই মানুষ, যে প্রচুর প্রতিকূলতা সত্ত্বেও প্রতিটি দ্রব্যকে সোনা বানিয়ে তুলতে চায় অথবা মহৎ কিছু– যা শেষ বিচারে কোনও একটা জিনিসের-মতন-জিনিস– কিন্তু ভাগ্য এমনই যে তার খাদ্য জুটছে না। কিন্তু আশা করি, ভবিষ্যতে খাঁটি মূল্যের যথার্থ ও উপযুক্ত বিচার হবে; আমার ভয় হয়, সেই ভালো দিন দেখতে আমি বেঁচে থাকব না।“
“যাঁরা সাধারণ মানুষ থেকে উচ্চগ্রামে বাস করেন, তাঁদের কাছে জীবনের সীমা এবং সময় স্রোত কেমন একটা সমস্যার মতো দেখা দেয়”।
জীবনানন্দ স্রোতের টানে গা ভাসিয়ে দেওয়ার লোক ছিলেন না। জগতের সমস্ত নিয়ম তাঁর মস্তিষ্কে চিন্তার চাপ ফেলত। সেসময়ের আপেক্ষিক তথ্য নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিলেন তিনি। এ জায়গাটায় একটা ভুল বুঝাবুঝি অনেকের মধ্যে হতে পারে। অথবা আমি নিজেই ব্যাপারটা ঠিক ততটা সঠিকভাবে নিজের ভেতরে ধারণ করতে পারি নি। এই যে ” যাঁরা সাধারণ মানুষ থেকে উঁচু গ্রামে”, ঠিক এই ব্যাপারটা রবীন্দ্রনাথ তাঁর এক কবিতায় নিজেকে আখ্যায়িত করেছিলেন। কিন্তু জীবনানন্দ নিজেকে সেই উঁচু জায়গায় বসিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু নিজ নিজ মতাদর্শের ভিত্তিতে দুজন ঠিক একে
অপরের বিপরীতে। সাধারণ হয়েও জীবনানন্দ আজ কত অসাধারণ!
পৃথিবী গাবে কি গান তোমার বইয়ের পাতা খুলে?
কিংবা যদি গায়,- পৃথিবী যাবে কি তবু ভুলে
একদিন যেই ব্যথা ছিল সত্য তার?
তাঁর কবিতার পৃথিবী আজ ঠিকই গান গাইছে। কিন্তু কি এমন ব্যাথার কথা বলেছিলেন তিনি?
“ভালোবেসে দেখিয়াছি আমি মেয়ে মানুষেরে
অবহেলা করে আমি দেখিয়াছি মেয়ে মানুষেরে,
ঘৃণা করে দেখিয়াছি মেয়ে মানুষেরে “
জীবনের চরম দুর্দশার মধ্যে লেখা “বোধ” নামের এই কবিতার সমালোচনার মুখে পড়েন বেশ জোরালোভাবে। সজনীকান্ত বলেছিলেন,
“কবি জীবনে সব করিয়াই দেখিয়াছেন, খালি বিবাহ করিয়া মেয়ে মানুষেরে দেখেন নাই। দেখিলে ভালো হইত। গরিব পাঠকেরা বাঁচিত”।
শোভনার প্রেমে মগ্ন থাকা জীবনানন্দ নিজের ভালোবাসার মানুষকে কাছে পান নি। বিয়ে করেছেন তাঁর ঠিক বিপরীত চরিত্রের এক সুর্দশন মেয়েকে। সাংসারিক জীবনের প্রায় পুরোটাজুড়েই তাঁর অসন্তুষ্টি আর অপ্রাপ্তি তে ভর্তি। দু’দণ্ড শান্তি চাইছিলেন কবি। কোথাও একটা পৌঁছাতে চাইছিলেন। স্ত্রী লাবণ্য দাশ কবির সামগ্রিক জীবন নিয়ে কতটা অসন্তুষ্ট সেটা কবির মৃত্যুর পরে লাবণ্য দাশের বক্তব্যে বোঝা যায়।
” জীবনানন্দ বাংলা সাহিত্যের জন্য তো অনেককিছুই রেখে গেলেন, আমার জন্য কী রেখে গেলেন?”
জীবনানন্দ দাশ তাঁর সৃষ্টিকর্মের এক বিশালাংশ জীবিত অবস্থায় প্রকাশ করেন নি। মৃত্যুর পর তাঁর ট্রাঙ্ক থেকে উদ্ধার করে প্রায় চল্লিশ বছর পর সেসব প্রকাশিত হয়।
সৈকত আমিনের এক কবিতার বইয়ে (ভেঙে পড়ে পুলসিরাত) পড়েছিলাম
“কবিতা পাঠ করুন এমন ভাবে-
যেন মৃত্যু পথযাত্রীর কানে শেষবার
কালেমা শোনাচ্ছেন আপনি”
অন্যান্য প্রিয় কবিতার মতো বোধ কবিতাটা আমার কাছে ঠিক তেমনি মনে হয়। অমৃত মনে হয় সামগ্রিক জীবন। অস্তিত্বের রহস্যময়তা ও কালস্রোতে কুটোর মতো ভেসে যাওয়া জীবন নিয়ে লেখা কবিতা আজকাল আমাদের সকলের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জীবনানন্দের চাকুরী জীবনের বিভীষিকা বলে শেষ করা যাবে না। ইংরেজি সাহিত্যে পড়াশোনা শেষ করে শিক্ষকতা পেশায় নিজেকে একরকম বাধ্য হয়েই নিয়োজিত করেন। ফলশ্রুতিতে শিক্ষকতা জীবন নিজে তো উপভোগ করেননি, পাশাপাশি ছাত্রদের বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছেন বারংবার। চাকুরী জীবনের নিশ্চয়তা ছিল না কোনো বয়সেই। চল্লিশোর্ধ্ব হয়েও চাকুরির আশায় এদিকওদিক ছুটেছেন, অক্লান্তভাবে ক্লান্ত শরীর নিয়ে কলকাতা শহর দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। চাকুরী জীবনের যা আয় রোজগার তা দিয়ে নিজেই চলা দায়, পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিবেন কীভাবে? সন্তান কিংবা নিজের স্ত্রীর প্রতি কোনোদিক থেকেই সুবিচার করতে পারেননি মিলু। মিলু, জীবনানন্দ দাশ নামে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র নামে যাকে আজ আমরা চিনি।
লেখালেখি জীবনে প্রতিনিয়ত ব্যর্থ হয়েছেন স্রোতের বিপরীতে গিয়ে। সেইসময়কার জনপ্রিয় লেখক বুদ্ধদেব বসু জীবনানন্দের পাশে না দাঁড়ালে হয়তোবা তাঁর কবি জীবনের সমাপ্তি ঘটতো জন্মানোর আগেই। নিজ স্ত্রীর কাছে কখনো নিজের লেখক সত্তার পরিচয় দিতে পারেন নি। একমাত্র নিজের পক্ষে কলম ধরার লোক বুদ্ধদেব বসু, পত্রপত্রিকা থেকে শুরু করে জীবনানন্দের কবিতা প্রকাশে যার সহযোগিতা শতভাগ। কলম হাতে জীবনানন্দের কবিতার সমস্ত সমালোচনার জবাব দিয়েছেন অকপটে। কিন্তু ওই যে, জগতের নিয়ম। সেই বুদ্ধদেব বসুর সাথেও জীবনের শেষ মুহূর্তে দ্বন্দ্ব জড়িয়ে যায়। তিথিডোর নামে এক উপন্যাস সম্ভবত এই ঘটনাবলীকে কেন্দ্র করে লেখা।
সুরঞ্জনা, শ্যামলী, সুদর্শনা, সবিতা, সুচেতনা, বিনতা, কল্যাণী, বিভা থেকে শুরু করে নীহারিকা মিত্র, অরুণিমা সান্যাল এবং বনলতা সেন এত এত কাল্পনিক চরিত্রের ভিড়ে আমরা জীবনানন্দের কবিতার মমার্থ বোঝার বৃথা চেষ্টা করছি বলে আমার মনে হয়। ভিন্ন সূত্র মতে জীবনানন্দ দাশের প্রথম প্রেম মনিয়া। তাঁর সারাজীবনের সমস্ত লেখা এই মনিয়ার উজ্জ্বল উদ্ধার। তবে শুরুতেই অবদমন। মনিয়া বাড়ির পরিচারিকার মেয়ে। জীবনানন্দ যে নীলনয়না মনিয়ার সঙ্গে মিলিত হবেন তাতে নিশ্চয় সমাজের স্বীকৃতি ছিল না। নিজের জীবনের প্রায় পুরোটাই অন্যের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত ছিলেন তিনি। একজন কমলালেবু অনুযায়ী প্রথম কাব্যগ্রন্থ “ঝরা পালক” উৎসর্গ করেছিলেন তাঁর একমাত্র ভালোবাসার মানুষ শুভনা কে, যাকে ঘিরে ভাবনায় মগ্ন থাকতেন লাবণ্য দাশকে বিয়ের পরও। এক আকাশ সমান অপ্রাপ্তি তাঁর জীবনে। সেই অপ্রাপ্তি ছড়িয়ে ছিল ব্যক্তি, পারিবারিক এবং লেখালেখির জীবনেও।
আত্নহত্যা?
মৃত্যু?
হত্যা?
সামগ্রিক বিবেচনায় বলা যায় আত্নহত্যা। জীবনানন্দ তাঁর ডায়েরিতে আত্নহত্যার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন বেশ কয়েকবার। এছাড়াও মৃত্যুর বেশ কয়েকদিন আগ থেকে প্রতিনিয়ত তিনি ট্রাম দুর্ঘটনার কথা অবচেতনভাবে সবাইকে বলতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত সেই ট্রামের চাপে সাতদিন হসপিটালে যন্ত্রনাভোগের পর মৃত্যু হয় তাঁর। কিন্তু ঠোঁট এবং চোখ নীল হয়ে যাওয়ায় অনেকেই ধরে নেন বিষপানে মৃত্যু হয়েছে তাঁর, নাকি হত্যা? মৃত্যুর ঠিক আগে তিনি কমলালেবু খেতে চেয়েছিলেন। জীবনানন্দ কমলালেবু ভালোবাসতেন। মৃত্যুর পর রোগীর পথ্য একটি কমলালেবু হয়ে পৃথিবীতে ফিরে আসতে চাওয়ার আকুতিভরা একটি কবিতা রয়েছে তাঁর। তাই হয়তো বইয়ের এই নাম।
আধুনিক কবিতার ক্ষেত্রে জীবনানন্দ দাশ এক স্বতন্ত্র কবি। লিখেছিলেন, ‘আমার মতন কেউ নেই আর।
কোনো এক কবিতা পড়ে ইচ্ছে হয়েছিল পাখি হবো। মুক্ত আকাশে উড়বো। তুলনামূলক বিশ্লেষনে ফড়িঙ হয়ে আছি। ফড়িঙ আমার কাছে আশ্চর্য সুন্দর সৃষ্টি মনে হয়। তাই হয়তো মানুষের দেখা পাই না,
‘যে জীবন ফড়িঙের দোয়েলের, মানুষের সাথে তার হয় নাকো দেখা …’
বাংলা সাহিত্যের প্রহেলিকাময় মানুষ জীবনানন্দ দাশের সঙ্গে এক নিবিড় বোঝাপড়ায় লিপ্ত হয়েছেন বর্তমান সময়ের শক্তিমান কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামান। জীবনানন্দের জীবনের এই রহস্য যেভাবে নিজ শব্দশৈলী দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন তা যে কাউকে মুগ্ধ করবে। আমার পড়া শ্রেষ্ঠ উপন্যাসের তালিকায় নতুন নাম যুক্ত হলো আজ।
ছবি কৃতজ্ঞতাঃ Protive Nitol
একজন কমলালেবু বই রিভিউ ২
একজন কমলালেবু ভিডিও রিভিউ
‘
একজন কমলালেবু’ বইয়ের ফ্ল্যাপের কথাঃ
লেখক পরিচিতি
শাহাদুজ্জামান শাহাদুজ্জামানের জন্ম ১৯৬০ সালে ঢাকায়। পড়াশােনা মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে। নেদারল্যান্ডসের আমস্টার্ডাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি অর্জন করেন চিকিৎসা নৃবিজ্ঞানে। পেশাগত ভাবে তিনি চিকিৎসক হিসেবে কাজ করেছেন উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের গ্রামীণ স্বাস্থ্য প্রকল্পে, পরে অধ্যাপনা করেছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে। বর্তমানে তিনি যুক্তরাজ্যের গ্লাসগাে। বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা ও অধ্যাপনায় যুক্ত আছেন। গল্প, উপন্যাস ছাড়াও প্রবন্ধ, অনুবাদ, ভ্রমণ ও গবেষণার ক্ষেত্রে রয়েছে তাঁর উল্লেখযােগ্য গ্রন্থ। মাওলা ব্রাদার্স আয়ােজিত কথাসাহিত্যের পাণ্ডুলিপি প্রতিযােগিতায় শ্রেষ্ঠ পুরস্কার পেয়ে প্রকাশিত। হয় তার প্রথম গল্পগ্রন্থ কয়েকটি বিহ্বল গল্প (১৯৯৬)। কথাসাহিত্যে অবদানের জন্য ২০১৬ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তিনি। Email : zshahaduz@gmail.com প্রচ্ছদ : সব্যসাচী হাজরা
একজন কমলালেবু বই রিভিউ ৩
একজন কমলালেবু PDF শাহাদুজ্জামান বই | Ekjon Komlalebu By Shahaduzzaman Books PDF | বুক রিভিউ এবং পিডিএফ
Click Here To Download Akjon Komlalebu Book
একজন কমলালেবু PDF শাহাদুজ্জামান বই | Ekjon Komlalebu By Shahaduzzaman Books PDF | বুক রিভিউ এবং পিডিএফ
Click Here To Download Akjon Komlalebu Book