এই গল্পটা পড়তে নিয়ে চোখের পানি ধরে রাখা কঠিন হয়ে যাবে

অনেকেই পড়েছেন। যারা পড়েননি, পড়ে নেন। না পড়লে সত্যিই খুব মিস করবেন..

চিতার আগুন দাউদাউ করে জ্বলছে। তারই উষ্ণতা এসে লাগছে আমার গায়ে। আগুনের নিচে লেলিহান আগুন। অন্তর্দৃষ্টি গিয়ে ঠেকছে শেষ সীমানায়। প্রচন্ড কষ্টে কুকড়ে যাচ্ছি আমি। থরথর করে কাঁপছে আমার শরীর। এভাবে ওরা মাকে না পোড়ালেও পারত। কাঁদতে কাঁদতে শ্মশানঘাট থেকে বেড়িয়ে এলাম এক দৌড়ে।
.
জীবনটা কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানে ওলটপালট হয়ে গেছে। ওরা আমার মাকে মেরে ফেলেছে। আমাকেও হয়ত মেরে ফেলবে। খুব শীঘ্রই । প্রচন্ড শীতেও আমি দরদর করে ঘামতে লাগলাম। পরনের শার্ট টা ভিজে গেছে একদম। না, মৃত্যুভয় একদমই কাজ করছে না এই মুহূর্তে। উত্তেজনা আর উদ্বেলতায় বড় বড় শ্বাস নিতে লাগলাম।
.
হঠাৎ পেছন থেকে বড় জ্যাঠা কাঁধে হাত রাখলেন। একমুহূর্তকাল চোখ বন্ধ করে একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে তার দিকে ঘুরে বললাম, “কেন মারলে এভাবে বড় জ্যাঠা? মা তোমাদের কি ক্ষতি করেছিল?
-ক্ষেতি করেনি বলছিস? জাত পাত সব বিসর্জন দেয়া বেটিছ্যালাকে আমাদের ঘরে রাখব কি করে বাবলি? আমাদের চৌদ্দগ্রামে এমন পাপ আর কেউ করেনি। জাত দিয়েছে, দিয়েছে , দুগ্গা মায়ের অপমান কললি কেনে? দুগ্গা ঠাকুরের অভিশাপেই ওর প্রাণ গেছে। ওকে তো আমরা মারতে চাইনি। তোর বাপ রাগের মাতায় দুঘা বসিয়ে দিয়েছে। প্রাণ যে চলি যাবে এটা কে জানত? দুগ্গা মাই চাইনি যে তোর মা তার সাতি বিয়াদবি করি বাঁচি থাকুক।
.
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে পাশে থাকা বেঞ্চিতে গা এলিয়ে দিয়ে বসলেন তিনি। যেন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন। এরই মধ্যে ছোট জ্যাঠা , বাবা আর রনকেষ দা এসে দাঁড়িয়েছেন‌। বাবার হাতে লাল কাপড়ে মোড়ানো কাঁসার ঘটি। মায়ের ছাই আছে ওতে। শেষ অস্তিত্ব। বাবার চোখেমুখে কেমন নির্লিপ্ত ভাব। না আছে রোগ না আছে শোক।
.
আগেপিছে কিছু না ভেবে আমি বললাম, “আমি থানায় যাব। তোমাদের নামে কেস করব।” সঙ্গে সঙ্গে বড় জ্যাঠা বসা থেকে উঠে আমার কলার চেপে ধরল। এক থাপ্পর বসাতে যাবে এমন সময় রনকেষ দা তার হাতটা ধরে ফেলল।
.
নরম গলায় রনকেষ দা বলল,” যা হয়েছে হয়েছে। এখন তো আর কিছু করার নেই। কেস করলেও তো তোর মা আর ফিরে আসবে না। অযথা নিজের পায়ে কুড়াল মারিস না। তোর বাপ , জ্যাঠারা তোর ই জাত তোর ই বংশ। “
.
মনে মনে বললাম,” নিকুচি করেছি এমন বংশের এমন জাতের। আমিও ইসলাম গ্রহন করেছি। যদি তোমরা সেটা জানতে। “
.
আর কথা না বাড়িয়ে দীঘির পাড়ের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। সন্ধ্যা প্রায় ঘনিয়ে এসেছে। চারিদিকটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকের সাথে অদ্ভুত এক সুর তুলেছে আমার কান্নার শব্দ। বিশাল এই পৃথিবীতে আমার মা আর নেই। চলে গেছে তার প্রিয় রবের কাছে‌। তবে কোথায় যেন মনের ভিতর এক অন্যরকম শান্তির বাতাস বয়ে যাচ্ছে। নিষ্পাপ অবস্থায় রবের সাথে মিলিত হবে মা। কালিমার জন্য জান দিয়েছে আমার মা। আহ। গর্বে বুকটা যেন ফুলে উঠছে।
.
সত্য পথের সন্ধান পাওয়া মাত্রই মা সবার আগে আমাকে জানিয়েছিল। সেদিনটা ছিল লক্ষীপূজোর দিন। প্রতিবার মা নিজ হাতে প্রতিমা সাজাতেন। ফুল নিয়ে আসতেন। মায়ের হাতে ভোগ রান্না সবার খুব পছন্দের ছিল‌ । মা সেদিন কিছুই করলেন না। সারাদিন শুয়ে কাটিয়ে দিলেন। সন্ধ্যার পর আমাকে কাছে ডেকে বললেন , “আমি মানি না এ ধর্ম। তুই আমাকে ইখান থেকে নিয়ি চল। তোর বাপের সাথে আমার বিয়ে ভাঙ্গি গেছে। আমি মুসলিম হয়ে গেছি।”
আমার বুকের ভেতরটা ধরাশ করে উঠল। কি বলছে মা এসব? মা কি পাগল হয়ে গেছে?
.
বললাম, “কি বলছ এসব? তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?”
মা বলল, “না , আমি একদম ঠিক আছি। সইত্য ধর্ম ইসলাম গ্রহন করেছি আমি। তোর বাপের সাথে এই মুহূর্তে আমার দেখা দিওয়াও পাপ। ঘোর পাপ। তুই আমার জন্য একটা ব্যবস্থা কর বাপ।”
আমি কি বলব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। কপাট লাগিয়ে দিয়ে বসলাম মায়ের পাশে। বললাম,” কিভাবে কি হল? বিস্তারিত বলো।”
.
মা মিনু মাসীর নাম নিতেই আমি সব বুঝে গেলাম। মিনু মাসী আমাদের প্রতিবেশী। উনার বাড়িতে একবেলা কাজ করত আমার মা। উনি বেশ কয়েকমাস ধরেই বিভিন্ন ভাবে মাকে ইসলাম নিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন। মা পড়তে জানত। তাই ডজন খানেক ইসলামিক বই দিয়েছিল পড়তে। আমি এসব কিছুই জানতাম না। লক্ষীপূজোর দিনে এমন অলুক্ষূনে কথা শুনে ছি ছি করতে করতে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।
পরদিন আবার মা আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করতে লাগলেন। হাতের বালা জোড়া খুলে আমার হাতে দিয়ে বললেন ,”এগুলো বিক্রি করে আমাকে অন্য কোথাও নিয়ে চল। ওরা আমাকে একঘরে করি দেবে জানতে পারলে। আমি লুকিয়ে নামাজ পড়ি যে।”
.
অসহ্য লাগছিল মায়ের এমন আচরণে। শেষ পর্যন্ত জাত দিল? হায় ভগবান! অগত্যা মায়ের কথা রাখতে বালা গুলো রমেন কাকার কাছে বন্ধক রেখে কিছু টাকা নিয়ে এলাম। এসেই বললাম, “কি করতে হবে বলো? এসব আমার আর ভালো লাগছেনা।”
.
মা বলল, “একটা কথা রাখপি বাপ?” বললাম,” বলো। তোমার সব কথাই তো রাখছি।” মা বলল, “এই বই টা তুই আজ রাতি পড়বি।” এই কথা বলে হাতে একটা কালো মলাটের বই ধরিয়ে দিল। বই টার নাম ছিল, যেমন ছিল আমার যাত্রা ( অন্ধকার থেকে আলোতে)
.
খুব বিরক্তের সাথে বই টা নিয়ে বললাম ,”পড়ব খন।” মা বলল, “বাছা আমার , একটুও যদি মাকে ভালোবাসি থাকিস তাহলে পড়িস। আমার ছেলে আমার মতোই হবে। আমি জানি।”
.
রাত বাড়লে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে বইটা নিয়ে বসলাম। খগেন নামক এক ব্যক্তির ধর্ম বিসর্জন এর কাহিনী। তার নাম এখন আব্দুর রহমান। মানে রহমান এর বান্দা।পড়তে পড়তে যতোই সামনে এগুচ্ছি ততোই গায়ের রক্ত হিমশীতল হয়ে যাচ্ছিল। তেত্রিশ কোটি দেব দেবীর পূজো ছেড়ে কিভাবে এবং কেন তিনি ইসলাম গ্রহন করলেন। আমার সামনে মুক্তির পথ ভোরের আলোর মত স্পষ্ট হতে লাগল। মুর্তিপূজার অসারতা স্বচ্ছ হয়ে ধরা দিতে লাগল।
.
পড়তে পড়তে ভোরই হয়ে গেল। চারিদিকে আযান দিচ্ছে। আমার মন টা কেমন যেন আনচান করতে লাগল। জানালার কপাট খুলে বাইরে তাকিয়ে দেখি মা বদনা হাতে পা টিপে টিপে কলপাড়ে যাচ্ছে। এই দৃশ্য দেখে আমি কেঁদে ফেললাম। আহ! কতোই না সৌভাগ্যবতী মা আমার! সত্যিকার এর পূজ্যকে পূজো দিতে পারছে। মনের অজান্তেই ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে উঠলাম।
.
পরদিন মাকে নিয়ে কোথায় যাওয়া যায় কিভাবে যাওয়া যায় এসব প্ল্যান করেই কাটালাম। তারপর দিনগত রাতে মাকে নিয়ে পালানোর জন্য সবকিছু রেডি করলাম। রমিজ কাকাকে আগেই বলে রেখেছিলাম বাড়ির পেছনের ঝোঁপে অটোরিকশা নিয়ে অপেক্ষা করতে। রমিজ কাকা বারবার বলছিল, “তুই ছোট ছ্যালা। এত বড় রিক্স নিবি?” আমার মাথায় তখন অন্য কিছু আর কাজ করছিল না। বারবার মনে হচ্ছিল জানতে পারলে ওরা মাকে আস্ত ছেড়ে দিবেনা। তাই যত দ্রুত পালানো যায় ততোই ভালো।
.
রাত একটু গভীর হলেই আমি সবকিছু গুছিয়ে নিলাম। বাবা , জ্যাঠা , জেঠিরা সবাই ঘুমুচ্ছে। মা ও সবকিছু গুছিয়ে আস্তে করে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। দুজন মিলে সন্তর্পনে উঠোন পেরুতে লাগলাম। পিছনে পড়ে রইল অসাড় এক জীবনগল্প। ঝোঁপের মধ্যে পৌঁছে দেখলাম রমিজ কাকা নেই। কিছুক্ষণ পর তিনি এলেন। আমরা অটোরিকশায় উঠতে যাব এমন সময় বড় জেঠি পুরো বাড়িময় চিৎকার করতে লাগলো।
“কই গো সব কোথায় গেলি রেএএএএএ??
আদি ঘরে নেই কো। আদি ঘরে নেই। “
.
‘যাহ’ বলে জিভে একটা কামড় বসিয়ে দিলাম। এ যাত্রায় বুঝি আর রক্ষে নেই। মা সমানে কালিমা আওড়াচ্ছে। লা~ ইলা-হা ইল্লাল্লাহ। লা~ ইলা-হা ইল্লাল্লাহ।
.
শীতের রাতে একটা শুকনো পাতা পড়ার শব্দও যেন কানের পর্দায় আলোড়ন তোলে। মা আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেন উঠোনে। বুঝতে পারছিলাম না কি হতে যাচ্ছে।
.
মাকে আর আমাকে দেখে জেঠি বলে উঠল, “কোথায় গেছিলে মা ব্যাটাতে?” রমিজ কাকা হড়হড় করে সব বলে দিল। আমার তখন মাথায় হাত। সব্বনাশ হয়ে গেল। এর মধ্যে বাবা, বড় জ্যাঠা সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। বাবা মায়ের চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে ঘরে নিয়ে গেল। আমি যেতে চাইলে জেঠি আমার হাত শক্ত করে ধরে রাখল।
.
বড় জ্যাঠা, ছোট জ্যাঠা মিলে মাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে লাগল। মায়ের বজ্রকন্ঠ আমার কানে এসে বাজতে লাগল। “তোরা যত যাই করিস আমি আর তোদের ওই দুগ্গা পুতুলকে পূজা করব না। আমি সত্য জেনে গেছি। আমার রব আল্লাহ। এক আল্লাহ”
.
বাবা মাকে বেদম প্রহার করতে লাগল। আমি এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিয়ে দৌড়ে ঘরে গেলাম। বললাম,” মাকে ছেড়ে দাও। মা ভুল করে ফেলেছে। মাকে এভাবে মেরোনা। “
.
মা এতটুকু বিচলিত হলনা। আমি আশ্চর্য নয়নে তাকিয়ে দেখলাম। ঈমান যেন ঠিকরে পড়ছে সর্বাঙ্গ দিয়ে। অমন তেজ ইহজীবনে এর আগে তো কখনো দেখিনি! আমি গ গ করে বলতে থাকলাম,” মাকে ছেড়ে দাও মা ভুল করেছে, মা ভুল করেছে।” মায়ের রক্তচক্ষু যেন বিস্ফোরিত হয়ে আমার ওপর পড়ল। বলল, “আমি কোন ভুল করিনি। আমার রব আল্লাহ। আমি আর কারো পূজো করিনা। তোরা আমাকে মেরে ফেললেও আমি আর কারো পূজো করব না। “
.
বাবা যেন দ্বিগুন বেগে মারা শুরু করল, এই কথা শুনে। বড় জেঠি ও উঠে এসে এলোপাথাড়ি লাথি মারতে লাগল। মায়ের কান্না দিগন্তরেখা ছাপিয়ে আকাশ বাতাস বিদীর্ণ করে দিচ্ছিল। আমি আমার পুরো শরীর পেতে দিলাম মায়ের ওপর যেন আঘাত না লাগে। এক পর্যায়ে বাবা খাটের নিচ থেকে বটি বের করে মায়ের ঘাড়ে এক কোপ বসিয়ে দিল। রক্তের ফোড়ারা ছুটে এসে আমি আর বাবা ভিজে গেলাম। মায়ের গোঙানির আওয়াজ স্পষ্ট কানে আসতে লাগল সবার। ‘ লা~ ইলা-হা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ’
.
জ্যাঠা জেঠিরা সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। বাবা ধপ করে মাটিতে বসে পড়ল। আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। কিছুক্ষণ তড়পাতে তড়পাতে ইহলোক ত্যাগ করল মা।
.
তারপর ভোর হবার অপেক্ষায় সবাই রাত পার করল। আমি আকাশ বাতাস কে সাক্ষী রেখে মনে মনে ইসলাম কবুল করলাম। আব্দুর রহমান এর মত বললাম, “আশহাদু আল্লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা~ শারি-কা লাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান ‘আবদুহু ওয়া রসু-লুহু।”
.
যে সত্যের জন্য আমার মা প্রাণ দিয়েছে দরকার ‌হলে সেই সত্যের জন্য আমিও প্রাণ দেব। মায়ের মৃত্যু যেন আমার ঈমানের জন্মহেতু হল।
.
সকাল হতেই মাকে ওরা পোড়ানোর বন্দোবস্ত করতে লাগল। আমি বাঁধা দিলাম। বললাম,‌”মা তো মুসলিম। মাকে কবর দাও। ” ওরা আমার কথা শুনল না। বলল, “তুই বড়দের মাঝে এত কথা বলবি না।” ছুটতে ছুটতে মিনু মাসীর বাসায় গিয়ে সব বললাম আমি। মিনু মাসী কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলিয় ফেললেন। তার বাংকার থেকে ৫০০ টাকার একটা মোটা বান্ডেল এনে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,” তুই ‌পালিয়ে যা। বললাম,” কোথায় যাব আমি?” উনি আমাকে একজন এর নাম আর নাম্বার লেখা কাগজ হাতে ধরিয়ে দিলেন। বললেন,” ইনাকে ফোন দে। ইনি তোর সব ব্যবস্থা করবেন ইন শা আল্লাহ। আল্লাহর উপর ভরসা রাখ বাবা”
.
কাগজটা অতি যত্নে বুক পকেটে ঢুকিয়ে বাড়ির দিকে এগুতে লাগলাম। অজানা আশঙ্কায় তনুমন ছেয়ে আসছিল আমার। বাড়ি ফিরে সৎকার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে লাগলাম। বাবা জ্যাঠারা কাউকে কিছু জানায়নি। পাছে থানা পুলিশ হয়। অসুস্থ বলে‌ মাকে কাপড় দিয়ে ঢেকে ভ্যানে করে নিয়ে চলল শ্মশানঘাট।
.
___________
.
সব আয়োজন শেষ। দীঘির পাড়ে‌ জল নিয়ে খেলা করছি আমি।জমে শক্ত হয়ে আছে আমার মন। গলার মাঝখানে কান্নাগুলো দলা পাকিয়ে আছে। মায়ের আদুরে মুখটা বারবার দীঘির জলে ভেসে উঠছে। একটু নাড়া দিতেই মিলিয়ে যাচ্ছে। আবার আসছে। আবার মিলিয়ে যাচ্ছে।আবার আসছে।
.
চোখমুখ বন্ধ করে জীবনে প্রথমবার মুসলমানদের মত দুহাত তুললাম আমি। ইহজীবনে এত কান্না কখনো কাঁদি নাই। আল্লাহকে সম্বোধন করে বুকের সব জ্বালা মেলে ধরলাম। মনে‌ হল আমার শরীরের ভিতর দিয়ে যেন শীতল বাতাস বয়ে যাচ্ছে। এত শান্তি আমি আগে কখনো পাই নাই । মনে হল, কেউ যেন আমাকে বলছে, আমি সব দেখি , সব শুনি। আমি তোমার একমাত্র অভিভাবক। তোমার কোন ভয় নেই। আমি তোমার সাথেই আছি।
.
মনের এই কল্পনায় আমি যারপরনাই চাঙা হয়ে উঠলাম। কষ্ট অনেক হালকা অনুভব হচ্ছে। আল্লাহ আমার সাথে আছে। আমার আর ভয় কিসের?
.
বুক পকেটে থাকা নাম্বারে কল দিয়ে সব বললাম। পরদিন সকালেই তিনি আমাদের গ্রামে এসে হাজির। আমাকে তার মাইক্রোবাসে করে তুলে নিয়ে গেলেন। বাবা, জ্যাঠা , জেঠি কাউকে কিছু না জানিয়ে আমি চলে এলাম উনার সাথে ঢাকায়, পেছনে ফেলে এক নৃশংস জীবনগল্প। হৃদয় জুড়ে নতুন করে বাঁচার এক অদম্য ইচ্ছার প্লাবন।
.
পুরোটা রাস্তা তিনি আমায় সাহস দিলেন।‌পাশে‌ থাকার ওয়াদা করলেন। নিজের ভাই বলে সম্বোধন করলেন। এমন মধুর ব্যবহারের শিক্ষা যে ধর্মের সেই ধর্ম কেমন করে মিথ্যা হয়?
.
কেবল আল্লাহর কালিমার জন্য সৃষ্ট টানে এক অজানা অচেনা ভাইয়ের জীবন বাঁচাতে যে ভাই এক রাতের মধ্যে ছুটতে ছুটতে ৪০০ কিলো পথ পাড়ি দিয়ে চলে আসে তার রবের বানী কি করে মিথ্যা হয়?
.
আমি বুঝলাম আল্লাহ সত্যিই আমার পাশে আছেন। আমার সত্যিই আর কোন ভয় নেই।
.
ভাই আমাকে আবার শাহাদাহ পাঠ করালেন। আমি পাঠ করলাম।তিনি আমার নতুন নাম রাখলেন ‘ আব্দুর রহমান’ । তারপর বললেন, “আব্দুর রহমান, আমার সাথে বলো,
.
হাসবুনাল্লাহু ওয়া নি’মাল ওয়াকিল। নি’মাল মাওলা ওয়া নি’মান নাছীর।” 📍
.
আমি ভাইয়ের সাথে সাথে বললাম। কেমন লাগল সেই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার ক্ষমতা নেই আমার। নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করলাম উদ্ভাসিত এক আলোর জোয়ারে। কৃতজ্ঞতার দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল আমার চিবুক বেয়ে। এর চাইতে বেশি আনন্দ বুঝি এই ছোট্ট জীবনে আর কখনোই উপভোগ করিনি আমি। কখনোই না।
.
||আঁধার হতে আলোতে||
লিখেছেনঃ আনিকা নাওয়ার
.
📍 [সূরা আল ইমরান :১৭৩]
অর্থ: আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট এবং তিনিই মঙ্গলময়, কর্মবিধায়ক।
.
আর তিনি কতোইনা উত্তম অভিভাবক ও সাহায্যকারী। [আনফাল :৪০]
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?