উবায়দুর রহমান খান নদভীর বয়ানে আল্লামা আবুল হাসান আলি নদভি রাহি – হিমালয়ের পায়ের কাছে

‘রগাে পে দৌড়ে ফিরনে কে হাম নেহি কায়েল
আঁখো সে না টপকে তো ফের লহো কেয়া হ্যায়।’
‘দেহের শিরায় শিরায় প্রবাহিত হওয়ার সমর্থক বাবা আমি নই, অনুভূতি মথিত করে চোখ বেয়েই যদি না পড়বে তাে আবার রক্ত কিসের?’

উরদু ভাষার শ্রেষ্ঠ কবি মির্জা আসাদুল্লাহ খাঁ গালিবের এ দুটো পঙক্তি দিয়েই ভাব প্রকাশ করতে হয়। সত্যিই শরীরের রক্ত যে অশ্রু হয়ে প্রবাহিত হতে পারে আমার বিরহব্যথা অনুভবের আগে এ কথা ভালো করে বুঝে আসত না। আল্লাহ তাকে জান্নাতে উচ্চাসন দান করুন। মুসলিম উম্মাহকে দিন তার
যােগ্য উত্তরসূরি।

জাহেলি যুগে একবার প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পবিত্র কাবাগৃহের চাবি চেয়ে ব্যর্থ হন। ওসমান ইবনে তালহা তখন তাঁকে চাবি দেয়নি। হজরত মনে কষ্ট পেলেও কিছু না বলে সবর করেন। এর কয়বছর পরই বিজয়ীর বেশে হযরত নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে দিন মক্কা নগরীতে প্রবেশ করেন তখন মাথা নত করে তার হাতে চাবিটি অপর্ণ করে পরাজিত ওসমান ইবনে তালহা। তার হাত থেকে চাবিখানা নিয়ে কাবা গৃহ খুলে প্রবেশ করেন হজরত। অতঃপর চাবি কাকে অর্পণ করবেন, এ নিয়ে ভাবছিলেন। প্রত্যাশার চোখ নিয়ে অনেক বড় বড় সাহাবিই প্রতীক্ষায়। প্রিয় রাসুল সবাইকে অবাক করে দিয়ে চাবিটি প্রত্যর্পণ করলেন ওই ওসমান ইবনে তালহার হাতেই। বিস্ময়ে বিস্ফোরিত তার দু-নয়ন। এও কি সম্ভব! শুধু তাই নয়, হুজুর আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কথাও বললেন, এ চাবি কিয়ামত পর্যন্ত তােমার বংশধরের হাতেই থাকবে। কোনাে অত্যাচারী ব্যক্তিই কেবল তা ছিনিয়ে নিতে পারে, অন্য কেউ নয়।’

সত্যিই দীর্ঘ দেড় হাজার বছর যাবত এ বংশের হাতেই পবিত্র কাবার চাবি। দীর্ঘ ইতিহাসে সম্মানসূচকভাবে এ চাবি প্রদান করা হয় যে কজন হাতেগােনা মানুষকে স্মরণকালের মধ্যে এর একজন ছিলেন শহীদ বাদশাহ ফয়সল। অপরজন আমাদের উপমহাদেশ তথা গােটা অনারব পৃথিবীর গৌরব আল্লামা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ.। আল্লাহ পাক তাকে কত বড় সম্মানে ভূষিত করেছিলেন তা কল্পনা করতেও আমাদের স্নায়ু ক্লান্ত হয়ে আসে। শুধু তা-ই নয়, গত ২৩ রমজান (৩১ ডিসেম্বর ১৯৯৯) ইন্তেকালের খবর মক্কা-মদিনায় পৌঁছুলে, সেখানকার শাসকবর্গ ২৭ রমজান বাদ তারাবীহ মক্কা ও মদিনার পবিত্র দুই হারাম শরিফে আল্লামা নদভির গায়েবানা জানাজা আদায়ের ব্যবস্থা করেন। বিশ্বের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে উমরা ও ইতেকাফের উদ্দেশ্যে সমবেত লক্ষ লক্ষ মানুষ শরিক হন এতে। কী অপূর্ব সম্মাননা ও সৌভাগ্য!

মদিনা ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম স্বপ্নদ্রষ্টা এই মনীষীর জীবদ্দশায়ই তাঁর নামে মদিনা শরিফে সড়কের নামকরণ করা হয়। শত শত নিবন্ধ ও
কথিকা তাঁর প্রচারিত হয় মধ্যপ্রাচ্যের অসংখ্য রেডিও টিভি সম্প্রচারকেন্দ্র থেকে। সাক্ষাৎকারের তাে সীমাই নেই। একবার মিসরীয় এক দৈনিক দেখেছিলাম আল্লামার সাক্ষাৎকারের শিরােনামই ছিল ‘আশ শায়খ আন নাদওয়ী যুহাররিমুস সূরাহ হাত্তাল আন’-‘আশ শায়খ আন নদভি আজও পর্যন্ত
প্রাণী চিত্রচর্চাকে হারাম মনে করেন।

আগামী দিনের বিশ্বব্যবস্থারূপে ইসলামী চিন্তা-চেতনার অন্তর্নিহিত প্রতিপত্তি হযরতের বই ‘ইলাল ইসলাম মিন জাদিদ’ তথা again towards islam পড়লে মনে হয় একজন মােজাদ্দেদ ছাড়া এসব কথা কেউ ভাবতেই পারে না। ইসলামের দেড় হাজার বছরের ধর্মীয় সংস্কার ও জাগৃতি আন্দোলনের ৫ ভল্যুম এবং আরও ৫ ভল্যুমের পরিশিষ্ট মনীষী জীবনচরিতে তিনি তুলে ধরেন। নিজের জীবনীটাও তিনি রচনা করে গেছেন কারওয়ানে জিন্দেগী নামে ৭ খণ্ডে। এর শেষ খণ্ড সম্ভবত পরবর্তী কেউ চূড়ান্ত করবেন। জীবনের শ্রেষ্ঠ কৃতিত্বগুলাে নিজে লিখতে বিব্রতবােধ করেছেন বলে ৭ খণ্ড আজীবনীর cream part গুলাের গ্রন্থিত করেছেন প্রিয় শিষ্য ড. আব্দুল্লাহ আব্বাস নদভী মীরে কারওয়াঁ নামে।

রাতদিন চব্বিশ ঘণ্টা জিকির, নামাজ ও গভীর চিন্তায় নিমগ্ন এই সাধক পুরুষ কঠোর শৃঙ্খলা পালন করতেন। বেলা ১০-১১ টায় ডাকে আসা পত্র পড়তেন। ১১ টার এক সেকেন্ড পর হয়ে গেলেও আর পত্র খুলতেন না। এভাবে অনেক রাজা-বাদশাহ ও দিকপালের পত্রও ২৪ ঘণ্টা পরে খুলেছেন। বহু সভা-সেমিনার মিস হয়েছে কিন্তু জীবনের মাপা সময় অপচয় হতে দেননি। চোখে অসুবিধা দেখা দিলে নিজে খুব কমই লিখতেন।

ডিকটেশন নিয়ে লিপিবদ্ধ করার জন্যে ছিলেন বিশেষজ্ঞ আবদুর রহমান বাট। পত্রের জবাব লেখার জন্যে ড. নজরুল হাফিজ আজহারি নদভি। প্রকাশনা সহকারী মাওলানা গােফরান নদভি। তথ্য ও উৎসগ্রন্থ অনুসন্ধান এবং ইনেডেক্স তৈরির জন্যে মাওলানা গিয়াসউদ্দীন নদভি। তাফসির, হাদিস ও ফিকাহ বিষয়ক গবেষণা সহযােগি মাওলানা বুরহান উদ্দীন সম্ভলি। ইতিহাস ও দর্শন বিষয়ক গবেষণা সহযােগি মাওলানা আবুল ইরফান খান নদভি। আন্তর্জাতিক যােগাযােগ ও মিডিয়া অ্যাডভাইজার আল্লামা ওয়াজেহ রশিদ নদভি। ইংরেজি ভাষ্যকার মহিউদ্দীন আহমদ। উর্দু ভাষ্যকার মাওলানা শামসে তাবরে খান। মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক সহযােগি ড. আব্দুল্লাহ আব্বাস নদভি। সর্বোপরি নদওয়াতুল উলামা, ইউনিভার্সাল লীগ অব ইসলামিক লিটারেচার ইত্যাদি বিষয়ে প্রধান সহযােগি, ভাগ্নে হজরত সাইয়েদ মুহাম্মদ রাবে নদভি। বর্তমান যিনি তাঁর স্থলাভিষিক্ত। এই ছিল তাঁর হাতে তৈরি কর্মীবাহিনী এবং কর্মসাধনার সুশৃঙ্খল নেটওয়ার্ক।

এ ছাড়া ইউরােপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা ও এশিয়া জুড়ে শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও বুদ্ধিচর্চার অঙ্গনে নিরন্তর কর্মরত বিশাল নদভি সম্প্রদায়
তাে আছেই। সবাইকে তিনি মনে রাখতেন, দুআ করতেন, নেতৃত্ব দিতেন। এখনও মনে পড়ে ঐতিহ্যবাহী সমাবর্তনে তিনি বলেছিলেন, ‘নদওয়ায়
শিক্ষাপ্রাপ্ত তরুণেরা এ প্রতিষ্ঠানকে চিরদিনই তাদের আশ্রয়স্থল মনে করে। আপনারাও যেখানেই যাবেন, যে কাজেই আত্মনিয়ােগ করবেন, মূল বিদ্যাপীঠকে ভুলবেন না। যোগাযােগ রক্ষা করে চলবেন এবং নামের সাথে অবশ্যই ‘নদভি’ লিখবেন।’

৮৬ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন নিজ পিতৃপুরুষের বরকতময় ভূমিতে, ভারতের রায়বেরেলি জেলার তাকিয়া শাহ আলামুল্লাহ গ্রামে। সেখানেই পারিবারিক কবরগাহে তাঁরও সমাধি রচিত হয়—গােমতি নদীর তীরের যে আম্রকানন আর ধু-ধু মাঠে বাতাসে কান পাতলে আজও শােনা যায় মুজাহিদ আন্দোলনের নেতা শহিদে বালাকোট, হযরত সাইয়েদ আহমদ শহীদ বেরেলভী (মৃ. ১৮৩১ ঈ.) ও তাঁর সহযােদ্ধাবৃন্দের ঘােড়ার খুরধ্বনি, সামরিক কসরত ও জিকরে ইলাহির মুহুর্মুহু শব্দ। আল্লামা নদভি রাহি. তাে হজরত সাইয়েদ শহিদেরই উত্তরপুরুষ।

ভারতীয় মুসলিম জনতার বিপুল ভিড়ের চাপ ও দুঃসহ এক শােকাভিভূত পরিবেশ সৃষ্টির ভয়ে হজরতের আত্মীয়রা তাকে ইন্তেকালের দিন রাত দশটার মধ্যেই দাফন করে নেন। রাতটি পার হলে আর এ ভিড় সামলানাে কারও পক্ষেই সম্ভব হতাে না। যে দৃষ্টান্ত হযরত আব্দুল কাদের জিলানি রাহি.-এর দাফনের বেলা তাঁর সন্তানেরা কায়েম করেছিলেন।

পরদিন লাখাে জনতা এসে কেবল কবর যিয়ারত করেছিল। জানাজা ও দাফনকার্যে শরিক হওয়া জন্যে কাতারের আমীর (বাদশাহ) এবং বর্তমান বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফকিহ ও ইসলামি চিন্তাবিদ আল্লামা ড. ইউসুফ কারজাভি বিশেষ বিমানযােগে রাতেই দোহা থেকে ভারতীয় শহর লখনৌ এসে পৌছেন কিন্তু নদওয়ার ফ্যাক্স লাইন খারাপ থাকায় তাদের মেসেজ কর্তৃপক্ষের হস্তগত না হওয়ায় তাঁরা জানাজা ও দাফন পাননি। উত্তর ভারতের কঠিন শীত ও কুয়াশার জন্যে তাঁরা রাতে ফিরতেও পারেননি। পরদিন বিফল মনােরথ আমিরকে নিয়ে বিশেষ বিমানটি ভারত ত্যাগ করে।

‘প্রিয় পদরেখা’ বই থেকে
লেখক—উবায়দুর রহমান খান নদভী
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?