আসলে উম্মাহ যে ইমাম আবু হানিফা, ইমাম মালেক, ইমাম শাফেয়ী এবং ইমাম আহমাদ (রহ.)-গণের ব্যাপারে একমত হয়েছে, এটা কোনো কাকতালীয় ব্যাপার নয়। আবার তাদেরকে কেন্দ্র করে বিভেদ সৃষ্টিকারীদের সংখ্যাও ইতিহাসে নেহায়েত কম নয়। এজন্য ইলমে-দ্বীন চর্চাকারী মাত্রই আমাদের সবার দায়িত্ব মহান ইমামগণের জীবন-কর্ম জানা। তাদের রেখে যাওয়া খেদমত, অনুসৃত মূলনীতি সম্পর্কে জানা অর্থ ইসলামের শিক্ষাকেই জানা। তাদের জীবনাদর্শ, আদব আখলাকের মাঝে আমাদের জন্য যে অকৃত্রিম শিক্ষা রয়েছে, সকলের জন্য অনুসরণীয়। এই বিষয়ে চমৎকার একটি বই ড. সালমান আল আওদাহ (হাফি.) রচিত ‘মাআল আইম্মাহ’। এতে ইমাম আবু হানিফা, ইমাম মালেক, ইমাম শাফেঈ, ইমাম আহমাদ—এই চার ইমামের জন্ম মৃত্যু থেকে শুরু করে তাদের কর্মপন্থা, জীবনের পরতে পরতে ছড়িয়ে থাকা আমাদের জন্য অনুপম শিক্ষা এবং মণিমুক্তাগুলো একত্র করা হয়েছে।
চার ইমামের জীবনাদর্শের ওপর সম্ভবত এই প্রথম এমন একটি গবেষণা-ধর্মী বই প্রকাশিত হলো, যেখানে তাদের জীবন কর্মের পাশাপাশি তাদেরকে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া বিভিন্ন মিথ্যাচার-অভিযোগ-আপত্তির খণ্ডন করা হয়েছে।
চার ইমাম ও চার মাজহাব এর সংক্ষিপ্ত ইতিহাসঃ
সুন্নি মুসলিম সম্প্রদায়ে চারটি মাজহাব স্বীকৃত। এই চার মাজহাবের চার ইমাম রয়েছেন, যাঁরা পুরো মুসলিম সমাজেই বরেণ্য ও সম্মানিত। হানাফি, মালেকি, শাফেয়ি ও হাম্বলি এই চার মাজহাবের চার ইমাম প্রায় সমসাময়িক কালের ইসলামী চিন্তাবিদ ও শরিয়তের ব্যাখ্যাকার। লক্ষ করার বিষয় হলো, এ চার ইমাম ইসলামের শরিয়ত নিয়ে নিজেদের চিন্তাধারাপ্রসূত দল বা উপদল তৈরি করেননি। তাঁরা প্রত্যেকেই গোটা মুসলিম সমাজের কাছে সমানভাবে গ্রহণীয় ও বরণীয়। শরিয়ত ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে তাঁরা নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করেছেন। এর ফলে ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে এসেছে বৈচিত্র্য এবং পরে তৈরি হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন চার মাজহাব। আরো লক্ষণীয় বিষয় হলো, এই মুজতাহিদ ইমামরা শরিয়ত বিধিবদ্ধ করার কাজ করেছেন মহানবী (সা.)-এর ওফাতের প্রায় ২০০ বছর পর। সুতরাং সহজেই বোঝা যায় শরিয়তের ব্যাখ্যা প্রদান, বিধিবদ্ধকরণ ও মাজহাবের অভ্যুদয়_এগুলো কোনো বিতর্কিত বা স্পর্শকাতর বিষয় নয়, বরং জ্ঞান চর্চার ফসল।
সময়ের সাথে সাথে মুসলিমদের মাঝে ফিক্হের চারটি ধারা জন্ম নেয় এবং বিস্তার লাভ করে ৷ আজ পর্যন্ত ঐ চারটি মাযহাবের প্রচুর প্রভাব পরিলতি হয় ৷ এই মাযহাবগুলি হহ্ছে:
১) হনাফী মাযহাব – এই মাযহাবের সূত্রপাত ঘটে কুফায়, যেখানে আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা.) এবংআলী ইবন আবু তালিব (রা.) এর মত সাহাবীরা বসবাস করতেন ৷ আবু হানিফা আল নু’মান ইবন সাবিতের (৮০ – ১৫০ হিজরী) নাম অনুসারে এই মাযহাব, হানাফী মাযহাব নামে পরিচিত ৷ ইসলামের ইতিহাসে তাঁকে সর্বকালের বৃহত্তম ফিক্হ শাস্ত্রবিদদের একজন বলে সবাই স্বীকৃতি দিয়ে থাকেন ৷ আবু হানিফার সাথে তাঁর শিষ্য আবু ইউসুফ, মুহাম্মাদ আল হাসান এবং জাফর – এঁরা সবাই এই মাযহাবের গঠন ও বিকাশে বিশেষ ভূমিকা রাখেন ৷ আধুনিক পাকিস্তান, ভারত, তুরস্ক, প্রাক্তন সাভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত মুসলিম রাষ্ট্রগুলো এবং পৃথিবীর অন্যান্য স্থানে আজও হানাফী মাযহাব প্রাধান্য বিস্তার করে আছে ৷
২) মালিকী মাযহাব – এই মাযহাবের বিকাশ ঘটে নবীর (সা.) শহর মদীনায়, যেখানে তাঁর অনেক সাহাবী বসবাস করতেন ৷ এই মাযহাব মালিক বিন আনাসের (৯৫ – ১৭৯ হিজরী) নামানুসারে পরিচিত – যিনি হাদীসের একজন স্কলার ও ফিকাহশাস্ত্রবিদ ছিলেন ৷ এই মাযহাব দ্রুত উত্তর আফ্রিকায় ছড়িয়ে পড়ে যেখানে আজও এর প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়, উপরন্তু মুসলিম স্পেনেও এটাই ছিল প্রধান মাযহাব ৷
৩) শফিঈ মাযহাব– এই মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মুহাম্মাদ ইবন ইদ্রিস আল শাফি’ঈ (১৫০ – ২০৪ হিজরী) – যাঁর নাম অনুসারে এই মাযহাবের নামকরণ হয়েছে ৷ মক্কার একটি পরিবারে জন্মগ্রহণ করা আল শাফি’ঈ মদীনায় গমন করেন ৷ তিনি ইরাকেও যান এবং আবু হানিফার ছাত্র মুহাম্মাদ আল হাসানের সাথেও কথাবার্তা বলেন ৷ উসূল আল ফিক্হ বা ইসলামী আইনতত্ত্বের উপরে প্রথম পুস্তকের সংকলন ইমাম শাফি‘ঈই করেছিলেন ৷ এটা একটা বিশাল কাজ ছিল এবং এতে ইসলামে সুন্নাহর কর্তৃত্ব ও মর্যাদা স্পষ্ট করে নির্দেশিত হয়েছে ৷ আজকের দিনে মিশর, সিরিয়া, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং অন্যান্য স্থানে শাফিঈ মাযহাবের প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয় ৷
৪) হাম্বলী মাযহাব – আহমাদ বিন হাম্বলের (১৬৪ – ২৪১ হিজরী) নামানুসারে এই মাযহাব পরিচিত ৷ ইমাম আহমাদ ছিলেন হাদীসের এক বিশাল পন্ডিত ব্যক্তি ৷ মুসনাদ আহ্মাদ নামে এক বিশাল গ্রন্থের তিনি ছিলেন প্রণেতা ৷ ফিকাহের ব্যাপারে তিনি তাঁর শিক্ষক ইমাম আল-শাফি’ঈ কর্তৃক গভীরভাবে প্রভাবিত হন ৷ আজকের দিনের সৌদী আরবে, হাম্বলী মাযহাবই হচ্ছে প্রধান ৷