ইন্দুবালা ভাতের হোটেল : কল্লোল লাহিড়ী

যে ভূমিতে জন্ম, পরিচিত বাতাসে শ্বাস ফেলা, চেনা মাটি, চেনা মানুষ সব ফেলে যখন একদমই অপরিচিত কিছুকে নিজের নতুন পরিচয় বলে মেনে নিতে হয়, তখন আসলে কেমন লাগে? চেনা পরিচিত সবকিছু যখন শুধু ফেলে আসা কিছু স্মৃতি তখন মনের গহীনে ঠিক কী অনুভূতি হয়? পুতুল খেলার বয়স পেরিয়ে যখন সদ্য মনে একটু বাতাস লাগে তখনই যদি শাঁখা-সিঁদুরের ভার বহন করতে হয়, তখন ঐ কিশোরী মনে যে ঝড় বয়ে যায় তার খোঁজ কি কেউ রাখে? স্মৃতি বড়ো আশ্চর্য জিনিস। যুগ পেরিয়ে গেলেও অতীত যেন মনের মণিকোঠায় জ্বলজ্বল করতে থাকে।
দেশভাগেরও আগের কথা।
খুলনার কলাপোতা গ্রামের ছোট্ট ইন্দু। উচ্ছল, প্রাণবন্ত কিশোরী। বাবা-মা, ভাই, ঠাকুমা-দাদু নিয়ে তার পৃথিবী। কাকডাকা ভোরে ভাইকে নিয়ে মাছ ধরে যাওয়া, ঠাকুমার কাছে গল্প শোনা আর নানা রকম রান্নার কথা শুনে কেটে যাচ্ছিল বেশ। স্কুলের লেখাপড়াও চালিয়ে যাচ্ছিল। সুন্দর একটা জীবন ছিল তার। 
এরপরেই হঠাৎ কলকাতার ছেনু মিত্তির লেনে মাস্টার রতনলাল মল্লিকের সাথে সাত পাকে বাঁধা পড়ল সে। পরিচিত কলাপোতা ছেড়ে পারি জমালো কলকাতায়। স্বামীর সংসারে। ভালো স্বামী আর সুখের সংসারের স্বপ্ন তো সবাই দেখে। ইন্দুর স্বপ্ন কেমন ছিল?
শশুরবাড়ি এসে ইন্দু বুঝতে পারলো পরিচিত গন্ডি, প্রিয় মানুষ সব এখন অতীত। সংসারের দায়িত্ব পালন আর রতনলালের শয্যাসঙ্গী হিসেবে কাঁটছে তার জীবন। এরইমাঝে হয়ে গেলো দেশভাগ। শান্তি আনতে নাকি একটা দেশকে কেঁ টে ছিঁ ড়ে দুই ভাগ করা হলো। কলাপোতা এখন পাকিস্তানের অংশ হয়ে গেলো।
দুইদেশের সীমানায় দাগ দিয়ে দেয়া হলো। যে দাগ বর্ষার বানেও ধুয়েমুছে ছাপ হয়ে যাবার নয়। এরপর সেই পাকিস্তানও ভাগ হয়ে বাংলাদেশ নামে আর্বিভূত হলো। খুলনার সেই কলাপোতা হয়ে গেল বাংলাদেশের অংশ। সময় এগিয়ে যায়। ইন্দুর সংসারে সন্তান হয়, শাশুড়ি পরপারে পাড়ি জমায়। মদ-জুয়ায় আসক্ত রতনলালও এক্সময় ভবলীলা সাঙ্গ করে চলে যায় পরপারে। ঘরে বাড়ন্ত চাল, সন্তানের ক্ষুধার্ত মুখ। এভাবেই হয়তো শেষ হতে পারতো ইন্দুবালার জীবন।
অন্ধকারে আলো হয়ে দেখা দিলো বিহারী লছমী। সেই কবে দু’টাকা ফেলে সে ইন্দুর বাড়িতে খাওয়ার মেলা জমালো তাই একসময় তড়তড় করে বেড়ে উঠলো ❝ইন্দুবালা ভাতের হোটেল❞ হিসেবে। সেই যে লোক খাওয়ানো শুরু হলো তা একদিনের জন্যেও বন্ধ হলো না। কত চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আজ সত্তরোর্ধ বিধবা ইন্দুবালা মাথা তুলে আছেন তা কেবল সেই সময়ের স্রোত জানে, জানে ইন্দু নিজে আর  কিছুটা জানে সেই মাছওয়ালী লছমী।
এতো বছর পেরিয়ে এতো স্মৃতি ইন্দুবালা সব নিজের মাঝে সযত্নে লুকিয়ে রেখেছেন। লুকিয়ে রেখেছেন কলাপোতার সেই না হওয়া না বোঝা আবেগকে। মুসলিম মনিরুল। যার সাথে সাইকেলে চড়া, স্কুলে যাওয়া কিংবা রথের মেলা দেখতে যেতেন। যার জন্য শাড়ির কোচে চন্দ্রপুলি নিয়ে যেতেন। যার মুখের বিষাদসিন্ধু কিংবা নকশী কাঁথার মাঠ শুনে চোখে জল আসতো। ভালোবাসতেন কি তাকে? রূপাই আর সাজুর মাঝে নিজেদের খুঁজে পেতেন কি? 
একাত্তরে পুরো পরিবারের পুড়ে ছাড়খার হয়ে যাওয়াও সয়ে নিয়েছিলেন ইন্দুবালা। নিজেকে গড়ে নিয়েছিলেন এক শক্ত প্রলেপ দিয়ে। কাজ, সন্তানদের মানুষ করে যার যার পথে পাঠিয়ে আঁকড়ে ধরে রেখেছেন শুধু নিজের হোটেলটাকে। শতশত লোক আজও ইন্দুবালার হোটেলে এসে দু❜বেলা অন্ন গ্রহণ করে যায়। চেখে যায় তার হাতের তৈরি অসাধারণ সকল পদ। রান্নায় সে মাঝে মাঝে তুলে নিয়ে আসেন একটুকরো কলাপোতাকেও। স্মৃতি হাতড়ে বেড়ান ছোটোবেলার। ঠাকুমার দেয়া প্রতিটি শিক্ষা মনে রেখেছেন। তাই কোথাকার সেই কলাপোতার ছোট্ট ইন্দু আজ ছেনু মিত্তির লেনের ভাতের হোটেলের মালিক। ছেলে, ছেলের বউয়েরা, নাতি-নাতনীতে পূর্ণ ইন্দুর জীবন। তাও সে বড্ড একা। তাকে ঘিরে ভীড় জমিয়েছে কত না স্মৃতি। যার কিছু লিখে রাখেন সেই মোটা হালখাতায় আর বেশিরভাগই আগলে রেখেছেন নিজের মনে। আর চালিয়ে যাচ্ছেন ❝ইন্দুবালা ভাতের হোটেল❞। 
পাঠ প্রতিক্রিয়া:
বইটার নাম যখন প্রথম শুনেছিলাম তখন খুব স্বাভাবিকভাবেই ধরে নিয়েছিলাম ❝আদর্শ হিন্দু হোটেল❞ এর কপিক্যাট হবে হয়তো। তাই খুব একটা বেশি আগ্রহ জন্মায়নি বইটার প্রতি সত্য। বেশ কয়েকটা রিভিউ দেখেছিলাম। খাবারের জিভে জল আনা বর্ণনা আর অতীত বর্তমান মিলিয়ে স্মৃতিচারণ বইটার প্রতি আগ্রহ তৈরি করে। এরপর শেষ জানলাম এই বই অবলম্বনে তৈরি হচ্ছে ওয়েব সিরিজ। পূর্ব অভিজ্ঞতা অনুযায়ী বই থেকে চিত্রনাট্য ৯৯ভাগেই হয় বইয়ের শ্রাদ্ধ। তাই সিরিজ আসার আগেই বইটা পড়ে ফেললাম।
খুলনার কলাপোতা গ্রামের ইন্দুর স্থায়ী নিবাস হয়ে যায় কলকাতার ছেনু মিত্তির লেন। গ্রামের মায়া মায়া পরিবেশ ছেড়ে ইট কাঠের শহুরে জীবনে প্রবেশ করে বুঝে যায় জীবনে টিকে থাকার কঠিন এক যুদ্ধে নেমেছে সে। স্বামীর দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে সংসারে প্রবেশ হয় একদম সাদামাটাভাবে। চলতে থাকে সংগ্রাম। এরপর বিখ্যাত ভাতের হোটেলের মালিক হয়ে যাওয়া। এই তো ইন্দুর গল্প। বা ইন্দুর স্মৃতিচারণ। যা লেখক অতীত বর্তমানের মিশেলে লিখেছেন। এ আর এমন কি!
কিন্তু না। সত্তরোর্ধ এক বিধবার জীবন সংগ্রামকে লেখক এত মায়া দিয়ে লিখেছেন যা পাঠককে মুগ্ধ হতে বাধ্য করবে। পুরো বইকে মোট আটটি অধ্যায়ে ভাগ করেছেন। প্রতিটি অধ্যায়ের নাম দিয়েছেন খাবারের পদে। আর সেখানে ইন্দুর অতীত আর  বর্তমানকে সমান্তরালে বর্ণনা করেছেন। ইন্দুবালার রান্নার খ্যাতি, তার সাধারণ জীবন আর নিজের ভেতরের অদ্ভুত ভালোবাসা লুকিয়ে রাখার এক অসীম ক্ষমতা মিলে ইন্দুবালা চরিত্রকে দাঁড় করিয়েছেন অনন্যভাবে।
অল্প বয়সে স্বামী হারিয়ে সন্তানদের নিয়ে যুদ্ধ করে গেছেন। কঠোর শা স নে সন্তানদের মানুষ করেছেন একদিকে। আবার তাদের বিয়ে দিয়ে আলাদা সংসার করতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। কাউকেই আঁকড়ে ধরে রাখেননি। তাও সন্তানেরা এক অদ্ভুত বন্ধনে আবদ্ধ নিজেদের সাথে, মায়ের সাথে। হাজারো সংগ্রামী নারীদের এক প্রতিনিধি হয়ে উপন্যাসে মুখ্য ভূমিকা পালন করে গেছেন তিনি।
খুলনার প্রকৃতির বর্ণনা লেখক এতো দারুণভাবে দিয়েছেন, যেন  সব নিজ চোখে দেখতে পাচ্ছিলাম। ইন্দুবলার শৈশব-কৈশোরের দুরন্তপনা থেকে সংসারের দায়িত্ব কাধে নিয়ে এক অন্যরকম ইন্দুবালার আত্মপ্রকাশ সবকিছুতে লেখকের লেখার দক্ষতা প্রকাশ পেয়েছে।
খাবারের বর্ণনাতে নাই বা গেলাম। উপন্যাসের খাবারের কথা থেকেও মনে বেশি দাগ কেটেছে ইন্দুবালার স্মৃতি। ভালো লাগার মানুষগুলোর কথা, পাওয়া না পাওয়ার কথা। অনেক অনেক মায়া দিয়ে লিখেছেন ইন্দুবালার প্রতিটা মুহূর্ত। খুব ভালো লেগেছে পড়তে।
আমি মোটামুটি ফাস্ট রিডার। তবে এ বইটা আমি বেশ সময় নিয়ে ধীরে ধীরে পড়েছি। উপভোগ করেছি। ❝আদর্শ হিন্দু হোটেল❞ এর কপিক্যাট ভেবেছিলাম। তবে লেখকের লেখার মুন্সিয়ানা সেই ভাবনা ভুল প্রমাণ করে দিয়েছে।
এবার একটু বাড়তি কথা বলি।
বইটা পড়ে যে মুগ্ধতা কাজ করছে জানি না সিরিজে সেটার কতটুক প্রতিফলন হবে। ইন্দুবালার চরিত্রে শুভশ্রী কতটা পারফেক্ট আমি জানিনা। তবে পড়ার সময় ক্যারেকটার পোট্রেট হিসেবে শুভশ্রী-ই কল্পনায় এসেছে। ইন্দুবালার ছোটকাল বা কিশোরী সময়টাতে আশা করি অন্য কাউকে দিয়ে করাবে। পরিণীতা সিনেমার মতো ছোট্ট দেখাতে ফ্রক পড়ে শুভশ্রীকেই সেই রোলে না দিক আশা করি।  
বই : ইন্দুবালা ভাতের হোটেল
লেখক : কল্লোল লাহিড়ী
প্রকাশনী : সুপ্রকাশ (কলকাতা)
রিভিউ ক্রেডিট : রেহনুমা প্রাপ্তি 
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?