Etihaser Dushorkhata Book Specification
Title | ইতিহাসের ধূসরখাতা |
Author | মাওলানা ইসমাইল রেহান |
Publisher | কালান্তর প্রকাশনী (সিলেট) |
Quality | হার্ডকভার |
ISBN | 9789849659006 |
Edition | 1st Published, 2022 |
Number of Pages | 312 |
Country | বাংলাদেশ |
Language | বাংলা |
মাওলানা মুহাম্মদ ইসমাইল রেহান এর সংক্ষিপ্ত জীবনী
নাম মুহাম্মদ ইসমাইল। ‘ইসমাইল রেহান’ তার কলমি নাম। হাফেজ, মাওলানা। জন্মেছেন করাচীতে। পহেলা ফেব্রুয়ারি, ১৯৭১। বাবা আব্দুল আজিজ। তার পূর্বপুরুষরা দেশভাগের সময় ইসলামি দেশে বসবাসের জন্য পশ্চিমবঙ্গ থেকে পাকিস্তানে হিজরত করেন। করাচীর পুরনো গোলিমার এলাকায় বড় হয়েছেন। মায়ের কাছে দ্বীনিয়াত বিষয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি স্থানীয় স্কুলে ফরমাল এডুকেশন গ্রহন করেন। ১৯৮৬ সালে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
এরপর ভর্তি হন দারুল উলুম করাচীতে। বাহাদুরাবাদের জামেয়া মা’হাদুল খলীল আল ইসলামী থেকে ১৯৯৫ সালে তাকমীল সমাপন করেন। এর মাঝে আল্লামা আবদুর রশীদ নু’মানীর শিষ্যত্ব অর্জন করেন। তারপর ২০০৬ সালে করাচী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে বি.এ (সম্মান) এবং ২০১০ সালে করাচীর উর্দু বিশ্ববিদ্যালয় (FUUAST) থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি সমাপ্ত করেন। দীর্ঘ দুই দশক ধরে শিক্ষকতা করে আসছেন। ‘যরবে মুমিন’ ও ‘রোজনামা ইসলাম’ পত্রিকায় কলাম লিখে বিখ্যাত হয়েছেন। ২০০৬ সাল থেকে ২০০৯ পর্যন্ত মাসিক সুলূক ও ইহসান পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন।
শিশুদের জন্য প্রকাশিত একটি পত্রিকা ‘বাচ্চোঁ কা ইসলাম’ ও নারীদের নিয়ে প্রকাশিত ‘খাওয়াতিন কা ইসলাম’ পত্রিকার সম্পাদনা র সঙ্গেও জড়িত ছিলেন।
ইসমাইল রেহান—এই সময়ের বহুল পঠিত ইতিহাসবিদদের একজন তিনি। উম্মাহর দরদ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে লেখা তাঁর বিশেষ কিছু প্রবন্ধের সংকলন ইতিহাসের ধূসরখাতা। সাধারণ ঘটনার আড়ালে যে অসাধারণ বাস্তবতা থাকে, উম্মাহর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এমন কিছু বাস্তবতার বিশ্লেষণধর্মী প্রবন্ধ দিয়েই সাজানো হয়েছে গ্রন্থটি। বলতে গেলে ইতিহাসের চেনা পথঘাটই এখানে অঙ্কিত হয়েছে একটু ভিন্ন আঙ্গিকে। কিছু ঘটনার দৃশ্যপট সামনে এনে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে উম্মাহর উত্থান-পতন ও ক্ষয়-লয়ের কারণ। হালের সংকট উতরে যাওয়ার ফরমুলাও বাতলে দেওয়া হয়েছে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে। ফলে নির্দ্বিধায় গ্রন্থটিকে আজকের মেধাসন্ত্রাস ও বুদ্ধিবৃত্তিক দাসত্বের যুগে পাঠকের চিন্তার দীনতা, বুদ্ধির অপূর্ণতা এবং সাহস ও কৌশল প্রয়োগের ভয়াতুর জড়তা থেকে মুক্তির সিলেবাস বলা যেতে পারে।
Read Before Buy Itihasher Dushorkhata
ইতিহাস কি ইসলামবিবর্জিত শাস্ত্র ?
এক.
ইতিহাস আসলে কী? ইতিহাস ইসলামবিবর্জিত কোনো শাস্ত্র? ইতিহাস রচনা করা কিংবা পড়া শরিয়তবিরোধী কাজ? ইতিহাস কি শুধু এমন কিছু গ্রন্থের নাম, যা রোম অথবা পারস্যের কেউ রচনা করেছে? ইতিহাস বলতে কি শুধু নবি-রাসুল আর রাজা বাদশাহদের ঘটনাপ্রবাহ কিংবা আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, তারিখু ইবনু খালদুন আর আকবর শাহ নজিবাবাদির তারিখে ইসলাম প্রভৃতি গ্রন্থ বোঝায়? কেউ যদি এমন মনে করে থাকে, তাহলে মেনে নিতেই হবে, এ ধারণা একেবারে অসম্পূর্ণ ও অপরিপক্ক।
ইতিহাস হচ্ছে অতীতের ঘটনাপ্রবাহ ও সামগ্রিক অবস্থার নাম; জাতীয়ভাবে সংরক্ষণযোগ্য একটি বিষয়ের নাম। যখন তা সংরক্ষিত থাকবে না, তখন একটি জাতির অবস্থাও তেমনই হবে, যেমনটা মানসিক ভারসাম্যহীন কোনো রোগীর হয়। ইতিহাস জাদুবিদ্যা বা বিপজ্জনক অন্যান্য শাস্ত্রের মতো কোনো ঘৃণ্যবিদ্যা বা শাস্ত্র নয়; বরং তা একটি সমাদৃত, সুন্দর, উপকারী ও মর্যাদাপূর্ণ বিদ্যা বা শাস্ত্র। ইতিহাসচর্চার প্রতি আল্লাহ তাআলা নিজে নবি-রাসুলদের উৎসাহিত করেছেন। যেমন, মুসা আ.-কে আল্লাহ বনি ইসরাইলের ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করে বলেছেন,
وذكرهم بأيم الله
আর আপনি তাদের স্মরণ করিয়ে দিন আল্লাহর দিনগুলো সম্পর্কে। সুরা ইবরাহিম : ৫)
মুফাসসিররা একমত যে, আয়াতটিতে ‘আইয়ামুল্লাহ’ দ্বারা উদ্দেশ্য, বনি ইসরাইলের অতীতের বড় বড় সেই ঘটনা, যেগুলোতে তারা আল্লাহর সাহায্যে বিজয় লাভ করেছে বা অন্য কোনো নিয়ামত লাভ করেছে; কিংবা যেগুলোতে তারা পরাজিত হয়েছে বা শাস্তি ভোগ করেছে, দুর্দশায় পড়েছে।
আল্লাহ তাঁর প্রিয় নবিকে লক্ষ করে আরও বলেছেন,
ও অবস্থা বর্ণনা করার পেছনে সুস্পষ্ট কোনো কারণ তো অবশ্যই বিদ্যমান—তাই না? নবিজি নিজে ঐতিহাসিক ঘটনা; বরং জাহিলি যুগের ঘটনাবলি শোনাতেন। তাঁর মজলিসে সাহাবিগণ নিজেদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা শোনাতেন। তিনি নিজেও সেগুলো শুনে শুনে মুচকি হাসতেন।
সাহাবিদের যুগ পর্যন্ত ইতিহাসের মধ্যে কিন্তু নবিজির পুরো জীবনবৃত্তান্ত চলে এসেছে, যার বিশাল অংশ ছিল শরিয়তের বিধানকেন্দ্রিক; কিন্তু এর একটা অংশ এমন আছে, যা জীবনচরিতসম্পৃক্ত। বুখারি ও মুসলিমের ‘কিতাবুল মাগাজি’ (জিহাদ অধ্যায়) অধ্যয়ন করে দেখুন, যার মূল উদ্দেশ্য কিন্তু নবিজির অবস্থা ও জীবনীসম্পৃক্ত বর্ণনাগুলোর ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা ঠিক রাখা। এরপর সাহাবিদের যুগে দিনপঞ্জিকা তৈরি হয়। উমর রা.-এর যুগে যখন বিজয়ধারা প্রসারিত হতে থাকে, মদিনার কেন্দ্রীয় দপ্তর ও বিভিন্ন প্রাদেশিক দপ্তরে নথিপত্রের স্তূপ পড়ে যায়, তখন কোন নথিটা কোন তারিখের, এটা নির্ণয় করা মুশকিল হয়ে যায়।
ইমাম বুখারি রাহ. আল-আদাবুল মুফরাদে বর্ণনা করেন, একবার উমর রা.-এর কাছে একটি চিঠি আসে, যেটিতে শুধু শাবান লেখা ছিল। উমর রা. বলে ওঠেন, ‘এখন কীভাবে জানব এটা কোন বছরের শাবান?’… এরপর তিনি উপস্থিত সাহাবিদের বলেন, ‘সবাই মিলে লোকদের জন্য বর্ষগণনার কোনো মাপকাঠি ঠিক করে দাও।’ উত্তরে কেউ বলেন, ‘রোমানদের মতো করে বর্ষগণনা করা যায়। প্রতিউত্তরে উমর বলেন, ‘রোমানদের হিসাবমতো বর্ষগণনা করলে সময়টা অনেক দীর্ঘ হয়ে যায়। কারণ, তারা ইসকান্দারের (Alexander the Great) যুগ থেকে বর্ষগণনা করে। কেউ একজন বলে বসেন, ‘পারসিকদের হিসাবমতো বর্ষগণনা করা যায়।’ প্রতিউত্তরে তিনি বলেন, ‘তাদের বর্ষগণনা তো বাদশাহ পরিবর্তন হওয়ার পর নতুন করে শুরু হয়।’ শেষমেশ সিদ্ধান্ত হয়— মুসলমানদের জন্য আলাদা কোনো দিনপঞ্জিকা ঠিক করা হবে। এখন প্রশ্ন ওঠে, তাহলে কবে থেকে বর্ষগণনা হবে? তিনটি মত সামনে আসে :
১. নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্ম থেকে।
২. হিজরত থেকে।
৩. মৃত্যু থেকে।
উমর রা. ফায়সালা দিয়ে বলেন, ‘হিজরত থেকে দিনপঞ্জিকার বর্ষগণনা শুরু হবে।
* এখানে যে বিষয়টি বলে রাখা জরুরি মনে করছি—বিগত জাতিগুলোর কোনো ঘটনা শরিয়তের বিধান প্রবর্তনের দৃষ্টিকোণ থেকে বর্ণিত হয়নি। এর অবস্থান ও মর্যাদা শুধু ঐতিহাসিক — হোক তা নবি-রাসুলদের ঘটনা। শামায়িলে তিরমিজি।*
কারণ, এর মাধ্যমেই হক আর বাতিলের মধ্যে পার্থক্য সাব্যস্ত হয়েছিল।’
যখন সাহাবিদের পরামর্শসভায় এটা সিদ্ধান্ত হয়, নবিজির হিজরত থেকে বর্ষগণনা করা হবে; এরপর প্রশ্ন আসে—কোন মাসের মাধ্যমে শুরু হবে? যেহেতু হিজরত সংঘটিত হয়েছিল রবিউল আউয়ালে, তাই সাহাবিদের অনেকে এ মাসকেই হিজরিবর্ষের প্রথম মাস নির্ধারিত করার প্রস্তাব দেন। অনেকে আবার রমজানের ফজিলত, মর্যাদা ও মাহাত্ম্য বিবেচনায় এ মাসের পক্ষে মত ব্যক্ত করেন; কিন্তু উসমান রা. বলেন, ‘মুহাররাম যেহেতু সম্মানিত ও নিষিদ্ধ মাস— অর্থাৎ, এ মাসে যেহেতু যুদ্ধবিগ্রহ নিষেধ, সে হিসেবে এর মাধ্যমেই হিজরিবর্ষের সূচনা হোক। তা ছাড়া এ দিনে লোকেরা হজের সফর শেষ করে প্রত্যাবর্তন করে।
উসমানের প্রস্তাব উপস্থিত সবার কাছে উত্তম মনে হয়। এরপর সিদ্ধান্ত হয়, হিজরিবর্ষ
মুহাররামের মাধ্যমে শুরু হবে। এটি ছিল ১৭ বা ১৮ হিজরির ঘটনা। তখনই মূলত হিজরিবর্ষ হিসেবে দিনপঞ্জিকা গণনা শুরু হয়; প্রকৃতপক্ষে যা ছিল ইসলামি ইতিহাস রচনার ভিত্তি। সাহাবিগণও ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো অনেক আগ্রহের সঙ্গে শুনতেন। ঐতিহাসিক ঘটনা শোনা ও বর্ণনা করার রুচিবোধ তৈরি করার ক্ষেত্রে আমির মুআবিয়া রা.-এর নাম সর্বাগ্রে আসে, যাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিদিন ইশার নামাজের পর ঐতিহাসিক ঘটনাবলি আলোচনা করার মজলিস অনুষ্ঠিত হতো।
এখন আসা যাক তাবিয়িযুগের আলাপে। তাঁদের যুগে তো সাহাবিদের আলোচনাও ইতিহাসের অংশে পরিণত হয়। তাঁদের জীবনচরিত ও সার্বিক অবস্থা বর্ণনা করা এবং একত্রিত করাকেও উম্মাহ জরুরি মনে করে। ফলে তাঁদের জীবনচরিতও ইতিহাসের অংশ হয়ে যায়। এভাবে তাবিয়িদের অবস্থা তাবে তাবিয়িরা একত্রিত করেন। আর তাঁদের অবস্থা একত্রিত করেন তাঁদের পরবর্তী যুগের লোকেরা। এভাবেই ইতিহাসের উপকরণ একত্রিত হতে থাকে। এরপর এই উপকরণগুলো মূলত ভিন্ন ভিন্ন শিরোনামে সন্নিবেশিত করা হতে থাকে; আর বিভিন্ন ইতিহাসগ্রন্থ অস্তিত্ব লাভ করতে থাকে।
দুই.
ইতিহাসের ব্যাপারে পুরানো এই আলাপগুলো আজ নতুন করে এ জন্য তুলতে হচ্ছে, তথাকথিত বুদ্ধিজীবী গবেষকসমাজ আবারও নিজেদের সীমারেখা ভুলে বলে বসেছে— ইসলামপন্থিদের মধ্যে তো নিয়মতান্ত্রিকভাবে ইতিহাসগ্রন্থের প্রচলনই ঘটেনি। এ জন্য তাদের ইতিহাসও পৃথিবীর অন্য সবার ইতিহাসের চেয়ে তুলনামূলক অসমৃদ্ধ! তাদের এ দাবি তিনটি বিষয়ে অজ্ঞতা বা ভুল ধারণা রাখার কারণে সৃষ্টি হয়েছে..
১. ইতিহাসের যারা বর্ণনাকারী, তাদের জীবনচরিতের ওপর কোনো কাজ হয়নি; শুধু হাদিসের বর্ণনাকারীদের জীবনচরিতের ওপর কাজ হয়েছে।
২. ইতিহাসগ্রন্থ বলতে যা কিছু প্রকাশিত হয়েছে, সবই তো নবিজি ও সাহাবিদের যুগের প্রায় ১৫০ বছর পর হয়েছে। এর বিপরীতে হাদিস নববি যুগেই সংকলিত হয়েছিল, বিভিন্নভাবে বিন্যস্তও হয়ে গিয়েছিল। এখন যে বিষয়টা সুস্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে, দেড়শো বছর পরের সিরাত-গবেষক আর ইতিহাসবিদরা নবিজি ও সাহাবিদের সার্বিক অবস্থা নিজেদের চোখে প্রত্যক্ষ করতে পারেননি। সুতরাং তারা যা কিছু লিখেছেন, সবই গালগল্প ছাড়া বেশি কিছু নয়। তবে হাদিস যেহেতু নববিযুগেই সংকলিত হয়ে গিয়েছিল, তাই তা পুরোপুরি গ্রহণযোগ্য ধরে নেওয়া যায়।
৩. হাদিস সংকলন নিয়ে যাঁরা কাজ করেছেন, তাঁরা সবাই ছিলেন আলিম। ছিলেন আমানতদারিতায় অতুলনীয়। তাঁরা দীনকে সংরক্ষণ করার মানসে একনিষ্ঠতার সঙ্গে কাজ করেছিলেন। বিপরীতে যারা ইতিহাস ও সিরাত রচনা করেছেন, মোটাদাগে তারা ছিল দরবারি মুনশি। যাদের স্বভাব-প্রকৃতি ছিল একেবারেই ভিন্ন। অধিকাংশই অসৎ ও খিয়ানতকারী ছিল। তারা ইসলামের জন্য নয়; নিজেদের ভ্রাতৃত্ববোধ, স্বজনপ্রীতি, গোত্রপ্রীতি, বংশীয় টান অথবা নিজের রাজা-বাদশাহর সন্তুষ্টিকামনায় রচনার কাজ করত।
সরল ভাষায় বললে, তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এ ভুল ধারণাগুলো সৃষ্টি হয়েছে ইসলামি জ্ঞান আর সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পর্যাপ্ত জানাশোনা না থাকার কারণে। বলা যায়, তারা এসব ভাবনা অন্য কোনো জগতে গিয়ে ভেবেছিল, যার সঙ্গে বাস্তবজগতের কোনো সম্পর্ক নেই।
তাদের প্রথম ধারণাটির ভ্রান্তি তাদের এ কথা থেকেই সুস্পষ্ট হয়ে যায়, হাদিস সংকলনের ক্ষেত্রে আলিমরা সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করেছেন। এক এক করে প্রত্যেক বর্ণনাকারীর জীবন, কর্ম, চরিত্র ও বিশ্বাস সম্পর্কে পর্যন্ত বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।’ কিন্তু পরের বাক্যেই বলে, ‘ইসলামি ইতিহাসের ক্ষেত্রে এর ঠিক বিপরীতটা হয়েছে। তাদের এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। বাস্তবতার সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। কারণ, যেভাবে হাদিস বর্ণনাকারীদের ইমান, আকিদা, আমানতদারিতা, ধার্মিক হওয়া, মিথ্যাবাদী হওয়া, দুর্বলতাসহ সব ধরনের অবস্থা সংরক্ষণ করা রয়েছে, ঠিক তেমনিভাবে হিজরি চতুর্থ অথবা পঞ্চম শতাব্দী পর্যন্ত ইতিহাস বর্ণনাকারীদের সার্বিক অবস্থাও সংরক্ষিত রয়েছে। রিজালশাস্ত্রের গ্রন্থগুলো রচনার সময় কখনো এটা আলাদাভাবে লক্ষ রাখা হয়নি যে, এসব গ্রন্থে শুধু হাদিস বর্ণনাকারীদের সার্বিক অবস্থা ও জীবনী লিপিবদ্ধ হবে; ইতিহাস বর্ণনাকারীদের নয়।
রিজালশাস্ত্রবিদদের কাজ হচ্ছে, মুসলমানদের মধ্যে বর্ণিত হয়েছে, এমন প্রতিটি বর্ণনার প্রত্যেক বর্ণনাকারীর অবস্থা ও জীবনী সংরক্ষণ করা। কে বর্ণনা করেছে আর কোন বিষয়ে করেছে–আকিদা, তাফসির, সিরাত, সুন্নাহ, ফাজায়িল, মানাকিব নাকি ইতিহাস, এসবের কোনো ধরাবাঁধা ছাড়াই। তাদের মূল কাজ হয়, শুধু সেই ব্যক্তির জীবনী সংরক্ষণ করা, যার নাম কোনো বর্ণনার সনদের ধারাবাহিকতায় এসেছে। আমাদের উপরের আলোচনা থেকে বোঝাই যাচ্ছে, যেভাবে হাদিসের বর্ণনাকারীদের সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে যাচাই-বাছাই ও গবেষণা করা হয়েছে, তেমনি ইতিহাসের কোনো বর্ণনাকারীও ‘জারহ্ ও তাদিল’-এর গবেষকদের যাচাই-বাছাই থেকে বাদ যায়নি। হাদিসের বর্ণনাকারীদের মধ্যে যেমন জয়িফ (দুর্বল) ও সিকাহ (নির্ভরযোগ্য) বর্ণনাকারী রয়েছে এবং রিজালশাস্ত্রের মাধ্যমে তাদের যাচাই-বাছাই করা হয়, একইভাবে ইতিহাস ও সিরাতের বর্ণনাকারীদেরও যাচাই-বাছাই করা হয়।
তাদের দ্বিতীয় ধারণা—অর্থাৎ, হাদিসের গ্রন্থগুলো তো অনেক আগেই সংকলিত হয়েছে; আর ইতিহাসের গ্রন্থগুলো বহু পরে। আরেকটু খুলে বলি; তারা সুন্নাহর ভান্ডার সম্পর্কে বলে, ‘হাদিসের সুবিশাল এই ভান্ডারের সংকলনের কাজ তো রাসুল -এর যুগেই শুরু হয়েছিল। যেমন, সহিফাতু হুমাম ইবনু মুনাব্বিহ৷’ এরপরই ইতিহাস সম্পর্কে মন্তব্য করে তারা বলে, ‘কিন্তু ইতিহাসের প্রথম গ্রন্থ সিরাতুন নবির ওপর ইবনু ইসহাকের সিরাতগ্রন্থ, যা নবিজির মৃত্যুর শতবর্ষ পর সংকলিত হয়েছে।’
দ্বিতীয় ধারণার আদলে এসব কথাবার্তা যে সেসব তথাকথিত বুদ্ধিজীবীর অজ্ঞতা এবং জানাশোনার পরিধি সংকীর্ণ হওয়ার বিষয়টা সুস্পষ্ট করে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ, তাওয়াতুর তথা ১৪০০ বছরের পারম্পরিকতায় মুসলিম উম্মাহর বিশ্বাস হচ্ছে, প্রথম হিজরি শতাব্দী থেকে দ্বিতীয় হিজরি শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে ইসলামি জ্ঞানের সংরক্ষণের আসল ভিত্তি ছিল মুখস্থশক্তি আর সনদের ধারাবাহিকতা। বিচ্ছিন্নভাবে বর্ণনাগুলো লিপিবদ্ধ করার অনেক দৃষ্টান্ত থাকলেও তা মোটেও ইলমের একক বা
* ইলমুল জারহি ওয়াত তাদিল : একশব্দে বললে ‘নিরীক্ষণশাস্ত্র’। কয়েক শব্দে বললে, ‘হাদিসের বর্ণনাকারীদের সামগ্রিক অবস্থা বিশ্লেষণ করে ভালোমন্দ হুকুম আরোপ করা।’ পরিভাষায় ইলমুল জারহি ওয়াত তাদিল বলা হয় এমন ইলম বা শাস্ত্রকে, যাতে রাবি বা বর্ণনাকারীদের বর্ণনা গ্রহণ-বর্জন করার দিক বিবেচনায় রেখে তাঁদের সামগ্রিক অবস্থার ওপর আলোচনা করা হয়। এটি মর্যাদা, স্তর ও প্রভাবের দিক থেকে উলুমুল হাদিসের গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রকার। কারণ, এর মাধ্যমে শুদ্ধ হাদিসকে অশুদ্ধ হাদিস থেকে এবং মাকবুল (গ্রহণযোগ্য, সর্বস্বীকৃত) হাদিসকে মারদুদ (পরিত্যাজ্য, অগ্রহণযোগ্য) হাদিস থেকে আলাদা করা হয়। তবে এই আলাদা করার বা পার্থক্য নিরূপণের ধরনটি বিভিন্ন হুকুম ও নীতির ভিত্তিতে হয়ে থাকে।*
সীমাবদ্ধ রূপ ছিল না। কারণ, এমন সংকলনগুলো সংরক্ষণের কোনো প্রয়াসও তখন চালানো হয়নি। তাই খুলাফায়ে রাশিদিনসহ অন্য কোনো সাহাবির কোনো সংকলনই আমাদের কাছে পৌঁছায়নি। এরপর হাজারো তাবিয়ির মধ্যে কেবল একজন তাবিয়ি হুমাম ইবনু মুনাব্বিহের সহিফা (পুস্তিকা) পাওয়া যায়, যাতে শুধু আবু হুরায়রা রা. এর ১৩৮টি বর্ণনা সংকলন করা হয়েছে। আবদুল্লাহ ইবনু আমর ইবনুল আস রা. এর সহিফার আলোচনাও ইতিহাসগ্রন্থগুলোতে পাওয়া যায়; কিন্তু তা মলাটবদ্ধ হয়ে উম্মাহর কাছে পৌঁছায়নি। তাঁর যত বর্ণনা পাওয়া যায়, সবই সনদসহ মৌখিকভাবে উম্মাহর কাছে পৌঁছেছে, যা হাদিসের গ্রন্থগুলোতে লিপিবদ্ধ রয়েছে।
এই সংক্ষিপ্ত আলোচনার পর আমি তথাকথিত বুদ্ধিজীবীসমাজের কাছে অনুরোধ করব, একটু ভেবে দেখুন, আপনাদের আপত্তির ভিত্তি কতটা নড়বড়ে। তাদের কাছে যদি নবিজি ও সাহাবিদের যুগে সংকলিত এবং তাঁদের যুগ থেকে মলাটবদ্ধ হয়ে চলে আসা বিষয়গুলোই নির্ভরযোগ্য হয়, তাহলে তাদের উচিত নিজেদের বানানো মূলনীতি অনুযায়ী শুধু সহিফাতু ইবনু হুমামের ১৩৮টি বর্ণনাতেই নিজেদের জীবনাচার থেকে শুরু করে আমল পর্যন্ত সবকিছু সীমাবদ্ধ রাখা। তারপর মুজতাহিদ হয়ে অজু, নামাজ, জাকাত, হজ, কুরবানি প্রভৃতির সব মাসআলাও সেই ১৩৮টি বর্ণনা থেকেই উদ্ঘাটন করা। এরপর তাদের কী করা উচিত? হাদিসের এই সুবিশাল ভান্ডারকে অনির্ভরযোগ্য মনে করা—যার ভিত্তিই হচ্ছে, নবিজির যুগ থেকে হিজরি দ্বিতীয় ও তৃতীয় শতাব্দী পর্যন্ত মৌখিকভাবে ধারাবাহিক বর্ণিত হওয়া। অর্থাৎ, যাকে আমরা ‘তাওয়াতুর’ বলেছিলাম। কারণ, হাদিসের প্রথম মলাটবদ্ধ সংকলন অর্থাৎ, ইমাম আবু হানিফা রাহ.-এর কিতাবুল আসারও মোটাদাগে হিজরি শতবর্ষ পরই দৃশ্যমান হয়েছে। আর এটাই ছিল সেই যুগ, যে যুগে মুহাম্মাদ ইবনু ইসহাকের সিরাত সংকলিত হয়েছে। ইমাম মালিকের মুআত্তা কিন্তু এরও পরে অস্তিত্বে এসেছে। আর সিহাহ সিত্তাহ তথা হাদিসের ছয় গ্রন্থের কথা তো বলাই বাহুল্য, যেগুলোর সংকলনই হয়েছিল হিজরি তৃতীয় শতকে।
এখন সেই বুদ্ধিজীবীদের কথা অনুযায়ী তো হাদিসের এই পুরো ভান্ডারই গালগল্প সাব্যস্ত হয়। কারণ, এর সংকলকরা কেউই নববি যুগ বা সাহাবিদের যুগের ছিলেন না। এখন যদি তারা হিজরি দেড়-দুই শতাব্দী পর্যন্ত অন্তর থেকে অন্তরে আর মুখ থেকে মুখে—এককথায় সম্পূর্ণ অলিখিত হাদিসভান্ডারের ওপর পুরোপুরি বিশ্বাস রাখতে পারে, তাহলে এ কথা বলে সিরাতুন নবি আর ইতিহাসের ওপর পানি ঢেলে দেওয়ার কী অর্থ যে, ‘ইতিহাসের প্রথম গ্রন্থ সিরাতুন নবি বিষয়ে সংকলিত ইবনু ইসহাকের সিরাত, নবিজির মৃত্যুর শতবর্ষ পর সংকলিত হয়েছে।’
এরই সঙ্গে ইসলামপন্থিদের ব্যাপারে এই অনর্থক মন্তব্য করারও বা কী অর্থ হয় যে,
‘তাদের মধ্যে তো নিয়মতান্ত্রিকভাবে ইতিহাসগ্রন্থের প্রচলনই ঘটেনি।’ আসলে বিষয়টা আমাদেরও তো জানা দরকার, কোন শতাব্দী পর্যন্ত প্রচলন না ঘটা উদ্দেশ্য? যদি প্রথম শতাব্দী উদ্দেশ্য হয় তাহলে বলব, তখন পর্যন্ত তো হাদিসের গ্রন্তগুলোরও প্রচলন হয়নি। দ্বিতীয় শতাব্দী উদ্দেশ্য হলে বলব— ততদিন পর্যন্ত ইতিহাস গ্রন্থগুলোরও প্রচলন হয়ে গিয়েছিল। ইমাম বুখারি তখনো সহিহ বুখারিসংকলন করেননি; কিন্তু এর বহু আগেই তাঁর উসতাজ ইমাম খলিফা ইবনু খাইয়াত ধারাবাহিক বর্ষ ঠিক রেখে ইসলামি ইতিহাসগ্রন্থ তারিখ রচনা করেছিলেন, যা আজও প্রতিটি গ্রন্থাগারকে সমৃদ্ধ করে রেখেছে।
ঐতিহাসিক বর্ণনাগুলোর সবচেয়ে মজবুত ও নির্ভরযোগ্য উৎসগ্রন্থ হচ্ছে, তাবাকাতু ইবনু সাআদ, যা আট খণ্ডের বিশাল এক গ্রন্থ। এটাও বুখারি ও মুসলিমের আগেই অস্তিত্বে এসেছিল এবং প্রসিদ্ধিও লাভ করেছিল। এমন উজ্জ্বল সব দৃষ্টান্ত বিদ্যমান থাকার পরও কি কেউ বলতে পারে যে, মুসলমানদের মধ্যে ইতিহাসগ্রন্থের প্রচলন হয়নি?
তিন.
তথাকথিত বুদ্ধিজীবীমহলের তৃতীয় ভুল ধারণা— যা মূলত একরকমের খারাপ ধারণা এবং বলা যায়, তাদের বক্র চিন্তাভাবনারই বহিঃপ্রকাশ— তা হচ্ছে, ‘হাদিস সংকলনে যাঁরা কাজ করেছেন, অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন, তাঁরা ছিলেন আলিমশ্রেণির। এই শ্রেণির সঙ্গে ইতিহাস আর সিরাত সংকলকদের তুলনা প্রত্যাশিত নয়। কারণ, ইতিহাস ও সিরাত সংকলকরা ছিলেন মোটাদাগে আজমি (অনারব) এবং বংশগত গোঁড়ামির শিকার।’
দীনি মাদরাসাগুলোর একজন সাধারণ স্নাতকও জানেন কুরআন, হাদিস, ফিকহ, সিরাত, রিজাল ও ইতিহাসশাস্ত্র; এসব শাস্ত্র নিয়ে গবেষণা করেছেন যোগ্য আলিম শাস্ত্রবিদদের বিশাল একটি দল, যাদের কর্ম ও প্রচেষ্টা সেই সূচনাকাল থেকে আজ অবধি একইভাবে চলে আসছে। হ্যাঁ, জ্ঞান ও শাস্ত্রের ভিন্নতার কারণে তাঁদের মধ্যে তারতম্য তখনো ছিল, এখনো আছে। তবে ইতিহাস যে বিষয়টি সাক্ষ্য দেয়, তাবিয়ি, হাদিসের ইমাম ও ‘জারহ-তাদিল’-এর আলিমদের বিশাল একটা অংশ একইসঙ্গে মুহাদ্দিস, ফকিহ,
* পুরো নাম খলিফা ইবনু খাইয়াত ইবনু আবু হুরায়রা। যেহেতু তিনি উসফুরের (একপ্রকার গুল্ম-লতা, যা থেকে হলুদ রং পাওয়া যায়) ব্যবসা করতেন, তাই তাঁকে খলিফা ইবনু খাইয়াত উসফুরিও বলা হতো। উপাধি ছিল ‘শাবাব’ (যুবক)। তিনি ছিলেন আত-তারিখ ও আত-তাবাকাতের রচয়িতা। ইমাম জাহাবি তাঁর মৃত্যুর কথা আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। তিনি ১৬০ হিজরির দিকে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বেড়ে উঠেছেন বসরায়। তাঁর দাদা আবু হুরায়রা হচ্ছেন ‘আহলুল হাদিস’। তাঁর পিতাও হাদিসের রাবিদের একজন। তিনি বিখ্যাত সব তাবিয়ি থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন। আর তাঁর থেকে ইমাম বুখারি, আবদুল্লাহ ইবনু আহমাদ ইবনু হাম্বল, আবু ইয়ালা মাওসিলি, সানআনি প্রমুখ মনীষী হাদিস রিওয়ায়াত করেছেন।
আরো পড়তে অথবা দেখতে :- অনুগ্রহ করে Hardcopy ক্রয় করুন।
অনুরোধঃ– বই : ইতিহাসের ধূসরখাতা এর প্রি অর্ডার চলছে … তাই ইতিহাসের ধূসরখাতা বইটি PDF Free Download চাহিয়া লেখকদের নিরুৎসাহিত করিবেন না।
We Respect Every Author Hardwork – boipaw.com™
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?