জোডিয়াক কিলার। আমরা যারা বই পড়ি বা মুভি দেখি তাদের কাছে বেশ পরিচিত একটা নাম। সে এতটাই বিখ্যাত অথবা কুখ্যাত তাকে নিয়ে ২০০৭ সালে ডেভিড ফিঞ্চারের মত জনপ্রিয় পরিচালক বানিয়েছিলেন জোডিয়াক মুভি। মুভিটি এখনো ভীষণ জনপ্রিয়।
“This is the Zodiac speaking. By the way have you cracked the last cipher I sent you? My name is…” একটা খুনী কতটা দাম্ভিক হলে খুন করার পর পুলিশের কাছে কোড করা চিঠি পাঠায়? জোডিয়াক ছিলো তেমন একজন ভয়ংকর সাইকোপ্যাথ যে পুলিশের সাথে খেলতে পছন্দ করতো।
জোডিয়াক ১৯৬০ সাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত অফিশিয়ালি পাঁচজনকে খুন করে। আনঅফিশিয়ালি বলা হয় তার খুনের সংখ্যা ৩০ এর উপরে। অফিশিয়াল হিসেবস জোডিয়াক প্রথম খুন করে ১৯৬৮ সালের ২০শে ডিসেম্বর। জোডিয়াকের প্রথম শিকার ছিলো ডেভিড আর্থার ফ্যারাডে আর বেটি লুইস জনসন নামের ১৭ এবং ১৬ বছয় বয়সী প্রেমিক প্রেমিকা। যাদের জোডিয়াক .২২ বন্দুক দিয়ে গুলি করে খুন করে। এরপর বেশ কিছু দিন জোডিয়াক চুপ ছিলো। পরের বছর ৪ জুলাই সে আবার দুই প্রেমিক প্রেমিকাকে গুলি করে। প্রেমিকা মারা গেলেও বেঁচে যায় প্রেমিক। সে জোডিয়াকের কিছুটা বর্ণনা দিতে সক্ষম হয়েছিলো।
১লা আগস্ট ১৯৬৯। তিনটা জনপ্রিয় পত্রিকা একটা চিঠি পায়। সেখানে সে খুন গুলোর কৃতিত্ব দাবি করে খুনগুলোর নিখুঁত বিবরণ দিয়ে। চিঠিগুলোতে সিগনেচারের বদলে ছিলো জোডিয়াক সাইন বসানো।
ভয়ংকর ব্যাপার হলো চিঠিগুলোর সাথে একটা কোডেড সাইফার দেয়া ছিলো। জোডিয়াক হুমকি দিয়েছিলো যদি এই সাইফার পত্রিকাগুলো প্রকাশ না করে তাহলে সে আরো অনেকগুলো খুন করবে। পরেরদিনই সাইফার পত্রিকায় ছাপা হয়। সপ্তাহখানেক পরে ডোনাল্ড আর বেটি হার্ডেন নামে দুজন শিক্ষক সাইফারের অর্থ বের করে ফেলেন। সেই সাইফারে জোডিয়াক খুন গুলোর কারণ হিসেবে বলে সে মৃত্যুর পরের জীবনের জন্য দাস সংগ্রহ করছে!
প্রথম সাইফারের অর্থ বের করার আগেরদিন আরেকটা চিঠি আসে। সেই চিঠিতেই প্রথম খুনী নিজেকে জোডিয়াক হিসেবে নামকরণ করে।
জোডিয়াকের খুন এরপরেও থেমে থাকেনি। সে সেপ্টেম্বর মাসে আরেক জোড়া প্রেমিক প্রেমিকাকে ছুরি দিয়ে আক্রমণ করে। এর মধ্যে প্রেমিক বেঁচে যায় কিন্তু প্রেমিকা দুদিন পর মারা যায়। জোডিয়াক এরপরের খুন করে এক ট্যাক্সি ড্রাইভারকে। সে ট্যাক্সিতে ভ্রমণ শেষ করে যাওয়ার সময় ড্রাইভারকে মেরে রেখে যায়। ততদিনে পুলিশের ধারণা হয় জোডিয়াক একজন নি*গ্রো। এর কিছুদিন পর পত্রিকা অফিসে আরেকটা চিঠি আসে। সেখানে সে খুন হওয়া সেই ট্যাক্সি ড্রাইভারের রক্তমাখা শার্টের একটা অংশ পাঠায়। আর হুমকি দেয় এক স্কুলবাস ভর্তি সবাইকে খুন করবে। যদিও ট্যাক্সি ড্রাইভারের পরে সে আর খুন করেছে বলে অফিশিয়ালি কনফার্মেশন নেই।
জোডিয়াক হিসেবে প্রধান সাসপেক্ট ছিলো আর্থার লী অ্যালেন। তার একজন পুরনো বন্ধু ডোনাল্ড চেনি কর্তৃপক্ষকে জানায় তাকে অ্যালেন একটা সিরিয়াল কিলার বইয়ের গল্প বলেছিলো যে নিজেকে “জোডিয়াক” বলে ডাকত এবং জোডিয়াক কিলারের খুনের সাথে বইয়ের গল্পের খুনের বা হুমকির মিল ছিলো। অ্যালেনকে গ্রেফতার করার পর তার ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেয়া হয় এবং তার হাতের লেখা পরিক্ষা করা হয়। কিন্তু কোনোটাই জোডিয়াকের সাথে ম্যাচ না করায় পুলিশ অ্যালেনকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ১৯৯১ সালে জোডিয়াকের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া একজনকে সকল জোডিয়াক সাসপেক্টের ছবি দেখানো হয়। সে অ্যালেনকেই জোডিয়াক হিসেবে চিহ্নিত করে। এরপরে তার বিরুদ্ধে আবারও খুনের অপরাধে মামলার কথা বলা হয়৷ কিন্তু শক্ত প্রমাণ না থাকায় করা যায়নি সে মামলা। অ্যালেন এরপরে স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করে। রেখে যায় রহস্য, সে কি আসলেই জোডিয়াক ছিলো নাকি জোডিয়াক আসলে মরিচীকা?
শেষ অফিশিয়াল খুনের পরেও জোডিয়াক পত্রিকায় এবং পুলিশের কাছে চিঠি পাঠাতো। বিভিন্ন জায়গায় খুনের কৃতিত্ব সে দাবী করেছে এরপরেও৷ কিন্তু বিশেষজ্ঞদের ধারণা জোডিয়াক এটেনশন পাওয়ার জন্য এসব করতো। সেই সময়ে জোডিয়াকের খুনগুলো নিয়ে প্রচুর লেখালেখি, রেডিও প্রোগ্রাম হত। সে এই জনপ্রিয়তা ভালোভাবেই উপভোগ করতো। জোডিয়াক বেশ অনেকগুলো চিঠি আর সাইফার পাঠিয়েছে। এরমধ্যে মাত্র দুটোর অর্থ পুরোপুরি ভাবে বের করা গিয়েছে। পুলিশের কাছে পাঠানো তার চিঠির যতটুকু অর্থ বের করা গিয়েছে সেটুকু থেকে তার নাম উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। তার পাঠানো বেশীরভাগ সাইফার এবং পাজল রয়ে গেছে রহস্য আবৃত হয়ে।
জোডিয়াক এতটাই কুখ্যাত হয়ে যায় অন্তত দুজন কপিক্যাট কিলার তাকে কপি করে খুন করে ধরা পড়ে!
অনেকেই বিশ্বাস করে জোডিয়াক তার নাম একটা ঘড়ির ব্র্যান্ড থেকে নিয়েছে। সেই ঘড়ি জোডিয়াক নামে পরিচিত ছিল। আর্থার লী অ্যালেন খুনগুলো শুরু হওয়ার কিছুদিন আগে ক্রিসমাস উপহার হিসাবে একটি জোডিয়াক সি উলফ ঘড়ি পেয়েছিলেন। ধারণা করা হয় সেখান থেকেই তিনি জোডিয়াক নামটা পেয়েছিলেন।
যদিও আর্থার লী এলেনই ছিলেন সবচেয়ে বড় সাসপেক্ট কিন্তু শতভাগ নিশ্চিত হয়ে কখনোই প্রমাণ করা যায়নি তিনিই ছিলেন জোডিয়াক। তার পাশাপাশি আরো বেশকিছু মানুষ ও ছিলো সন্দেহের তালিকায়। হয়ত কখনোই আর জানা সম্ভব হবে না কে ছিলো জোডিয়াক বা সে আসলে কতগুলো খুন করেছিলো। হয়ত দুনিয়ার অসংখ্য অমীমাংসিত রহস্যগুলোর তালিকায় আরো একটি রহস্য হয়েই থেকে যাবে জোডিয়াক!
source: criminalminds/zodiacfacts/theguardian/crimemuseum
writer : অন্বয় আকিব
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?