দরসে বুখারি শরীফ যেদিন পড়া শুরু করলাম, সেদিনের আনন্দটাকে আসলে কোনো কিছুর সাথে তুলনা করতে পারছি না। মনের থেমে থাকা বাগানে হাদীসের সুরভিত হিল্লোল। হৃদয় নহরে উচ্ছ্বাসের ঢেউ। সূত্র পরম্পরায় আল্লাহর রাসূলের কথা শোনা ও বলার আনন্দ—এই অনুভূতি প্রকাশের ঊর্ধ্বে।
ছোটবেলায় গাঁয়ের পরিবেশে এসব কথা ভাবতেও পারিনি। সাধারণ শিক্ষিত একটা পরিবার থেকে বুখারির দরস পর্যন্ত এগুতে পারব, তখন এমন আশাও ছিল না। কত ছেলেই তো ঝরে যায়, আমি থাকতে পারতাম তাদের সারিতেও। আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ এ পর্যন্ত আসার তাওফীক দিয়েছেন।
যাকগে, মূল কথায় আসি। আমাদেরকে বুখারি প্রথম খণ্ড পড়ান মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হুজুর। মার্জিত আচরণ, স্নেহ পরায়ণ, অমায়িক কথাবার্তা, শীলিত গাম্ভীর্যের অধিকারী ও প্রান্তিকতামুক্ত একজন উদার মনের মানুষ তিনি। একাডেমিক লেখাপড়ার এটাই যেহেতু শেষ বছর, অনেক ছাত্র এখানেই শিক্ষার ইতি টানবে, তাই তিনি বিদায়ি উপদেশ দিতেন। ছাত্রদেরকে কর্মক্ষেত্রের জন্য উপযোগী করে গড়ে তুলতেন। কর্ম-জীবন যে ছাত্র-জীবন থাকে সম্পূর্ণ আলাদা, বিভিন্ন উপমা দিয়ে তা বোঝাতেন। মাঝে মাঝে শিক্ষণীয় গল্প বলতেন।
সেদিনও মনে রাখার মতো একটা গল্প বললেন। মুহাম্মাদ ইবনুল হানাফিয়্যাহ রাহ. আলি রা. এর সন্তান। ছিলেন বাবার মতো বীর। তার বীরত্বের অনেক কাহিনি আছে ইতিহাসে। ছিলেন অকুতোভয়, নির্ভীক, সাহসী যোদ্ধা। আলি রা.-ও বিভিন্ন যুদ্ধে তাকেই কাছে রাখতেন। অনেক যুদ্ধে ঝাণ্ডা তুলে দিতেন তার হাতে। তরবারির ঝনঝনানি যেন তার হৃদ-তন্ত্রের বীনা। যুদ্ধই যেন তার নেশা।
একবার কিছু লোক হিতাকাঙ্ক্ষী সেজে তার কাছে এসে বলল, মুহাম্মাদ, তোমার বাবা তো তোমাকে তোমার অপর দুভাইয়ের মতো ভালোবাসে না। তুমি কিছু মনে করো না?
মুহাম্মাদ রাহ. মুচকি হেসে বললেন, তোমরা কীভাবে বুঝলে বাবা যে হাসান ও হুসাইনকেই বেশি ভালোবাসে, আমাকে তাদের মতো ভালোবাসে না?
লোকগুলো বলল, আমরা তো দেখি সব যুদ্ধে তোমাকেই আগে রেখে, তোমার জীবন মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়, আর তাদেরকে নিরাপদ দূরত্বে রাখে।
ও এই কথা! দেখো, তোমরা আসলে বুঝতে ভুল করছো।
ওরা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, আমরা ভুল করছি!
মুহাম্মাদ রাহ. বললেন, শোনো, একজন মানুষের চোখে আঘাত আসলে তিনি হাত দিয়ে তা প্রতিহত করেন। তার মানে এই নয় যে, তিনি তার হাতকে ভালোবাসেন না। কোনো পাগলও কি এ কথা চিন্তা করার সময় নেবে যে, আঘাত চোখে আসছে, তাতে হাতের কী? ঠিক সেরকম হাসান ও হুসাইন বাবার কাছে চোখের মতো, আমি তার কাছে হাতের মতো। বাবা আমার মাধ্যমে তার চোখ নিরাপদ রাখেন। এখানে ভালোবাসার তারতম্যের প্রশ্ন নিয়ে আসা নিতান্তই বোকামী। আসলে বাবা আমাদের সবাইকে ভালোবাসেন। যেমন একজন মানুষ তার চোখ ও হাতকেও ভালোবাসে।
এই ক্ষেত্রে আমরা হলে কী বলতাম? আমাদের স্বাভাবিক মানব প্রকৃতি ওই লোকগুলোর মতো করেই ভাবত। ভেতরটা বলে উঠত, আসলেই তো, সব যুদ্ধে আমাকেই সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে হয়, আমার জীবন থাকে হুমকিতে। যেকোনো সময় তরবারির আঘাতে আমার মৃত্যু চলে আসতে পারে। অথচ আমার অন্য ভাইয়েরা ঠিকই নিরাপদ দূরত্বে থাকে। বাবা ওদেরকে নিরাপদে রাখেন। সত্যিই মনে হয় বাবা ওদেরকে বেশি ভালোবাসেন। তাইতো তাদের জীবনের প্রতি বাবার এত মায়া।
কিন্তু না, মুহাম্মাদ রাহ. দেখিয়েছেন চেতনার শুদ্ধতা ও স্বচ্ছতা। তিনি যা ভেবেছেন, সাধারণ বোধ থেকে তার প্রকাশ অনেকটা অসম্ভবের মতো। অতি উন্নত ও নির্মল চিন্তা থেকেই কেবল এমন ইতিবাচক দিক বের করে আনা সম্ভব।
ওদের কথা মেনে নিলে ব্যাপারটা কী হতো? তারা বাবা আলি রা.। উম্মাহর শ্রেষ্ঠ ৪র্থ ব্যক্তি। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে ভালোবাসতেন, স্নেহ করতেন। দুনিয়াতে জান্নাতের সুসংবাদ শুনিয়েছেন। ওদের কথা অনুযায়ী এমন একজন মানুষ সন্তানদের মাঝে ভালোবাসায় তারতম্য করছেন! না, এমন নেতিবাচক ধারণা এই মানুষটির ব্যক্তিত্বের সাথে মানায় না। এমন ভাবনা হতে পারে না শুদ্ধ চিন্তার বিচ্ছুরণ। এমন চিন্তাকে স্থান না দিয়ে তিনি নিজেই শুধু মহত্বের পরিচয় দেননি, বরং ইতিহাস সেরা একজন ব্যক্তিত্বের প্রতি নিক্ষেপিত কুধারণার ময়লাও ঝেড়ে ফেলেছেন।
চিন্তার নির্মলতায় এসে ঘোলাটে বিশ্বাসও এমন স্বচ্ছ হতে পারে, এমনটা ছিল ওদের ধারণাতীত কিছু। তাইতো মুহাম্মাদ রাহ.-এর এমন প্রতিউত্তরে ওরা একেবারে থ। অনাবিল চেতনার কাছে হেরে যাওয়ার লজ্জায় যেমন অবাক, তেমনই নতশির।
লিখেছেন, ওমর আলী আশরাফ
সহঃসম্পাদক, সিয়ান পাবলিকেশন
সিয়ান | বিশুদ্ধ জ্ঞান | বিশ্বমান
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?