আহাম্মকের খুদকুড়ো – দুর্লভ সূত্রধর

আহাম্মকের খুদকুড়োঃ দুর্লভ সূত্রধর
প্রচ্ছদঃ সৌজন্য চক্রবর্তী
মুদ্রিত মূল্যঃ ২৮০ টাকা
– Tistan Sriyan

ছোটোদের কাছে ঘি-এর ব্যাপারটা বরাবর ছিল রহস্যময়

আমাদের শহরে তখন সত্যিকার ঘি পাওয়া যেত একটামাত্র দোকানে। সেটা ছিল শুধুমাত্র ঘি-এরই দোকান। সেই দোকান থেকে অনেক দূর পর্যন্ত বাতাস ঘি-এর গন্ধে সর্বদা আমোদিত থাকত। মাখন জ্বাল দিয়ে ঘি তৈরি হতো। দোকানটি একটু অন্ধকার অন্ধকার, রহস্যময়। সারাদিন দোকানের ভেতরে জ্বলত একটামাত্র টিমটিমে বাতি। তাতে ভুতো ভুতো অন্ধকার আরও বেড়ে যেতো। অতীব ক্ষীণ দৃষ্টিসম্পন্ন দোকানের মালিক নাকি বন্ধুমহলে বলতেন—’ওরে, বেশি পাওয়ারের আলো জ্বালিয়ে শুদুমুদু পয়সা খরচা করব কেন, যতই আলো জ্বালি আমার মতো অন্ধের তো একই অবস্থা থাকবে, ওই যে বলে না, ‘অন্ধের কী বা দিন কী-বা রাত।’
একেই বলে নিজের মাপ-বুঝে চলা!
সারাদিন ঘি জ্বাল দেওয়ায় দোকানের সবই তেলতেলে, চকচকে— দাঁড়িপাল্লা থেকে বাটখাড়া, ‘করচা’ করার অবনীন্দ্রিয় কুটুম কাটুমগুলো থেকে দোকানের টেবিল-বেঞ্চি— মায় মালিকটি পর্যন্ত। তাঁর লম্বা দাড়িও ঘিয়ে রঙ প্রাপ্ত হয়েছিল। তাঁর চোখে ছিল মোটা ফ্রেমের পুরু কাচওয়ালা চশমা। পরনে থাকতো খাটো ধুতি আর ফতুয়া। তাঁর দাড়ির মতোই সে-দুটির রঙ বোধহয় এককালে সাদাই ছিল, কিন্তু আমরা দেখতাম তার রঙ কালচে মেটে মেটে। সারা শরীর তাঁর ঘিময়। খরিদ্দারদের সঙ্গে তিনি কথা বলতেন ইঙ্গিতে। আঙুল দেখিয়ে ঘি-এর পরিমাণ বোঝাতে হতো তাঁকে। কেননা চোখের মতোই তাঁর শ্রবণেন্দ্রিয়ের ক্ষমতা ছিল কম এবং তিনি কথা বলতেন আরও কম।
সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার ছিল তাঁর ঘি ওজন করার কায়দা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তিনি খরিদ্দারের আনা শিশিটি নানা-মাপের লোহার টুকরো, ছোটো ছেটো টিনের পাত, ছোটো খাটো কালো পাথর দিয়ে ‘করচা’ করে নিতেন, তারপর শিশিতে যে পরিমাণ ঘি ঢালতেন সেটা একবারে প্রার্থিত ওজনের সঙ্গে মিলে যেত। আর মিল কি সোজা মিল— পুরোনো আমলের দাঁড়িতে একেবারে কাঁটায় কাঁটায় মিল। 
দোকানে খরিদ্দার না থাকলে দোকানের বেঞ্চিতে বসে একেবারে নাকের ডগায় ধরে তিনি পাঠ করতেন খবরের কাগজ। ইংরেজি কাগজ, স্টেটম্যান—মাঝে মাঝে ছোটোমাপের ইংরেজি বই। পরে জেনেছি ঐ বইগুলোকেই বলে পেপারব্যাক সিরিজ। বড়োরা তাঁকে রীতিমতো সম্ভ্রম করতেন সবাই। তিনি ছিলেন মেধাবী ছাত্র। কোনো এক রহস্যময় জ্বরে প্রথমে তাঁর শ্রবণেন্দ্রিয় নষ্ট হয়, পরে অতিরিক্ত পাঠ ও দারিদ্র্য তাঁর দৃষ্টি হরণ করে। লোকে বলে একটি ইন্দ্রিয় ক্ষতিগ্রস্ত হলে ক্ষতিপূরণস্বরূপ অন্য ইন্দ্রিয়গুলো শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ফলে চোখ আর কান গিয়ে তাঁর ঘ্রাণেন্দ্রিয় প্রবল শক্তিশালী হয়ে ওঠে। নিজের মাপ-বুঝে ছাত্র পড়ানো ছেড়ে তিনি এই ঘি-এর দোকান করেন।
ঘি-বস্তুটি নিয়ে প্রচুর নিরীক্ষার ফলস্বরূপ তাঁর তৈরি ঘি সমস্ত শহরের গর্ব হয়ে দাঁড়ায়। আজকের দিন হলে নিশ্চিতভাবে একটি লেবেল মেরেই তাঁর ঘি ব্র্যান্ড হয়ে দ্বিগুণ দামে কায়দা-বিপণিগুলোতে শোভা পেত। তারই নিদর্শনস্বরূপ এই অকৃতদার মানুষটি প্রয়াত হবার পর তাঁর ভাইপোদের হাতে দোকানের হাল বদলায়। ঝাঁ-চকচকে শোকেসে বোতল ও শিশিভর্তি ঘি শোভা পেতে থাকে। সেই সঙ্গে উধাও হয় ঘি-এর দীর্ঘবৃত্তে ছড়িয়ে পড়া অসামান্য সুগন্ধ, সেই সুযোগে শহরে আরও ঘি-এর দোকান গজিয়ে ওঠে। বিলুপ্ত হয় শহরের স্থানীয় বৈশিষ্ট্যের বনেদিয়ানার একটি গল্প।
আমাদের মতো পরিবারগুলোতে এই দোকান থেকে ঘি আসত নিয়মিত, কিন্তু তা সাধারণভাবে ছোটোদের পাত পর্যন্ত পৌঁছাতো না। বাড়ির খাটিয়ে কর্তারা পাতে খেতেন, আর বিশেষ বিশেষ তরকারিতে সেই ঘি ব্যবহৃত হতো। আমাদের বাড়িতে বাবার পাতের দুপুরের আলুসেদ্ধ মাখা হতো ঘি দিয়ে। তিনি আমাদের জ্ঞানকালে পুরোপুরি নিরামিষাশি ছিলেন। সুতরাং আমরা ঘি-এর গন্ধ যতটা পেতাম, পাতে ততটা পেতাম না।
তা এই ঘি-দেওয়া পোড়ের ভাতের গন্ধে দশদিনের ভাত-উপবাসী জ্বরের রোগীর জ্বর জ্বর-ভাব পালাত অনেক দূরে। আর পোড়ের ভাতের লোভে যাকে বলে ‘পরিমল লোভে অলি আসিয়া জুটিল’-র প্রত্যক্ষ-প্রদর্শন।
সকলেই জানত জ্বরের পর ভাত খাওয়াটা যতটা কাঙ্ক্ষিত ছিল জ্বরের মুখে ততটা খাওয়ার সাধ্য ছিল না। এক চামচ করে পোড়ের ভাতের ভাগ পেতে দাদার লুব্ধ-ঘুরঘুরানি শুরু হয়ে যেত। দিদিরা যদিও ছিল বড়ো, ছোটো ভাইদের অভিভাবক, তবু সুযোগ পেলে তারাও একটু ভাগ পেতে চাইত। এমন কী পাশের বাড়ির ছোটোরাও এসে জুটত। সে-এক অদ্ভুত দৃশ্য—সারি সারি ছোটোরা বাটি নিয়ে বসে পড়েছে, আর মা সকলের বাটিতে একহাতা করে পোড়ের ভাত দিয়ে যাচ্ছেন। সেই এক হাতা ভাত তারিয়ে তারিয়ে খেতে সময় লাগতো আধ-ঘন্টা! তাই আশেপাশে কারও জ্বর হলেই আমরা তক্কে তব্ধে থাকতাম, খোঁজ রাখতাম কবে তার ভাত খাওয়ার দিন।
গরম পোড়ের ভাতে কখনও অতিরিক্ত একফোঁটা ঘি দিয়ে খেতে—আহ্! পোড়ের ভাতে জ্বরের রোগীর কী উপকার হতো তা জানা নেই, কিন্তু জ্বরের মুখে সে একেবারে—উহ্!
সেই স্বাদ, সেই তৃপ্তিটা তো এতদিন পরেও মিথ্যে হতে পারে না।
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?