আহমদ ছফা (৩০ জুন, ১৯৪৩ – ২৮ জুলাই, ২০০১) একজন বাংলাদেশি লেখক, ঔপন্যাসিক, কবি, চিন্তাবিদ ও গণবুদ্ধিজীবী ছিলেন। জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক ও সলিমুল্লাহ খানসহ আরো অনেকের মতে, মীর মশাররফ হোসেন ও কাজী নজরুল ইসলামের পরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাঙালি মুসলমান লেখক হলেন আহমদ ছফা। তার লেখায় বাংলাদেশি জাতিসত্তার পরিচয় নির্ধারণ প্রাধান্য পেয়েছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে রচিতবুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস (১৯৭২) প্রবন্ধগ্রন্থে আহমদ ছফা বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের মানচিত্র অঙ্কন করেন এবং বাংলাদেশি বুদ্ধিজীবীদের সুবিধাবাদিতার নগ্ন রূপ উন্মোচন করেন তথা বুদ্ধিজীবীদের সত্যিকার দায়িত্বের স্বরূপ ও দিকনির্দেশনা বর্ণনাপূর্বক তাদের সতর্ক করে দিতে বুদ্ধিজীবীদের ব্যর্থতায় বাংলাদেশের কী দুর্দশা হতে পারে তা সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেন।
আহমদ ছফা তার বিখ্যাত “বাঙালি মুসলমানের মন” (১৯৭৬) প্রবন্ধে বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয়ের হাজার বছরের বিবর্তন বিশ্লেষণপূর্বক তাদের পশ্চাদগামিতার কারণ অনুসন্ধান করেছেন। আনিসুজ্জামান ও সলিমুল্লাহ খানসহ আরো অনেকে ছফার বাঙালি মুসলমানের মন (১৯৮১) প্রবন্ধসংকলনটিকে বাংলা ভাষায় রচিত গত শতাব্দীর ‘সেরা দশ চিন্তার বইয়ের’ একটি বলে মনে করেন।
ছফা রচিত প্রতিটি উপন্যাসই ভাষিক সৌকর্য, বিষয়বস্তু ও রচনাশৈলীর অভিনবত্বে অনন্য। মানসিক, সাংস্কৃতিক ও আর্থসামাজিক সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অনুষঙ্গসহ ছফার চরিত্র সৃষ্টির তথা কাহিনিকথনের পারঙ্গমতা অসামান্য। আবুল ফজল ও আরো অনেকের মতে ছফার ওঙ্কার (১৯৭৫) বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সর্বোত্তম সাহিত্যিক বহিঃপ্রকাশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে রচিত গাভী বিত্তান্ত (১৯৯৫) বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ ব্যঙ্গাত্মক উপন্যাসগুলোর একটি। পুষ্প বৃক্ষ ও বিহঙ্গ পুরাণ-এ (১৯৯৬) ছফা ঢাকা শহরের প্রেক্ষিতে ফুল, পাখি, বৃক্ষ তথা বৃহৎ প্রকৃতির সাথে মানুষের সম্পর্কের এক নিজস্ব বয়ান হাজির করেন।
আহমদ ছফা ও তার রচনাকর্ম অনেক লেখক, শিল্পী, চলচ্চিত্রকর ও বুদ্ধিজীবীকে অনুপ্রাণিত করেছে; তাঁদের মাঝে অন্যতম হুমায়ূন আহমেদ, ফরহাদ মজহার, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, তারেক মাসুদ এবং সলিমুল্লাহ খান। বর্তমানে ছফা স্বাধীন বাংলাদেশের সর্বোত্তম ও সর্বশ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবী বলে বিবেচিত।
জীবিতকালে আহমদ ছফা তার প্রথাবিরোধিতা, স্পষ্টবাদিতা, স্বকীয় দৃষ্টিভঙ্গির জন্য লেখক ও বুদ্ধিজীবী মহলে বিশেষ আলোচিত ও বিতর্কিত ছিলেন।
জীবদ্দশায় অনেকে তাকে বিদ্রোহী, বোহেমিয়ান, উদ্ধত, প্রচলিত ব্যবস্থার প্রতি শ্রদ্ধাহীন ও বিতর্কপ্রবণ বলে অভিহিত করেছেন।
প্রতিষ্ঠানবিরোধী আহমদ ছফা ১৯৭৫ সালে লেখক শিবির পুরস্কার ও ১৯৯৩ সালে বাংলা একাডেমির সাদত আলী আখন্দ পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। ২০০২ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে সাহিত্যে মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করেন।
বি. দ্র.: আহমদ ছফার লেখা এর সকল বই পেতে বইয়ের নাম লিখে সার্চ অপশনে সার্চ করুন।
প্রবন্ধ
জাগ্রত বাংলাদেশ, ১৯৭১
বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস, ১৯৭২
বাংলা ভাষা: রাজনীতির আলোকে, ১৯৭৫
বাংলাদেশের রাজনৈতিক জটিলতা, ১৯৭৭
বাঙালি মুসলমানের মন, ১৯৮১
শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য প্রবন্ধ, ১৯৮৯
Aspect of Social Harmony in Bangla Culture and Peace Song, ১৯৯১
রাজনীতির লেখা, ১৯৯৩
আনুপূর্বিক তসলিমা ও অন্যান্য স্পর্শকাতর প্রসঙ্গ, ১৯৯৪
নিকট ও দূরের প্রসঙ্গ, ১৯৯৫
সঙ্কটের নানা চেহারা, ১৯৯৬
সাম্প্রতিক বিবেচনা: বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস, ১৯৯৭
শরবর্ষের ফেরারী: বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ১৯৯৭
শান্তিচুক্তি ও নির্বাচিত প্রবন্ধ, ১৯৯৮
বাঙালি জাতি এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্র, ২০০১
উপলক্ষের লেখা, ২০০১
আমার কথা ও অন্যান্য প্রবন্ধ, ২০০২
সেইসব লেখা, ২০০৮
অনুবাদ
তানিয়া (মূল: পি. লিডভ), ১৯৬৭
সংশয়ী রচনা: বার্টাণ্ড রাসেল, ১৯৮২
ফাউস্ট (মূল: ইয়োহান ভোলফ্ গাঙ ফন গ্যোতে), ১৯৮৬
কবিতা
জল্লাদ সময়, ১৯৭৫
দুঃখের দিনের দোহা,১৯৭৫
একটি প্রবীণ বটের কাছে প্রার্থনা, ১৯৭৭
লেনিন ঘুমোবে এবার, ১৯৯৯
উপন্যাস
সূর্য তুমি সাথী, ১৯৬৭
ওংকার, ১৯৭৫
একজন আলী কেনানের উত্থান-পতন, ১৯৮৮
মরণবিলাস, ১৯৮৯
অলাতচক্র, ১৯৯৩
গাভী বিত্তান্ত, ১৯৯৫
অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী, ১৯৯৬
পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরাণ, ১৯৯৬
গল্পসংগ্রহ
নিহত নক্ষত্র,১৯৬৯
ইতিহাসগ্রন্থ
সিপাহী যুদ্ধের ইতিহাস, ১৯৭৯
সৃজনশীল জীবনী
যদ্যপি আমার গুরু, ১৯৮৮
কিশোর গল্প
দোলো আমার কনকচাঁপা, ১৯৬৮
শিশুতোষ ছড়াগ্রন্থ
গো-হাকিম, ১৯৭৭
পুরস্কার
তিনি লেখক শিবির পুরস্কার ও বাংলা একাডেমী কর্তৃক সাদত আলী আখন্দ পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছেন। ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে ইতিহাস পরিষদ পুরস্কার গ্রহণ করেছেন বলে জানা যায়। তাঁকে ২০০২ খ্রিস্টাব্দে সাহিত্যে (মরণোত্তর) একুশে পদক প্রদান করা হয় ।
মৃত্যু
২০০১ খ্রিস্টাব্দের আটাশে জুলাই অসুস্থ অবস্থায় ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতালে নেয়ার পথে তাঁর মৃত্যু হয়। পরদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদে জানাজা শেষে মিরপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবি গোরস্থানে তাঁর দাফন হয়।