বই: আমি মৃণালিনী নই
লেখক: হরিশংকর জলদাস
প্রকাশনী: প্রথমা
প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি, ২০১৪
প্রচ্ছদ মূল্য: ৩২০৳
বাস্তব চরিত্রদের নিয়ে, কল্পনা এবং সত্যতার মিশেলে লেখা বই আমার কাছে বরাবরই বেশি আকর্ষণীয়।
আমি মৃণালিনী নই- উপন্যাসের কতটা সত্য, কতটা কল্পনা তা বোঝা আমার পক্ষে সম্পূর্ণরূপে সম্ভব না হলেও, লেখক যা লিখেছেন তার প্রকৃতস্বরূপ বুঝতে কোনো সমস্যা হয়নি।
“আমি মৃণালিনী নই” বইটিতে হরিশংকর জলদাস খুব সাবলীলভাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর জীবন কাহিনি তুলে ধরেছেন মৃণালিনী দেবীর নিজ বয়ানে।
বইটি পড়ার সময় মনে হচ্ছিল, কোনো উপন্যাস পড়ছি না। সাধারণ বধূ মৃণালিনী দেবী সম্মুখে বসে তার মুখে জীবনের দুঃখ-ভরা কাহিনী বলছেন।
লেখক যশোরের ভবতারিণী থেকে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে মৃণালিনী হয়ে যাওয়া অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের সাথে বিয়ের দিন থেকে নিজের মৃত্যুর আগ পর্যন্তকালের ঘটনা তুলে ধরেছেন এই উপন্যাসটিতে।
বিয়ের পর রবিঠাকুর ভবতারিণী থেকে তার নাম মৃণালিনীতে পালটে দেন। এই দুঃখ সেই নয় বছর বয়স থেকে শুরু করে তার জীবনের শেষ পর্যন্ত ছিল। কারণ এটা শুধু ভবতারিণীর নাম ছিল না, এই নাম তার স্বত্তারও বাহন ছিল।
এই উপন্যাসে তুলে ধরা হয়েছে ঠাকুর বাড়ির তৎকালীন নারীদের অবস্থা, ঠাকুর পরিবারের অন্দরমহলের কড়াকড়ি নিয়ম, এছাড়া রবি ঠাকুর এর সাথে তার নতুন বউঠান কাদম্বরী দেবীর সম্পর্ক, কাদম্বরী দেবীর রহস্যময় ভাবে আত্মহত্যা। উপন্যাসটি শেষ হয়েছে মৃণালিনী দেবীর অন্তিমকালে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মৃণালিনী দেবীর মন অভিমানে পূর্ণ ছিল। এতটা সংসারের জন্য করেও তিনি তার কাঙ্ক্ষিত সম্মান, ভালোবাসা, গ্রহণযোগ্যতা কোনোটাই রবীন্দ্রনাথের কাছে পাননি। রবীন্দ্রনাথ এর মনের একটা কোণও তিনি দখল করতে পারেননি। সেখানে নতুন বৌঠান, ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা এবং প্রকৃতিরই সম্পূর্ণ আধিপত্য ছিল।
তিনি রবি ঠাকুর এর অবজ্ঞার শিকার হয়েছেন বহুবার। সুযোগ বুঝে দুই এক কথা প্রতুত্তরও দিয়েছেন তারপরও করে ফেলা অপমানের আঘাত তার কমেনি।
রবীন্দ্রনাথের সহধর্মিণী সবসময় বলতে চেয়েছেন, “আমি মৃণালিনী নই, আমি ভবতারিণী। রবিবাবুর স্ত্রী ছাড়াও আমার নিজস্ব একটা সত্তা আছে, সেই সত্তার প্রতি তিনি কখনো সুবিচার করেননি।’’
এই উপন্যাস পড়ার সময় রবীন্দ্রনাথের আত্মকেন্দ্রিকতা, সংসারের চাইতে বাইরের দিকে,লেখার দিকে মনোনিবেশ, স্ত্রীকে তার প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা, যেন মৃণালিনী দেবীর সাথে আমাদেরকে আরও বেশি একাত্ম করে ফেলে। হরিশংকর জলদাসের লেখনী-নৈপুণ্যে এই উপন্যাস হয়ে উঠেছে এক নারীর ব্যক্তিসত্তার হাহাকারপূর্ণ জীবন বৃত্তান্ত।
কপালকুণ্ডলা pdf download বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় Kopalkundola pdf
যে নারী নিজের জীবনের সবটুকু আনন্দ, শ্রম ত্যাগ করেছেন সংসারের জন্য অথচ বিনিময়ে তেমন কিছু না পেয়েও রবীন্দ্রনাথের কাছে নিজের আত্মসম্মানবোধের রক্ষা করে গিয়েছিলেন। শান্তিনিকেতনে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময় তার সব গহনা বেঁচে দিয়ে তিনি একাধারে যেমন বলেন্দ্রের স্বপ্ন পূরণ করেছিলেন তেমনই তিনিও যে কিছু একটা করতে পারেন তার পরিচয় দিয়েছিলেন। আমাদের চারপাশে এমন অনেক মহান চরিত্র থাকে যারা সম্মানের একদম উচ্চস্থানে অধিষ্ঠিত হোন কিন্তু তাদের নিকটে গেলে দেখা যায় সেই উচ্চস্থানে পৌঁছানোর জন্য কী পরিমান বঞ্চনা এবং ত্যাগের শিকার হতে হয় তাদের কাছের মানুষদের। হাজার, হাজার ন্যায়-অন্যায়ের বুলি বলে বেড়ানো লোকগুলো কী নিদারুণ নিষ্ঠুরভাবে তাদের অধিকারীদেরকে বঞ্চিত করে যান! সমাজ সংস্কার, সাহিত্যে তাদের অবদান থাকে বলে, খালি চোখে সেসব ঢাকা পড়ে যায় সাধারণ মানুষের কাছে। তাদের আচরণ এবং কথাবার্তার মাঝে আকাশ-পাতাল তফাৎ থাকে।
আসলে একটা মানুষ যখন ভাগ ভাগ হয়ে যান সর্বসাধারণের মধ্যে তখন চাইলেও তাকে ছোট গণ্ডিতে আটকানো সম্ভব হয় না। সে সবার হয়ে যায়, নিজের মানুষের গুরুত্ব তার কাছে তুচ্ছ হয়ে যায়। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এমন মানুষের কাছাকাছি থাকা অনেক বড় যন্ত্রণা, ধৈর্য এবং আত্মত্যাগের ব্যাপার। রবীন্দ্রনাথের বেলায় যার সবটুকু একা বরণ করে নিয়েছিলেন এই উপন্যাসের বক্তা মৃণালিনী, অন্তত আমার কাছে যিনি ভবতারিণী।
রিভিউ লিখেছেন: Munia Rashid Chowdhury
আমি মৃণালিনী নই – হরিশংকর জলদাস ক্রমে ক্রমেই এই লেখক আমার প্রিয় লেখকের লিস্টে জায়গা করে নিচ্ছেন। তার লেখার স্টাইল,শব্দগঠন সবকিছুই জাস্ট পারফেক্ট। এই বইটা ওনার আর যে কয়টা বই পড়েছি তার মতো না। পুরোপুরি সাবলীল। এত ছন্দময় লেখনী যা পাঠককে এক অধ্যায় থেকে আরেক অধ্যায়ে নিমেষেই নিয়ে যায় এবং শেষ হয়ে গেলে আফসোস জাগায়,”ইশ! আরেকটু যদি বড় হতো।”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে যারা একবিন্দু পরিমাণও আগ্রহী তারাই এই বইটা উপভোগ করবে। নতুবা বাকিদের কাছে এটাকে অর্থহীন বা কাঠখোট্টা মনে হতে পারে। আর রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে আমি অতি আগ্রহী বিধায়ই বোধহয় আমার এটাকে অমৃতসম লেগেছে।
Halal Marketing
লেখার ক্রুটি, সেটা আগে বলে নিই। রবীন্দ্রনাথের সম্পর্কে প্রথম জেনেছিলাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘প্রথম আলো’ পড়ার মাধ্যমে। সুনীল তো সুনীলই! রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে এত জেনে এত গবেষণা করেও তিনি যখন লিখতে বসেছেন রবীন্দ্রনাথকে পূর্ণ সম্মান দিয়েছেন। কাদম্বরী-রবীন্দ্রনাথ,ইন্দিরা-রবীন্দ্রনাথ এমনকি মৃণালিনী-রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক নিয়েও অন্তরঙ্গ বা রসালো একটা শব্দ লেখেননি সুনীল। তার প্রেজেন্টেশন ছিল চমৎকার। পড়লে কেউ রবীন্দ্রনাথকে ঘৃণা করবে না, বরং রবীন্দ্রনাথের সব কাজের পেছনেই একটা ব্যাখ্যা খুঁজে পাবে। কিন্তু এই লেখক তা করেননি,তিনি সরাসরি লিখে দিয়েছেন, ইন্দ্রিয়ের ওপর দখল হারিয়ে সেটার পক্ষে যুক্তি দিয়ে রবীন্দ্রনাথ নিজের দূর্বলতা ঢাকতে চাইতেন। সংসারের ছোট-বড় প্রতিটা ঘটনায় রবীন্দ্রনাথকে মৃণালিনীর তরফ থেকে বারবার দোষী সাব্যস্ত করার এই চেষ্টাটা ভালো লাগেনি। আর এর পেছনে রেফারেন্সও উল্লেখ করেননি,যেটা করা দরকার ছিল।
দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে, বইয়ের নাম মৃণালিনীকে নিয়ে যার আসল নাম ভবতারিণী। শ্বশুরবাড়িতে আসার পর রবীন্দ্রনাথ তার নাম পরিবর্তন করে দিলে সেটা তার একটুও ভালো লাগেনি। স্বাভাবিকভাবেই পাঠকের মনে হবে নামকরণের উদ্দেশ্য হচ্ছে মৃণালিনীর পেছনের ভবতারিণী চিৎকার করে আত্নপ্রকাশ করতে চাইছে। কিন্তু বস্তুত,এটা কিন্তু শুধুই মৃণালিনীর জীবনের গল্প না। এটাতে ঠাকুরবাড়িতে সে আসার আগের,বা তার বুদ্ধি উদয় হবার আগেরও অনেক গল্প তার মুখ দিয়ে বলানো হয়েছে যার থেকে মনে হয় রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে লেখক যা জানতেন সবটাই জানাতে চাইছেন এই মৃণালিনীর মুখ দিয়েই। এমনকি কাদম্বরীর সাথে সম্পর্ক নিয়েও রবীন্দ্রনাথ নাকি তার সাথে সরাসরি গল্প করতেন!
রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিজীবনের গল্প রেফারেন্স ছাড়া মানায় না। মৃণালিনী যেভাবে রবীন্দ্রনাথের মুখের ওপর যুক্তি দিয়ে কথা বলে তাকে পরাস্ত করতো এটা কেমন অবাস্তব বলে মনে হয়েছে আমার।
ভালো দিকও কিন্তু আছে। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে এত ভেতরের কিছু কথা বলা হয়েছে যা কেবল তার জীবনসঙ্গীনি যে প্রতিটা রাত তার পাশে কাটায় সেই বলতে পারবে। যেমন হঠাৎ হঠাৎ রবীন্দ্রনাথের রেগে যাওয়া, ঘুমের ঘোরে কাদম্বরীর সাথে সম্পর্কের অন্তরঙ্গতা নিয়ে কবিতা বানিয়ে পড়ে যাওয়া,তাকে নিয়ে একের পর এক কবিতা লিখে যাওয়া,কাদম্বরীর মৃত্যুর পর রবীন্দ্রনাথের মনের অবস্থা সবচেয়ে কাছ থেকে দেখার সুযোগ যার হয়েছিলো তার মুখ থেকেই এই কথাগুলো যেন মানায়।
সর্বোপরি গল্পে মৃণালিনীর একাকিত্বের কথা বারবার যেন চিৎকার করে বলতে চেয়েছেন তিনি। যিনি রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী হতে পারলেও মনের সঙ্গী হতে পারেননি,যিনি চাইতেন রবীন্দ্রনাথ তার চমৎকার কথাগুলো ইন্দিরাকে না বলে তাকে বলুক। রবীন্দ্রনাথ তার মধ্যে নলীনিকে না খুঁজে ভবতারিণীকেই ভালোবাসুক। রবীন্দ্রনাথ নিশ্চয়ই তার স্ত্রীকে ভালোবাসতেন কিন্তু সেই ভালোবাসায় স্ত্রী যে সন্তুষ্ট ছিলেন না সেটাই লেখক বারবার বোঝাতে চেয়েছেন।
ভালোমন্দের মিশেলে উপভোগ করার মতো একটা বই। ননফিকশন খুব বেশী পড়িনি। তবে এটার মতো উপভোগ করিনি বাকিগুলো। কিছু ক্রুটি গল্পে থাকলেও লেখনী বা স্টাইলের ত্রুটি কোথাও নেই। হরিশংকর জলদাসকে আবারও শ্রদ্ধা ফিকশনের কায়দায় চমৎকার নন ফিকশন এই বইটার জন্য।
Credit : Jannatul Ferdaus
Ami Mrinalini Noi PDF Download Link
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?