আমাদের ভাষা-শরিয়ত – সাইফ সিরাজ

ঘটনা: ০১
ঘটনাটা ১৯৯৯ সালের। একটা মাসিক পত্রিকায় কবিতা পাঠালাম। কবিতা ছাপাও হলো। পত্রিকা হাতে আসার পর দেখি কবিতা সম্পাদিত। কেমন যেন এক আলগা আলগা অনুভব পুরো কবিতায়। আমি আসলে কিছুই ধরতে পারছি না। আব্বা বললেন মূল কবিতার সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে। খাতা বের করে মিলাতে গিয়ে দেখি তারা চারটা শব্দ বদলে দিয়েছেন। জল, অর্ঘ্য, স্বর্গ আর সঙ্গী। সঙ্গী কেন বদলেছিলেন সম্পাদক, সেই প্রশ্নের উত্তর অদ্যাবধি পাইনি। বাকি তিন শব্দের বদলের কারণ সেই সম্পাদকের এক বক্তব্যে পেয়েছিলাম। 

ঢাকার এক প্রকাশনীতে বই কিনতে গিয়েছি। একটু সকালে যাওয়ার সুবাদে দোকানে ভিড় নেই। আমার সঙ্গে ম্যানেজার ও সেখানে বসে থাকা একজন নানারকমের আলাপ করছেন। একপর্যায়ে জানতে পারি বসে থাকা ভদ্রলোক সেই পত্রিকার কবিতার বিভাগটা দেখেন। একবার মনে হলো পরিচয় দিই। কিন্তু ততদিনে আমি জেনে গেছি তাঁরা এই পরিচয়ে কাউকে সহজে চেনেন না। ফলে আলাপ চলতে থাকল। একপর্যায়ে তিনি বললেন, ‘দেখুন, তারুণ্যের কথা বলবেন না। এরা কিছুই জানে না। এরা শব্দের কোনো বাছবিচার জানে না। হালাল-হারাম সব শব্দ তারা লেখায় ব্যবহার করে। ক’বছর আগে একজনের কবিতা পেলাম। নবীজির শানে কবিতা। সেখানেই হিন্দুয়ানি শব্দ স্বর্গ অর্ঘ্য ব্যবহার করেছে। ইসলামি কবিতায় কোনোভাবেই এইসব শব্দ ব্যবহার জায়েজ হবে না।’
ঘটনা: ০২
সময়টা মনে নেই। সেসময়ের বিখ্যাত একজন তেজোদ্দীপ্ত মাওলানার এক মাহফিলে যাই বয়ান শুনতে। তিনি বয়ান শুরু করলেন। ভেতরে ভেতরে চেতনাদীপ্ত হচ্ছি। বয়ানের প্রভাবে প্রভাবিত হচ্ছি। হঠাৎ করেই তার বয়ানের বাঁক বদল হলো। তিনি বলতে লাগলেন, “এই সমাজ এখন শিরকের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হচ্ছে। সব জায়গায় আপনি দেখবেন শিরকে পূর্ণ। আলিমদের মধ্যে শিরক। জাহিলদের মধ্যে তো কথাই নেই। কবিদের মধ্যেও শিরক। এই নজরুল আছে না! এই দেশের জাতীয় কবি। সে ‘খোদা’ শব্দের ব্যবহার করেছে দেদারসে। অথচ এই শব্দটি একটি শিরিকি শব্দ। আপনারা ‘নামায’ বলেন, ‘রোজা’ বলেন এসবই হারাম শব্দ। বাংলা ভাষাকে বহুত যাচাইবাছাই করে ব্যবহার করবেন। না হলে শিরকের গুনাহের কারণে জাহান্নামি হবেন।” 
স্মৃতি থেকে লেখা; কিছু শব্দ এদিক-সেদিক হয়েছে সম্ভবত।
ঘটনা: ০৩
ব্যাপক নামডাক বিশিষ্ট একজন শ্রদ্ধেয় মুফতি সাহেবের মক্তব প্রজেক্টের একটা বই হাতে এল। উলটে-পালটে দেখতে লাগলাম। শিরকের বর্ণনায় এসে হয়রান হয়ে গেলাম। তখনো আমি এই ধরনের বক্তব্যের সঙ্গে পরিচিত ছিলাম না। সেখানে দেখলাম, এই সমাজের আওয়ামের বলা অগণিত কথাই শিরক! যেমন, সাধারণ বা প্রান্তিক মানুষ বলে থাকে, ‘এই চৈত মাসে গাইটা না থাকলে উপায় ছিলো না।’ বিপদ থেকে উদ্ধার পেয়ে বন্ধুকে বলে, ‘দোস তুই না থাকলে আজকে মরেই যেতাম।’ এই ধরনের রূপকাশ্রয়ী বাক্যগুলোকে শিরক বলে দেওয়া হচ্ছে।
এই ঘটনাগুলো বা এমন পরিস্থিতি প্রায়ই ঘটে আমাদের এই সময়ে। ভাষা-বিষয়ক বোঝাপড়া কম থাকার কারণে কখনো এমন কট্টর পন্থার আবির্ভাব ঘটে। কখনো এজেন্ডা ভিত্তিক প্রকল্প বাস্তবায়নের কারণেও ঘটে। 
আরবি-আজমি একটা উঁচনিচু ব্যাপার পুরো পৃথিবীতেই চলছে। চলে আসছে। ইসলামের সাম্য ও ফিতরাতের কথা ভুলে গিয়ে অনেকেই আরবীয় উপনিবেশের গ্যাঁড়াকলে আটকে আরবি ভাষার ভাষিক উপনিবেশ গ্রহণ করে নেন। ফলে তাদের কাছে এই অঞ্চলের কট্টর বাঙালি জাতীয়তাবাদের মতোই আরবীয় ভাষিক জাতীয়তাবাদ ঝেঁকে বসে। একদল বাংলায় আরবি, ফার্সি ও উর্দু সইতে পারেন না। আরেকদল পিউরিটান চৈতন্যে বাংলাকে মুসলমানের ভাষা মনে করতে পারেন না। এই দুই ভাষা-মৌলবাদীদের খপ্পরে পড়ে বাংলা ভাষাও যে মুসলমানদের হাত ধরে সমৃদ্ধি লাভ করেছে, সেই ইতিহাসই এখন ভুলতে বসেছে বাংলা ভাষাভাষীরা। 
যেই ব্যুৎপত্তিগত কারণে খোদা, নামায ও রোজা ব্যবহার অবৈধ বলছেন; ঠিক একই ব্যুৎপত্তিগত কারণ ‘আল্লাহ’ শব্দেও আছে। ইসলাম আসার আগে ‘ইলাহ’ বা ‘আল-ইলাহ’ শব্দটি পৌত্তলিকরা তাদের দেবতাদের ডাকতে ব্যবহার করত। সেখান থেকেই শব্দটিকে ‘আল্লাহ’ শব্দে বদলে একক সত্তার জন্য খাস করা হয়েছে। 
খোদা শব্দটি ফার্সি ভাষার। শব্দটির বিশ্লেষণে পাওয়া যায় এটি খুদ+আ থেকে গঠিত। ‘খুদ’ অর্থ স্বয়ং। ‘আ’ আগত। সুতরাং খুদ এর ‘ওয়াও’কে বিলুপ্ত করে ‘খুদা’ যা বাংলা বানানে ‘খোদা’ হয়েছে। এই শব্দটি নিয়ে পাকিস্তানের জামিয়াতুল উলুমিল ইসলামিয়াহ আল্লামা ইউসুফ বানুরি টাউনের ফতোয়া হলো এই শব্দ আল্লাহর শানে ব্যবহার জায়েজ। তাদের ফতোয়ায় এই শব্দের অর্থ সম্পর্কে বলেন, 
“عربی میں لفظ رب ،مالک اور صاحب کے معنیٰ میں ہے”
অর্থাৎ, খোদা শব্দটি আরবি রব, মালিক, ও সাহিবের প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহৃত।
বাংলা ব্যাকরণ ও ইলমুল মানতিকের শব্দ ব্যবহার ও শব্দের উৎপত্তিগত ব্যাখ্যাতেও এই শব্দ ব্যবহারে কোনো রকম ভাষিক বাধা নেই। 
হ্যাঁ, অধিকতর তাকওয়া ও কারো ব্যক্তিগত রুচিবোধের কারণে এই শব্দ এড়িয়ে যেতে পারেন। এমনকি কেউ অন্যকে এই শব্দে আল্লাহকে না ডাকতে উদ্বুদ্ধও করতে পারেন। কিন্তু এই শব্দের ব্যবহারকে শিরক বলতে পারেন না। ইসলামি শরিয়তে মাতৃভাষা ব্যবহারের যে মূলনীতি আছে, তাতেও এই শব্দকে শিরক বলার কোনো সুযোগ নেই। কেউ কেউ ‘খোদা’ শব্দকে অগ্নিপূজারিদের শব্দ বলে থাকেন। অথচ আজকের পৃথিবীতে যদি এক কোটি মুসলমানকে প্রশ্ন করা হয়, ‘খোদা’ শব্দ দ্বারা কী বোঝেন? শতভাগ মানুষ উত্তর দেবে ‘আল্লাহ’কে বুঝি। একটা শব্দের ‘উরুফি’ ও ‘পারাভাষিক’ বিবর্তনের জন্য আর কী প্রয়োজন?
বালাগাত শাস্ত্র অনুযায়ী আদেশসূচক অনুজ্ঞার (আমর) মৌলিক শব্দ চারটি। এ ছাড়াও বাইশটি অর্থে এই আমর ব্যবহার হয়। সেই বাইশটি অর্থই অনুধাবনের জন্য ব্যবহারের স্থান-কাল-পাত্র ও বক্তার বাকভঙ্গি অনুসরণ করতে হয়। 
বক্তব্যের ‘স্থান-কাল-পাত্র’ ও ‘বাকভঙ্গি’ একটা চর্চাগত বিষয়। ভাষা ও ভাষার অলিগলি এবং ভাষাভাষীদের উইট, বাগধারা, প্রবচন, জীবনযাত্রার পদ্ধতি ইত্যাদি না জানলে একজন সতর্ক আলিমের কাছে শুধু শিরক আর শিরক ভাসতে থাকবে। এসব সংকট থেকে নিজে বাঁচতে ও জাতিকে বাঁচাতে প্রয়োজন ইলমের সিলসিলা তথা পরম্পরা। প্রয়োজন নিজ মাতৃভাষাটাকে আপন করে ভাবতে শেখা।
অবশ্য, এজেন্ডা হলে এসব কিছুরই দরকার হয় না। তাকফির করা আর দলিল দেওয়াতেই পপুলারিটি অর্জন করা যায়। 
ধরুন, এই অঞ্চলের বিশজন মানুষ বলল, ‘এই কার্তিকে গাভীর দুধটা থাকাতে রক্ষে’। আপনি যদি এই বিশজন মানুষকেই পালটা প্রশ্ন করেন, ‘কী বললেন’? সঙ্গে তারা বলবে, ‘গাভী তো আল্লাহরই দান!’ অনেক আগে একটা উসুলের কথা পড়েছিলাম। অনেক খুঁজেও উৎস উদ্ধার করতে পারিনি। তবে উসুলটা মনে আছে। ‘কোনো ব্যক্তির (সম্ভবত কবির ছিল) শব্দগত ভাবের অবৈধতা নির্ধারিত হবে তার যাপিত জীবনের আকিদা ও দর্শন দিয়ে। জীবনের অপরাপর বক্তব্য, বিশ্বাস ও কর্মপদ্ধতি দিয়ে। যদি সেই বক্তব্যে ভিন্নার্থ নেওয়ার ভাষিক সুযোগ থাকে।’ এতে মূলত রূপকার্থের দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। 
তেমনিভাবে নামায ও রোজা শব্দদ্বয় বাংলা ভাষাভাষীদের মুখে-চোখে-ধ্যানে সালাতের ও সাওমের প্রতিশব্দ অথবা এই দুই ইবাদতের নামেই উদ্ভাসিত হয়। এর বাইরে এই শব্দের মূল ভাষা ফারসি অথবা এর ব্যুৎপত্তিগত অর্থ কখনোই কারও চিন্তায় অথবা দূর কল্পনায়ও আসে না। ফলে, এই শব্দগুলোকে নিষিদ্ধ শব্দ। নাজায়েজ শব্দ। অগ্নিপূজারিদের শব্দ বলা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না। ‘এক দেশের বুলি আরেক দেশের গালি’ এই রকমভাবে ভাষার শব্দের অর্থ বদলায়। ফলে ভাষা-শরিয়তে ইসলামের যে নীতিমালা, তা মানলে ভাষিক বিশৃঙ্খলা ও সামাজিক অস্থিরতা থেকে আমরা বেঁচে থাকতে পারি।
ইসলামি শরিয়তের একটা মূলনীতি হলো, ‘আল-আসলু আল-ইবাহা’ অর্থাৎ ‘মূল হলো বৈধতা’। আকিদা বা ইবাদত নয়, এমন সকল ক্ষেত্রে মূল হলো সবকিছু বৈধ। যতক্ষণ না তা হারাম বা নিষিদ্ধ হওয়ার দলিল পাওয়া যায়। আমরা যদি ভাষার উপমা, উৎপ্রেক্ষা, মাজাজ, কেনায়া, অলংকার ইত্যাদিকে সামনে রেখে শরিয়তের এই মূলনীতি ব্যবহার করি, তাহলে এই ধরনের ভাষা-উপনিবেশ থেকে বেঁচে থাকতে পারব।
[এই লেখাতে শুধু নোকতাগুলো সন্বিবেশিত করে রাখা হলো। বিস্তারিত আরেক কিস্তিতে, ইনশাআল্লাহ।]
সাইফ সিরাজ 
কবি ও বিশ্লেষক
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?