আমাদের চিঠিযুগ ও কুউউ ঝিকঝিক | লেখক ইমতিয়াজ শামীম | Amader Chithijug O Kuu Jhikjhik

▪️বই : আমাদের চিঠিযুগ ও কুউউ ঝিকঝিক
▪️লেখক : ইমতিয়াজ শামীম
▪️প্রকাশনী : কথাপ্রকাশ
▪️পৃষ্ঠা সংখ্যা : ১০৪
▪️মুদ্রিত মূল্য : ২০০ টাকা
▪️ব্যক্তিগত রেটিং : ৪.৫/৫

সন্তান যখন হারিয়ে যায়, তখন মা-বাবার কষ্টের সীমা থাকে না। নিজের চোখের মণির অন্তর্ধানে মা যেমন চিৎকার করে কাঁদেন, বাবা তা পারেন না। তার চোখের কোণে অশ্রু জমে। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যায়। কিন্তু সে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে না। চোখের কোণে জমে থেকে মুখের হাসি অদ্ভুত বিষাদের গল্প লেখে। প্রতিবেশীরা আসে স্বান্তনা দিতে। সে স্বান্তনা কষ্টটাই বাড়ায় কেবল। কেউ বোঝে না। প্রিয়জনকে হারিয়ে গুমড়ে মরার ভিতরের কষ্টটা কেউ জানে না। জানতে চায় না।
সময়টা ১৯৭৫ সাল। সামরিক এক অভ্যুত্থানে শেষ হয়ে গেছেন শেখ সাহেব ও তার পরিবার। এখানেই শেষ নয়। এর ধারাবাহিকতায় অসংখ্য তরুণ বন্দী হয়েছে ওই খাকি পোশাক পরা সামরিক জান্তার হাতে। “আমাদের চিঠিযুগ ও কুউউ ঝিকঝিক” উপন্যাসিকার গল্পকথকের বড়ো ভাইও এভাবে হারিয়ে যায় কোনো এক রাতের অন্ধকারে। একটি পরিবার নিমেষেই শেষ হয়ে যায়। মায়ের হাহাকার, বাবার নির্বাক হয়ে যাওয়া কিংবা ভাই-বোনের প্রতিনিয়ত বড়ো ভাইকে খুঁজে ফেরা যেন জীবনের-ই প্রতিচ্ছবি হয়ে দাঁড়ায়। 
জীবন তো থেমে থাকে না। তা আপন গতিতে বহমান। আর এই জীবনের স্রোত ভাসিয়ে নিয়ে যায় বহুদিকে। তবুও চলার পথে কখনো শিশিরের বিন্দুতে অথবা প্রবল বিক্রমে জানলা দিয়ে প্রবেশ করা সূর্যের আলোয়, আবার পাখির কলকাকলিতে বা শুঁকনো পাতার মর্মর শব্দে ভাইকে মনে পড়ে। আর তখনই মন বিদ্রোহ করে। সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে এক ঘৃণ পরিবেশের সৃষ্টি হয়। তাদের যত অর্জন, সব হারিয়ে গিয়ে কোথায় যেন ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকে। কত মায়ের বুক খালি হয়েছে, কত পরিবার নিঃশেষ হয়েছে; তার হিসাব মেলে না।
তারই মধ্যে প্রেম আসে। “আমাদের চিঠিযুগ ও কুউউ ঝিকঝিক” উপন্যাসিকার গল্পকথকের জীবনেও প্রেম এসেছে। রেললাইন দিয়ে হুট করে হুট করে ছুটে আসা ট্রেনের মতো করে স্নেহা এসেছে তার জীবনটা রাঙিয়ে দিতে। তখনকার সময় চিঠির আদান প্রদানে গল্প চলে। মনের কথা ব্যক্ত করার সবচেয়ে উপযুক্ত মাধ্যম। এভাবেই চলে সময়। কী রোদ আর কী বৃষ্টি; নিয়মের মধ্যে থেকে চিঠি দিতেই হবে। এভাবেই জন্ম নেয় ভালোবাসার। কলেজ পড়ুয়া দুই কিশোর কিশোরীর তখন নতুন দিনের স্বপ্নে বিভোর। বৃষ্টির দিনে রিকশা ভ্রমণে হুড তুলে প্রথম স্পর্শ বা প্রথম চুম্বনের অনুভূতি কেবল তারা-ই জানে। ট্রেন যেমন হুট করে প্ল্যাটফর্মে ঢোকে, তেমনই হুট করে বেরিয়ে যায়! জীবনের পথে এভাবে কেউ আসে আবার কেউ চলে যায়… কোথায় যায়, কেন আসে; এর জবাব কেউ জানে না। শুধু হারিয়ে যাওয়ার ক্ষণে মনে পড়ে যায় স্মৃতি। এই স্মৃতি যে ভোলা দায়!
অদ্ভুত বিষণ্ণতায় মোড়া সুন্দর গল্প “আমাদের চিঠিযুগ ও কুউউ ঝিকঝিক” বইটি। লেখকের লেখায় গভীরতা মনে দাগ কাটার জন্য যথেষ্ট। অসম্ভব সুন্দর লেখনী। দারুণ উপভোগ্য। এই উপন্যাসিকার দুইটি অংশ রয়েছে। এক অংশে দেশের সামরিক জান্তার শেখ সাহেবকে হত্যা আর এর পরবর্তী সময়ে ধরপাকড়। যেখানে সামরিক বাহিনীর প্রতি বিশ্বাস আস্থা হারিয়ে যায়। প্রবল আক্রোশ আর ঘৃণার জন্ম নেয় সেখানেই। আর এর ফল বইয়ের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় ছিল।
আর দ্বিতীয় অংশে ছিল, একদল কলেজ পড়ুয়া কিশোর কিশোরীর গল্প। মনের মধ্যে সদ্য প্রেম ফোঁটার সময় তখন। কিংবা দলবদ্ধ হয়ে কোনো এক বিশেষ উদ্দেশ্যে হারিয়ে যাওয়া। লেখক খুব দারুণভাবে সেসব উপস্থাপন করেছেন। লেখক দেখিয়েছেন, প্রথম প্রেমের অনুভূতি কেমন হতে পারে। বইয়ের গল্পকথক আর স্নেহার প্রেমের আবেশ ছড়িয়েছে পুরো বই জুড়ে। ভালোবাসার কথা বলতে হয় না। এখানেও না বলা ভালোবাসার গল্পে গভীর প্রেমের উপস্থিতি ছিল।
এই গল্পের প্রধান বিষয় ছিল, মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ের সামরিক অভ্যুত্থান। কখন কোন মায়ের বুক খালি করে সন্তানকে ধরে নিয়ে যাওয়া হবে, সে বিষয়ে সবসময় তটস্থ থাকতে হতো সবাইকে। এমন এক বিষয় নিয়ে লেখার জন্য লেখকের তারিফ করতেই হয়। এমন এক সময়কে লেখক তুলে ধরেছেন, যা ইতিহাসের পাতায় বিলীন। সেনাবাহিনীর কর্মকাণ্ডে সোচ্চার তরুণ তরুণীর প্রতিবাদের ভাষা অন্য মাত্র পেয়েছে বইটিতে। গল্পের ছলে লেখক প্রবল আক্রোশ ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন। মায়েদের হাহাকারের অনুভূতি ব্যক্ত করতে পেরেছেন। পেরেছেন বাবাদের নির্বাক চোখের অশ্রুর গল্প লিখতে। ভাই হারানো আরেক ভাইয়ের প্রতিনিয়ত ভাইকে খুঁজে ফেরার নিবেদন জানিয়েছেন। প্রিয়জনকে তো এভাবেই অনুভব করতে হয়।
কিশোর কিশোরীর মনঃস্তত্ত্ব উঠে এসেছে লেখকের লেখায়। লেখকের লেখায় ছিল কয়েক দশক আগের চিঠিকালের সে সময়। আজকাল প্রযুক্তির যুগে হয়তো যোগাযোগ সহজলভ্য। তবে সে সময় কেবল চিঠিই ভরসা ছিল। চিঠিতে প্রেম, চিঠিতে ভালো লাগা। আর এভাবেই চিঠির যুগের গল্প লেখক তুলে ধরেছেন। সেই সময়টা প্রযুক্তিতে প্রবেশের সময় ছিল। বিশাল বিশাল অট্টালিকা আটকে দিচ্ছিল মফস্বল শহরে সূর্যের আলোর প্রবেশ পথ। রেফ্রিজারেটরের প্রবেশ বিস্ময়ের জন্ম দিচ্ছিল অনেকের মনে। কিংবা মুদ্রাস্ফীতির সুযোগে দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি নাজেহাল করে তুলেছিল স্বল্প আয়ের মানুষকে, যা যেন এ যুগেরই প্রতিচ্ছবি।
বইটি বেশ অন্যরকম। লেখকের লেখনী চমকে দেওয়ার মতো। অনেক গভীরে আঘাত করার ক্ষমতা লেখকের আছে। তা দিয়েই লেখক মুগ্ধতা ছড়াতে পারেন। কিছু জিনিস অবশ্য বাহুল্য লেগেছে। আরো সংক্ষিপ্ত হতে পারত। কিছুটা অগোছালো। এই অগোছালো গল্পের পেছনে লেখকের ভাষ্য বেশ গোছানো। লেখক যা বলতে চেয়েছেন, তা স্পষ্টভাবেই তুলে ধরেছেন। পাঠকের মনঃস্তত্ত্বে আঘাতের জন্য তা যথেষ্ট।
পরিশেষে, আমাদের জীবনের গল্পে অনেকে হারিয়ে যায়। অনেক কিছুই হারিয়ে যায়। প্রিয় মানুষের অন্তর্ধানে হাহাকার জমে। এই হাহাকার ধীরে ধীরে কমতে থাকে। এক সময় সেই মানুষটার গল্প আর লেখা হয় না। বড়ো ভাই বা স্নেহার মতো কেউ আর আসে না। তাদের চিঠি নিয়ে কোনো ট্রেন আর প্ল্যাটফর্ম স্পর্শ করে না। পুরনো চিঠিতে ধুলো জমে। মলিন হয় খাম। ট্রেনের কুউউ ঝিকঝিক শোনা যায় না। কোনো এক দূর আকাশের তারা অজান্তেই মনে করিয়ে দেয় প্রিয়জনের কথা। তাদের চিঠির কথা। হয়তো কেউ আসে চিঠি নিয়ে। কিংবা ট্রেনের বগি থেকে নামে স্নেহা বা বড়ো ভাইয়ের মতো কে একজন। তাদের সাথে আর দেখা হয় না। সময়ের পরিক্রমায় শেষ হয়েছে চিঠিযুগ, থেমে গেছে কুউউ ঝিকঝিক শব্দ।
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?