আন্তর্জাতিক কুরআন প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের অংশগ্রহণ : কয়েকটি প্রশ্ন ও প্রস্তাবনা

সৌদি আরবে গত সপ্তাহে যে আন্তর্জাতিক কুরআন প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়েছে, সেখানে মোট ৫ ক্যাটাগরিতে প্রতিযোগিতা নির্ধারিত ছিল। বাংলাদেশী প্রতিযোগী হাফেজ তাকরিম চতুর্থ ক্যাটাগরিতে অংশ নিয়ে তৃতীয় স্থান অর্জন করেছেন।এই ক্যাটাগরিটি হচ্ছেঃ “তাজভীদ ও সুন্দর সুরের মাধ্যমে ধারাবাহিক পনেরো পারা মুখস্থ” বিভাগ। এর পুর্বে তৃতীয় ক্যাটাগরি হচ্ছেঃ “তাজভীদ ও সুন্দর সুরের মাধ্যমে পূর্ণ কুরআন মুখস্থ” বিভাগ। পৃথিবীর যে দেশের প্রতিযোগিতাই হোক সাধারণত বাংলাদেশের হাফেজগণ এই দুই বিভাগেই অংশ নিয়ে থাকে। প্রথম ও দ্বিতীয় বিভাগে তাজভীদ ও সুরের পাশাপাশি ইলমুল কিরাআত ও তাফসিরের কথাও যুক্ত রয়েছে। এসকল বিভাগে বাংলাদেশীদের অংশগ্রহণের বিষয়ে জানা যায়না। 
আমরা যদি প্রতিযোগিতার নামের দিকে লক্ষ্য করি তাহলে দেখতে পাব, এর পূর্ণ নাম হচ্ছেঃ কিং আব্দুল আজিজ কুরআনের হিফজ, তেলাওয়াত ও তাফসীরের প্রতিযোগিতা। চলতি বছর এর ৪২তম আসর সমাপ্ত হল। তারমানে প্রায় চার দশক ধরে এই প্রতিযোগিতা চলছে এবং ২/৩ দশক থেকে বাংলাদেশী প্রতিযোগীরাও অংশ নিয়ে পুরস্কার অর্জন করছেন।
.
প্রথম প্রশ্ন হল-
এই দীর্ঘ সময়ে প্রথম ও দ্বিতীয় বিভাগে কেন বাংলাদেশী হাফেজদের অংশগ্রহণ নেই?
এর একমাত্র কারণ বলা যায়, বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ইলমুল ক্বিরাআতের চর্চা নেই। প্রতিযোগিতার প্রথম ক্যাটাগরিতে যে “শাতিবিয়্যাহ” কিতাবের নাম ও ত্বরিক বলা হয়েছে  তা কি ও কেন তাও অধিকাংশ হাফেজগণ জানেন না। 
.
দ্বিতীয় প্রশ্ন,
বাংলাদেশের সাধারণ মহলে ইলমুল ক্বিরাআতের পরিচিতি না থাকলেও এসকল প্রতিযোগিতার সাথে যারা সংশ্লিষ্ট তারা কেন এই বিষয়ে উদ্যোগী হলেন না?
প্রায় দুই দশকেরও অধিক সময় যাবৎ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের ছাত্ররা যাচ্ছে, পুরস্কার পাচ্ছে। কিন্তু তারা শুধু হিফজের ক্যাটাগরি নিয়েই সন্তুষ্ট থেকেছে। তাদের দায়িত্বশীল শিক্ষক বা প্রতিষ্ঠানও তাদের সেদিকে আগ্রহী করেনি বা ব্যবস্থা নেয়নি। আমাদের দেশে ক্বিরাআত বলতে এখনো ‘কানে হাত দিয়ে মুখ লম্বা দমের’ তেলাওয়াতকেই বুঝে মানুষ। তাদের এই অবস্থার পরিবর্তনে, মানুষের মাঝে ইলমুল ক্বীরাতের ক্ষেত্রে কী ভূমিকা রাখছেন এসব বিশ্বজয়ী হাফেজ বা তাদের প্রতিষ্ঠান, এটি মুল্যায়নের সময় এসেছে এখন।
.
উদাহরণস্বরূপ বলি…
হাফেজ তাকরিম নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের সম্পদ। সে ইতিপূর্বেও দুই দেশের প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে জয়ী হয়ে এসেছে। তারপরও কেন সৌদি আরবের প্রতিযোগিতায় তাকে চতুর্থ বিভাগে অংশ নিতে হল? কেন এতদিনেও তাকে ইলমুল ক্বিরাআতের বিশেষজ্ঞ কারো মাধ্যমে (অনলাইনে হলেও) প্রস্তুত করা হলনা?
কেউ হয়তো বলবেন, অল্প বয়সের বাচ্চা তাই। কিন্তু যে বাচ্চা ছেলে এটুকু বয়সে এত বড় অর্জন করতে পারে তাকে সঠিক পরিচর্যা দিলে অবশ্যই পারত, যেমনটা আরব বাচ্চাদের দেয়া হয়ে থাকে।
আমরা শুধু তাদের দেখেই যাই, আর অপেক্ষাকৃত সহজ বিভাগে অংশ নিয়ে বিশ্বজয়ের আত্মতৃপ্তিতে ভুগি।
তৃতীয় প্রশ্ন,
হিফজ – হুফফাজদের নামে যে অজস্র সংগঠন আছে, শাস্ত্রীয়ভাবে ইলমুত তাজভীদ ও ইলমুল ক্বিরাআত চর্চায় তাদের ভূমিকা কী?
দেশব্যাপী লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে নানারকম অনুষ্ঠান তারা আয়োজন করেন। তাদের অনেকে এসব পদ – পদবী নিয়ে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে কুরআনের অনুষ্ঠানেও অংশ নেন। কিন্তু “উলুমুল কুরআন” (তাজভীদ – ক্বিরাআত – তাফসীর) বিষয়ে তাদের জ্ঞানচর্চা কতটুকু?
বরং দুঃখজনক কথা হল, যারা বাংলাদেশে ইলমুল ক্বিরাআত চর্চার উদ্যোগ নিয়েছেন বা নিচ্ছেন তাদেরকে অনেকে সহোযোগিতা করেন না।
শেষকথা…
কুরআন চর্চা ও কুরআনের প্রতি ভালবাসার যে জোয়ার উঠেছে, সময় এসেছে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ইলমুল ক্বিরাআতকে শেখা ও শেখানোর। শুধু মাকামাতি সুর নয়; শাস্ত্রীয়ভাবে
দশ ক্বিরাআতকে শেখা জানা ও পড়ার প্রয়োজন এখন।
সস্তা জনপ্রিয়তা ও মাহফিল কেন্দ্রীক হাদিয়া তোহফার মোহে বিশ্বজয়ী হাফিজদের না খাটিয়ে তাদের এই পথে মেহনত করানো হোক। যোগ্য আলিম হবার তত্বাবধান করা হোক।
.
কারী আব্দুল বাসেত, মাহমুদ খলিল হুসারি, মিনশাভী বা সুদাইস, শুরাইম, মাহের মুকাইলির সুর শুনিয়ে হিফজখানা চালানোর পরিবর্তে তাদের সনদে ইলমুল ক্বিরাআতের চর্চা করা হোক।
হিফজ ও হুফফাজ সংশ্লিষ্ট সকলে এই বিষয়ে কার্যকরী ভূমিকা নিবেন বলেই আশা রাখি।
.
সর্বোপরি বিশ্ববিজয়ী এসকল হুফফাজগনের এ বিজয়কে কোনো অবস্থাতেই খাটো করে দেখার সুযোগ নেই, ছয় ধাপের কঠিনতম স্নায়ুযুদ্ধ আর পারফর্ম করে শতাধিক দেশের (যার ২৫ টির অধিক দেশের প্রতিযোগি জন্মগতভাবে আরবি ভাষাভাষী) মাঝে এদেশের পতাকাকে উড্ডীন করেছেন, যা একটি নি:সন্দেহে অনন্য অর্জন। এতগুলি দেশের মাঝে প্রতিযোগিতা করে অন্য কোনো ক্ষেত্রে লাল সবুজের এতবড় বিজয় আছেকিনা আমাদের জানা নেই।
( ইষ্যত সম্পাদিত ও পরিমার্জিত )
© মুহতারাম লুতফে রাব্বি আফনান।
Abdul Hi Muhammad Saifullah
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?