আদর্শ হিন্দু হোটেল
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
“বয়স” সেটা একটা সংখ্যা মাত্র, বার্দ্ধক্য গ্রাস করে নিবে সে প্রস্তুতি নেওয়ার কোনো বিষয় নয়। মানুষ স্বপ্নের সমান বড়। স্রোত হারালে যেমন নদী মরে যায় তেমনি স্বপ্ন হারালে মানুষ মরে যায়। আমি শারীরিক মৃত্যুর কথা বলছি না। আত্মিক মৃত্যু টা, স্বপ্নহীন দেহ টা, শারীরিক ভাবে মৃত লাশের চেয়েও ভয়ঙ্কর। তাই, মানুষ তখনই মরে যায়, যখন তার জীবন থেকে আশা-আকাঙ্কা-স্বপ্ন দেখার শক্তিটা হারিয়ে ফেলে। যাদের জীবনে কোনো স্বপ্ন নেই, লক্ষ্য নেই তারা বেঁচে থেকেও পঙ্গু জীবন যাপন করার মতো। আর কিছু উদ্যমী মানুষ বয়সের ভারে বার্ধক্য গ্রাস করার সময়েও তাঁর স্বপ্নের ফলে তাঁর শরীরে ফিরে নতুন কর্মোদ্যম, কাজ করার শক্তি, যা তাকে নতুন করে জাগিয়ে তুলে। নিজের স্বপ্নের পিছনে ছুটে চলা ব্যক্তির বৃদ্ধ বয়সেও কাজ করার জন্য শরীরে ভার করে তারণ্যের শক্তি, তার শরীর হাত ও শরীর দূর্বল হয়ে পড়লেও তার আত্মবিশ্বাস তাকে এগিয়ে নিয়ে যায় সামনের দিকে, অসম্ভবকে সম্ভব করার দিকে। আজ এমনই একটি উপন্যাস নিয়ে আলোচনা করবো যা মানুষের নিস্তেজ ও ভেঙ্গে পড়া মনকে জাগিয়ে তুলতে সক্ষম। ভারতীয় কালজয়ী কথা সাহিত্য বিভূতি-ভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত উপন্যাস “আদর্শ হিন্দু হোটেল” নিয়ে আলোচনা করবো এখানে-
১৯৪০ সালে রচিত রচিত উপন্যাস “আদর্শ হিন্দু হোটেল ” তৎকালীন পল্লী বাংলার সাথে মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক ও সেই সাথে একজন মাঝ বয়সী দরিদ্র রসুয়ে বামন (হাজারী ঠাকুর) এর শূন্য থেকে সফল উদ্যোক্তা হওয়ার গল্প তুলে ধরা হয়েছে। যদিও পুরো গল্পের প্রধান চরিত্র হাজারী ঠাকুর পল্লী থেকে উঠে আসা নগর কেন্দ্রিক একজন শান্তশিষ্ট মানুষ। যার দুচোখ জুড়ে স্বপ্ন, মনে আত্মবিশ্বাস রয়েছে। যা তাকে কর্মোদ্যমী করে তুলেছে।
পশ্চিম বঙ্গের রানাঘাট রেল স্টেশনের পাশে পাশাপাশি বেচু চক্কোত্তী (বেচু চক্রবর্তী) ও যদু বাড়ুয্যের দুটি আদি হিন্দু হোটেল। স্টেশনে ট্রেন এসে থামলে “গরম ভাত তৈরি, মাছ, ডাল তৈরি; হিন্দু হোটেল বাবু আসেন” বলে বলে দু হোটেলের চাকরদের মধ্যে ক্রেতা ডেকে হোটেলে আনার প্রতিযোগিতা শুরু হয়।
অস্থায়ী ক্রেতাদের নিয়ে দুটি হোটেল টানাটানি করলেও স্থায়ী ক্রেতারা বেচু চক্কোত্তির হোটেলে খেতো। অবশ্য তা মাঝ বয়সী রসুয়ে বামন বা রাধুনী হাজারী ঠাকুরের রান্নার গুনেই। চাকরির খুঁজে পাঁচ বছর আগে গ্রাম থেকে শহরে এসে রান্নার এই কাজটি পায় হাজারী ঠাকুর। গ্রামের এক ব্রাহ্মন বিধবার কাছ থেকে নিরামিষ চচ্চড়ি রাঁধতে শিখেছিলেন হাজারীর মা। আর হাজারীর মায়ের কাছ থেকে হাজারীর রান্না শেখা। রানাঘাটে এসে ৭ টাকা মাইনে ২ বেলা খাওয়া আর বছরে দুটি কাপড়ের বিনিময়ে কাজটি নিয়ে ছিলো। পাঁচ বছরের চাকরির জীবনে হাজারীর বেতন এক পয়সাও বাড়ে নি। উল্টো বিভিন্ন কারণে জরিমানা করে বেতন কাটা যেত হাজারীর। হাজারীর ব্যক্তিগত লাভ ছিলো ক্রেতাদের কাছ থেকে পাওয়া প্রশংসা, সেটাও আবার হোটেল পরিচালিকা পদ্মঝি সহ্য করতে পারতেন না। পদ্মঝি অধিক লাভের আশায় লোভ করে পচা মাছ, নষ্ট দই, স্টেশনের বাইরের থেকে বরফ দেওয়া কেনা মাছ ক্রেতাদের জন্য রান্না করাতো। ক্রেতাদের সাথে এমন অন্যায় হাজারী সহ্য করতেও পারতো না, আবার প্রতিবাদ করার সাহসও নেই। ক্রেতারা খাবারের মান নিয়ে কোনো অভিযোগ করলে পদ্মঝি হাজারীর দোষ দিতো। বেচু চক্কোত্তিও পদ্মঝির কথার বাইরে যেত না। হোটেলে বেচে যাওয়া খাবারের সিংহভাগ চলে পদ্মঝির বাসায়। সারাদিন এতো খাটুনির পরও কোনো কোনো দিন হাজারী ঠিক মতো খাবার পেত না। হোটেলে রান্নার কাজ করতে করতে হাজারী ভাবতো তার একটা হোটেল হবে। যেখানে ক্রেতারা টাকা না থাকলেও খেতে পারবে, ভালো ভালো খাবার দিবে, ক্রেতাদের ঠকাবে না, বিশ্রামের ব্যবস্থা থাকবে। সেই হোটেলের বাইরে লিখা থাকবে-
“হাজারী চক্রবর্তীর হিন্দু হোটেল, রানাঘাট
ভদ্রলোকদের সস্তায় আহার ও বিশ্রামের স্থান।
আসুন…! দেখুন…!! পরীক্ষা করুন…!!”
দূরের যাত্রীরা খাওয়া শেষে বিশ্রাম করবে তার হোটেলে। হোটেলের নিয়ম থাকবে- খাও দাও, বিশ্রাম করো, তামাক খাওয়া চলে যাও। হাজারীর স্বপ্ন যেমন সুন্দর উদ্দেশ্যও তেমন সৎ। কিন্তু হোটেল খুলতে ২০০ টাকার মতো লাগবে। এতো টাকা সে পাবে কোথায়?
এর মধ্যে বেচু চক্কোত্তির হোটেলের কিছু থালা বাসন হারালে হাজারী তা চুরি করেছে বলে পদ্মঝি তাকে তাড়িয়ে দিতে বলেন৷ বেচু চক্কোত্তিও তাই করলেন। কাজ হারিয়ে হাজারী এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করে। ওদিকে সংসারের অভাবের চিন্তা মাথায়। হোটেল খোলার ব্যাপারে সহায়সম্বলহীন দরিদ্র হাজারী মনের বিশ্বাস ও উদ্যম নিয়ে কুসুম (হাজারীকে জেঠা মশাই বলে ডাকে, হাজারীও তাকে নিজের মেয়ে টেপির থেকে কোনো অংশে আলাদা করে দেখে না) ও গ্রামের টেপির বান্ধবী অতসীর বাবার সাথে পরামর্শ করে। কুসুম নিজের জমানো ৮০ টাকা দিতে চাইলে, অসহায় মেয়ে মানুষ তাই সেই টাকা নিতে রাজি ছিলো না। অতশীর তখন বাবা টাকা দিতে না পারলেও ধনীর দুলালী অতসী নিজ থেতে ২০০ টাকা ধার দিতে চায়। পরে সেই টাকা ধার নিয়ে স্টেশনের বাইরে হোটেল খুলেন। যা ছিলো হাজারীর স্বপ্নের হোটেল। হাজারীর রান্নার গুণে তার হোটেলে ক্রেতার সংখ্যা বাড়তে থাকে। ওদিকে বেচু চক্কোত্তির হোটেল দিন দিন ক্রেতাহীন হয়ে খারাপের দিকে যাচ্ছিলো। হাজারীর রান্নার গুণে ক্রেতাদের প্রশংসা শুনে ট্রেন স্টেশনের ভিতর নতুন হোটেল খোলার প্রস্তাব পায় হাজারী। ধীরে ধীরে ব্যবসা বাড়তে থাকে। হোটেল টি খুলতে পেরে এমনিতেই হাজারীর মনে হলো তার বয়স দশ বছর কমে গেছে। তার মধ্যে ব্যবসা বাড়তেছে দেখে শরীরে কাজ করার নতুন শক্তি ফিরে পেল। হাজারী এখন বিত্তবান। খরচ পোষাতে না পেরে বেচু চক্কোত্তির হোটেল বন্ধ হয়ে গেছে। বেচু চক্কোত্তি ও পদ্মঝি এখন হাজারীর হোটেলে কাজ করে। তবে হাজারী এখনো তাদের পুরনো মনিব আর পরিচালিকার মতো সন্মান করে।
শুধু অর্থবিত্ত থাকলেই মানুষ সব করতে পারবে এমন না। অর্থ বিত্ত থাকলে সব হবে এমন ভেবে নিজের সাথে কাজ করা লোকদের অন্ধভাবে বিশ্বাস করলে একসময় তা কাল হয়ে দাঁড়াবে।
Adorsho Hindu Hotel PDF Download Link
Adorsho Hindu Hotel PDF Download Link
স্বপ্ন-আশা নিয়েই মানুষের জীবন। সেই স্বপ্ন বা আশা পূরণ করতে হলে নিজেকে হতে হবে পরিশ্রমী, নিষ্ঠাবান, সৎ। সেই সাথে যাদের দ্বারা প্রভাবিত সেই মানুষগুলোকে অন্ধ বিশ্বাস করা যাবে না। অন্যথায় বেচু চক্কোত্তির মতো সাজানো সব কিছু হারাতে হবে। সফল হতে বয়স লাগে না, স্বপ্ন দেখা লাগে।
সফলতা কিভাবে আকাশচুম্বী হবে যদি স্বপ্ন টা হয় ছোট…?