আদর্শ পাঠক শিশু গঠনে যা করণীয় – শিশুদের বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলবেন যেভাবে

শিশুদের বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলবেন যেভাবে – ড. আব্দুল কারীম বাক্কার।

কোনো কিছুর প্রতি আকর্ষণ, ঝোঁক ও প্রবণতা সৃষ্টি করে শিশুর সঠিক মানস গঠনে তার জীবনের প্রথম ছ’টি বসন্ত সব থেকে উপযুক্ত সময়।

আদর্শ পাঠক শিশু গঠনে যা করণীয় - শিশুদের বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলবেন যেভাবে

তাই অধ্যয়নানুরাগের বীজ তার হৃদয়ে বপন করতে এ-সময়টা যারপরনাই গুরুত্ব বহন করে। অনেক অভিভাবক আবার ধারণা করেন যে, পড়ায় মনোযোগ আর অমনোযোগ একটি জন্মগত বৈশিষ্ট্য, তাই উল্লেখযোগ্য কোনো চেষ্টাই তারা ব্যয় করেন না, যা শিশুদের পড়ায় উদ্বুদ্ধ করবে।
আবার কেউ বিশ্বাস করেন, যে-কোনো বয়সেই শিশুকে পাঠানুরাগী করে তোলা সম্ভব; ফলে যাচ্ছেতাই করে এড়িয়ে যান বিষয়টি; আর এভাবেই শিশুরা বেড়ে ওঠে এক পর্যায়ে কৈশোরে পদার্পণ করে অধ্যয়নের সাথে কোনো প্রকার সখ্যতা ছাড়াই।
আমাদের নিকট অসংখ্য বাস্তবতা আর চাক্ষুস প্রমাণ রয়েছে, শৈশবে যদি আমরা শিশুর কচি-হৃদয়ে বইয়ের সাথে সখ্যতা ও নিবিড় সম্পর্কের বীজ বপন করতে ব্যর্থ হই; তবে তা-যৌবনে কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠে। যেমন শীত বসন্তের শস্য; এ-ঋতুর শুরুতে বপন না করলে, পরে তা-পূর্ণ বিকশিত হয় না; তেমনি শিশুর মনোযোগ আগ্রহ, ঝোঁক ও প্রবণতা সৃষ্টিরও একটি উৎকৃষ্ট সময় আছে; মোটেও তাতে বিলম্ব করা উচিত নয়।
জনৈক পিতা তার সন্তানের শৈশবে লেখা-পড়ায় অনুরাগী ও আগ্রহী করে তুলতে অবহেলা করেন; এভাবে শৈশব পেড়িয়ে কৈশোর-বসন্তের এগারোতে পদার্পণের পর তিনি তাতে মনোনিবেশ করেন। ততক্ষণে তার সন্তান মনোযোগী হয়ে উঠেছে খেলাধুলায়, আসক্ত হয়ে পড়েছে সতীর্থ আড্ডায় এবং অভ্যস্থ হয়ে গিয়েছে রকমারি চ্যানেল ও সিরিয়ালে-ফলে এখন বাবার কোনো প্রকার সদুপদেশ শুনছে না সে। উল্টো বাবার কথায় অবাক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকছে, বিচলিত হয়ে বিরক্তিভাব প্রকাশ করছে। এখন বাবা অভিযোগ করে বলছে : আমি তাকে তার পছন্দের যে-কোনো বই : কিনে দিতে প্রস্তুত; যেমনটি, তাকে বহু-মূল্যের বাই-সাইকেল কিনে দিয়েছিলাম- যখন সে ওয়াদা করেছিল যে, প্রতি সপ্তাহে একটি করে তার বয়সোপযোগী গল্প পড়বে। কিন্তু সে মুখ রক্ষা করেনি। এখন কোনো রকম করে একটি-একটি ক্লাশ নামমাত্র নাম্বার নিয়ে পার করছে…!
আমি সকল পিতা-মাতার প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি; তারা যেন হৃদয়ঙ্গম করেন- সময়ের দ্বার সবসময়-ই তাদের সামনে উন্মুক্ত নয়, সুযোগ-সে তো অতিথি হরীণ; হাত ছাড়া হলে তার নাগাল পাওয়া অসম্ভব।
(২). জীবনের শুরু লগ্নেই অধ্যয়ন পরিশীলনে-তৎপরবর্তী একাডেমিক শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের সাথে একটি সুদৃঢ় বন্ধন রয়েছে।
কারণ, শুধুমাত্র একাডেমিক পড়াশোনার উপর ভিত্তি করেই আপন সহপাঠী সতীর্থদের ছাপিয়ে সৃজনশীলতায় তাদের উপর বিশদ ব্যবধানে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন এক প্রকার দূরহ ব্যাপার। এর জন্য থাকতে হয় অধ্যয়ন ও বইয়ের প্রতি এক অসম্ভব ঝোঁক অনুরাগ-অনুরক্তি। বই সঙ্গতায় পার করতে হয় দিনের একটি দীর্ঘ সময়। শুধু তাই নয়, তার অধ্যয়ন ও গবেষণা হতে হয় কার্যকর ও কল্যাণমুখী।
একাধিক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে; নার্সারির প্রথম শ্রেণীতে একটি শিশু যে টুকু অধ্যয়ন-দক্ষতা অর্জন করে; উচ্চ মাধ্যমিকে উঠেও ছাত্রটির শিক্ষামান বৃদ্ধির ভিত্তি হিসেবে সে আগের দক্ষতা-ই কাজ করে। তাই, শিশুদের শিক্ষার অন্তরালে পিতা-মাতাদের একটি অনিস্বীকার্য টার্গেট থাকবে তাদের বই অনুরাগী করে তোলা। আর অধ্যয়নকে করে তোলা তাদের নিত্যনৈমিত্তিক পানাহার আর খেলাধুলার মতো আপন করেই। কেননা, অধ্যয়ন-বিরাগী শিশুদের অধিকাংশই শিক্ষাবৃত্তিতে দুর্বল হয়ে পড়ে; যদিও সে সর্বশ্রেষ্ঠ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে! এর হেতুও অস্পষ্ট নয়—যখন শিশুটি বই-এর প্রতি আকর্ষণ হারায়, তখন লেখা-পড়া ও অধ্যয়নে যৎসামান্যই প্রচেষ্টা ব্যয় করে। আনন্দ খুঁজে ফিরে খেলাধুলায়, জড়িয়ে পড়ে অনর্থক কাজে। দুঃখজনকভাবে অধিকাংশ শিশুই এখন এই বলির অসহায় শিকার।
(৩). অধ্যয়ন প্রেম ও পাঠাগ্রহ শিশুকে একটি বৃহৎ উন্মুক্ত ফটকের সন্ধান দেয়; যার পথ ধরে সে বাহ্যিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতির এক জগতে প্রবেশ করে। হাঁটি-হাঁটি, পা-পা করে ব্যাপক করে তোলে তার অনুধাবন শক্তি; আর মসৃণ করে তোলে তার কল্পনার জগৎ।
নিম্নে বিষয়টি পয়েন্ট আকারে ব্যাখ্যা করছি :
(ক) যখন অধ্যয়ন ও পড়ার প্রতি বাচ্চাদের এক প্রকার আসক্তির সৃষ্টি হয়, তখন অধ্যয়নাসক্তিই তার জীবনের প্রধান উপভোগ্য হয়ে ওঠে।
আমি জীবন-বসন্তের এগারোতে পদার্পণ করা এক কিশোরকে লক্ষ্য
করলাম; সে “সাহাবায়ে ক্রোমের ঘটনাবলী” অধ্যয়নে তন্ময় হয়ে আছে।
তার মাতা বার-বার খাবারের জন্য পীড়াপীড়ি সত্ত্বেও ভালোলাগার ঘটনাটি ত্যাগ করতে পারছিল না। সে ছিল আসক্তির একাগ্রতায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত। মাঝে-মধ্যে তার পড়ার রুমটি অন্ধকার হয়ে যেত। তথাপিও মনসংযোগের ছন্দপতন হবার আশঙ্কায় আলোর জন্য উঠে দাঁড়াতো না, যেন আসক্তির
মোহনায় একাকার হয়ে আছে।
সে-শিশু আজ বৃদ্ধ, পরিণতির মহীরুহ। এখন নিজ গবেষণায় সতীর্থদের ছাপিয়ে বিশ্বসভায় প্রসিদ্ধ দশের একজন।
বিষয়বস্তুর বৈচিত্রতায় শিশুর চেতনায় বিচিত্রতা লক্ষ্য করা যায়। যেমন :
হাস্যরসের গল্পে-কৌতুক কিংবা ভূতের কাহিনী পড়লে বাচ্চাদের ভেতর এক প্রকার ব্যাপক উদ্দীপনা কাজ করে। সে কাহিনী তার শিশু-মানসকে শিহরিত করে তোলে।
অন্যপক্ষে মনিষীদের জীবনচরিত অধ্যয়নে বাচ্চারা আত্মচেতনা ও মহত্ববোধ অনুভব করে। যেমনটি যুদ্ধের গল্প পড়ে নিজের বীরত্ব জাহির করে।
যখন-ই কোনো বাচ্চাকে বলতে শুনবেন-“আমি অমুকের মতো হতে চাই”, একথা সে কেবল তখনই বলে যখন সে ঐ ব্যক্তিকে জেনে বা পড়ে তার কৃষ্টি কালচার, আচার-আচরণ সর্বোপরি তার ব্যক্তিত্বের দ্বারা ব্যাপক প্রভাবিত হয়।
বই পড়ার একটি নূন্যতম উপকার হলো-এটি শিশুকে উচ্চাকাঙ্ক্ষী করে তোলে এবং বড় পরিসরে স্বপ্ন দেখতে শেখায়। আর প্রত্যেক মনীষীই তার বিদ্বান হওয়ার যাত্রার শুরুটা উচ্চাকাঙ্ক্ষা, উন্নতচিন্তা আর বৃহৎ চূড়ার পথ ধরেই শুরু করেছেন।
(খ) হতদরিদ্রের ঘরে জন্ম নেয়া সুবিধাবঞ্চিত শিশু অথবা শিক্ষার আলো থেকে বহু দূরের পরিবেশে বেড়ে ওঠা শিশুর জন্য শিক্ষা এবং অধ্যয়ন প্রেম মুক্তির দূত হয়ে অবতীর্ণ হয়।
এই ধ্বংসাত্মক পরিবেশ শিশুর উচ্চাকাঙ্ক্ষার বিনাস করে। ফলে যেকোনো তুচ্ছ অবলম্বনই তাকে সন্তুষ্ট করে তোলে। এখানে শিক্ষার ভূমিকা অপরিসীম; যা তাকে সীমিত ও ক্ষুদ্র পরিসর থেকে বেরিয়ে মুক্ত আকাশের সন্ধান দেয়। তার গলায় চেপে ধরা কঠিন সময় থেকে বের করে ইতিহাস সম সুপ্রশস্ত দীর্ঘ পথের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়।
তাই অনেক শিশুর ক্ষেত্রে শিক্ষাটা তার জীবন-সম গুরুত্ব বহন করে। বিশেষত হতদরিদ্র নিরক্ষর পরিবারে জন্ম নেয়া শিশুর বেলায় শিক্ষাটা অন্যের তুলনায় অধিকতার প্রয়োজন। হতাশা-নৈরাশ্য ও ভারসাহীনতা যেন উদ্যমতা হারিয়ে কষ্টে চেপে থাকা সংকীর্ণতা তাকে গ্রাস না করে।
আর আমরা লক্ষ্য করেছি, পারিবারিক সূত্রে সাংস্কৃতিক দীক্ষা থেকে বঞ্চিত শিশুদের বেলায় বুদ্ধিবৃত্তিক জরিপগুলো তাদের মেধা যাচাই ও পরিমাপ করতে গিয়ে আশানুরূপ কিছু পেতে ব্যর্থ হয়েছে।
এখানেই পরিষ্কার হয়ে যায় যে, পাঠে মনোযোগী ও অধিক পড়ুয়া শিশুরা আত্মবিশ্বাসী; আচরণে উচ্চারণে সতীর্থদের মাঝে শ্রেষ্ঠত্ব ও দক্ষতার স্বাক্ষর রেখে চলে।
এক শিশু যার বয়স পাঁচ বছর অতিক্রম করেনি। তবে এরই মধ্যে সে তার মায়ের বিশেষ নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছে। সে সবচেয়ে ভালো এক কিন্ডারগার্টেন এ পড়ে, যা তাকে শ্রেষ্ঠত্বের উপলদ্ধি দেয় এবং সে সম্পূর্ণ স্বাধীন ব্যক্তির মতো আচরণ করে, ভাষার ব্যতিক্রমধর্মী ব্যবহারেও সে স্বাক্ষর রেখেছে। একবার তার বাবা একটা অনুষ্ঠানে যাচ্ছিলেন। শিশুটি তার সাথে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু তার বাবা তাকে বলল, তোমাকে আজকে এখানে থাকতে হবে, বাইরে যেতে পারবে না! কিন্তু শিশুটি অবাক করা জবাব দিয়েছিল। বলল : কি? বাবা, তুমি কি আমার বস? যে বাইরে যেতে
বাধা দিচ্ছো! এটা শুনে পিতা হেসেছিল এবং তার কথায় অবাক হয়ে গিয়েছিল এবং তাকে তার সাথে নিতে রাজি হলো। ঐ একই শিশুর সাথে তার বড় ভাই যার বয়স কিনা ৮ বছর, একদিন খারাপ ব্যবহার করেছিল। বড় ভাই তার ভুল বুঝতে পেরেছিল এবং শিশুটির কাছে সরি বলেছিল কিন্তু শিশুটি অবাক করে দিয়ে বড় ভাইকে বলল, “ইট ইজ টু লেট।”
গ. আমাদের শিশুরা ঐসব গল্প করা এবং শোনার প্রতি মুখাপেক্ষী যেগুলো তাদের আত্মাকে উন্নত করে এবং নৈতিকতাকে পরিশোধন করে। এটা বর্তমানে বিশেষভাবে সত্য, যেখানে সহানুভূতি স্থলাভিষিক্ত হয়ে যাচ্ছে আধিপত্য দ্বারা এবং সমতা ও পরোপকারিতাকে স্থলাভিষিক্ত হয়ে যাচ্ছে স্বার্থপরতা দ্বারা। বিশেষ করে এমন সময়ে যখন মানুষ এগুলোর প্রতি প্রবল মুখাপেক্ষী।
এক মা লক্ষ করলেন, তার ১১ বছরের মেয়েটির যেকোনো জিনিস তার নিজের করে নেওয়ার জন্য প্রবল আগ্রহ রয়েছে, এমনকি যে জিনিস তার নয় এমন জিনিস নিজের বলে দাবি করতে সে মিথ্যা বলতেও দ্বিধাবোধ করে না। এছাড়া সেই মা এটাও লক্ষ্য করলেন তার সাত বছরের ছেলে সন্তানটি পিঁপড়ার মতো ক্ষুদ্র প্রাণীগুলোকে এমনভাবে পা দিয়ে পৃষ্ঠ করে যেন সে তাদের থেকে প্রতিশোধ নিচ্ছে।
এ সমস্যাটি সমাধান করার জন্য সেই মা একটি বইয়ের দোকানে গেলেন এবং উদারতা, পরোপকারিতা ও প্রাণীর প্রতি দয়া প্রদর্শন শিক্ষা দেয় এমন কিছু গল্পের বই কিনে নিয়ে আসলেন।
কিছুদিন পর তাদের মা এর ফলাফল এভাবে বর্ণনা করলেন,
“যে গল্পটি শিশুদের সচেতনতার উপর প্রভাব ফেলেছিল তা ছিল একটি অন্ধ বিড়ালের। গল্পটি ছিল এমন এক বিড়ালের যে গর্ভাবস্থায় তার দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছিল। যখন সে ছানাগুলোকে জন্ম দিল তাদের যত্ন নিতে এবং তাদেরকে কাছে রাখতে বিড়ালটিকে অনেক সমস্যায় পড়তে হয়েছিল। সেই মা আরো বললেন, আমি দশ বারের বেশি এই গল্পটি আমার সন্তানদেরকে বলেছি, প্রত্যেকবারই তাদের কেউ-না কেউ গল্পটি শুনে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছে। একদিন খুব সরল মনে তাদের একজন বলল, মা তুমিতো বিড়ালটিকে আমাদের বাসায় নিয়ে আসতে পারো, যাতে আমরা তার বাচ্চাদের যত্ন নিয়ে তাকে হেল্প করতে পারি।
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?