আত্মজীবনী – মরহুম মাওলানা আবদুস সালাম চাটগামী রহ

জাতি হিসেবে আমাদের জন্য একটা আক্ষেপের 
বিষয় হলো বড় মানুষদের আমরা মৃত্যুর আগে 
চিনতে পারি না। মরহুম মাওলানা আবদুস সালাম চাটগামী রহ. এর কথাই ধরুন। 

গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে তার মৃত্যুর আগপর্যন্ত না তার নাম জানতাম। আর না জানতাম তার কোনো সৃষ্টিকর্ম সম্পর্কে। অথচ তিনি সারা বিশ্বে সমাদৃত একজন আলেমে দীন ছিলেন। নানান সময়ে বহু জটিল বিষয়ে ফতোয়া দিয়ে তিনি মুসলিম উম্মাহর উপকারে আত্মনিয়োগ করেছেন। 
ডিজিটাল প্রচারমাধ্যমের এ যুগে তার মতো বিশাল জ্ঞানের অধিকারী একজন মানুষ সম্পর্কে না জানা থাকাটা নিজের জন্যই কিছুটা লজ্জাজনক বটে।
সাম্প্রতিক সময়ে আত্মজীবনী পড়ার প্রতি একটা 
বিশেষ ঝোঁক উপলব্ধি করতে পারছি। একজন 
মানুষের আত্মজীবনী পাঠের মধ্য দিয়ে তাকে ভেতর থেকে কিছুটা হলেও অনুভব করার সুযোগ সৃষ্টি হয়। কারণ, এখানে লেখকের নিজস্ব চিন্তা, দর্শন, পৃথিবীকে দেখার অনুভূতি—সবই আপন মহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। তাছাড়া একজন মানুষ এবং তার সমকালীন ইতিহাস সম্পর্কেও জানার জন্য আত্মজীবনী হতে 
পারে অন্যতম নির্ভরযোগ্য মাধ্যম। 
মুফতি আবদুস সালাম চাটগামী রহ. র আত্মজীবনী যখন বের হয়, তখন থেকেই বইটির প্রতি আমার 
বিশেষ আগ্রহ ছিল। কারণ, ইতোমধ্যে পত্র-পত্রিকা 
এবং তার কাছের মানুষদের থেকে কিছু কিছু লেখা প্রকাশিত হয়েছিল; যেখানে মরহুম মুফতি সাহেবের জীবন ও কর্মের অল্পবিস্তর আলোচনা এসেছিল। আমি সেসব পাঠ করার পরই আবদুস সালাম চাটগামী রহ. সম্পর্কে অধিক আগ্রহ বোধ করতে থাকি।
আত্মজীবনী সাধারণত লেখক নিজে লিখে থাকেন। এজন্যই তো একে আত্মজীবনী বলে অভিহিত করা 
হয়। কিন্তু মজার বিষয় হলো, আমাদের আলোচ্য ‘আত্মজীবনী’ লেখক নিজ হাতে লেখেননি। কারণ, একদিকে তিনি বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছিলেন; আর অপরদিকে নানাবিধ রোগব্যাধি তাকে একেবারে দুর্বল করে দিয়েছিল। ফলে শ্রুতিলেখক দিয়েই কাজটি 
সারতে হয়েছে। তবুও আমাদের বিরাট সৌভাগ্য যে মৃত্যুর আগে তিনি নিজের সম্পর্কে কিছু কথা আমাদের জানিয়ে যেতে পেরেছেন। তা না হলে বিরাট একটা আক্ষেপ থেকেই যেত!
একজন মানুষের চট্টগ্রামের অজপাড়াগাঁ থেকে 
শুধুমাত্র জ্ঞান অর্জনের জন্য পাকিস্তানের করাচিতে 
ছুটে যাওয়া এবং সেখান থেকে ইসলামি জ্ঞানের নানা শাখাপ্রশাখায় বিচরণ করে একজন বিশ্বমানের 
আলেমে দীন হয়ে ওঠার গল্পই বর্ণিত হয়েছে পুরো আত্মজীবনীজুড়ে। এখানে তার শৈশবের কথা, শিক্ষাজীবন, বানুরিটাউনের প্রধান মুফতি হয়ে ওঠা থেকে শুরু করে পুনরায় দেশে আগমন এবং 
হাটহাজারি মাদ্রাসায় কর্মকাণ্ড শুরু করা পর্যন্ত ঘটনা বিবৃত হয়েছে। বইটিতে যে ঘটনাগুলো 
বর্ণিত হয়েছে তা কিন্তু ধারাবাহিকভাবে নয়। বরং একজন মানুষ অপর একজনের সঙ্গে গল্প করার সময় যেমন আলোচনা করেন, তেমনি বিচ্ছিন্নভাবে 
আলোচনা এসেছে। তবে পাঠ করার সময় নিশ্চয়ই ঘটনার পরম্পরা বা যোগসূত্র অনুধাবন করা 
সম্ভব হবে।
একজন মানুষ জ্ঞানের প্রতি কতটা তৃষ্ণার্ত হতে পারেন, মুফতি সাহেবের জীবনী পড়ার পর একজন পাঠক তা উপলব্ধি করতে পারবেন। আবদুস সালাম চাটগামী রহ. মাদ্রাসায় পড়ার ব্যাপারে নিজের সিদ্ধান্তে 
অনড় ছিলেন। কিন্তু তার পিতা তাকে ভর্তি করাবেন স্কুলে। তিনি তাতে নারাজ। ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ত্যাগ করে তাকে লাগাতার কয়েক বছর মাঠে কৃষিকাজ করতে হয়েছে। তারপর একদিন বাড়ি থেকে পালালেন। পালিয়ে একটা মাদ্রাসায় গিয়ে ভর্তি হলেন পরিচিত একজনের সহায়তায়। এই তার জীবনের পথচলা শুরু হলো; যা মৃত্যুর আগপর্যন্ত আর থামেনি। বাড়ি থেকে পালিয়ে সবাই যে বিপথে যায় না; কেউ কেউ বিশ্বমানব হয়ে ওঠেন—মরহুম আবদুস সালাম চাটগামী রহ. তার অন্যতম উদাহরণ। বইয়ের পাতায় পাতায় তার 
জ্ঞানতৃষ্ণা দেখে বিস্মিত হয়েছি।
জানার প্রতি বিপুল আগ্রহ তার সামনে অবশ্য সুযোগের ডালা হাতেও হাজির হয়েছে। ফলে আমরা দেখতে পাই ছোট ক্লাসে পড়েও তিনি বড়দের জন্য নির্ধারিত লাইব্রেরিতে গিয়ে পড়ার সুযোগ পাচ্ছেন, শিক্ষকদের সুনজরে পড়ে যাচ্ছেন অতি দ্রুত। কেউ যখন কোনো কিছু অর্জনের জন্য দৃঢ়তার সঙ্গে এগিয়ে যায়, তার সামনে নতুন নতুন বহু দরজা উন্মুক্ত হয়ে যায়। আবদুস সালাম চাটগামী রহ. র আত্মজীবনী পড়ার পর আমার এই উপলব্ধিই হয়েছে। 
সে সময় করাচির জামেয়া ইউসুফ বানুরিটাউন পুরো ভারতবর্ষের অন্যতম সেরা মাদ্রাসা। আল্লামা ইউসুফ বানুরি রহ. এর প্রতিষ্ঠাতা এবং পরিচালক। ভারতীয় উপমহাদেশ এবং এর বাইরেও রয়েছে তার গ্রহণযোগ্যতা। আমরা সে সময়ের কথা বলছি—যখন আজকের বাংলাদেশ ছিল পাকিস্তানের অংশ। ফলে বাংলাদেশ থেকে করাচিতে জ্ঞানার্জনের জন্য যাওয়ার চিন্তা করতে তাকে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি। তিনি যে ওখানে গিয়ে সঠিক কাজ করেছেন তা খুব দ্রুতই উপলব্ধি করতে পারেন। কারণ, যে জ্ঞানের সন্ধান উনি চাচ্ছিলেন তার ষোলআনাই আল্লামা ইউসুফ বানুরি এবং তার প্রতিষ্ঠানের লাইব্রেরিতে বিদ্যমান ছিল।
ইতিহাসের শিক্ষার্থী হিসেবে যেকোনো বইয়ের মাঝেই ইতিহাস খোঁজার একটা প্রবণতা আমার মধ্যে রয়েছে। বিশেষ করে কারও আত্মজীবনী পাঠ করতে গেলে সমকালীন ইতিহাসের একটা আঁচ অবশ্যই পাওয়া যায়। আবদুস সালাম চাটগামী রহ. তখন ছাত্রজীবন  শেষ করে সদ্যই শিক্ষকজীবন শুরু করেছেন, তখনই বাংলাদেশে স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয়ে যায়। সেসময় যে ভীতিজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল এবং আল্লামা ইউসুফ বানুরির যে দৃঢতার সাথে অবস্থান—তা খুব দারুণভাবে ফুটে উঠেছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে পাকিস্তানের আলেমসমাজ, সাধারণ জনগণ কী ধারণা পোষণ করতো তার একটা সংক্ষিপ্ত ধারণা পাওয়া যায় এখান থেকে। 
নানান সময়ে পাকিস্তান সরকারের কর্মকাণ্ডে বিরক্ত হয়ে ফতোয়া প্রদান করতে হয়েছে। সেসময় বানুরিটাউনের ইফতা বিভাগের দৃঢ ও স্পষ্ট অবস্থান আমাদের জন্য দারুণ শিক্ষণীয় হয়ে উঠতে পারে। ভয় ও প্রলোভন যে আলেমসমাজকে সত্য প্রকাশ করতে বাঁধা দিতে পারে না তার বেশ কয়েকটি উদাহরণ পাওয়া যাবে বইয়ের পাতায়। 
দীর্ঘসময় পর আবদুস সালাম চাটগামী রহ. দেশে ফিরে আসেন। এখানে এসেও তিনি বসে থাকেননি। হাটহাজারি মাদ্রাসার দারুল ইফতা বিভাগকে শক্তিশালী করার জন্য কাজ করে গেছেন। অর্থাৎ জীবনের শেষপর্যন্ত তিনি জ্ঞান অর্জন এবং বিতরণের কাজে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। 
একজন জ্ঞানী মানুষের জীবনীর ঘটনাবলী জানাই একমাত্র কাম্য হতে পারে না। বরং সমস্যা মোকাবিলার ক্ষেত্রে তাদের অবস্থান কেমন ছিল সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেদের জীবনে তার প্রয়োগ করতে পারাই হলো আসল কথা। আশা করি আমাদের আলেমসমাজ সেদিকে অগ্রসর হবেন।
আবদুস সালাম চাটগামী রহ.’র ‘আত্মজীবনী’ শুধু একটি বইই নয়, বরং অনুভূতিতে নাড়া দেওয়ার মতোই কিছু। আমাদের বর্তমান প্রেক্ষাপট এবং ঘটনাপ্রবাহের দরুন বইটি অবশ্যপাঠ্য হয়ে ওঠার পাশাপাশি আরও নানাবিধ কারণে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। 
রিভিউ: আরাফাত শাহীন 
২২ সেপ্টেম্বর, ২০২২
সাভার, ঢাকা
টিম ইত্তিহাদ Ettihad Publication
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?