আকাশ রাঙানো জাদু ! ✍️ Peal Roy Partha

ভোর থেকে আকাশটা থমথমে। পৌষ মাসের সকালটা ঠিক যেমন হওয়া উচিত। চারদিকে কুয়াশার গাঢ় রাজত্ব। দু’হাত দূরের দৃশ্যটাও স্পষ্ট করে দেখার সাধ্য কোনো প্রাণীর নেই। মাঘ মাসে এমনটা হতে প্রায়ই দেখা যায়। এ-বার যে সেটা পোষ মাসে এসে ধরা দিবে; তা শহরের মানুষগুলোর জানা ছিল না। তারা অবশ্য বেঘোরে ঘুমিয়ে। মরাগুলো কবর-শ্মশানে; যে-ভাবে ঘুমোয় ঠিক সেইভাবে। বেশ কিছু বছর হলো শীতের দাপট আর আগের মতো নেই। তবে এই বছরে শীত—নিজের তেজোদীপ্ত যৌবনের জানান দিচ্ছে বেশ জোরেশোরে। 
শহরের লোকেরা জানে, এই কুহেলিকার চাদরে নিজেদের জরিয়ে কোনো কাজ নেই। সূয্যিমামা যে আজ পণ করেছে, তা বোধহয় কুয়াশারাও আন্দাজ করতে পেরে জমায়েত হয়েছে। একেবারে ঝাঁকিয়ে বসা যাকে বলে। শুধু বসে না থেকে নিজেদের মধ্যে বাতচিত চালিয়ে নিচ্ছে তারা। কখন তল্পিতল্পা গুটিয়ে বাতাসে মিশে যাবে; সেই হিসাব কষে চলছে ক্ষণকাল ধরে। পরিবেশ শ্রান্ত আর সুখী ক্লান্ত হলেও, ঘুমন্ত শহরের কেউ কেউ এখন আর ঘুমিয়ে নেই। নানান ব্যস্ততার পাশাপাশি উৎকণ্ঠা—তাদের মধ্যে লক্ষণীয় মাত্রায় বেড়ে চলেছে।
তেমনই এক পরিবারের জনাতিনেক সদস্যদের ঘুম নেই চোখে। ভোর হতে না হতে তাদের ছোট্ট ছেলেটি খিদের জ্বালায় ছটফট করছে। মাঝেমধ্যে কেঁপে কেঁপে জানান দিচ্ছে তার কষ্ট। দম্পতি পড়েছে মহাবিপদে। ভোরের কুয়াশায় ঢাকা এই শহরে খাবার যে পাওয়া যাবে না—স্বয়ং বিধাতাও জানে; তারা তো সামান্য সৃষ্টি মাত্র। সূর্যের আলো ফোটা পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। তাও যদি কিছু মিলে। কিন্তু সেই অবধি অপেক্ষার সময়টা বড্ড সংকীর্ণ। ক্ষুধার কষ্ট—ছোট্ট দেহের দুটো চোখে স্পষ্ট। ছেলেটির মুখের দিকে তাকাতে হাহাকার যেন বুক চিড়ে বেরিয়ে আসে বাবা-মায়ের। 
──
বেলা বারোটার কাঁটা ছুঁইছুঁই। মেঘলা আকাশ। রোদের ছিঁটেফোঁটার দেখা দূরদূরান্ত পর্যন্ত মিলে না। যদিও ভোরের কুয়াশারা বিদায় নিয়েছে বহু আগে। তাই বলে আলস্যরা ঘোমটা তুলে চোখ মেলে থাকাবে না—তা কী করে হবে? বাইরে চোখ দিতে দেখা যায়—শহরে অলিতেগলিতে সবার হাঁটাচলা। রিকশার থেমে থেমে বেজে ওঠা ট্রিং-ট্রিং, সিএনজির পিঁপ-পিঁপ, ট্রাক-বাসের বিরক্ত ধরা হর্ণে মুখরিত পুরো শহর। সবাই ব্যস্ত নিজ নিজ কাজে। সবকিছু ছাপিয়ে নির্দিষ্ট কিছু দোকানে ভিড় বাড়ছে ভীষণভাবে। আজ রাত বারোটায়; বিশেষ একটি দিনের সূচনা হবে। সেই খুশিতে খদ্দেররা ব্যস্ত আকাশ-রাঙানো-জাদু কিনতে। বয়স তাদের কারও গুরা; কারও আবার বুড়া। বাদ নেই শৌখিনরাও। উদ্‌যাপনের কোনো কমতি কেউ আজ রাখতে চায় না। 
হরেক রকম আকাশ-রাঙানো-জাদুর মেলা দোকানগুলোতে। নানান রঙের, নানান ঢঙের। তেলতেলে হাসি দিয়ে দোকানদারেরা সেগুলো বেচাকেনা করতে তুমুল ব্যস্ত। একজন খদ্দের গেলে আরেক জন এসে সেই স্থান দখল করে। ব্যগ ভর্তি আকাশ-রাঙানো-জাদু নিয়ে তারা বাড়ি ফিরে। সুন্দর একটি রাতের আকাশ রাঙাতে তাদের এত জল্পনা-কল্পনা ঈর্ষণীয় বটে। 
──
“কীভাবে সামাল দিব ও-কে? ছেলেটা তো এ-ভাবে কাঁদতে কাঁদতে মূর্ছা যাবে।” দুঃখী সুরের আকুতি ঝড়ে পড়ল জননীর কণ্ঠে। জনকের নির্লিপ্ততা তাকে আরও মুষড়ে দিচ্ছে ভেতর থেকে। চেয়েও পারছে না, সামান্য কিছু খাবার জোগাড় করতে। কত আকুতি, কত আহাজারি, কত চেষ্টা আর প্রচেষ্টায় ক্লান্ত দম্পতি। সকাল গড়িয়ে দুপুর হলো, শুধু জল খেয়ে কাটিয়ে দিলো। বিকেলে কোত্থেকে দু’মুঠো খাবার এনে দিলো বাবা। সন্তানের পেট কিছুটা পূর্ণ হলো। বাবা আবার বেরিয়ে পড়ল, রাতের অন্ন জোগাতে। ওই সামান্য খাবারে মাঝরাত শেষ না হতে ছোটু আবার কান্না করবে। এ-দিকে মা আগলে রাখে আদরের সন্তানকে। ছোটু—ভীতু প্রকৃতির। বেশি শব্দ সহ্য করতে পারে না সে। বাসার পাশে কোনো হালকা আওয়াজ হলে ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে থাকে। মিনমিনিয়ে মাকে ডাকে। মায়ের দায়িত্ব বাড়ে। হরেক রকম গল্প শুনিয়ে মা তার ভয় ভাঙে। এইভাবে চলছে ছোটুর দেখাশোনা। 
মধ্যরাত প্রায় হয়ে এলো। শহরের ছোটো-বড়ো অট্টালিকার ছাদে-কার্নিশে অবয়বের মেলা জমতে শুরু করেছে। তাকিয়ে আছে সবাই আকাশপানে। আর মাত্র কিছু ক্ষণের অপেক্ষা। ছাদে ছাদে নানান ভাষার গানের সুরে একে অপরের হাতে হাত রেখে চোখ চাওয়াচাওয়ি, অন্ধকার কোণে গায়ে পড়ে ডলাডলি। উদরপূর্তিতে পিছিয়ে নেই পেটুকরা। চেটে খেতে ব্যস্ত চাটুকাররা। নতুন বছরে সবাইকে শুভেচ্ছা। 
ঠুসঠাস করে কয়েকটা শব্দ ভেসে আসছে দূরের আকাশ থেকে। তার পরপরই ঝিলমিলে আলোর ঝলকানি। তারাদের মতো এক জায়গায় স্থির না থেকে হাওয়াতে মিলিয়ে যাচ্ছে সেগুলো। দেখতে সুন্দর। দূর থেকে বাতাসের ভেসে আসা শব্দের—তৎপরতা টের পাচ্ছে দম্পতি। গত বছরের ঠিক এই দিনে এমন কিছু ঘটেছে এই শহরে। প্রতি বছরই ঘটে। ছেলের কথা মনে পড়তে দেখে—ছোটু ঘুমিয়ে আছে পরম শান্তিতে। খাওয়ার চিন্তা কমতে না কমতে শব্দের চিন্তা নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়ল দম্পতি। আচমকা কোনো শব্দ শোনা মাত্র ছেলেটার বুক ধড়ফড় করে ওঠে। আকাশ-রাঙানো-জাদুর শব্দ যদি কোনোভাবে তার কানে প্রবেশ করে; তাহলে কী হবে? দুশ্চিন্তা ভর করে দম্পতির ঘাড়ে।
শব্দের মাত্রা বাড়ছে। প্রথমে গুড়গুড়, তারপর ফটফট। সময় যত যাচ্ছে শব্দের মাত্রা তত বিকট হচ্ছে। এমন শব্দ যেন কর্ণকুহর দিয়ে মৃত্যুর তলোয়ার শানিত করার আদেশ পৌঁছে দিচ্ছে। আকাশ-রাঙানো-জাদুর শব্দের সাথে সৃষ্টির সেরা জীবদের হইহুল্লোড় পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। পৃথিবীর অবলা জীবগুলো শঙ্কিত হচ্ছে অজানা কোনো অনিশ্চয়তার আগমনে।
──
ছোটুর কানে যেন শব্দ না ঢুকে সেই প্রয়াস অনেকক্ষণ যাবৎ করে যাচ্ছে দম্পতি। ক্ষুধায় সারাদিন চ্যাঁচানো ছোটু বাবা-মায়ের দিকে মিটিমিটি চোখে তাকিয়ে আছে। তার উৎসুক দৃষ্টিতে ভয় মিশ্রিত। দম্পতি নিজেদের মাঝে ছোটুকে যতটা পারে ডুবিয়ে রাখার পূর্ণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। চারদিকে তাকিয়ে ছোটু কী যেন খুঁজে চলছে। আজ যেন বিকট শব্দরা শহরটিকে ছারখার করে দেওয়ার পণ করেছে। বেশিক্ষণ আর এই খড়কুটায় তৈরি বাসায় থাকা যে যাবে না—বুঝতে পারে দম্পতি। দ্রুত এই বাসা ছেড়ে নিরাপদ কোথায় আশ্রয় না নিলে ছোটুকে বাঁচানো সম্ভব না। ইতোমধ্যে ছোটু কুঁইকুঁই করে কয়েকবার কষ্ট আর ভয়ের কথা পাচার করেছে বাবা-মায়ের কাছে।
বিলম্ব না করে বাবা ছোটুকে ঠোঁট দিয়ে আলতো চেপে গাছের ডাল থেকে উড়াল দিলো। পেছনে মা উড়ে আসছে। শহর থেকে যতটা দূরে নিজেদের সরিয়ে নেওয়া যায় এই ভেবে। কিছু দূর যাওয়ার পরে পরিত্যক্ত এক অন্ধকার দালান চোখে পড়ে দম্পতির। ওখানে আজ রাতে আশ্রয় নেওয়ার কথা ভেবে ঢুকে পড়ে। উষ্ণতার বড়োই অভাব এখানে। একেতো শীতের রাত তার ওপর খড়কুটা  দিয়ে তৈরি বাসাটা সাথে নিয়ে আসতে পারেনি তারা। শীতল কার্নিশে জড়োসড়ো হয়ে বসে থাকা ছাড়া উপায় নেই। ওদিকে আকাশ-রাঙানো-জাদুর শব্দে যেন সময়ের সাথে সাথে বেড়ে চলেছে। কোনোদিক থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় ছোটুর বাবা-মা’র জানা নেই।
──
ঠান্ডায় জুবুথুবু হয়ে বসে থাকা দম্পতি টের পায়নি, সেই পরিত্যক্ত দালানে একদল উৎসুক তরুণ-তরূণী চড়ুইভাতিতে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর গুরু দায়িত্ব খুবই নিষ্ঠার সাথে পালন করছে তারা। চড়ুই দম্পতি সাড়াশব্দ না পেয়ে ভেবে নিয়েছে এই দালান পরিত্যক্ত! তাদেরকে ভুল প্রমাণ করতে ক্ষণিক সময় পেরিয়ে যেতে উচ্চ-শব্দের-যন্ত্রে অজানা কোনো এক ভাষার সুর বেজে উঠতে—জীবন্ত হয়ে উঠেছে পুরো দালান-সহ এলাকার একাংশ। আচমকা এমন শব্দে হতচকিত হয়ে পড়ে দম্পতি। ছোটুর ঘুম পুরোপুরি ভেঙে ইতস্তত শুরু করে। যন্ত্রের শব্দ শুরু হতে না হতে ঠুসঠাস শব্দে আকাশ-রাঙানো-জাদুর রঙিন ভেলকি দেখানো শুরু করে।  
আলোকিত আকাশের নিচে দম্পতির মুখ আঁধার কালো। মাঝে হাঁটু ভেঙে জেগে থাকা ছোটুর কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। নিথর হয়ে আছে তার দেহ। দম্পতি একটু সরে যেতে ছোটুর দেহ ঢলে পড়ল একদিকে। চোখ দুটো খোলা, সেখানে স্পষ্ট ভয়ের প্রকাশ। দুনিয়া না দেখার আকুতি খেলা করছে নিথর ওই দু’চোখে। দম্পতিও অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শব্দ করতে যেন ভুলে গেছে তারা। তাদের কর্ণকুহরে কেউ যেন শব্দের বিষ ঢেলে দিয়েছে। সহ্যক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে সবকিছু। বেশিক্ষণ আর সহ্য করতে পারল না দম্পতি। তারাও ছোটুর পাশে ধীরে ধীরে ঢলে পড়ল। তিনটি নিথর দেহ পাশাপাশি ঘুমিয়ে আছে। যে ঘুম চিরদিনের। 
আকাশ-রাঙানো-জাদুর বিকট শব্দে না-কি ছোটুর শোকে এই পরিণতি; কখনোই জানা হলো না। উদ্‌যাপনে ব্যাস্ত সেই মানব সন্তানেরা টের পেল না—তাদের খুশি করার অস্ত্রে তিনটে খুনের ব্যথাটুকু।
[গল্পটির ধারণা আসে ইংরেজি নববর্ষের সময় ‘আতশবাজি’র শব্দে মারা যাওয়া পাখিদের খবর দেখে। সেই থেকে এই নিয়ে একটা ছোটো গল্প লিখব বলে ঠিক করে রাখি। আর এই হচ্ছে সেই অসংলগ্ন, অগোছালো গল্পটি। গল্প বলার চেয়ে জমে থাকা কিছু কথা উগড়ে দিতে চেয়েছি। না বলা অনেক কথা বলতে চেয়েছি। এই লেখাটি সেটা।]
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?