আকাশের ওপারে আকাশ : রাহাত খান | Akasher Opare Akash By Rahat Khan

Title : আকাশের ওপারে আকাশ

Author : রাহাত খান
Country : Bangladesh
Language : Bangla
Number of Pages : 128
ISBN : 9844124239

প্রেমটেম আমাদের জন্যে না। লোয়ার মিডল ক্লাস ফ্যামিলির মেয়ে। মন্দ-না গাছের একটা বিয়ে হলেও বেঁচে যাই

এই কথাগুলি ইংরেজিতে পাস করা, ওপর-পার্টিতে সামান্য দাঁত উঁচু, তবে বেশ ঝকঝকে স্বাস্থ্যের ইলাহীকে বলছিল সোসিওলজি মাস্টার্সের শেষ বর্ষের ছাত্রী আনজুমান আরা বর্ষা, সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের একটা বড়োসড়ো বাদাম গাছের নিচে বসে। দুপুর শেষ হয়ে বিকেলের সবে শুরু। গাছপালার ঘেরাও’র মধ্যে কাছেই ঝিকমিক করা একটা ছোট মজা পুকুর। বর্ষা ও ইলাহী সামনে বেশ খানিকটা ফাঁকা, মাঠমতো জায়গা নিয়ে বসেছিল যাতে শরৎ শুরু হওয়া আকাশের সাদা মেঘ ও নীল দেখা যায়।
ইলাহীর পুরো নাম আখতার ইলাহী। সে পরেছিল গলায় বোতাম আঁটা আড়ংয়ের লম্বা ঝোলা পাঞ্জাবি। ঘষটানো সাদা রঙটা ওকে মানিয়েছে বেশ। বর্ষা পরেছে জামরঙের টাঙ্গাইল শাড়ি। ওর হাইট এবং ফিগার দুই-ই ভালো । চারদিকে রোদ। এখানে-ওখানে গাছের ছায়া। পার্কের চৌকো বেষ্টনীর বাইরে গাড়িঘোড়ার শিস দিতে থাকা ঢাকা শহর। গাছপালার নিরিবিলিতে ওরা বসেছিল বেশ
অনেকটা সময় হাতে নিয়ে। মাস দুই আগে ওদের দেখা ও পরিচয়। অনেকগুলি ভদ্র
দেখা ও ক্যাম্পাসের এখানে-ওখানে দাঁড়িয়ে কথা বিনিময়ের পর আজই প্রথম পার্কের
নিরিবিলিতে একান্তে বসে ওদের বোঝাপড়া হচ্ছিল।
ইলাহীর পছন্দ হয়েছিল মেয়েটার হাইট এবং শরীর। তার বরাবরের পছন্দ মেয়েদের মধ্যে ঐ দুটি চুম্বক। যা এর আগে শারমিনের মধ্যে ছিল, রেহানার মধ্যে ছিল। ইলাহীকে বৃষ্টির পছন্দ হওয়ার একটাই কারণ । ছেলেটার চিতানো স্বাস্থ্যের মধ্যে একটা নম্র ভাব থাকা । দেখে প্রথমেই ভালো লেগে যায়। এছাড়া ওর মধ্যে গভীর কী যেন একটা আছে, ইলাহীর স্থির শান্ত চোখ দুটি সেটাই মাঝে-মাঝে বলে। বৃষ্টির সুন্দর ও গভীর করে কথা বলতে না পারা ছেলেদের তেমন ভালো লাগে না। সৌভাগ্যক্রমে ইলাহী সুন্দর করে কথা বলতে জানে ।
কয়েকটা দিন দেখেটেখে বন্ধু ও প্রেমিক হিসাবে বৃষ্টি শাকিলকে বাতিল করে দেয় ওর অর্ডিনারি এবং স্থূল কথাবার্তার কারণে, মনে মনে আহত ও বিরক্ত হয়ে। মেয়ে পুরুষের বন্ধুত্বের প্রথম দরজাটিই তো খোলে সুন্দর চোখ এবং সুন্দর কথা বৃষ্টির সেরকমই মনে হয়। অবশ্য ইলাহীর ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড যা শুনেছে তা একদমই পছন্দ না হওয়ার মতো। ইলাহীর বাবা জামালপুর শহরে ছোটখাটো চাকরি করেন। শহরে নিজেদের কোনো বাড়িঘর নেই, ছেলেমেয়ে মিলে সংসারটাও না-কি অনেক বড়। চাকরি শেষ হলে মাথা গোঁজার জন্য ভদ্রলোককে ফ্যামিলিসুদ্ধ ছুটতে হবে গ্রামের বাড়ি। এমন ব্যাকগ্রাউন্ডের ছেলের সাথে মেলামেশার কোনো ভবিষ্যত আছে? এ নিয়ে বৃষ্টি মনে মনে চিন্তিত। বাপ মফস্বল শহরের ছোট কেরানি, টিউশনি করে পড়ার খরচ চালায়, এমন ছেলের দিকে ঝুঁকে পড়াটা ঠিক হচ্ছে কি-না এ নিয়ে তার মনে বাস্তবিকই দ্বিধা-দ -দ্বন্দ্ব আছে।
ইলাহীর ব্যাকগ্রাউন্ড মোটেও আকর্ষণ করে না বৃষ্টিকে। বাঙালি মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ের কাছে ভালো একটা বিয়েই যখন প্রধান বিবেচনা- তখন এ ধরনের নিধিরাম ছেলেকে পছন্দ করার যুক্তিও নেই! সত্যি কথা, ইলাহীকে নিয়ে বৃষ্টি একটু দ্বিধা-দ্বন্দ্বে আছে।
তবে কি-না ইলাহী ভদ্র ছেলে। তার কথা বলাটা যেমন সংযত তেমনি সুন্দর। ছাত্র হিসাবে মোটামুটি মেধাবী। অনার্সে এবং এমএতে সেকেন্ড ক্লাস পেলেও ইন্টার এবং স্কুল ফাইন্যাল, দুটোতেই হাই ফার্স্ট ডিভিশন। তার বিসিএস কমপ্লিট করে অ্যাডমিন কিংবা ফরেন সার্ভিস পেয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা খুবই আছে। বৃষ্টির হিসাবের মধ্যে ইলাহীর এই প্লাস পয়েন্টটা আছে। ইলাহীর ভালো-মন্দ দুই দিকই ভেবে দেখছে সে ইদানীং। আজ মনে মনে খুব আগ্রহী হয়ে পার্কে এসেছে সে ইলাহীকে বুঝতে ।
ছাত্রী হল এবং ক্যাম্পাসের কাছে বলে বন্ধুদের সাথে এই পার্কে সে প্রায় প্রায়ই আসে। এসে গাছতলার নিচে বসে গল্প মারে বন্ধুদের সাথে। বাদাম কিংবা ঝালমুড়ি খায়। সময়টা চমৎকার কেটে যায়। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে অবশ্য কারো সাথেই তার পার্কে আসা হয়ে উঠেনি। শেষ এসেছিল বোধহয় মাস দেড়েক আগে শাকিলের সাথে। শাকিলের সাথে তার সম্পর্কের শুরু এই পার্কে, শেষও এখানেই।
শাকিল ইতিহাসের ছাত্র। প্রায় সমবয়সী, দু’চার মাসের বড় বড়জোর। সে বৃষ্টিকে খুবই চাইত বটে। তা শাকিল মুহম্মদ ভার্সিটির কোন মেয়েকেই বা না চায়! প্রায় প্রত্যেকটা সময়ই তো কোনো না কোনো মেয়ের গা ঘেঁসে ঘেঁসে সে থাকে। এরপরও ছেলেটাকে মন্দ লাগত না। নিজের গাড়ি থাকা, দামি রেস্টুরেন্টে বন্ধুদের খাওয়ানো, হৈচৈ আমুদে স্বভাব—সব মিলিয়ে ওর একটা আলাদা ক্যারিশমা আছে। মেয়েদের পেছনে প্রচুর খরচও করে সে। কিন্তু শাকিলকে নিয়ে মুশকিল হয় যখন তারা দুজন ছাড়া আশেপাশে কেউ থাকে না। তখন সে নির্বিবাদে চুম্বন চেয়ে বসে। হোটেলে গিয়ে একটা রুম নিলে কেমন হয়?—বৃষ্টিকে জিজ্ঞেস করেছিল একদিন। শাকিল বোধহয় বিশ্বাস করে পয়সা দিয়ে সব মেয়েকে পাওয়া সম্ভব।
বৃষ্টিকে সে খুবই চাইত বটে। এমনভাবে এবং এমন ভাষায় চাইত, যা রীতিমতো পীড়াদায়ক। বেশির ভাগ সময়ই অশালীন ও অশ্লীল তার মুখের ভাষা। হাব-ভাব । একদিন কথায় কথায় হিন্দি ছবির নায়িকা মাধুরী দীক্ষিতের রূপ বর্ণনা করতে গিয়ে শাকিল বলে——মাগির পাছাটা হেভি সুন্দর ।
শাকিলের বাবা একজন বিশাল শিল্পপতি। খুব নাকি শরিফ লোক। কিন্তু শাকিলের কথা এবং স্বভাবের সাথে এর কোনোই মেলে না। এই পার্কেই, কিছুদিন আগে শাকিলকে সে বলতে বাধ্য হয়—আমার সাথে আর দেখা করার চেষ্টা কইরেন না, প্লিজ সেই থেকে শাকিলের সাথে তার সম্পর্ক শেষ। ক্যাম্পাসে কখনো-কখনো বৃষ্টির সাথে দেখা হলে শাকিল মাথা নিচু করে থাকে।
বৃষ্টি-ইলাহী পাশাপাশি বসে আছে। দুপুর গিয়ে বিকেল শুরু হয়েছে সবে। ইলাহী ভাবছিল মেয়েটা তাহলে কী? প্রেমকে প্রেমটেম বলা, বিয়ে হলে বেঁচে যাই বলা— রোমান্স-বিরোধী কথাবার্তা নয়? মন দিয়ে ভাবছিল সে। বৃষ্টির চোখেমুখে কোনো বিষণ্নতার ছায়াপাত ছিল না। তার লম্বা, চাপা মুখে বরং একটা আলগা ঔজ্জ্বল্য ছিল । ইলাহী তখন ভাবে, একটু আউট-স্পোকেন টাইপের মেয়েরা ওরকম হেলাফেলা করেই কথা বলে। সে দেখেছে।
বৃষ্টি আবার বলে—প্রেমটেমের কথা ভাবি না, বুঝলেন! ওসব হলো গরিবের জন্য
ঘোড়া রোগ। আমাদের মতো লোকদের মানায় না। ইলাহী বলে—কী যে বলেন! আপনার এক ভাই ম্যাজিস্ট্রেট, আরেক ভাই
কানাডায়, আপনি তো বলতে গেলে সমাজের টপ ক্লাসের লোক…।
দুই ভাই-ই বিয়ে-শাদি করে একদম সেপারেট! ফ্যামেলির কথা ভাবেও না। নিজের নিজের ধান্দায় ব্যস্ত ।
নিজের নিজের ধান্দায় ব্যস্ত তো সবাই। কে ব্যস্ত না বলেন? এর মধ্যেও ভাই
বোনের জন্য করে, বন্ধু বন্ধুর জন্য করে। করে না? না করলে দুনিয়াজাহান চলত?
রাখেন আপনার দুনিয়াজাহান। লাখ লাখ ছেলেমেয়ে বেকার হয়ে আছে, ইউনিভার্সিটির হাইয়েস্ট ডিগ্রি নিয়া কেরানির চাকরিও জোটে না। আবার কন দুনিয়াজাহান ! ইলাহী একটু হেসে বলে – হ্যাঁ, বাস্তব এটাই। তবে এর মধ্যেও কারো কারো চাকরি হয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ ব্যবসা ধরে তরতর ওপরে উঠে যাচ্ছে। আর বিয়ের কথা বলছেন? আপনার মতো সুন্দর আর একোমপ্লিসড মেয়েকে বিয়ে করার জন্যে তো লাইন পড়ে যাওয়ার কথা ।
বৃষ্টি বলে—কচু! বিয়ের লাইন পড়া দূরে থাক, কেউ একটু আধটু প্রেম নিবেদন
করতেও আসে না ।
ইলাহী বলে—আপনার মুখে মিথ্যা কথাটাও খুব সুন্দর মানায় কিন্তু! মিথ্যা কথা? কখনো না। বৃষ্টি হেসে ফেলে।
এই রাউন্ডে কে জিতেছে, ইলাহী না বৃষ্টি? বলা কঠিন। বোধহয় ইলাহীই জিতেছে। বৃষ্টি মনে মনে ইলাহীর জয় অনুভব করে, যদিও তাতে কোনোরকম খারাপ লাগে না তার। বরং ইলাহীর পাঞ্জাবিতে ঘষটা খাওয়া কলোনের মিহি গন্ধটা তার বেশ লাগছিল। পরনের পাঞ্জাবিটা তো বটেই, ইলাহীর পায়ের লাল চকচকে ফিতাওয়ালা স্যান্ডেল জোড়াও বেশ দামি বলে মনে হচ্ছিল বৃষ্টির। সব মিলিয়ে ইলাহীর জয়ই মেনে নিচ্ছিল সে মনে মনে ।
ইলাহী ভাবছিল মেয়েটা বেশ ম্যাচিউরড আছে। কথা বলতে জানে, ফটাফট উত্তর দেয়, জড়তা-ফড়তা কিছু নেই। শারমিন কিছুটা এই ধরনের ছিল। এই ধরনের মেয়ে সহজে বাগে আসতে চায় না। তবে একবার এসে গেলে প্রেমিককে ম্যালা দেয়টেয়। দিতে কৃপণতা করে না। ইলাহীর চোখ দুটি তৃষ্ণা ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। সে তাকায় লিপস্টিক না-ছোয়ানো বৃষ্টির সামান্য মোটা ও কিছুটা কালচে ঠোঁটের দিকে। সে জামালপুরের ছেলে। তার যাচ্ছি খাচ্ছি করে কথা বলতে একটু ঝামেলা হচ্ছিল। ভয়ে থাকছিল কখন ‘ও’কে ‘উ’ করে ফেলে। এর আগে একবার শারমিনের কাছে তার ভালোবাসা বালোবাসা হয়ে গিয়েছিল। এসবই ঝামেলা। যাহোক, সে মোটামুটি অভিজ্ঞ প্রেমিক, বুঝতে পারছিল, সহজে কিছু পাওয়া যাবে না। বৃষ্টি অনেক সময় নেবে।
দুপুর গিয়ে চারদিকে একটা শান্ত, সুন্দর, তাপ ঝরে যাওয়া, বাতাস ঝিরঝির করা বিকেল ফুটে উঠেছে। তারা বাদাম গাছের নিচ থেকে ওঠে পড়ে। গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে ঘুরতে থাকে। বৃষ্টি কুমিল্লা-দাউদকান্দির মেয়ে। একটা কথার কিউ পেয়ে গিয়ে সে গ্রামে তার বাবা-মা’র কথা বলতে থাকে। সে চাচ্ছিল ইলাহীও বলুক ইলাহী নিরাশ করছিল না, ফাঁকে ফাঁকে সেও বৃষ্টির কাছে বলে যাচ্ছিল তার ও তার পরিবারের খবরাখবর। তেমন কিছু লুকোবার চেষ্টা করছিল না সে। এক রকমের অব্যক্ত অস্পষ্টতা ছিল যদিও। সে বলে যে গ্রামের হিসাবে তারা মোটামুটি স্বচ্ছল পরিবার, বংশ, ক্ষেত জমি, পুকুর, বাগান সবই আছে। তবে শহরের হিসাবে তারা যে দরিদ্র, এমনকি উদ্বাস্তু, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এই যেমন, ঢাকা তো দূরের কথা, জামালপুর শহরেও কোনো বাড়িঘর নেই তাদের। একটা ছোট ভাড়া বাড়িতে থাকেন তার বাবা, মা পাঁচটা ভাইবোনের বড় সংসার নিয়ে। ইলাহী বড় ছেলে, তার দিকে সবাই তাকিয়ে আছে।
নিজের নিজের এবং পরিবারের কথা বলে দুজনই তারা এক রকমের স্বস্তি ও সুখ পাচ্ছিল। ঘর-বাড়ি, পরিবার এবং নিজের একান্ত কথার মধ্যে কিছু গৌরব ও গর্ব যেমন থাকে, তেমন থাকে দীনতাহীনতাও। মানুষ সেসবের কিছু বলে, কিছু বলে না। জীবন এইরকমের হয়। এসব ইতি-নেতি’র কথা এক সময় না এক সময় বন্ধু বা শত্রুকে কিছু কিছু বলতেই হয়। বৃষ্টি ও ইলাহী এই জরুরি কাজটা সেরে নিচ্ছিল গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে ঘুরে বেড়াবার সময়।
বৃষ্টি একবার কথাবার্তার ফাঁকে আচমকা বলে—আমার কিন্তু আগে একটা ঘটনা
ছিল … ।
অ্যাফেয়ার?
না, ঠিক অ্যাফেয়ার না। এমনি এক সাথে বেড়াতাম টেড়াতাম। বলতে পারেন একটু ডিপ ফ্রেন্ডশিপ… |
এখনো আছে?
না।
সম্পর্ক ছিন্ন করেছে কে, আপনি, না আপনার বন্ধু? না, আমি। কারণ ছিল…।
শাকিলের কথাটাই বৃষ্টি এভাবে আভাস দিয়ে বলে রাখে ইলাহীকে, পরে যেন এটা টাইম বোমা হয়ে না ফাটে। এর বেশি কিছু তার বলারও ছিল না।
ইলাহী হাসতে থাকে। বৃষ্টি বলে, হাসছেন যে? বাহ, হাসা কি নিষেধ? নিষেধ না। কিন্তু হাসার একটা কারণ তো থাকা উচিত ।
ইলাহী বলে, হাসছি আপনার কাণ্ড দেখে।
বাহ্, আমি ক করলাম?
একটা সামান্য ফ্রেন্ডশিপকে আপনি বলছেন ঘটনা! আপনার স্ট্যান্ডার্ডে আমি তো তাহলে রীতিমতো নষ্ট ছেলে। বহুত ঘটনা ঘটাইছেন?
কম কী! একবার তের বছর বয়সে। সেকেন্ড টাইম কয়েক মাস আগে।
ইউনিভার্সিটিতেই।
শারমিনের ঘটনাটা বৃষ্টিও জানে। তার ও ইলাহীর সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার কথাটা সে শুনেছিল ডিপার্টমেন্টের জুনিয়র টিচার লতা ম্যাডামের কাছে। লতা ম্যাডামের হাজব্যান্ড ইলাহীর কীরকম যেন ভাই হয়। সেজন্যে কি-না, সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার দোষটা শারমিনের ওপর চাপাচ্ছিল লতা ম্যাডাম ।
বৃষ্টি বলে, খুব ডিপ সম্পর্ক ছিল বোধহয় । আমার দিক থেকে ছিল
বিশ্বাস করি না! তারপর?
বিশ্বাস করেন না?
না। ছেলেরা ভালোবাসতে জানে না। বড়জোর ভালোবাসার ভান করে। কিন্তু এই নিয়ে কোনো তর্কে যেতে চাই না, প্লিজ! আপনি বরং ছ্যাকটা কে দিছে, আপনি না শারমিন, সেইটা বলেন।
বৃষ্টির কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে ইলাহী। যেন খুব দুঃখ পেয়েছে। তার নম্র, ভদ্র মুখাবয়বে দুঃখ ও বিষণ্নতার ছাপটা বেশ ভালোই ফুটেছিল। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ত্যাগ করে সে। বলে, আটানব্বই সালে আমাদের বিয়ে করার কথা ছিল। এর মধ্যে হঠাৎ একদিন খবর পাই শারমিনের বিয়ে হয়ে গেছে, স্বামীসহ হানিমুন কাটাতে গেছে বালি দ্বীপে। ওর হাজব্যান্ড আমেরিকায় থাকে, গ্রীনকার্ড পাওয়া, দেখতেও না-কি টল এবং হ্যান্ডসাম।
ঠিক কাজটাই তাহলে করেছিল শারমিন। ইলাহীর গল্প শুনে ভাবে বৃষ্টি তার রীতিমতো ঈর্ষা হচ্ছিল শারমিনের হঠাৎ আমেরিকার গ্রীনকার্ড পাওয়া ছেলের সাথে বিয়ে হয়ে যাওয়াতে। তার আর রাগ থাকে না ইলাহীর প্রতি। বরং একটুখানি মায়া হয় তার উপর।
বৃষ্টি হাসতে হাসতে বলে, ছ্যাঁকটা তাহলে শারমিনই দিয়েছিল। আপনি খুশি হয়েছেন?
হ্যাঁ। মেয়েরা জিতে গেলে আমার খুব ভালো লাগে । বেশ। তাহলে আপনি জেনে খুশি হোন যে, দুই দুইবারের ঘটনায়ই ছ্যাঁক ছোঁক যা খাওয়ার, আমি খেয়েছি।
বৃষ্টি হাসছিল ইলাহীর বলার ধরন দেখে। মনে মনে এও ভাবছিল, ধান্দাবাজ না হয়ে যায় না ছেলেটা। ধান্দাবাজ আর চালু ছেলেরাই মেয়েদের কাছে এরকম ভাবসাব করে যেন কত ত্যাগী পুরুষ। আর মহান। আসলে কচু। আসলে বাংলাদেশের বেশির ভাগ মেয়ে চায় একটা ভালো বিয়ে আর ছেলেরা চায় চাকরি। রুজি রোজগার। ব্যস, এই হলো গূঢ় কথা ইলাহীর দিকে চেয়ে বৃষ্টির কোনো রাগ বা করুণা হচ্ছিল না । শারমিনের সাথে সম্পর্ক করতে পারায় ইলাহীকে বরং তার বেশ যোগ্য বলে মনে হচ্ছিল।
পার্কে লোক সমাগম বাড়ছে। কেউ হাঁটার পোশাকে। কেউ বা বন্ধুবান্ধব কিংবা
পরিবার নিয়ে ঘুরছে ফিরছে। আশেপাশে ঘোরাফেরা করতে থাকা লোকজনের মধ্যে বৃষ্টি ও ইলাহীর চেনা কয়েকটা জোড়াও ছিল। তারা ইলাহী ও বৃষ্টিকে পাশাপাশি হাঁটতে দেখে উইশ করে। বৃষ্টি বুঝতে পারছিল ইলাহীর সাথে আজ বিকেলে সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে তার ঘুরে বেড়ানোটা ক’দিনের মধ্যেই ক্যাম্পাসে এবং বিশেষ করে ছাত্রী হলে চাউর হয়ে যাবে। শাকিলের সাথে তার মেলামেশাটা চারদিকে যেমন রাষ্ট্র হয়ে গিয়েছিল।
শাকিল বড় অদ্ভুত ছেলে। সবকিছুতে সে বাড়াবাড়ি করে ফেলে। তাদের ধানমণ্ডির বাসাটা খুবই সুন্দর ও সাজানো গোছানো। ভাইবোনগুলি যেমন ভদ্র তেমন মিশুক শাকিলের বাপ তো বাংলাদেশের বিজনেস লাইনে শীর্ষ লোক খুব ডিগনিফাইড এবং শরিফ। শাকিলের নিজেরও যথেষ্ট আকর্ষণ রয়েছে। দীর্ঘ, সুঠাম শরীর তার। ঝকঝকে ঢাউস একটা গাড়ি চালিয়ে হিন্দি ছবির বেপরোয়া হিরোর ভঙ্গিতে রোজ ইউনিভার্সিটি যায়। ইংরেজি বলে চোস্ত আর কী সুন্দর স্মার্ট! বন্ধুদের জন্য প্রচুর খরচ করতে পারা শাকিলের বাস্তবিকই আকর্ষণ করার বহুকিছু আছে। কিন্তু তার বাড়াবাড়ির জন্য সবকিছু মাটি হয়ে যায়। বাসায় কোনো বান্ধবী গেলে শাকিলের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া খুব কঠিন। গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে চূড়ান্ত করতে চায় সে। প্রত্যেকটাবার বৃষ্টি অনেক কষ্টে ওর চূড়ান্ত করা থেকে নিজেকে বাঁচিয়েছে। পরে তো শাকিলের বাসায়ই যেত না সে। শাকিল ওর কাছে লক্ষ কোটিবার মাফ চেয়েছে, ‘আর করব না’ বলেছে এবং বিয়ের প্রমিজ করেছে। প্রত্যেকটা মেয়েকেই না-কি সে এরকম করত। আবার জনে জনে বন্ধুদের বলত অমুক মেয়েকে আমি কিস করেছি, অমুক মেয়ের শরীর ছুঁয়েছি। হারামির একশেষ যাকে বলে! এরকম বলে বলেই বৃষ্টির সাথে তার ব্যাপারটা সে সারা ক্যাম্পাসে রাষ্ট্র করে দিয়েছিল। পরে বৃষ্টি ডিসিশন নেয়। শাকিলের সাথে তার সব চুকেবুকে গেছে ৷ শাকিলের বান্ধবীর অভাব নেই, সে মনে হয় নির্বিবাদেই মেনে নিয়েছে সেটা 1
বৃষ্টি জানে ইলাহীর সাথে ডেটিং করাটা ক্যাম্পাসে ক্রমে ক্রমে রাষ্ট্র হয়ে যাবে । তা যাক বৃষ্টি তাতে পরোয়া করে না। সে চাইছে ইলাহী ছেলেটা কতটা পছন্দ করার মতো, তার ভবিষ্যৎ কীরকম—এইসব আগডুম বাগড়ম জানতে। বছরখানেকের মধ্যে তার মাস্টার্স পাস দেওয়া হয়ে যাবে। বয়স হবে চব্বিশ ছাড়িয়ে পঁচিশের কাছাকাছি। সে আসলেই মনের মতো কাউকে খুঁজছে। যাকে বিশ্বাস করা যায়। সময়টা কাটানো যায় ভালো। আর বিয়ে করার মতো হলে তো কথাই নেই।
ঘোরাফেরা করছিল ওরা পাশাপাশি। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ ইলাহী বৃষ্টির হাত চেয়ে বসে। ইংরেজিতে বলে, আমি কি তোমার হাত ধরতে পারি? হাত ধরা মানে তো বাংলায় পাণিগ্রহণও হয়! বৃষ্টি হাসতে হাসতে ইলাহীর হাতে ওর হাতটা দেয়। ইলাহীর হাত একটু থ্যাবড়া, আঙুল ও গিঁটের ওপর গোছা গোছা চুল। বেশ মাংসল ও উষ্ণ তার হাত। তার হাতকে সুন্দর বলা যায় না। বৃষ্টির হাত-পা দুইই খুব সুন্দর। শাকিলের হাতও বেশ সুন্দর ছিল। কিন্তু সবাই তো একরকম হয় না। সেরকম আশা করাও উচিত না। তাছাড়া সুন্দর হাত-পা পছন্দের কোনো ক্রাইটেরিয়া নয়।
বৃষ্টি ও ইলাহী হাত ধরাধরি করে সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে সারা বিকেল হাঁটে। ইলাহীর ইচ্ছে ছিল বৃষ্টিকে সন্ধ্যার দিকে মহিলা সমিতির সামনের রাস্তায় তার বন্ধুদের কাছে নিয়ে যায়। নিয়ে গিয়ে উপস্থিত করে।
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?