অবরোধ-বাসিনী
বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন
বেগম রোকেয়ার নাম জানে না এমন বাঙালি পাওয়া ভার। আলোচনা-সমালোচনা, তর্ক-বিতর্ক ইত্যাদি তাঁকে নিয়ে লেগেই থাকে। ফেরেশতা থেকে শয়তান – এই দুই মেরুর দুই বিশেষণ-ই তাঁকে দেওয়া হয়। তবে তিনিই যে প্রথম বাঙালি মুসলিম নারীদের শিক্ষার সুযোগ করে দিয়েছেন তাতে কারও দ্বিমত থাকার কথা না। শিক্ষিত ও সচেতন একজন মানুষ হিসেবে তিনি তৎকালীন সমাজকে দেখেছেন গভীরভাবে, নানা বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, সংস্কারের দাবি জানিয়েছেন । এই বইটাও তেমনি এক সংস্কারের দাবি নিয়ে লেখা ; এবাবের বিষয় নারীদের অবরুদ্ধ করে রাখার প্রতিবাদ।
মূলত উচ্চবিত্ত মুসলিম সমাজে পর্দাপ্রথার স্বরূপ নিয়ে বইটা লিখেছেন তিনি। পর্দার নামে যেভাবে নারীদের দুনিয়ার সমস্ত পুরুষ থেকে এমনকি নিকটাত্মীয় বাদে অন্যান্য নারীদের থেকেও পৃথক করে রাখা হতো সেদিকটাই তুলে ধরেছেন তিনি। সাথে দু-একটা ঘটনা বলার মাধ্যমে এটাও দেখিয়েছেন যে তখন সময়টাই ছিল অবরোধের ; কেননা হিন্দু নারীরাও প্রায় একই ধরনের পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতেন। ভূমিকাতে যেমনটা বলেছেন লেখিকা, ঘটনাগুলোর বেশিরভাগই হাসির উদ্রেগ করে কিন্তু সাথে সাথে একটা সমবেদনা আর সহানুভূতিও খেলা করে মনে।
চোরের সাথে কথা বলতে হবে দেখে গায়ের অলঙ্কার খুলে দেওয়া, পরপুরুষ গলার স্বর শুনে ফেলবে ভেবে আগুনে পুড়ে মরা, পরপুরুষ গায়ে হাত দেবে আশঙ্কায় ট্রেনে কাঁটা পড়ার মতো ঘটনা যেমন উল্লেখ করেছেন লেখিকা তেমনি অবরুদ্ধ থাকায় নারীদের দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা, নিজেদের নাম হারিয়ে ফেলা, বাস্তবজ্ঞানহীনতার কথাও বলেছেন। বিশ্বাস করা শক্ত হলেও বেশিরভাগ ঘটনাই লেখিকার নিজে দেখা ; সাথে কিছু শোনা এবং বইয়ে পড়া ঘটনাও রয়েছে।
বইটা একটা কালের দলিল। একশ বছর আগেও বাংলার পরিস্থিতি কেমন ছিল সেটা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছে বইটা। বর্তমানের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অবাস্তব মনে হতে পারে অনেক ঘটনা-ই কিন্তু সব ঘটনাই সত্য। পর্দাপ্রথার ভারে ক্লান্ত এক নারী সখেদে অথচ হাস্যরসাত্মকভাবে বর্ণনা করেছেন সেই সময়টাকে। অবরোধের মাত্রাটা কতটা ভারী ছিল সেটা স্পষ্ট হয় লেখিকার লাইন দুটো থেকেই :
‘কেন আসিলাম হায়! এ পোড়া সংসারে, কেন জন্ম লভিলাম পর্দানশীন ঘরে!’