কথায় আছে, ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। সেই জন্যই হয়তো তিন গোয়েন্দা যেখানেই যায়, রহস্য তাদের তাড়া করে বেড়ায়। কিশোর পাশাকে রহস্য খুঁজে বের করতে হয় না। রহস্য-ই গোয়েন্দা প্রধানকে খুঁজে নেয়। ছুটির দিনগুলোতে, নিশ্চিতভাবে সময় কাটানোর মুহূর্তে, কিংবা কোনো মানবিক কাজের ব্যস্ত সময়ও তাই কিশোরকে তার মস্তিষ্কের বেয়ারিংগুলো সচল রাখতে হয়। কখন, কোথা থেকে লুকোচুরি খেলতে খেলতে রহস্য হাজির হয়ে যাবে, কে জানে!
বাংলাদেশের ছেলে কিশোর পাশা আমেরিকায় চাচা চাচীর কাছে মানুষ। পাশ্চাত্য সংস্কৃতির ছোঁয়া পেলেও কখনোই নিজের বাঙালিয়ানা বিসর্জন দেয়নি কিশোর। বরং মনে-প্রাণে বাঙালি সত্তা ধারণ করে সে। আর তাই তো খবরে বাংলার উপকূল দিয়ে বয়ে চলা ঘূর্ণিঝড়ের সংবাদে সে শঙ্কিত হয়। ভয়াবহ এ ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণ গেছে অসংখ্য মানুষের। তাদের সাহায্যের প্রয়োজন। সেই সাহায্য করতেই বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখে কিশোর। সঙ্গে দুই বন্ধু মুসা ও রবিন। কক্সবাজারে খালার বাসায় উঠে ওরা। আয়না খালাও সমাজসেবী মানুষ। বিপদে পড়া মানুষদের সাহায্যে বারবার এগিয়ে যায় সে।
ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্থ মানুষদের সাহায্য করতে কক্সবাজারের নতুন ক্যান্সার হাসপাতালে ভলেন্টিয়ার হওয়ার সুযোগ পায় কিশোর। ভেবেছিল সুযোগ মিলবে মানুষকে সাহায্য করার। কিন্তু কীসের কি! সেখানে গাধার মতো খাটতে হয়। যা ইচ্ছে তাই করায়। যেন কিশোর কোনো ভলেন্টিয়ার নয়, হাসপাতালের ওয়ার্ড বয়! অন্যদিকে রেড ক্রসের সাহায্যকারী রবিন। আর মুসা ছুটছে আয়না খালার সাথে। উপকূলের ক্ষতিগ্রস্থ মানুষদের ত্রাণ বিতরণের জন্য।
আগেই বলেছি, “ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে”। হাসপাতালে কাজ করতে করতে রহস্যের গন্ধ নাকে এসে লাগে কিশোরের। কী সেই রহস্য? দীপু নামের ছেলেটার কী অসুখ হয়েছে? এভাবে কাঁদে কেন বারবার। সবসময় তটস্থ হয়ে থাকে। এর পিছনে গভীর এক রহস্য আছে। কিশোর ভাবছে কিছু একটা করা দরকার। বাচ্চা ছেলেটার স্বাস্থ্যবতী মা-কে ঠিক সুবিধার মনে হচ্ছে না। এর সাথে জড়িয়ে গেছে সাফিয়া নামের নার্সটি।
কিশোর শুরু করল তদন্ত। তদন্ত করতে গিয়ে মিলল নার্স সাফিয়ার লাশ। আবার পরক্ষনেই লাশ উধাও। তবে কি ভুল দেখল কিশোর? তা কী করে হয়? তীক্ষ্ণ দৃষ্টিসম্পন্ন কিশোরের যে ভুল হতেই পারে না। তবে? সাপের গর্তে হাত দিয়েছে কিশোর। হিসহিস করে ওঠা সাপ যেকোনো মুহূর্তে ছোবল মারতে পরে। বিপদে পড়েছে সে। সেইসাথে বিপদে ফেলেছে আয়না খালাকে। কীভাবে বাঁচবে সে? কীভাবে বাঁচাবে আয়না খালাকে? ঘোর অমনিশার মতো আঁধার ধেয়ে আসছে। তাতে গ্রাস হতে হবে। নয়তো আঁধার পেরিয়ে আলোর দিকে ধাবিত হতে হবে। তবেই খুলবে রহস্যের জট।
▪️পাঠ প্রতিক্রিয়া :
তিন গোয়েন্দার “অপারেশন কক্সবাজার” কিশোর, রবিন ও মুসার প্রথম বাংলাদেশ অভিযান। আমি যখন বইটি প্রথম পড়েছিলাম, তখন স্কুলের ছাত্র ছিলাম। এত বছর পর আবার যখন বইটি পড়ি, তখন অনুভব করি আমার অনুভূতিতে এখন আকাশ পাতাল পার্থক্য। সেবার বইটি ভালো লাগলেও, এই সময় এসে ঠিক মনঃপুত হলো না। কেমন যেন খালিখালি লেগেছে। বলা চলে, তিন গোয়েন্দার অন্যান্য বইয়ের তুলনায় বেশ সাদামাটা “অপারেশন কক্সবাজার”।
লেখক রকিব হাসানের হাতে সুযোগ ছিল, কক্সবাজারের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তার অসাধারণ লেখনীর মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলার। তিনি সেই চেষ্টা করেননি দেখে মর্মাহত হয়েছি। তিনি শুধু গল্প বলার দিকেই মনোযোগ দিয়েছেন। লেখকের লেখনীতে মুগ্ধতা আছে, তা নতুন করে বলার কিছু নেই। একটা সাধারণ মানের রহস্যকে তিনি লেখার মাধম্যে অসাধারণ বানিয়ে তুলতে পারেন। “অপারেশন কক্সবাজার” তেমনই সাধারণ মানের রহস্যে ঘেরা।
হাসপাতালের আড়ালে অনেক অনৈতিক কাজ চলতে পারে, যা নিয়ে অসংখ্য গল্প, নাটক রয়েছে। তাই লেখকের হাতে চ্যালেঞ্জ ছিল গল্পটিকে আকর্ষণীয় করার। সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে বলেই মনে হয়েছে। প্রেডিক্টেবল এক গল্প। সেই সাথে কাহিনির মোড় অনুমান করা খুবই সহজসাধ্য ব্যাপার। ছোটোবেলায় যখন বইটি পড়েছিলাম তখন এতকিছু বুঝতাম না বলেই হয়তো ভালো লেগেছিল।
সবচেয়ে বড়ো বিষয়, “অপারেশন কক্সবাজার” বইটিতে থ্রিল অনুভূত হয়নি। তিন গোয়েন্দার অন্যান্য বইয়ে যেভাবে রহস্যে ডুব দিতে পারি, তার কিছুই এই বইয়ে পাইনি। সবচেয়ে বেশি হতাশ লেগেছে লেখক সচেতনভাবে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বর্ণনা এড়িয়ে গিয়েছেন। অথচ এই বর্ণনাই লেখকের শক্তি। এছাড়া শেষটা নিয়েও আমার অভিযোগ আছে। আরও বেটার হতে পারত। হুট করেই যেন রহস্যের পরিণতিতে পৌঁছে গিয়েছেন লেখক।
▪️চরিত্রায়ন :
তিন গোয়েন্দা সিরিজের “অপারেশন কক্সবাজার” বইটিতে প্রধান চরিত্রে ছিল কিশোর। তিন গোয়েন্দার অন্য দুই সদস্য রবিন ও মুসার এখানে কোনো ভূমিকাই ছিল না। যা আমার কাছে হতাশাজনক ছিল। মুসা অসুস্থ হয়ে বিছানায়, আর রবিন যেন কাঠ পুতুল। কিছুই করার নেই। সবকিছু একাই করছে কিশোর। অন্যদের ভূমিকাহীন অভিব্যক্তি ভালো লাগেনি।
এছাড়া অন্যান্য চরিত্রগুলোও ঠিক মনে দাগ কাটতে ব্যর্থ। সে ভিলেন হোক বা অন্য কেউ। দীপু, আয়না খালা, নার্স সাফিয়া, অরুণ মোটামুটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হলেও আরও ভালোভাবে ফুটিয়ে তোলা যেত বলে মনে হয়েছে।
▪️বানান ও সম্পাদনা :
সেবা প্রকাশনীর এ বিষয়ে অভিযোগ করার জায়গা নেই। নির্ভুল বানান, দারুণ সম্পাদনা; পাঠককে অভিযোগ করতে না দেওয়ার সবরকম চেষ্টা তাদের। তাদের নিউজপ্রিন্টের পেপারব্যাক বই বিছানার পাশে নিয়ে শুয়ে থাকলেও শান্তি লাগে। ছোটো বই। যেখানে খুশি নিয়ে যাওয়া যায়।
পরিশেষে, তিন গোয়েন্দা সিরিজের অন্যান্য বইয়ের তুলনায় বেশ দুর্বল “অপারেশন কক্সবাজার” বইটি। তারপরও তিন গোয়েন্দার বাংলাদেশে প্রথম অভিযান একটু বেশি আবেগের জায়গা দখল করে রাখে। এছাড়া ছোটোবেলার ভালোবাসা তিন গোয়েন্দার আরও দারুণ দারুণ বই গভীর আবেশে জড়িয়ে রাখে।
▪️বই : অপারেশন কক্সবাজার
▪️লেখক : রকিব হাসান
▪️প্রকাশনী : সেবা প্রকাশনী
▪️ব্যক্তিগত রেটিং : ৩/৫