বইয়ের নামঃ কক্সবাজারে কবি সাহেব
লেখকঃ মুহাম্মাদ ইব্রাহীম
ধরনঃ গোয়েন্দা উপন্যাস
প্রচ্ছদঃ মৌমিতা কর
প্রকাশনীঃ শব্দভূমি প্রকাশনা
প্রকাশকালঃ একুশে বইমেলা ২০১৯
পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ৯৬ টি
মুদ্রিত মূল্যঃ ২২০ টাকা
★ব্যাক্তিগত রেটিংঃ ৯/১০
✍️Keya Sami (review all credit)
“এই যুগের সবচেয়ে বড় আফসোসের বাক্যটি হলো, ” আমরা বই পড়া ভুলে গেছি”।-মুহাম্মাদ ইব্রাহীম (কক্সবাজারে কবি সাহেব।
★শুরুর কথাঃ
‘কক্সবাজারে কবি সাহেব’ একজন লেখকের লেখক থেকে গোয়েন্দা হওয়ার গল্প। এক রাতে হঠাৎ করেই ‘হোটেল সী প্রাইম’ এ খুন হয়ে যায় একটি মেয়ে,পরেরদিন সকালে আরেকটি ছেলের লাশ পাওয়া যায় হোটেলের পাশেই। গল্প লেখতে আসা একজন লেখক বড়ই বিচলিত হয়ে পড়েন এতে। কিন্তু কেন? কবি সাহেবের সাথে তাদের কিসের সম্পর্ক? দুটো খুনের উদ্দেশ্য কি একই ছিলো?
পাঠকরা নিশ্চয়ই এতক্ষণে রহস্যের গন্ধ পেয়ে গেছেন। হ্যাঁ, বইটির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত রয়েছে শুধু রহস্য আর রহস্য।
★লেখক পরিচিতিঃ
লেখক মুহাম্মাদ ইব্রাহীম (জন্মঃ ৯ই নভেম্বর,১৯৯২) শরীয়তপুরে জন্মগ্রহণ করেন। শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে বড় হলেও হয়ে গেলেন লেখক। ঘুরতে পছন্দ করা এই প্রকৃতি প্রেমিকের প্রথম গোয়েন্দা উপন্যাস ‘কক্সবাজারে কবি সাহেব’। এছাড়াও তার এলিমানুষ,দিঘির জলে চাঁদের ছায়াসহ আরো কয়েকটা বই প্রকাশিত হয়েছে।
★লেখকের কথাঃ
আমার মতে পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ হচ্ছে গোয়েন্দা গল্প লেখা। তবুও পাঠকদের আনন্দ দেয়ার জন্য লেখকরা এই কঠিন কর্মটি করে আসছে। আমিও পাঠকদের আনন্দ দিতে চাই। তাই কষ্ট হলেও লিখে ফেললাম আমার প্রথম গোয়েন্দা উপন্যাস।
কোনো অভিজ্ঞতা ছাড়াই গোয়েন্দা গল্প লিখছি। পাঠকদের কাছে আমার একটাই অনুরোধ থাকবে, জীবনের সব ক’টি অভ্যাস ছেড়ে দিলেও বই পড়ার অভ্যাসটি ছাড়বেন না। বই আপনার জীবনকে সুন্দর করবে।
পৃথিবী বইয়ের হোক, বইয়ে বইয়ে ভরে যাক প্রতিটি ঘর।
★প্রচ্ছদঃ
বইটির প্রচ্ছদটি অতি সাধারণ। তবে প্রচ্ছদ শিল্পী এই সাধারণ প্রচ্ছদটি সহজ-সরলভাবে অসাধারণ করে তুলেছেন। একটা বন্দুক, কয়েক ফোঁটা রক্ত,খুব স্বাভাবিকভাবেই ইঙ্গিত করছে ভেতরে পাঠকদের জন্য রহস্যেভরা একটি গল্প অপেক্ষা করছে। প্রচ্ছদ শিল্পী সত্যিই প্রশংসার দাবীদার।
★পাঠ সংক্ষেপঃ
পৃথিবীর সকল গোয়েন্দা চরিত্রকে উৎসর্গ করে লেখা এই বইটির মূল কাহিনী ‘হোটেল সী প্রাইম’ এ ঘটে যাওয়া হত্যাকান্ডকে নিয়ে।
দেশের স্বনামধন্য লেখক ‘কবি সাহেব’ তার রাইটার্স ব্লক কাটাতে ডাক্তার বন্ধু তামিমকে নিয়ে বেড়াতে আসেন কক্সবাজারে। বাসে একটা মেয়ের ওপর কবি সাহেবের বড্ড রাগ ওঠে। মেয়েটা গভীর রাতে হুট করেই বান্ধবীদের সাথে উচ্চঃস্বরে হেসে উঠে কবি সাহেবের মেজাজ বিগড়ে দেয়। ঘটনাক্রমে কবি সাহেবরা এবং মেয়েটা ও তার বন্ধু-বান্ধবসহ একই হোটেলে ওঠে। হোটেল সী প্রাইমে। কক্সবাজারে পৌঁছে কবি সাহেব জানতে পারেন মেয়েটার নাম রিতা। আশ্চর্যজনকভাবে,পরেরদিন রাতে নিজের হোটেল রুমেই খুন হয়ে যায় মেয়েটা। ব্যাপারটা কবি সাহেবকে ভাবিয়ে তোলে। তিনি সিদ্ধান্ত নেন, এর একটা কূল-কিনারা করেই ছাড়বেন তিনি। এবার তিনি লেখক থেকে হয়ে উঠবেন গোয়েন্দা। আর তাই নেমে পড়েন তদন্তে। তার বন্ধু তামিম প্রথমে দ্বিমত করলেও কবি সাহেবের পাগলামির কাছে হার মেনে রাজি হয়ে যায়। তদন্তে নামার সাথে সাথেই আরেকটা খুন! এবার খুন হলো রিতার প্রেমিক সানি। কবি সাহেব দ্বিধায় পড়ে যান। দুটো খুন কি একই উদ্দেশ্যে করা? একই ব্যক্তির কাজ? নাকি অন্য কোনো ব্যাপার আছে এখানে?
জটের পর জট লাগতেই পারে। একটা জট খুললেই আরেকটা জট সামনে এসে যায়। কবি সাহেবকে জট খুলতে পুলিশ অফিসার বশির আহমেদ এবং বন্ধু তামিম সাহায্য করতে থাকেন। একের পর এক সূত্র হাতে আসতে থাকে। আবার পরক্ষণেই তা ধোঁয়াশা মনে হতে থাকে কবি সাহবের কাছে। রহস্যের শেষ সীমানায় পৌঁছে যাওয়ার আগে কবি সাহবকে হুমকি দিয়ে আসে একটা চিঠি। আর এই চিঠিটাই ছিলো অপরাধীর সবচেয়ে বড় ভুল এবং কবি সাহেবের ট্রাম্প কার্ড। চিঠিটাই কবি সাহেবকে রহস্য সমাধানের পথে অগ্রসর করে দেয়।
অবশেষে কবি সাহেব দুটো হত্যারই পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করে ফেলেন। তদন্ত শেষে বেরিয়ে আসে চমকপ্রদ সকল তথ্য। সানির খুনের সাথে জিমের মালিক জনি আর রকির এবং রিতার খুনের সাথে তারই পরমাত্মীয়দের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। সবচেয়ে বড় চমক হলো শুধু দুটো খুন নয়,তৃতীয় একটা খুনও হয়েছিলো বহু বছর আগে। এই ঘটনার সাথে রয়েছে তার যোগসূত্র। কিন্তু কিভাবে তা এই ঘটনার সাথে মিলে গেলো? কবি সাহেবেই বা তা কি করে জানলেন? সানির খুনের সাথে জিম মালিকদের সম্পৃক্তটা কি ছিলো? নিজের মেয়ের খুনের সাথে বাবা-মায়ের কি এমন গভীর সম্পর্ক? ভালোবাসা,বিচ্ছেদ নাকি সম্পত্তির অধিকার? কি ছিলো এই হত্যাগুলোর মোটিভ?
এইসকল প্রশ্নের উত্তর আমি দিবো না। উত্তর পেতে হলে ঘুরে আসতে হবে ‘কক্সবাজারে কবি সাহেব’ বইয়ের পাতা থেকে।
★পাঠ প্রতিক্রিয়াঃ
৯৬ পৃষ্ঠার এই বইটি পড়ার সময় একবারও বিরক্তিবোধ করি নি। প্রতিটি পৃষ্ঠা পড়ছিলাম আর কবি সাহেবের সাথে সাথে আমিও খুনিকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু কবি সাহেবের মতো অতো বুদ্ধিমান না হওয়ায় বারবার গুলিয়ে ফেলছিলাম। অবশেষে আমার আগেই কবি সাহেব সমাধান করে দিয়ে আমাকে মুক্তি দিলেন। তবে কবি সাহেবের সাথে রহস্য সমাধানের এই যাত্রা আমি খুব ভালোভাবেই উপভোগ করেছি। আমার মতে, বইটি পাঠকদের নিরাশ করবে বলে মনে হয় না। অত্যন্ত আমাকে তা করে নি।
★নামকরণে স্বার্থকতাঃ
বইটির সম্পূর্ণ প্রেক্ষাপট ছিলো কক্সবাজারে ঘটে যাওয়া হত্যার সমাধান নিয়ে। কবি সাহেব তার ভক্তর হত্যার তদন্তে নেমে তা সফলভাবে সম্পন্ন করেন। গল্পের প্লট খুঁজতে এসে তিনি নিজেই একটা গল্পের চরিত্র হয়ে যান। আর এই সমস্ত ঘটনা তিনি লিপিবদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেন একটি বইয়ে। যে বইটি আগামী বইমেলায় প্রকাশিত হবে। বইটির নাম হবে ‘কক্সবাজারে কবি সাহেব’। আর তাই প্রেক্ষাপটের আলোকে বইটির নামকরণ স্বার্থক।
★প্রিয় উক্তিঃ
১.লেখকদের মাঝে মাঝে এরকম হয়। কলম দিয়ে লেখা বেরুতে চায় না। এটাকে ইংরেজিতে “রাইটার্স ব্লক” বলে।
২.পুলিশের বউ হওয়া ধৈর্য্যের ব্যাপার। পুলিশদের মতো তাদের বউদেরও মাঝে মাঝে জনগণের স্বার্থে অনেক ত্যাগ করতে হয়।
৩.সব মানুষের মনেই পাগলাটে স্বভাব থাকে। দোষ পড়ে শুধু কবি-লেখকদের উপর।
৪.পৃথিবীতে কাকতালীয় কোনো ব্যাপার নেই। যা ঘটে সব কিছুর ব্যাখ্যা আছে। আমরা যেটার ব্যাখ্যা দিতে পারি না সেটাই কাকতালীয় বলে চালিয়ে দেই। নিজের ব্যর্থতা ঢাকার এক হাস্যকর প্রচেষ্টা এটা।
★বইয়ের ভালো দিকঃ
বইটির অত্যন্ত ভালো দিক ছিলো কবি সাহেবের আত্মবিশ্বাস। কবি সাহেবকে তদন্ত করতে নিরুৎসাহিত করা হলেও তিনি নিজের প্রতি বিশ্বাস রেখে হত্যার রহস্য সমাধান করতে নেমে পড়েন। অবশেষে তিনি সফলও হন।
অন্য একটি ভালো দিক হলো কবি সাহেবের অপ্রতিরোধ্য মনোভাব। ভালো কাজে বাঁধা আসবেই, প্রতিহত করার চেষ্টা থাকবেই। আর কবি সাহেবও তা জানতেন। আর তাই তিনি হুমকি পেয়েও দমে যান নি। বরং সাহসিকতার সাথে নিজের মনোবলে অটুট থেকেছেন। এই কারনে সফলতার দেখাও পেয়েছিলেন।
বইটি থেকে অনেকের অনেক কিছু শেখার রয়েছে বলে আমার বিশ্বাস।
★পাঠক সমালোচনাঃ
বইটির শুরুতেই লেখক বলেছেন তিনি আসল নামে নয় বরং ছদ্মনামে লেখেন। ব্যক্তিগত জীবনে রহস্য রাখতে চান বলেই আসল নাম গোপন রেখেছেন। আবার তিনি ছবিও তুলতে পছন্দ করেন না। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, তাকে দেখামাত্রই লোকেরা কিভাবে চিনে ফেলে?
আবার বইয়ের এক জায়গায় কবি সাহেব রিমান্ডের বিরোধিতা করলে পুলিশ অফিসার বশির আহমেদ তার উপর বিরক্ত হয় এবং মনে মনে কবি সাহেবকে কড়া একটা ঝাড়ি দেয়ার অভিপ্রায়ও ব্যক্ত করেন। কিন্তু কয়েক পৃষ্ঠা পরেই বশির আহমেদ কবি সাহেবকে বলেন, তিনি কবি সাহেবের একজন ছোটোখাটো ভক্ত। কয়েক পৃষ্ঠা আগেও ঝাড়ি দিতে চাওয়া মানুষটা কিভাবে কয়েক পৃষ্ঠা পরেই আবার ভক্ত হয়ে যায় তা আমার বোধগম্য হলো না।
এছাড়াও বইয়ের মধ্যে দুটো-একটা বানান ভুলও চোখে পড়েছে। আশা করি বইটির পরবর্তীতে মুদ্রণে কোনো বানান ভুল থাকবে না।
★সার্বিক মূল্যায়নঃ
আলোচনা-সমালোচনা করার পরও বইটিতে যে অনেক ভালো দিক রয়েছে তা অস্বীকার করার মতো নয়। খুব সহজ-সরল একটা গোয়েন্দা উপন্যাস এটি। যারা গোয়েন্দা উপন্যাস পড়ায় একদম নতুন, তাদের জন্য বইটি সর্বোত্তম বলে আমি মনে করি। বইটিতে লেখক পাঠকদের ধরে রাখতে পেরেছেন। একটানে পড়ে শেষ করার মতো একটি বই। তবে বইটি অনেক ছোটো হয়ে গেছে। তার জন্য একটা আক্ষেপ রয়েই গেছে। সেই আক্ষেপ নিয়েই বিড়বিড় করে যাচ্ছি,
“শেষ হয়েও হইলো না শেষ”।
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?