এক নজরে:
উপন্যাসের নাম: ❝হৃদয়জ❞
লেখক: তানিয়া শেখ
ধরন: সমকালীন
প্রকাশনী: নবকথন প্রকাশনী
প্রচ্ছদ : পরাগ ওয়াহিদ
মুদ্রিত মূল্য : ২৯৯
পৃষ্ঠা সংখ্যা : ১৬০
প্রকাশকাল: বইমেলা ২০২২
ফ্লাপে লেখা:
শাহরিয়ার শৈশবে এতিম, তারুণ্যে হয়েছে পরান্নপুষ্টে। সমবয়সীদের মতো রঙিন চমশার ভেতর দিয়ে পৃথিবীটা দেখার সুযোগ হয়ে ওঠেনি। জীবনের রূঢ় বাস্তবতার চপেটাঘাতে বার বার সংকুচিত হয়ে উঠেছে জীবন, নত হয়েছে মাথা। উজানে ভেসে যাওয়া কচুরিপানার মতো ভাসতে থাকে জীবন! ভাসতে ভাসতে একপর্যায়ে মামাবাড়ি থেকে ঠাঁই হয় খন্দকার বাড়িতে। দুমুঠো ভাত, মাথার ওপর একটুখানি ছাদের বিনিময়ে এ বাড়ির গৃহশিক্ষক হয়। চোখে তার একটাই স্বপ্ন বড়ো হতে হবে, অনেক বড়ো। লক্ষ্য যখন গলগ্রহের জীবন থেকে পরিত্রাণের, তখনই দেখা নিজেরই মতো ভাগ্য বিড়ম্বিত এক বালিকার সাথে। খন্দকারের ভাতিজি এবং আশ্রিতা চতুর্দশী কাজরি। মেয়েটি ভারি মুখচোরা। কিন্তু এই মুখচোরা মেয়েটির প্রতি বিশেষ করুণা জাগে শাহরিয়ারের। যেই অনুভূতিকে করুণা, সহমর্মিতা বলে মনে ঠাঁই দিলো- সে জানে না, এই করুণা সময়ের আবর্তে কতটা ওপরে গিয়ে ঠেকবে। প্রভাবিত করবে তার সমগ্র জীবনটাকে।
বই থেকে,
❝বিশেষ একজন থাকে যে কেবল দৃষ্টিকে আকর্ষণ করে না, হৃদয়কেও আকৃষ্ট করে। তারপর ধীরে ধীরে হৃদয়ে নিজের একচ্ছত্র আধিপত্য গড়ে তোলে। হয় হৃদয়জ।❞
প্রচ্ছদ : প্রথমটা প্রথম যেদিন দেখেছিলাম সেদিনই ভালো লেগেছিলো। প্রচ্ছদ এর সৌন্দর্য যেন গল্পের প্রেক্ষাপটের সাথে খাপেখাপে মিলে গেছে। একজন মেয়ে তার প্রথম অলিখিত সম্পত্তি সবকিছু যেন জড়িয়ে রয়েছে প্রচ্ছদটায়। তবে কোথাও যেন খামতি মনে হ’য়েছে। হয়তো আরেক মূল চরিত্র ঠঁায় পেলে সুন্দর হতো।
নামকরণ : বিশেষ একজন থাকে আমাদের জীবনে। যার পদধূলিতে জীবন এক অন্যরকম সুখ খুঁজে পায়। যাকে দেখলেই হৃদয় আকৃষ্ট করে। আর তার ধীরে ধীরে আমাদের হৃদয়ের সবটুকু জুড়ে জড়িয়ে যায়। তাই তাকে হয়তো বলা হয় হৃদয়জ। তাই উপন্যাসের নামকরণটি যথাযথ সার্থক হয়েছে।
উৎসর্গ : লেখকের প্রথম উপন্যাস। আর তার প্রথম সৃষ্টি বা সন্তানকে নিজের বাবা-মা র নামে উৎসর্গ করেছে। বিষয়টা আমার অনেক ভালো লেগেছে।
চরিত্র বিশ্লেষণ :
♪শাহরিয়ার : অনেক গম্ভীর,রাগী, লাজুক,ভদ্র একটি চরিত্র। নিজের অসহায়ত্বের কাছে একজন ছেলে কতোটা অপরাগ তা এই চরিত্রে উঠে এসেছে। নিজের অনুভূতিকে অসহায়ত্বকে পিছনে ফেলে প্রকাশ করতে পারিনি।
♪কাজরি: নামটাই অদ্ভুত সুন্দর। নামটা যেমন সুন্দর এর অর্থটাও অনেক সুন্দর। চাপা স্বভারের লাজুক মেয়ে অথচ অসম্ভব ভালোবাসতে জানে নিজের কাছের মানুষদের।ভালোবাসা,অবহেলা,তুচ্ছ, তাচ্ছিল্য পাওয়ার পরও যেন সূর্যের রাঙা আলো। কাজরি নামটা পড়েই খেয়াল এতো দুটো কথা – ❝কাগজের খেয়া❞ ও❝ মেঘের মতো আলো❞। উপন্যাসটা পড়া শেষে মনে হলো লেখিকার সাথে আমার অনুভূতির দেওয়া নাম দুটোও সার্থক।
♪আশরাফ : শাহরিয়ারের মামা। নিজের অসহায়ত্বের কাছে হেরেও বোনকে দেওয়া কথা রাখতে ভাগ্নর দায়িত্ব নেন। নিজের সন্তানের অধিক ভালোবাসেন। দারিদ্র্যের সংসারেও ভাগ্নেকে আগলে রেখেছেন, ভালোবেসেছেন,তাকে যোগ্য করে তুলছেন যা প্রশংসনীয়। কিন্তু উপন্যাসে তিনিই নিজের অজান্তেই শাহরিয়ার দুঃখের কারণ হয়ে দাড়ান। যদিও তিনি পরে তা বুঝতে পারেন এবং অনুতপ্ত হন।
♪খন্দকার, রাশেদা: কাজরির চাচা-চাচি। খন্দকার কাজরিকে নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসেন কিন্তু স্ত্রী র জন্য তা পালন বা প্রকাশ করতে পারেন না। কাজরিকে ভালোবেসে অনেক কথা দিয়ে থাকলেও স্ত্রীর আক্রোশে তা শেষ পর্যন্ত পালন করতে পারেন না।
♪রুমি,শাম্মী,মঈন: সম্পর্কে কাজরির চাচাত ভাই- বোন। রুমি, শাম্মী দুজন সহোদর বোন হলেও তাদের আচরণ সম্পূর্ণ ভিন্ন। একজন অসহায় কাজরিকে আপন করে কাছে টেনে নিয়েছে তো আরেকজন ঠিক ততোটাই ঘৃণা মনে কাজরিকে দূরে ঠেলে দিয়েছে।
♪মোসাদ্দেক: সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র মনে হয়েছে। ওনার জন্যই আজকেই এই শাহরিয়ার। শাহরিয়ার কে নিজের সন্তান তুল্য স্নেহ করতেন। কিন্তু প্রতিটি মানুষের জীবনেই নিজস্ব কিছু দুঃখ, অপ্রাপ্তি আছে যা হয়তো কোনদিন প্রাপ্তির খাতায় নাম লেখায় না। তার চরিত্র টা ঠিক উপন্যাস না পড়লে বোঝা সম্ভব নয়।
♪অন্যান্য চরিত্র: দৃশ্য প্রেক্ষিতে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন চরিত্রের আগমন ঘটেছে। আর লেখক প্রতিটি চরিত্রকে সুনিপুণ ভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। যা লেখকের লেখার দক্ষতাকে প্রশংসনীয় করে তুলতে বাধ্য।
প্রিয় চরিত্র : উপন্যাসের প্রিয় চরিত্রের ক্ষেত্রে অনেক ভাবতে হয়।এই উপন্যাসের সবচেয়ে প্রিয় চরিত্র কাজরি। সবচেয়ে ভালো লেগেছে, ভালোবাসান মানুষের জন্য দীর্ঘ অপেক্ষা করা।
পাঠপ্রতিক্রিয়া: এই উপন্যাসের সবচেয়ে যে জিনিস ফুটে উঠেছে তা হলো -পটভূমি ও জীবনধারা। এখানে এই বিষয়গুলোই উপন্যাসকে সুন্দর একটা ইতি দিয়েছে। পুরো উপন্যাস জুড়ে দ্রারিদ্রতা, অসহায়ত্ব, ভালোবাসা, বিচ্ছেদ, অপেক্ষা, মিলন, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি সবকিছুই কিছু স্বয়ংসম্পূর্ণ। কেউ কেউ অসহায়ত্বের কারণে নিজের ভালোবাসা প্রকাশ করতে পেরে প্রতিনিয়ত জ্বলে, কেউবা সুযোগ থাকা সত্ত্বেও নিজের ভালোবাসা প্রকাশ না করে পালিয়ে যায় এবং সেই ভালোবাসা ফেলে পালিয়ে আসার জন্য সারাজীবন বিরহের জ্বালায় জ্বলে পুড়ে ম’রে।
কেউ তার ভালোবাসা অপ্রাপ্তি নিয়ে জীবন বয়ে বেড়ায় কেউ হারানো ভালোবাসা ফিরে পেয়ে প্রাপ্তির খাতায় নিজেকে নাম লেখায়। ভালোবাসা এক অদ্ভুত মায়াজাল রয়েছে উপন্যাসটিতে।
শেষের দিকের চমকটা ছিলো অপ্রত্যাশিত। শেষ দুই পাতা পড়ে লেখক পাঠক সমাজকে আবেগী ও কাঁদিয়ে তুলেছেন। উপন্যাসটা পড়ে মায়ায় পড়েছি, কখনো মুচকি হেঁসেছি বা কখনো চোখে বেয়ে নোনা জল পড়েছে।
চরিত্র গঠন, পটভূমি, জীবনধারা সবকিছু অসাধারণ ভাবে তুলে ধরেছেন লেখক। সবকিছুর ভারসাম্য ছিলো যথাযথ।
নেগেটিভ দিক: হাতে ধরে দুইটা বিষয় খেয়াল করলাম।এক… যেহেতু গ্রামীণ প্রেক্ষাপটে উপন্যাসটি লেখা সেহেতু দু তিন জায়গায় মনে হলো ইংরেজি শব্দ না এনে বাংলা শব্দ ব্যবহার করলে ভালো লাগতো। যেমন : এক জায়গায় “ হিস্টিরিয়া ” রোগ না দিয়ে মৃগী বা বাংলা অন্য নাম দিলে সুন্দর হতো। এক জায়গায় খন্দকার, বাক্যে“ ফর্মালিটি ” শব্দটা ব্যবহার করছেন। এখানে বাক্যের সাথে ইংরেজি এই শব্দটা যায় না বলে মনে হ’য়েছে।
দুই… কয়েক জায়গায় হিন্দির বাক্য দেখা গিয়েছে। লেখিকা গল্পের স্বার্থেই হয়তো এনেছেন কিন্তু বাংলা উপন্যাসে হিন্দির ব্যবহার আমার পারসোনালি ভালো লাগেনা। তাই এখনেও ভালো লাগেনি ব্যাপারটা। হিন্দি গান হলে নিজেকে বুঝ দিতে পারতাম কিন্তু হিন্দি বাক্য ঠিক মানিয়ে নিতে পারলাম না।
প্রিয় লাইন: ❝ শয়’তান মাস্টার, এইজন্যই তোর কাছে পড়তি যাই না।ফেল করে সারা দুনিয়া ঝাড়ু দিতি হলিও দিবানে।তাও তোর কাছে যাবান না পড়তি।চৌদ্দ গুণ দুই কতো বলো তো? গুণবিদ হইছে ভারি। হু।❞
লেখক প্রসঙ্গে : লেখক তানিয়া শেখের প্রথম উপন্যাস অথচ এতো নিপুণ ভাবে লেখেছেন যা আসলেই প্রশংসার যোগ্য। ভাষাগত দিক, বাক্য চরণ সবকিছু ছিলো নিপুণ। পুরো উপন্যাস জুড়ে রয়েছে মায়ামায়া, মিষ্টি একটা গন্ধের লেখনী। সব মিলিয়ে লেখক অসাধারণ ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।
প্রকাশনী: ❝ নবকথন প্রকাশনী ❞ নতুন প্রকাশনী কিন্তু তাদের কাজ কতোটা শৃঙ্খল ও সুনিপুণ। তা প্রশংসা পাওয়ার আসলেই যোগ্যতা রাখে। প্রচ্ছদ এর কাজ সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলে নিজেদের প্রডাকশন এর দক্ষতা দেখিয়েছেন। তাছাড়া বইয়ের কাগজ, বাইন্ডিং সুন্দর ভাবে এসেছে। টাইপিং মিস্টেক আমার চোখে ধরা পড়েনি।
রেটিং : ৯/১০
রিভিউ লেখনীতে: জেবিন-জারা
Leave a comment