বইঃ সাতকাহন
লেখকঃ সমরেশ মজুমদার
খণ্ডঃ ২
মোট পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ৮৬৮
প্রকাশনীঃ আনন্দ পাবলিশার্স
সাতকাহন এমন একটা উপন্যাস, যা আপনার ভিতরে একটা নির্মল মুগ্ধতা ছড়িয়ে দেবে। এই বিশাল উপন্যাসটা সমরেশ এত নিখুঁত করে এত যত্নের সাথে লিখছে, যে প্রতিটা চরিত্র আর চরিত্রগুলোর অনুভূতি পাঠকের মন ছুঁয়ে যেতে বাধ্য। যদি উপন্যাসটার সূচনা বা প্রথম খণ্ডের কথা বলি তাহলে বলতে হবে এই অংশটা লেখকের ভেতর থেকে উঠে এসেছে, এই অংশে লেখকের বাস্তব জীবনের প্রতিফলন স্পষ্ট। লেখকের জন্ম, বেড়ে ওঠা যে এলাকায় সেই এলাকা থেকেই উপন্যাসের সূচনা এবং সেই এলাকার মানুষদেরকে নিয়েই উপন্যাসের কাজটা শুরু হয়েছে। যার ফলে প্রথম খণ্ডটা প্রাণবন্ত বর্ণনায়, চরিত্রায়নে বা প্রকৃতির অঙ্কনে।
সেই তুলনায় দ্বিতীয় খণ্ডটা আলাদা মনে হয়েছে। দুইটা খণ্ড পাশাপাশি রাখলে জিনিসটা কেন যেন মনে হতে থাকে। তা ছাড়াও লেখক প্রথম খণ্ডেই হয়তো উপন্যাসটার সমাপ্তি টানতে চাইছিলেন।পরবর্তীতে পাঠকের অনুরোধ আর লেখকের নিজস্ব ভাবনা থেকে দ্বিতীয় খণ্ডের জন্ম হয়। তাই যদ্দুর মনে হয় দুই খণ্ডের কাজের মাঝে সময়েরও কিছু ব্যবধান হয়। এর ফলে দুই খণ্ডে বেশ কিছু পার্থক্য আমার কাছে ধরা পড়ে। প্রথম খণ্ডের সেই আবেগ অনুভূতির বয়ান মৃয়মান হয় দ্বিতীয় খণ্ডে এসে।
কাহিনি সংক্ষেপ বলতে কিছু নাই। এখানে দীপাবলি চরিত্রটির মাধ্যমে লেখক ব্রিটিশ পরবর্তী স্বাধীন ভারতের বাঙালী নারীদের একটা জাগরণকে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছে। এই দীপাবলির জীবনটাই হলো উপন্যাসের কাহিনি। তার সংগ্রাম মুখর জীবন, যার পদে পদে দুঃখ দুর্দশা আর ঘাত প্রতিঘাতে জর্জরিত, তা সত্ত্বেও তার অদম্য স্পৃহা, জীবনী শক্তি আর ভেঙে-না-পড়া মনোবল এমন এক নারী চরিত্রকে ফুটিয়ে তোলে, যার মধ্যে আছে তীব্র আত্মসম্মান, ন্যায় অন্যায়ের ক্ষেত্রে কঠোর আপোষহীন এক চরিত্র। বাঙালী সনাতন সংস্কৃতির বেড়াজালে আবদ্ধ নারীদের মধ্য থেকে বেরিয়ে আসার ব্যাপার দীপাবলিকে যেমন বিদ্রোহী করে তোলে তেমনি তার নৈতিকতা বোধ তাকে অতি মাত্রায় উচ্ছৃঙ্খলও করে তোলে না। তাই তার চরিত্রটার মধ্যে যে ব্যাপারটা ঘটে সেটা পাঠককে দীপাবলির প্রতি একটা স্নেহপূর্ণ ভালোবাসা এনে দিতে পারে।
দীপাবলি বেড়ে ওঠে ডুয়ার্সের এক চা বাগানে। দূরন্ত শৈশব পার হতে না হতেই তাকে বিয়ে দেওয়া হয়। তখন তার বয়স বার কি তের। কিন্তু বড় ঘর দেখে বিয়ে দেওয়া হলেও এবং সমাজে প্রচলিত যৌতুক বা ইত্যাদি কোন দাবি দাওয়া ছাড়াই যখন বিয়ের প্রস্তাব আসে তখন ওই ঘরের অতুলনীয় বৈভব অমরনাথকে বা মনোরমা এবং অঞ্জলিকে এই বিয়ের প্ররোচনা দেয়। ফলে বিয়ে হয়ে যায় এবং দেখা যায় যার সাথে দীপাবলির বিয়ে হলো সে বিয়ের রাতেই এক অজানা রোগে মারা যায়।
এরপর থেকেই দীপাবলির জীবনটা শুরু হয়, বাস্তবতার নিদারুণ সব আঘাত একের পর এক আসতে থাকে। আর এই যে বিয়ের ব্যাপারটা, যা ট্রমার মতো সময়ে অসময়ে তাকে মনোপীড়া দিয়ে যায়। পরবর্তী জীবনে দীপাবলি স্কুল কলেজ পেরিয়ে কলকাতার স্কটিশ কলেজে পড়বে। তার মাস্টারের কথা মতো সে উঠতে চাইবে সবচেয়ে উঁচুতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে কি সেই উচ্চতায় যেতে পারে!
উপন্যাসটার মধ্যে সাহিত্য সংস্কৃতির সাথে সাথে ওই সময়কার রাজনীতি এবং অন্যান্য বিষয়ও উঠে এসেছে। রবীন্দ্রনাথ থেকে নিয়ে মুজতবা আলীও উপন্যাসে উপস্থিত ছিলেন নিজ নিজ ব্যক্তিত্ব ও কর্ম নিয়ে। জীবনান্দ আর রবীন্দ্রনাথ নিয়ে চরিত্রগুলোর
মধ্যেকার তর্কও কম উপভোগ্য নয়। তা ছাড়া কলকাতায় থাকাকালীন দীপাবলির পরিচয় হয় থিয়েটার নাটকের সাথে। এমন এক নাট্যদল, যারা কোনো লাভের আশা ছাড়াই মানুষের মাঝে সুস্থ নাটকের বোধ তৈরি করতে চায়। সেই সাথে আসে ততকালীন বাংলা সিনেমার কথাও।
দেশ ভাগের পরে বাংলার মানুষেরা যে অসুবিধায় পড়ে সেটার একটা দিক এখানে রয়েছে। এখানে বাংলাদেশ থেকে আসা রিফিউজিদের প্রতি বিরক্ত কলকাতাবাসীকে দেখা যাবে। তাদের মতে সভ্যতা ভদ্রতা আর আদব লেহাজের যে ধারণা তা এই অসভ্যরা জানে না। আর শুদ্ধ বাংলাও তাদের মুখ দিয়ে বের হয় না। এসব ব্যাপারই তৈরি হয় দুই দলের মধ্যেকার অপরিচিতির ফলে। দেখা যাবে দীপাবলির মধ্যস্ততায় লেখক চেষ্টা করবে দুই বাংলার মানুষের ভুল বুঝাবুঝিকে দূর করতে আর তা ছাড়াও দেখাবে, এই রিফিউজিরা কতটা হীনমন্যতায় ভোগে। এমনকি নিজস্ব ভাষা ছেড়ে দিয়ে তারা কলকাতার ভাষায় কথা বলার জোর চেষ্টা চালায়।
তা ছাড়াও রাজনৈতিক অস্থিরতা, কম্যুনিস্ট আন্দোলন আর ছাত্রদের মধ্যেকার চিন্তাগত দৈন্যতাও কিছু কিছু ফুটে ওঠে। এটাকে মূল বিষয় না করেও দীপাবলির নৈতিক চরিত্র গঠনে এগুলো কতটা ভূমিকা রাখে সেটা বোধ হয় দেখার বিষয়।
রমলা সেন বা মায়ার মতো চরিত্রের মাধ্যমে লেখক এমন একটা বার্তা দেন, যে স্বাধীনতার নাম করে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি জীবনে বিপর্যয় ডেকে আনে। নৈতিক অধঃপতন ও দুর্বলতার দিকটা এভাবে দেখানোর চেষ্টা। দীপাবলি এদের থেকে কীভাবে আলাদা হয়ে ওঠে সেটাও বুঝতে পারি।
উপন্যাসটায় লেখকের সবচেয়ে বড় মুন্সিয়ানা মনে হয়েছে, একটা চরিত্রকে ভালো থেকে খারাপ করে তোলা বা পরিচিত থেকে অপরিচিত আর দুর্বোধ্য করে তোলার ব্যাপারটি। যেমন অঞ্জলি, যাকে শুরুতে স্নেহময়ী মা মনে হলেও একটা সময় গিয়ে পাঠক এই চরিত্রটাকে ঘৃণা করবেন তা বলতে পারি। এরপরে রমলা সেনের কথাও বলা যায়। দীপাবলি এই নারী থেকে অনুপ্রেরণা পেলেও একটা সময়ে দেখা যায় রমলা কেমন বিরক্তিকর হয়ে উঠেছে, বা দীপাবলি তাকে যেরকমটা দেখত সেখান থেকে রমলা দূরে সরে গিয়ে অপরিচিতের তালিকায় চলে যায়। এমনকি যে দীপাবলিকে একটা সময়ে ভালোবেসে ফেলা যায় সে-ই শেষদিকে কেমন দুর্বোধ্য আর অপরিচিত হয়ে ওঠে। শেষদিকের ব্যাপারগুলো এন্ডিংটাকে আশানুরূপ হতে দেয়নি।
লেখা চাইলে আরো অনেক বাড়ানো যায়। কিন্তু এত দীর্ঘ রিভিউ লিখে উপন্যাসটার সবকিছুকে খুলে দিতে চাই না। একটা সুন্দর উপন্যাস যা তারিয়ে তারিয়ে পড়া যায়। এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলার মতো উপন্যাস এ নয়।
Leave a comment